সংস্কৃতি হত্যার ষড়যন্ত্র?
পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি বাসিন্দার মাতৃভাষা বাংলার লিপিসমস্যা বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। এ ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করিবার জন্য কেন্দ্রিয় এবং তস্য লেজ প্রাদেশিক সরকার এবার উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গিয়াছেন। বাংলা ভাষার লিপি নিয়া তেমন কোনাে জটিল সমস্যা আছে বলিয়া আমরা মনে করি না কিন্তু কেন্দ্রিয় ও প্রাদেশিক সরকারের গােপন পরিকল্পনা অনুসারে তাহাকেই একটা ভীষণ সমস্যারূপে দাঁড় করানাে হইয়াছে। দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষা বিস্তারের জন্য যখন সুষ্ঠু গঠনমূলক কাজে শিক্ষা বিভাগের সকল প্রয়াস নিয়ােজিত হওয়া উচিত সেই সময় সমস্ত শক্তিকে আনিয়া কেন্দ্রিভূত করা হইয়াছে লিপি সমস্যার উপর। যুক্তি আর কিছু নয়, মুসলিম জাহানের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য ঘনিষ্টতর করিবার জন্য বাংলা ভাষার পক্ষে আরবি লিপি গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নাই-উর্দুভাষী স্ত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীবুদ্ধি মি. করিম ও ডিপুটি সেক্রেটারি মি. মিজানুর রহমানের মতাে আরবির পান্ডাদের স্থির বিশ্বাস। এই তিন মহারথীই দেশের নানাস্থান হইতে অজ্ঞাত কুখ্যাত কতকগুলাে আজ্ঞাদাস জুটাইয়া লইয়া লিপিযুদ্ধে গদা ঘুরাইতে শুরু করিয়াছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়াছে, আগামী ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকায় কেন্দ্রিয় পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হইবে, সেই সভায়ই বাংলা ভাষার জন্য আরবি হরফ গ্রহণের সিদ্ধান্তটি গৃহীত হইয়া রহিয়াছে। উল্লেখিত পাণ্ডাদের চেষ্টা ও উদ্যোগে লিপি সমস্যাটি আজ এমন এক পর্যায়ে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যে চুপ করিয়া থাকিলে আমাদের কর্তব্যের প্রতিই অবহেলা করা হইবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যখন উপযুক্ত আর্থিক সাহায্যের অভাবে প্রায় বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে, ঠিক সেই সময়ে বাংলার লিপি লইয়া এই অনাবশ্যক মাতামাতি। এবং পূর্ববঙ্গে আরবি লিপি নিয়া পরীক্ষা নিরীক্ষণের জন্য হাজার হাজার টাকার মঞ্জরী পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বনাশই সূচনা করিতেছে। দুঃখের বিষয় লিপি সমস্যাটিকে বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞদের উপর ছাড়িয়া না দিয়া, এফ, এ করিমের মতাে বাঙালি মুসলিম বিদ্বেষী পশ্চিমা কর্মচারীর অতি উৎসাহে মিজানুর রহমানের মতাে ইনফেরিয়াটি কমপ্লেক্স প্রসূত পূর্ব বঙ্গীয় মুসলিমের আত্মলাঞ্ছনায় ও আরব সাগরের হাওয়ায় স্ফীত পূর্ববঙ্গের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্ভট কর্ম প্রতিভায়, ইহাকে বর্তমানের জটিল পর্যায়ে টানিয়া আনা হইয়াছে।
সৃষ্টি ও গঠনমূলক কাজে এই দৃষ্টিহীন অবদের বন্ধ্যাত্ব সুদীর্ঘ দুই বৎসর ধরিয়া আমরা লক্ষ্য করিয়া আসিয়াছি। ইহাদেরই অন্ধতায়, পাকিস্তানের দুই তৃতীয়াংশ অধিবাসীর শিক্ষা সংস্কৃতি, উন্নতি প্রগতি, তথা জীবন মরণকে লইয়া যে পুতুল খেলা শুরু হইয়াছে, তার পরিণাম পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানের পক্ষেও মারাত্মক হইতে বাধ্য। কারণ একটা জাতির উন্নতি, প্রগতি ও সমৃদ্ধি তার শিক্ষার উপর নির্ভর করে এবং সে শিক্ষা একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভবপর। অথচ লিপি সমস্যার আবরণে সেই মাতৃভাষাকেই গলা টিপিয়া হত্যা করিবার জন্য দস্যুদের হস্ত প্রসারিত হইয়াছে।
আরবি ভাষা ও আরবি সাহিত্য পাণ্ডিত্য অর্জন না করিয়াও, শুধু আরবি লিপির সাহায্যেই কোরআন ও ইসলামের মর্যাদা দেওয়া হইবে, দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য ঘনিষ্ঠতরাে হইবে, একথা সেই সব ভণ্ড মােনাফেকের পক্ষেই বলা সম্ভব যারা ইসলাম এবং আল্লাতে বিশ্বাস না করিয়াও মুসলমানী পােশাক পরিচ্ছেদ পরিয়া মুসলিম সমাজে পরম ধার্মিকরূপে বিচরণ করে, পােশাকের জোরে, মুখের জোরে জনসাধারণকে ভাওতা দিয়া নিজেদের শয়তানী মতলব হাসিল করে। আজ যাহারা ইসলামের পায়রবি করিবার বাহানায় লিপি পরিবর্তনের কথা বলে মুখে ফেনা ছুটাইতেছে, দুঃখের বিষয় ইসলামের কণামাত্র উত্তরাধিকারও এইসব ভণ্ডের মধ্যে নাই। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই সব মােনাফিক মুসলমান জনসাধারণের কাছে সমতা জনপ্রিয়তা অর্জন করিবার জন্য, কোরআনের শিক্ষাকে হাড়িয়া কোরআনের হরফ লইয়া মাতামাতি শুরু করিয়াছে, আত্মাকে ছাড়িয়া অক্ষরের মূর্তিকে পূজার বেদিতে বসাইয়াছে। ইহাদের ধারণা, নিরক্ষর জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিকে লুণ্ঠন করিয়া অনায়াসেই তাদের মতলব হাসিল করিবে, সদ্যমুক্তি প্রাপ্ত জনতাকে কায়েমী স্বার্থের ধ্বজাধারী কতিপয় অভিজাত পরিবারের শাসন ও প্রভুত্বের নিচে চিরকাল বন্দি করিয়া রাখিবে। কিন্তু এই সুচতুর ষড়যন্ত্রকে যে সার্থক হইতে দেওয়া হইবে না, পূর্ববাংলার জাগ্রত জনতার পক্ষ হইতে সে কথা আজ তীব্রস্বরে ঘােষণা করিবার সময় আসিয়াছে। ভাষা আন্দোলনের বন্যায় পূর্ববঙ্গের জাগ্রত বিক্ষুব্ধ জনমতের কাছে সরকার নতি স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিল, এ কথাও স্মরণ করাইয়া দিবার প্রয়ােজন আছে লিপি পরিবর্তনের চোরাপথে সাড়ে চারকোটি লােকের মাতৃভাষাকে কতল করিবার এই পরিকল্পনাকে সহজে সফল হইতে দেওয়া হইবে? একথা মনে করিলে বিরাট ভুলই করা হইবে। সুদীর্ঘ দুই বৎসর ধরিয়া পাকিস্তানের বর্তমান কর্ণধারদের ইসলাম প্রীতির যে নমুনা পাওয়া গিয়াছে, আদর্শ বিষয়ক প্রস্তাব গ্রহণ করার পর, পাকিস্তান ইসলাম সম্মত জীবন ও শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁদের কৃতিত্বের যে পরিচয় পুঞ্জিভূত হইয়াছে, ইহার পরেও ইসলামের নাম ভাঙ্গাইয়া জনসাধারণকে ধোকা দিতে গেলে অভ্যর্থনাটা যে খুব সাদর ও হৃদ্যতাপূর্ণ হইবে না, তাহা বলাই বাহুল্য। কপট মােনাফিকদের এই ইসলামদ্রোহীতাকে জনসাধারণ ধরিয়া ফেলিয়াছে। কাজেই এই অতিউৎসাহী পাণ্ডারা সমায়ােচিত সাবধানতা অবলম্বন করিলে বুদ্ধিমানের কাজ করিবেন।
পরিশেষে, আমরা পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারী প্রত্যেককে লিপি, সমস্যাটি গভীরভাবে ভাবিয়া দেখিতে অনুরােধ করি। ইহাকে কেন্দ্র করিয়া আমাদের শিক্ষা ও সংসকৃতি জীবনে যে অশুভ ছায়া বিস্তৃত হইতেছে, সময থাকিতে না রুখিলে পরিণামে তাহা আমাদের সর্বনাশ ডাকিয়া আনিতে পারে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম