You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952 | ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের জন্মের ইতিবৃত্তি - সংগ্রামের নোটবুক

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের জন্মের ইতিবৃত্তি

ভাষার আবশ্যকতা : ভাষা আন্দোলন আজ এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছিয়াছে। ইহার মূল, পরবর্তী ইতিহাস ও অবস্থা বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরী হইয়া পড়িয়াছে। যে, আন্দোলন ঘরে ঘরে সাড়া জাগিয়াছে, তাহার সব দিক জানা প্রত্যেকেরই জনেরই উচিত তাহা বলছি বাহুল্য।
দেশ বিভাগের পর : সকলেই জানেন দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তাহা লইয়া মাথা ঘামাবার মতাে লােক খুব কমই ছিল। শুধু তাই নয়, তখন অনেকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব উর্দুরই সমর্থক ছিলেন। তাহার কারণও অখণ্ড ভারতে বর্ণ হিন্দুরা কংগ্রেস ও মহাসভা মারফত হিন্দীকে যেমন ভবিষ্যতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার সকল প্রকার প্রস্তুতি হইয়াছিলেন তেমনি মুসলমান ও হিন্দীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন পত্রিকার আলােচনার অবস্থা করিয়াছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের মূলে : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার মাত্র দুই সপ্তাহ অর্থাৎ ১৯৪৭ সনের ১লা সেপ্টেম্বর তারিখে ‘তুমুদুন মজলিশ’ নামে এক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ছাত্র ও অধ্যাপকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই তমুদুন মজলিশই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ভাষা সম্বন্ধে কয়েকটি বৈঠকের আয়ােজন করেন। অতঃপর সেপ্টেম্বরে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামক পুস্তকটি তমদুন মজলিশ কর্তৃক বলিয়াদী প্রেস হইতে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের লেখক তিনজন – অধ্যাপক কাজী মােতাহার হােসেন, ইত্তেহাদ অধ্যাপক আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেব। প্রবন্ধগুলােতে নানা ধরনের প্রস্তাবের দ্বারা প্রমাণ করা হয় – বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার উপযুক্ত। পুস্তকটির মুখবন্ধে তমদুন মজলিশের একটি প্রস্তাব সনিবেশিত হয়। তাহার হুবহু নকল দেওয়া হইল—
সৈনিক
শহীদ সংখ্যা-১৯৫৩
(সাপ্তাহিক সৈনিক ১৯৫৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল)
মজলিশের প্রস্তাব
(১) বাংলা ভাষাই হবে—
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা।
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।
(২) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা দু’টি বাংলা ও উর্দু।
(ক) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশ জনই এ ভাষা শিক্ষা করবেন।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু হবে- দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকরি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত হবেন শুধু তারাই ও ভাষা শিক্ষা করবেন। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ হতে ১০ জন শিক্ষা করবেন। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ হতে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে। মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতার শ্রেণীতে এই ভাষা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেওয়া যাবে।
(গ) ইংরেজি হবে পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসেবে যারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চাকরি করবেন বা যারা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষায় নিয়ােজিত হবেন তারাই শুধু ইংরেজি শিক্ষা করবেন। তাদের সংখ্যা পূর্ব-পাকিস্তানের হাজার করা ১ জনের চেয়ে কখনাে বেশি হবে।।
ঠিক এই নীতি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিতে স্থানীয় ভাষার দাবী না উঠলে উর্দু প্রথম ভাষা, বাংলা দ্বিতীয় ভাষা আর ইংরেজি তৃতীয় স্থান অধিকার করিবে।
(৪) শাসনকার্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাতত কয়েক বৎসরের জন্য ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকার্য চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়ােজনানুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার সাধন করতে হবে। দেশের শক্তির যাতে অপচয় না হয় এবং যে ভাষায় দেশের জনগণ সহজে ও অল্প সময়ে লিখতে, শিখতে ও বলতে পারে সে-ভাষাই হবে রাষ্ট্রভাষা। এই অকাট্য যুক্তিই উপরােক্ত প্রস্তাবের প্রধান ভিত্তি।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?
কর্মীরা প্রথমে সাড়া পান নাই
বলা বাহুল্য- এই পুস্তকটি কিনিবার মতাে ৫ জন লােকও প্রথমে পাওয়া যায় না। মজলিশের যে কয়জন কর্মী ছিলেন তাহারা বইটি লইয়া বিভিন্ন জায়গার দৌড়াদৌড়ি করিয়াছেন ব্যক্তিগতভাবে বহু লােকের সঙ্গে আলাপ করিয়াছেন কিন্তু ২/১ টি ছাড়া তাঁহারা প্রায় জায়গাতেই নিরাশ হইয়াছেন। সবে মাত্র পাকিস্তান আন্দোলন সফল হইয়াছে এই সময়ে একাধিক ভাষার প্রশ্ন তােলা যে কত ক্ষতিকর এবং বিশেষ করিয়া ২টি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়া যে কতবড় ‘অবাস্তব প্রস্তাব তাহাই সেদিন সকলকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেন। শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্র মুসলিম হল ও ‘ফজলুল হক হলেও’ মজলিস কর্মীরা বৈঠক করার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইয়াছেন। শুধু তাই নয়, তাহারা প্রতিরুমে গিয়া ব্যক্তিগত আলােচনা ও চালাইয়াছেন। কিন্তু ২/১ জন ছাড়া প্রায় ছাত্রই ইহার প্রতি বিরূপ ভাবে প্রদর্শন করিয়াছেন। উর্দুই যে কেবলমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত এবং তাহা লইয়া যে তখন মাথা ঘামানাে উচিত নয়, তাহাই তাহারা বার বার বলিয়াছেন।

সরকারি কর্মচারী ও কয়েকজন সাহিত্যিক
অতঃপর মজলিশ কর্মীরা কয়েকজন সাহিত্যিক ও কয়েকজন সরকারি কর্মচারীর সহিত আলাপ আলােচনা চালাইয়া সাফল্য অর্জন করেন। এই সময়ে দেশের নামকরা ব্যক্তিদের দস্তখত লইয়া একটি মেমােরেন্ডাম তৈয়ার করা হয়- মজলিশ কর্মীরা ঘুরিয়া বহু কষ্টে এই দস্তখত সংগ্রহ করেন। মেমােরেন্ডামাটি গভর্নমেন্টের কাছে পেশ করা হয় এবং তাহার কপি কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। তৎকালীন স্থানীয় কোনাে পত্রিকা ইহাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় নাই। এ ব্যাপারে বিশেষ সাহায্য করিয়াছিল কলিকাতার ‘ইত্তেহাদ’।
একটি কথা স্মরণযােগ্য যে যাহারা দস্তখত করিয়াছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন সরকারি কর্মচারী। এমন কি পুলিশ বিভাগের আই, জি, ডি, আই, জি ও ইহাতে দস্তখত করিয়া সমর্থন জানাইয়াছিলেন। (১) এই সময়ে কয়েকজন মন্ত্রীও গােপনে ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করিতে থাকেন।

ফজলুল হক হলে সাহিত্য সভা
যাহাতে ছাত্রদের মধ্যে এই প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয় তজ্জন্য ফজলুল হক হলেও তমদুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে এক মিটিং আয়ােজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন হবীবুল্লাহ বাহার এবং বক্তৃতা করেন কবি জসিম উদদীন, কাজী মােতাহার হােসেন এবং আরও কয়েকজন মন্ত্রী।

আন্দোলন ও ফজলুর রহমান
মজলিশের এত চেষ্টা সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলন যে বিশেষ দানা বাঁধিয়াছিল তাহা বলা চলে না। কিন্তু সৌভাগ্য এই যে, এই সময়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান করাচীর প্রভাবে উর্দু ওকালতী করিতে গিয়া বাংলা ভাষা সম্বন্ধে এমন কয়েকটি আপত্তিকর মন্তব্য করেন, যাহার জন্য বাংলাভাষীদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। তদুপরি বিভিন্ন সূত্রে উর্দুকে পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে করার প্রচেষ্টা হইতে থাকে। হইতে অনেকেই মজলিশের আন্দোলনকে আপন বলিয়া ভাবিতে শুরু করেন। এই সময় হইতেই ইউনিভার্সিটির নিকটে মজলিশের ভাঙ্গা। অফিস ঘরটিতে লােকজন আসিতে আরম্ভ করে। আর এই অফিসেই মসলিশ কর্মিদের এক বৈঠক প্রথম সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তদানিন্তন মজলিশ কর্মি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক সংগ্রাম পরিষদের প্রথম কনভেনর নির্বাচিত হন।

প্রথম সংগ্রাম পরিষদের কাজ
সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের ভার লইয়া প্রথমেই ফজলুর রহমান সাহেবের সঙ্গে নাজিরাবাজার মওলা সাহেবের বাসায় সাক্ষাৎ করেন। তাঁহার সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের তুমুল বিতর্ক হয়। ফজলুর রহমান সাহেব তাহাদের সঙ্গে অনেকটা অপমানজনক ব্যবহার করেন। ইহার পর সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রদের পক্ষ হইয়া মেমােরেন্ডাম পেশ করার জন্য কাজে নামিয়া যান। কয়েক সপ্তাহের চেষ্টাই কয়েক হাজার সই সংগ্রহ হইয়া যায় এবং তাহা সরকারের নিকট পেশ করা হয়। বিভিন্ন পত্রিকাতেও ইহা প্রকাশিত হয়।

সমর্থন লাভের চেষ্টায়
এই পর্যন্ত মুসলিম কর্মিরাই এককভাবে আন্দোলনটি আগাইয়া নিয়া যাইতে দিলেন। মজলিশ কর্মিরা এই আন্দোলনকে সাহায্য করিবার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে যান। কিন্তু লীগ কংগ্রেস কম্যুনিস্ট পার্টি। ছাত্র ফেডারেশন ইহাদের প্রত্যেকের নিকট হইতেই কর্মিদের নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিতে হয়। মুসলিম লীগ ইহাকে মােটেই আমল দেয় নাই, কংগ্রেস কর্মীরা ইহার নাম শুনিয়া আঁতকাইয়া উঠেন। ঢাকা জজ কোর্টের পিছনে কম্যুনিস্ট পার্টির যে বিরাট অফিস ছিল তাহাতে একদিন ক্যুনিস্ট পার্টির এক মিটিং ছিল। কমরেড মুজাফফর আহমদ এই বৈঠকে নেতৃত্ব করিতেছিলেন।

‘বহু ভাষার বিপক্ষে
কিন্তু ৭টি রাষ্ট্রভাষার দাবি তােলা যে বাংলা ভাষার দাবিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্রেই শামিল তাহা ব্যাখ্যা করিয়া সভার অন্যান্য সমস্ত বক্তা জোরালাে ও যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা করেন।

অধ্যাপক কামরুজ্জামান
জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক, আওয়ামী লীগ নেতা জনাব কাজী কামরুজ্জামান সাহেব তাহার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বাংলা ভাষার দাবি ব্যাখ্যা করেন। বহু ভাষার স্লোগান সম্পর্কে তিনি বলেন: এ দাবি নেহায়েৎ অবাস্তব।

আবদুল ওদুদ
ছাত্রলীগ সম্পাদক জনাব আবদুল ওদুদ বলেন, বাংলা ও উর্দু ব্যতীত অন্যান্য ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলিলে বর্তমান পরিস্থিতিতে গােটা আন্দোলনকেই বানচাল করিয়া দেওয়া হইবে।

সৈয়দ আবদুর রহীম
ব্যক্তি স্বাধীনতা লীগের সম্পাদক জনাব সৈয়দ আবদুর রহীম বলেন, লাহাের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান ফেডারেশনের প্রধানত দুইটি ইউনিট থাকা উচিত: পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। আর এই দুই ইউনিট সম্বন্বিত পাক ফেডারেশনের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শুধু উর্দু ও বাংলার দাবিই যুক্তিযুক্ত।

এস, এম, নুরুল আলম
সদ্যমুক্ত ছাত্রনেতা পূর্ব-পাক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এস, এম, নুরুল আলম বলেন, মাতৃভাষার দাবি কোরানে সম্পূর্ণ স্বীকৃত। এ লড়াই হইতে আমাদের কেহ হটাহতে পারিবে না। পরিশেষে তিনি ও ৭টি রাষ্ট্র ভাষার শ্লোগানকে সম্পূর্ণ অবাস্তব বলিয়া আখ্যায়িত করেন। আবদুল মােমেন। বিশিষ্ট ছাত্রকর্মী জনাব আবদুল মােমেন তালুকদার তাঁহার আবেগময়ী বক্তৃতায় বলেন, বাংলা ভাষার দাবির বিরুদ্ধে কোনাে ষড়যন্ত্রই আমরা বরদাস্ত করিব না। বাংলা ভাষার লড়াই যখন বহুদূর আগাইয়া গিয়াছে তখন হঠাৎ অন্যান্য ভাষার স্লোগান তােলা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্রেরই সামিল।

শেখ মুজিবুর রহমান
সর্বশেষ পূর্ব পাক আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান তাহার বক্তৃতায় বহু ভাষা প্রশ্ন সম্বন্ধে বিস্তারিত আলােচনা করেন। সকল ভাষাকে সমান অধিকার দেওয়া। আর সকল ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করার এক কথা নয়। এই বিষয়ে আমরা যেন প্রতারিত না হই। সকল ভাষার মর্যাদা আমরা স্বীকার করি। পাকিস্তানে কোনাে জনগণের সরকার গঠিত হইলে তাহার অন্যতম কর্তব্য হইবে অনুন্নত ভাগগুলিকে উন্নত করিবার চেষ্টা করা। কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, সব ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করিতে হইবে। এই দাবি যাহারা করে তাহারা ভাষা আন্দোলনের শত্রুতা করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতি-কেও অস্বীকার করে। সেখানে বাস্তব অবস্থা এই যে, তাহারা গ্রামে, কি শহরে, উর্দুকেই তাহার আত্মবিশ্বাসের ও সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করিয়াছে। পিকিং শান্তি সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতা অধ্যাপক আনিসেসােভের সহিত তাহার সাক্ষাৎকার উল্লেখ করিয়া মুজিবুর রহমান আরও বলেন, বহু ভাষার দাবিদার অনেক বন্ধু রাশিয়া সম্বন্ধে ভুল ধারণা লইয়া পাকিস্তানে ভাষার দাবি তােলেন। কিন্তু আসল ব্যাপার হইল। রাশিয়াতে প্রায় ১০০ টি ভাষার মাত্র ১৬টি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হইয়া ছিল এই সমস্ত ভাষার হরফকে শুধু রাশিয়া (সিরিলিক) হরফে তাে পরিবর্তিত করা হইয়াছিল এমন কি এবং ১৬টির স্থানে এখন মাত্র তিনটি ভাষায় দ্বারা রাশিয়া ভাষার কাজ চালানাে হইতেছে এবং চেষ্টা করা হইতেছে ভবিষ্যতে যাহাতে মাত্র একটি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করা যায়। পরিশেষে জনাব রহমান বলেন: পাকিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতিতে শুধু বাংলা ও উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করা সম্ভবপর। যারা এই অবস্থাকে অস্বীকার করিয়া বহু ভাষার আবদার তুলিতেছে তাহারা ভাষা আন্দোলনকেই পিছন হইতে ছুরিকাঘাত করিতেছে।

সভাপতির বক্তৃতা
সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান তাহার ভাষণে বলেন, ইহা একটি প্রকাশ্য সত্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানির উর্দুকেই তাহাদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করিয়াছে। তাহাদের ঐক্যবদ্ধ এই দাবিকে বিরােধিতা করিবার আমাদের কোনাে অধিকার নাই। পূর্ববাংলার উর্দু বাধ্যতামূলক বিষয়ভুক্ত করা সম্পর্কে তিনি বলেন পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করার পূর্বেই আমাদের উপর উর্দু জোর করিয়া চাপাইবার অর্থ পাকিস্তানের ঐক্যের মূলে আঘাত করা। ইহা দ্বারা সরকার অনৈক্যের বীজই বপন করিতেছেন। রাত প্রায় ১১টায় বিপুল উদ্দীপনার মধ্যে সভা শেষ হয়।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম