যেন ভুলে না যাই
খােন্দকার গােলাম মুস্তফা
…. ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে ‘বেলতলায় মিলিত হন। তখন ইদানিংকালে সর্বজন বিশ্রুত ‘আমতলার’ খ্যাতি ছিল না। এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ছাত্র-জনতা অতঃপর আমতলায় সমবেত হলাে। ছাত্রনেতা গাজীউল হক সে মহতীসভায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। ছাত্ররা শামসুল হকের বক্তব্য শুনলাে, কিন্তু তারা সর্বদলীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মানতে রাজী হলাে। তারা পূর্ব ঘােষণা অনুযায়ী শােভাযাত্রা বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে কড়া পুলিশ পাহারা।
এ সময়ে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের আব্দুস সামাদ একটি আপস প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। তিনি প্রস্তাব করলেন, ছাত্ররা দশ জন দশ জন করে বের হবে। এটা এক ধরনের সত্যাগ্রহ। প্রস্তাবটির অর্থ হলাে এই যে, এতে এক দিকে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করা হবে, অপরদিকে ব্যাপক আকারের গােলযােগ এড়ানাে সম্ভবপর হবে।।
ছাত্ররা এ প্রস্তাব মেনে নিল শেষ পর্যন্ত। দশজন করে ছাত্র বের হতে লাগলাে। আর পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে লাগল। এইরূপ পরিস্থিতিতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। কাদুনে গ্যাসের এক একটি শেল ছাত্রদের উত্তেজনা আরাে বাড়িয়ে দিল। এরপর পুলিশ বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর নিরস্ত ছাত্র আর সশস্ত্র পুলিশের এ খণ্ড যুদ্ধের স্থান বদলে গেল। মেডিকেল কলেজ গেট, মেডিকেল কলেজ হােস্টেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হােস্টেল ও তার চারিদিকের এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ল। এসব স্থানে বেপরােয়া লাঠিচার্জের ফলে বহু ছাত্র আহত হলাে।
বেলা তিনটা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন। বাইরে সদস্যদের নিকট ছাত্ররা পুলিশ জুলুমের প্রতিবাদ জানায় এই সময়।
আনুমানিক বেলা ৩টার সময় পুলিশ মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের সামনে গুলি চালায়। গুলিতে জব্বার আর রফিকউদ্দিন প্রাণ দেয়। এদের মধ্যে একজন ছিল নিকটবর্তী একটি হােটেলের বয়’।
এরপর ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে মােড় নেয়। এম এ (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আবুল বরকত মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের এক নম্বর শেডের বারান্দার এসে দাঁড়িয়েছিল প্রথম গুলির আওয়াজ শুনে। বুলেট তার উরুদেশ বিদ্ধ করে। প্রচুর রক্তপাতের পর রাত আটটায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর প্রাণবিয়ােগ হয়। | বরকত আর অন্যান্য শহীদদের মৃত্যুর খবর দাবাগ্নির মতাে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে পরিষদ ভবনেও বাইরের ঢেউ লাগে। উত্তেজিত পরিষদে খয়রাত হােসেনের মূলতবী প্রস্তাব সমর্থন করেন সরকার পক্ষীয় সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ ও আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেব।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন নির্লজ্জভাবে পুলিশের গুলি চালনা সমর্থন করেন। ফলে মওলানা তর্কবাগীশ ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন তৎক্ষণাৎ মুসলিম লীগ পার্টি থেকে পদত্যাগ করে খয়রাত হােসেনসহ পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। শামসুদ্দিন সাহেব পরদিন পরিষদ সদস্যপদেও ইস্তেফা দেন।
ওদিকে বিক্ষুব্ধ ঢাকা নগরী ভেংগে পড়ে শােকে। হাজার হাজার মানুষ চলে মেডিকেল কলেজের দিকে। সারা বিকাল সারারাত জনস্রোতের আর বিরাম নেই। শােকাভিভূত জনতা শ্রদ্ধা জানায় শহীদদের প্রতি। মেডিকেল করেজ নয়, যেন। তীর্থস্থান।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম