You dont have javascript enabled! Please enable it! 1947.06.29 | বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব | দৈনিক ইত্তেহাদ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব

ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি শুধু ইংরেজিরই আধিপত্র দেখতাম, অন্য কোনাে ভাষার আধিপত্য না দেখাত, তাহলে বলতাম এর কারণ ইংরেজির ওই রাষ্ট্রভাষিক মর্যাদা, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার অতি-মূল্যবানতা, এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলার নিম্নতর স্থান-নির্দেশ। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে বাঙালিদের ব্যবহারিক জীবনে শুধু ইংরেজির নয়, উর্দু এবং হিন্দিরও সমান আধিপত্য।
যে-ক্ষেত্রে উর্দু বা হিন্দি ভাষীর সঙ্গে একজন বাঙালির কথা বলার দরকার হয়, সেক্ষেত্রে বাঙালি কোন ভাষার আশ্রয় নিয়ে থাকেন? যদি উভয় পক্ষেরই ইংরেজি জানা থাকে তবে কথা হয় ইংরেজিতে। যদি দু’জনের মধ্যে একজন ইংরেজিঅজ্ঞ হন, তবে কথা হয় সাধারণত সেই অবাঙালির মাতৃভাষায়, সে কোটিপতি ব্যবসায়ী হােক অথবা স্টেশনের কুলি হােক, যদি বাঙালি পক্ষ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থান অধিকারী এম. এ. হন তবুও। সহজ কথায় মােটামুটি বলা যেতে পারে যে, ইংরেজিতে কথা বলব না— দেশব্যাপী এই প্রতিজ্ঞা যদি আজ করা হয়, তবে জওহরলাল থেকে শুরু করে বােধ হয় তার আদালী পর্যন্ত সকলেরই সঙ্গে ড. সুনীতি চ্যাটার্জী এবং হুমায়ুন কবীর কথা বলবেন খুব সম্ভব হিন্দিতে, বাংলায় নয়। জওহরলাল বাংলা বলবেন না, তিনি জানেন না। কিন্তু সুনীতি চ্যাটার্জী এবং হুমায়ুন কবীর উভয়েই হিন্দি জানেন অন্তত কথা বলবার মতাে, যেমন প্রায় বাঙালিই জানেন।
বস্তুত এটাই হলাে সাধারণ সত্য। প্রায় বাঙালি এটা মনেপ্রাণে জানেন যে, হিন্দি-উর্দুভাষীর সঙ্গে কথা বলতে হলে তাঁকে হিন্দি-উর্দুতে বলতে হবে, কেননা অপর পক্ষ বাংলা জানেন না। জ্ঞাতসারেই বাঙালি এই অবশ্য কর্তব্য নিজের ঘাড়ে নেয়। স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হলেও এটা একটা বাধ্যবাধকতা; এরূপ বাংলা জানা এবং বলার বাধ্যবাধকতা ও গরজ এখন পর্যন্ত অবাঙালির নেই।
আমি এই কোলকাতার কোনাে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারের কথা জানি, যে পরিবারের কর্তা আমাদের জেলার লােক, খাঁটি বাঙালি। তাঁর স্ত্রী (২য় পক্ষ) উর্দুভাষিণী। স্ত্রীর অত্যন্ত অসুবিধা হয় বলে বরাবর উর্দুভাষী চাকর রাখা হয়েছে। বর্তমানে কর্তা বৃদ্ধ এবং কত্রী প্রায় প্রৌঢ়া। তাঁদের ছেলে মেয়ে সবশুদ্ধ ৮টি। আজ সেই খাঁটি বাঙালি প্রতিপালিত সংসারটি সম্পূর্ণরূপে অবাঙালি উর্দুভাষী পরিবারে পরিণত হয়েছে। স্বয়ং কর্তাকেও স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে হয়। আমার প্রশ্ন : সেই উর্দুভাষিণী গৃহিণীর প্রতি বিবেচনাই কেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেল? এই কোলকাতার কোনাে একটি মেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবস্থায় দেখেছি, সেখানকার উর্দুভাষী চাকরটির সঙ্গে সকলেই কথা বলে উর্দুতে। চাকরটি এই সেদিন পর্যন্ত ছিল রিকশাওয়ালা, দাঙ্গা-পরিস্থিতিতে রিকসা টানা নিরাপদ নয় বলে বাবুর্চির কাজে লেগেছে। তাকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি, সে আজ ৮ বছর ধরে বাংলায় বাস করছে। এই ৮ বছরে নিশ্চয়ই অধিকাংশ বাঙালিকে সে রিকশায় টেনেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলা বলতে শেখেনি, বুঝতেও শেখেনি ; কেননা সে প্রয়ােজন আজ পর্যন্ত সে অনুভব করেনি, তাকে এবং তার মতাে লক্ষ লক্ষ অবাঙালিকে বাংলা শেখানাের প্রয়ােজনীয়তা ৬ কোটি বাঙালি কোনােদিন প্রয়ােজন মনে করেনি। ইংরেজের সঙ্গে এমনকি একজন তৃতীয় শ্রেণীর ইংরেজের সঙ্গে কথা বলতে হলেও ইংরেজিতে কথা বলতে হবে, এমনি একটা সহজাত ধারণা যেমন বাঙালিদের আছে, তেমনি একটা উর্দু-হিন্দিভাষী কুলি-চাকর রিকশাওয়ালামেথরের সঙ্গে কথা বলতে হলেও উর্দু-হিন্দিতে কথা বলতে হবে, এরূপ একটা সহজাত ধারণা শুধু হেঁজিপেঁজি বাঙালির নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থান অধিকারী বাঙালিরও আছে। এর ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবু সাধারণভাবে একথা সত্য। অথচ উর্দু-হিন্দি ইংরেজির মতাে রাষ্ট্রভাষা নয়। উর্দুহিন্দিবাসীরা শাসক-সম্প্রদায় এবং বাঙালিরা শাসিত সম্প্রদায় নন।
এর প্রধান কারণ এই যে-বাঙালির জাতীয়তাবােধ এখনাে পরিপূর্ণভাবে স্কুরিত হয়নি। তাঁর জাতীয় মর্যাদাবােধ এখনাে অত্যন্ত কাঁচা, তার পূর্ণ জাতীয় বক্তিত্ববােধ এখনাে অপ্রতিষ্ঠিত। এই কারণেই বাঙালিরা সাধারণত বুঝতে পারেন না যে, নিজ বাসভূমেও ইংরেজ তথা অবাঙালিদের সঙ্গে তাঁদেরই ভাষায় কথা বললে জাতীয়তাবােদের দিক দিয়ে নিজেকে ছােট করা হয়, নিজের অমর্যাদা করা হয়, নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া হয়। ইংরেজের সঙ্গে ইংরেজিতে এবং নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলার অর্থ কেবলমাত্র এইটুকুই নয় যে, ইংরেজি আমাদের রাষ্ট্রভাষা এবং ব্যবহারিক জীবনে ইংরেজির মর্যাদা বেশি। এর কারণ আমাদের অর্ধস্ফুরিত জাতীয়তাবােধ, অর্ধস্ফুরিত জাতীয় মর্যাদাবােধ। নইলে নিজেদের মধ্যেও কোনাে বাঙালি ইংরেজি বলতেন না এবং বলতে পেরে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতেন না বাংলা ভাল বলতে পারিনে, বাংলায় কিছু লিখতে পারিনে, বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারিনে বলে লজ্জার পরিবর্তে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতেন না। জাতীয় মর্যাদাবােধ অতি ক্ষীণ বলেই এবং সেই মর্যাদাবােধের অঙ্গস্বরূপ বাংলা ভাষার মর্যাদাবােধ অতি ক্ষীণ বলেই, উর্দুহিন্দিভাষীর সঙ্গে বাঙালিরা বাংলার পরিবর্তে উর্দু-হিন্দি বলার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে থাকেন।
অথচ কেমন উর্দু-হিন্দি আর কেমন ইংরেজি যে অধিকাংশ বাঙালি বলেন, তা ভেবে ওয়াকেফহাল মাত্রেই কৌতুক অনুভব না করে পারেন না। আমরা কয়জন।
ব্যাকরণ-শুদ্ধ উর্দু-হিন্দি জানি? অথচ সাধারণ অর্থে শতকরা যতজন বাঙালি শিক্ষিত তার চেয়ে অনেক বেশি বাঙালিকে জীবনের কোনাে-না-কোনাে দিন উর্দুহিন্দি বলতে হয়-ই। সে উর্দু-হিন্দি কার কাছে শেখা? সেই সব উর্দু-হিন্দিভাষীদের কাছে শেখা, যাদের অধিকাংশই আমাদের মতাে অশিক্ষিত এবং আমাদের অশিক্ষিতদের মতাে তাদেরও অশিক্ষিতদের ভাষা অমার্জিত। শুধু তাই নয়, আমাদের বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা যেমন বিভিন্ন রকম, উর্দু-হিন্দিও তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম। সেই বিভিন্ন অঞ্চলের উর্দু সেই-সব অঞ্চলের প্রধানত অশিক্ষিত লোেকদের কাছে শিখে আমরা যে কি অপরূপ খিচুড়ি উর্দুহিন্দিভাষা তেমনই হয়, বেকায়দায় পড়ে উর্দু-হিন্দিভাষীরা যেমন বাংলা বলতে শিখেছে এবং যেমন বাংলা শুনে, প্রকাশ্যে না হলেও মনে মনে প্রত্যেক বাঙালিই কৌতুক অনুভব করেন।
উর্দু-হিন্দির মতাে, ইংরেজি বলার বেলায়ও তেমনি ঘটে। আমরা যে ইংরেজিতে কথা বলি, তা কেতাবী ইংরেজি, আর এই ইংরেজি শিখেছি ১৬শ১৭শ শতাব্দীর শেক্সপিয়ার থেকে আরম্ভ করে দেশী বি. এ., এম. এ. পাস মাস্টার ও অধ্যাপক পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যিক এবং ইংরেজি-অভিজ্ঞদের কাছে। আধুনিক মার্জিত কথা-ইংরেজির তুলনায় কী অপরূপ খিচুড়ি ইংরেজি যে আমরা বলি, তা আমরা না জানলেও মার্জিত-ভাষী ইংরেজ এবং মার্জিত ইংরেজি-অভিজ্ঞ এদেশরাই জানেন। মার্জিত খাঁটি আধুনিক ইংরেজি যে এদেশের কেউ-ই জানেন এবং বলতে পারেন না তা নয়; আমি তাদের কথা বাদ দিয়েই বলছি। কিন্তু, তারা ছাড়া আর সবাই, এমন কি ইংরেজির বহু এম.এ. ও যে খাঁটি আধুনিক মার্জিত ইংরেজি পুরােপুরিভাবে জানার এবং বলার দাবি করতে পারেন না, বিশেষত উচ্চারণের দিক দিয়ে, তা অত্যন্ত বিধিত সত্য। তবু তাঁদের থেকে শুরু করে আন্ডার-ম্যাট্রিক পর্যন্ত আমাদের শিক্ষিতরা গভর্নর বারােজ থেকে শুরু করে একজন গুঁড়ি ইংরেজ পর্যন্ত সকলের সঙ্গে এবং নিজেদের পরস্পরের মধ্যে ইংরেজি বলবেনই, ইংরেজি ছাড়া বাংলায় তাঁরা চিঠি পর্যন্ত লিখবেন না, এবং ইংরেজি জানার আত্মপ্রসাদে বাংলা ভালাে জানি না বলে আভিজাত্য প্রকাশ করবেনই।
এরূপ ইংরেজি-প্রীতি, এরূপ উর্দু-হিন্দি-প্রীতির কোনাে মূল্য, কোনাে মর্যাদা নেই খাটি বাংলা-প্রেমীদের কাছে। এভাবে ইংরেজিভাষী উর্দু-হিন্দি-ভাষীদের কাছে নিজেদের মাতৃভাষার অমর্যাদা যারা করেন, তারা আত্ম-অমর্যাদা করেন, তাঁদের খাঁটি দেশপ্রেমী বলতে অন্তত আমার মন চায় না, আমি তাঁদের মধ্যে দেখতে পাই ইংরেজিয়ানাপ্রীতি, অবাঙালিয়ানাপ্রীতি।
আমার মনে একটা প্রশ্ন সব সময়েই উদ্যত হয়ে থাকে: আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজি উর্দু-হিন্দি বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেই সব ইংরেজ বা উর্দু-হিন্দি-ভাষীরা কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে না? আমার মত এই যে, এদেশে যেসব অভারতীয় অথবা অবাঙালি বাস করবে,
তাদের বাংলা শিখতে হবে, যদি তারা এদেশে বাস করতে চায় এবং আমাদের সঙ্গে চলতে চায়। বাংলা শেখা তাদেরই গরজ। তাদের জন্য ইংরেজি উর্দু হিন্দি শেখা আমাদের গরজ নয়, বরং আমাদের পক্ষে ঘাের অমর্যাদাকর। আন্তর্জাতিক সম্বন্ধের জন্য এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংযােগের জন্য যতটুকু ইংরেজি উর্দু হিন্দি শেখা দরকার, শুধু ততটুকুই আমরা শিখব, এবং অন্তত ততটুকু বাংলা পৃথিবীর জাতিপুঞ্জকেও শিখতে হবে। ভারতের অন্য অঞ্চলে যেয়ে যেমন সেঅঞ্চলের এবং ভারতের বাইরে যেয়ে যেমন সেখানকার ভাষা ব্যবহার না করে আমাদের গত্যন্তর নেই, তেমনি ভারতের অন্য অঞ্চলের এবং ভারতের বাইরেকার দেশের লােকদের বাংলায় এসে, বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে গত্যন্তর না থাকা উচিত। তাতেই প্রকৃত জাতীয় মর্যাদা এবং জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।

দৈনিক ইত্তেহাদ, ২৯ জুন ১৯৪৭