You dont have javascript enabled! Please enable it! 1947.12.15 | ‘উর্দু কিছুতেই বাংলার রাষ্ট্রভাষা হইতে পারে না' মুছলিম হলের সভায় মওলানা আকরম খাঁর ঘােষণা | দৈনিক আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

‘উর্দু কিছুতেই বাংলার রাষ্ট্রভাষা হইতে পারে না’
মুছলিম হলের সভায় মওলানা আকরম খাঁর ঘােষণা

ঢাকা, ৮ই ডিসেম্বর ১৯৪৭ (বিলম্বে প্রাপ্ত) – ৭ই ডিসেম্বর তারিখে পূর্ব পাকিস্তান সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান পরিষদের উদ্যোগে ছলিমুল্লাহ মুছলিম হলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা সমস্যা আলােচনা করার জন্য ঢাকার শিক্ষাবিদ ও ছাত্রদের এক বিরাট সভার অধিবেশন হয়। সভাপতিত্ব করেন জনাব মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব।
বক্তৃতা প্রসঙ্গে জনাব মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ বলেন, “উর্দুর সর্বাপেক্ষা অনিষ্ট করিতেছে উর্দুর নাদান দোস্ত। বাঙ্গলাদেশে উর্দু ও বাঙ্গলা লইয়া যে বিতণ্ডা চলিতেছে, তাহার কোনই অর্থ হয় না। বস্তৃত বাঙ্গলা দেশের শিক্ষার বাহন বা আফিস আদালতের ভাষা বাঙ্গলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা হইতেই পারে না।
তিনি বলেন, ‘শতকরা নিরান্নব্বই জন যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষা ব্যতিরেকে অন্য ভাষা তাহাদের উপর চাপাইয়া দিবার কোনও প্রশ্নই উঠে না। আম বৃক্ষের নিকট হইতে আখরােট ফল আশা করা যেমন সম্ভব নয়, বাঙ্গলাদেশেও বাঙ্গলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা শিক্ষা বা সরকারি অফিস আদালতের মাধ্যম হিসেবে আশা করা সেরূপ অসম্ভব ব্যাপার।’
অতঃপর তিনি ঐদিনের ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়ের স্থান বিশেষ হইতে পাঠ করিয়া বলেন, ইহাতে লেখা হইয়ছে যে, যাহারা অনতিবিলম্বে উর্দু না শিখিয়ে তাহারা নিজেদের দেশেই শাসন ব্যাপারে পরবাসী হইয়া থাকিবে— এরূপ জবরদস্তি বাঙ্গলার মুছলমান সহ্য করিবে না- এরূপ কখনও আমরা হইতে দিব।
উর্দু সম্বন্ধে তিনি বলেন যে, আমরা বাঙ্গলার পক্ষপাতী কিন্তু উর্দুর আমরা বিরােধী নহি। আমরা উপরের দিকের শ্রেণিতে উর্দু বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে অবশ্যই শিখিব, যেমন বর্তমানে আমরা আরবী, ফারসী বা ইংরাজি শিখি। বাঙ্গলার পক্ষপাতিত্ব করা উর্দুর বিরােধিতা করা বুঝায় না।
বিভিন্ন ভাষার বর্তমান অবস্থা পৰ্যালােচনা করিয়া তিনি বলেন যে, বাঙ্গলা ও উর্দু ভাষাকে আরও উন্নত করিতে হইবে। বাঙ্গলা ভাষা যাহাতে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শ্রেণীসমূহে শিক্ষার মাধ্যমে হইতে পারে, যাহাতে যাবতীয় বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য টেকনিক্যাল পুস্তকাদি ইহাতে লিখিত হইতে পারে তজ্জন্য এখন হইতে শিক্ষাবিদদের অগ্রসর হওয়া প্রয়ােজন। উর্দু সম্বন্ধে তিনি বলেন যে, এই ভাষারও সংস্কার প্রয়ােজন। ইহার ব্যাকরণকে সহজ করিতে হইবে।
ইংরেজি ভাষা সম্বন্ধে তিনি বলেন যে, ইংরেজ বিদ্বেষের সহিত যেন আমরা ইংরেজি ভাষাকেও এখনই বিসর্জন না দেই। আমাদের ভাষাকে ইংরাজি ভাষার সম পৰ্য্যায়ে উন্নীত করিতে এখনও বহু সময় লাগিবে। ইতিমধ্যে যদি আমরা ইংরেজিকে একেবারে বিসর্জন দেই তাহা হইলে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। উচ্চ বৈজ্ঞানিক ও টেকনিকাল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে হয়ত আরও পঞ্চাশ বৎসর ইংরেজি ভাষাকে আমাদের রাখিতে হইবে। এই ব্যাপারে আধুনিক ও প্রাচীন এই উভয় প্রকার গোঁড়ামিকেই ত্যাগ করিতে হইবে।
করাচী শিক্ষা সম্মেলন সম্বন্ধীয় পরস্পর বিরােধী সংবাদাদি লইয়া যে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হইয়াছে তৎসম্বন্ধে জনাব মওলানা সাহেব বলেন যে, তিনি একথা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারেন না যে, করাচীতে বাঙ্গলাদেশের মতের বিরুদ্ধে কোনােরূপ ভাষা চাপাইয়া দিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইতে পারে। ঐ সভায় কে কি প্রস্তাব করিয়াছিল সম্পূর্ণ ব্যাপারের বিশদ বিবরণ তিনি লিখিতভাবে দাবি করেন।
জনাব মওলানা সাহেবের বক্তৃতার পূর্বে অধ্যক্ষ জহরুল ইসলাম, মি. আবু সুফিয়ান, জনাব হাবিবুল্লাহ বাহার প্রভৃতিও বক্তৃতা করেন। হলে তিল ধারণের স্থান ছিল না।

দৈনিক আজাদ, ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৪৭