সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই
আলী আশরাফ
[ভাষা আন্দোলন কিভাবে লক্ষ্যহারা হইয়া নানা পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এই প্রবন্ধে তাহার সুন্দর প্রমাণ মিলিবে। প্রবন্ধটি ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখের ‘নওবেলাল’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। পরে ইহা ‘পূর্ব-বাংলা’ নামক সাপ্তাহিক পত্রের ১৩ই ফালগুন সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত হইয়াছে। নওবেলাল’ ও ‘পূর্ববাংলা প্রগতিশীল তরুণ দলের মুখপত্র। বাংলা ভাষার ইহারা পূর্ণ সমর্থক। কাজেই এই দুই খানি সংবাদপত্রে নতুন কথা শুনায় আমরা সত্যই বিস্মিত হইয়াছি। লেখক যে গতানুগতিক চিন্তা-ধারায় ভাসিয়া যান নাই এবং সমস্যাটির উপর সে কিছুটা নতুন আলােকপাত করিতে পারিয়াছেন, তজ্জন্য আমরা প্রবন্ধটির অংশবিশেষ সংকলিত করিয়া দিলাম।]।
… পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু-এ মতই বর্তমানে প্রগতিশীল মহলে প্রচলিত। এবং এ মতবাদ থেকেই দাবিও জানানাে হচ্ছে যে (যেমন আওয়ামী লীগ নেতারা জানাচ্ছেন) পূর্ববঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে যে-ভাবে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, সে-ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাংলাভাষাকে বাধ্যতামূলক করা হােক।
‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দ্ব্যর্থবােধক আওয়াজই আজ বিকশিত হয়ে বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা চাই’— এই সুস্পষ্ট আওয়াজেরই রূপ ধারণ করেছে। প্রগতিশীল মহল সাধারণভাবে ভাবছেন যে, এটাই হলাে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার’ সমস্যা সমাধানের পথ। কিন্তু সত্যই কি তাতে সমসার পরিপূর্ণ ও গণতন্ত্রসম্মত সমাধান হবে? ২২ শে ফেব্রুয়ারি যে গৌরবময় সংগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়েছিল, বাংলা ও উর্দু এ দুটি ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হলেই কি সে সংগ্রামের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হবে এটাই কি গণতন্ত্র? না, এতে সমস্যার সমাধান হবে না, এটা গণতন্ত্রও নয়। কারণ, যে নীতি অনুসারে আমরা আমাদের মাতৃভাষার অধিকার চাইছি, সে নীতি অনুসারেই অন্যান্যকেও তাদের ভাষার অধিকার দিতে হবে। পাকিস্তানের জনগণ শুধু বাংলা ও উর্দু এ দুটি ভাষায় কথা বলে না। পাকিস্তানে শুধু যে বাংলা ভাষাভাষী ও উর্দু ভাষাভাষী, পশতু ভাষাভাষী, বেলুচ ভাষাভাষী ও গুজরাটী ভাষাভাষী জনগণ। এছাড়া রয়েছে কয়েকটি উপজাতি যাদের রয়েছে স্থানীয় ডায়লেক্ট, মুসলিম লীগ সরকারও বাংলা উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, পশতু, বেলুচি ও গুজরাটি— এই সাতটি ভাষাকে পাকিস্তানের জনগণের ভাষা বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বস্তুত পাকিস্তানে রয়েছে পাঁচটি প্রধান প্রধান জাতি বাঙালি, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, পাঠান ও বেলুচি। এদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট, স্থায়ী অবিচ্ছিন্ন বাসভূমি আছে, প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি অর্থনৈতিক জীবন আছে, প্রত্যেকের নিজস্ব মানসিক গঠন ও কৃষ্টি রয়েছে এবং প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ মাতৃভাষা।
মুসলিম লীগ এই বাস্তব সত্য অস্বীকার করে এক জাতি, এক তমদুন, এক ভাষার প্রতিক্রিয়াশীল যুক্তির অবতারণা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন। এই পরিস্থিতিতে যদি গণতন্ত্র কর্মীরাও শুধু বাংলা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চান, তাহলে সিন্ধিভাষী পশতুভাষী, পাঞ্জাবীভাষী, বেলুচিভাষী ও গুজরাটিভাষী জনগণের উপর ঐ দু’টো ভাষা চালিয়ে দেয়া হবে। এটাও স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রবিরােধী। কাজেই ‘বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা হােক’ এ দাবি কখনােই পরিপূর্ণ গণতন্ত্র সম্মত নয়। অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’—এই দ্বাৰ্থবােধক আওয়াজ, যে আওয়াজ থেকেই শুধু বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি এসেছে, সেই আওয়াজ আজ পরিত্যাজ্য আন্দোলনের প্রথম স্তরে জনগণের যে আওয়াজ প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু মহান একুশে ফেব্রুয়ারির এক বৎসর পর যখন জনগণের অভিজ্ঞতা ও গণতান্ত্রিক চেতনা আরাে বেড়ে গেছে, তখন আন্দোলনের মূল দাবিরূপে ঐ দ্ব্যর্থবােধক আওয়াজের কোন আন্দোনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে বাধা হচ্ছে। তার প্রমাণ হলাে, সে আওয়াজ সিন্ধিভাষী, প্রভৃতি জাতির গণতান্ত্রিক দাবিকে আমল না দিয়ে শুধু বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা’র আসনে বসাতে চাইছে। এতে ভাষার আন্দোলনের পিছনে সিন্ধিভাষী, পশতুভাষী, বেলুচভাষী, পাঞ্জাবীভাষী প্রভৃতি সারা পাকিস্তানের সাধারণ জনতাকে সমাবেশ করা যাচ্ছে না। বরং তারা এর বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠবে। উর্দুকে পূর্ববঙ্গে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করার দাবিও অগণতান্ত্রিক। কোন ভাষাভাষী জনগণের উপর অন্য ভাষাকে বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়াটা স্বৈরাচারের অবিব্যক্তি। এভাবে, এর ভাষা অপরের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করলে জনগণের শিক্ষা ব্যাহত হয় ও জাতিগত বিরােধ সৃষ্ট হয়। পূর্ববঙ্গে উর্দু ও পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা বাধ্যতামূলক করার আওয়াজ দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জাতিগত বিরােধ সৃষ্টি হচ্ছে আজই, এ আওয়াজও পরিত্যাজ্য।
বহু ভাষাভাষী জনগণের অর্থাৎ বহু জাতির মিলনক্ষেত্র পাকিস্তানের ভাষা সমস্যার গণতন্ত্রসম্মত সমাধানের জন্য আমাদের আন্দোলনের মূলনীতি হবে : ছােট-বড় প্রত্যেকট ভাষাভাষী জনগণের প্রত্যেকটি ভাষাকে সমান মর্যাদা ও সমান অধিকার দেয়া। বিভিন্ন ভাষাভাষী সাধারণ জনগণ যাতে রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে ও শিক্ষার পূর্ণ সুযােগ পায়, তার জন্য এ আন্দোলনে দাবি হবে নিম্নরূপ :
(ক) কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সমস্ত আইন, ঘােষণা, দলিল, প্রভৃতি বাংলা, উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পশতু ও বেলুচি ভাষায় প্রকাশ করতে হবে। গুজরাটী ভাষাভাষী জনসংখ্যা যদি যথেষ্ট সংখ্যক হয়ে থাকে তবে সে ভাষায়ও প্রকাশ করতে হবে।
(খ) কেন্দ্রীয় আইন সভায় প্রত্যেক সভ্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ বক্তব্য বলতে পারবেন ও দোভাষীরা সেগুলাে বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা করে দেবেন। (জাতিসংঘে ও সােভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রে এ ব্যবস্থা সাফল্যের সঙ্গে চলছে।)
(গ) প্রত্যেক ভাষাভাষী জনগণের নিজ নিজ বাসভূমির (অর্থাৎ বিভিন্ন প্রদেশের) রাষ্ট্রকার্য, আইন আদালতের কার্য্য যে প্রদেশের ভাষায় চলবে। বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত অন্য ভাষাভাষীরা (যেমন পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষীরা বা পাঞ্জাবের বাঙালিরা) যে সব প্রদেশের আইন-আদালতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ বক্তব্য বলতে পারবে। (ঘ) বিভিন্ন উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে সেসব উপজাতীয় ভাষায় আইন আদালতের কাজ চলবে।
(ঙ) ছােট-বড় প্রত্যেক ভাষাভাষী জনসমষ্টি ও বিভিন্ন প্রদেশে সংখ্যালঘুরাও নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করার অধিকার ভােগ করবে।
এই সমস্ত দাবিগুলাের সারমর্ম নিয়ে আমাদের আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তিরূপে মূল শ্লোগান বা আওয়াজ হবে।
আলী আশরাফ নামটি ছদ্মনাম। লেখকের আসল নাম খােকা রায়। তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।
সূত্র: নও বাহার ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২