বুকের রক্তে রচে গেল যাঁরা
রক্তাক্ত ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করা জন্যে যারা পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন তাঁদেরই কয়েক জনের পরিচিতি। সংগ্রহ করেছেন ও লিখেছেন :
মাে: হেদায়েতুল ইসলাম খান সম্পাদক, সৈনিক
গত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যাদের তাজা রক্তে রাজধানী, ঢাকার প্রশস্ত রাজপথ রঞ্জিত হয়ে উঠেছিল শহীদ আবুল বরকত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ ক্লাসের ছাত্র। মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার অন্তর্গত বাবলা গ্রামে ১৯২৮ খ্রী আবুল বরকত জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার পিতা মৌলভী শামশুজ্জোহা সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বহরমপুর কলেজ হতে আই, এ পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি, এ অনার্সে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে উচ্চ সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করেন। বয়স তখন তার ২৩ বৎসর। ভবিষ্যতের কত রঙ্গিন স্বপ্ন তার মনে। বর্তমান পুতিগন্ধময় সমাজের বিরুদ্ধে কত তার অভিযােগ। এ সমাজ তিনি ভাঙ্গবেন; নিয়ে আসবেন তখন এক শ্রেণীহীন, শােষণহীন, কুসংস্কার মুক্ত পবিত্র সমাজ। কিন্তু অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস। ফুল ফোটার আগেই সে ফুল কলি অবস্থায় ঝরে গেল। দেশ হলাে তার প্রাণ মাতানাে আঘ্রাণ হতে বঞ্চিত। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা। নাজিমউদ্দিন ঢাকায় ঘােষণা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জাগ্রত ছাত্র সমাজ প্রধানমন্ত্রীর এই অগণতান্ত্রিক উক্তির তীব্র প্রতিবাদ করল। ধর্মঘট ও শােভাযাত্রা হলাে শুরু। ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরী হলে সংগ্রাম পরিষদ হলাে গঠিত। তীব্র গণআন্দোলন ও দারুণ হতাশার ভিতর দিয়ে ক্রমে ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘনিয়ে আসল। সাড়ে চারি কোটি মানুষের মাতৃভাষাকে বলি দিতে ছাত্রেরা রাজী নয়। তারা ধর্মঘট করতে ও সরকারের ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে বদ্ধ পরিকর। সরকার তাতে হলেন বিরূপ। শুরু হলাে দুই দলে সংঘর্ষ। একদল নিরস্ত্র আর অন্যদলে রয়েছে রাইফেল, বেয়নেট ও কাঁদুনী গ্যাস। দেশ প্রেমিক বরকত, বাংলার কৃতী সন্তান বরকত তার রিক্ত হস্ত নিয়েই এগিয়ে আসলেন সরকারের এই জুলুমের বিরুদ্ধে বজ্রকঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে। বেলা তখন ২টা ঢাকার রাজপথ ললাকে লােকারণ্য। পুলিশ ও মিলিটারির ছাউনি ফেলেছে ঢাকার প্রসিদ্ধ স্থান গুলিতে। ক্লান্ত দেহে বীর বরকত মেডিকেল কলেজের ১২ নং শেডের বারিন্দায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলেন জালিম সরকারের বর্বর পুলিশী জুলুম। হঠাৎ পেছন হতে একটি রাইফেলের গুলি এসে তার বুক ভেদ করে জানিয়ে গেল ছাত্র সমাজের প্রতি লীগ শাহী সরকারের অপূর্ব ভালােবাসা!
বরকত পড়ে গেলেন। তার তপ্ত খুনে রঙিন হয়ে উঠল মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গণ। কয়েকজন ছাত্র তার অবসন্ন দেহকে মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।
ভাষা আন্দোলনে দুর্নীতি গত বৎসর ভাষা আন্দোলনের হাজার হাজার টাকা আত্মসাৎ ও গােপন করার জন্য অভিযােগ করে সৈনিকে যে সম্পাদকীয় ও চিঠি ছাপানাে হয়েছিল। জানা গেছে তাতে বেশ কাজ হয়েছে। একটি যুব প্রতিষ্ঠানের জনৈক ট্রেজারার যে ১৩ হাজার টাকা নিয়ে গেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আশা করা যাচ্ছে- সব টাকা পাওয়া না গেলেও টাকার খোঁজ পাওয়া যাবে।
সৈনিক ১৯৫৩
একুশে ফেব্রুয়ারি
চৌধুরী লুৎফর রহমান
চোখের জলের ইতিহাস সেতাে, একুশে ফেব্রুয়ারি
মর্মর আঁকা তাজমহলের চেয়েও অনেক ভারী।
রেখে গেছে এক স্মৃতির স্তম্ভ, আহা অসংখ্য নামী
বেনামী অনেক মানুষের খুনে, রক্তের অভিসারী।
রক্তের ফুল ফুটেছিল বুঝি অজগর রাজপথে
বেয়ােনেট আর বুলেটের শীস বিধেছে পাজর ফুড়ে
পুষ্পের মতাে নিস্পাপ হাসি মুছে গেছে বহুদূরে
স্বপ্নের মতাে অসংখ্য আশা স্মৃতির পুষ্প রথে ॥
জীবনের আজো দিকে দিকে লাখাে মানুষের হাহাকারে
সাঁড়াশীর মতাে গলাটাকে ধরে কালের করাল হাত
একুশে ফেব্রুয়ারি আজো তাহার ছায়াফেলে কালাে রাতে
গেল যদি যাক, হােনা এবার মনের অভিসার।
হাজার বারের মরণ পেয়ে ও বুঝেনা আজো যারা
বাচার মন্ত্র ‘মরণ বরণ আজকে জানুক তারা।
২১ ফেব্রুয়ারি ৫৩/৯ ফাগুন জমাদিউস সানি