পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে, তা এখন স্থির করার সময় এসেছে। যে ভাষাকেই আমরা রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করি, তার আগে আমাদের বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে, কোন্ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করলে সব থেকে বেশি সুবিধা হবে, কোন্ ভাষায় পাকিস্তানের সব চেয়ে বেশি সংখ্যক লােক কথা বলে, পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাষা কোটি, কোন ভাষায় সব থেকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, এবং কোন ভাষা ভাব প্রকাশের পক্ষে সব থেকে বেশি উপযােগী। যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবিই সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে দ্ব্যর্থক যদিও কিছু নেই, তবু এখানে স্পষ্ট করেই বলা প্রয়ােজন বােধ করছি যে, কেবল পূর্ব-পাকিস্তানের জন্যই নয়, পশ্চিম-পাকিস্তানসহ সমগ্র পাকিস্তানেরই রাষ্ট্রভাষা হওয়ায় দাবি এবং যােগ্যতা সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষার।
পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভাষা পাঁচটি; বেলুচি, পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি এবং বাংলা। পশ্চিম-পাকিস্তানে উর্দুভাষা নেই তা নয়, বাংলায়ও আছে। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানের তাে নয়ই, পশ্চিম-পাকিস্তানেরও কোনাে প্রদেশের মাতৃভাষা উর্দু নয়।।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচন করতে হলে এই পাঁচটি ভাষার মধ্য থেকেই করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম চারটি ভাষায় যারা কথা বলেন, তাঁদের কারােই সংখ্যা বাংলাভাষীদের সমান নয়। পশতুভাষীদের সংখ্যা ১ কোটির অনেক নিচে। বেলুচি এবং সিন্ধিভাষীদের সংখ্যা তার চেয়েও কম, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লােকে কথা বলে পাঞ্জাবিতে। কিন্তু ভাষা হিসেবে এগুলাের কোনটিই প্রথম শ্রেণীর পর্যায়ে পড়ে না। এসব ভাষায় কোনাে উন্নত সাহিত্য গড়ে উঠেনি। অতএব এসব ভাষাকে রাষ্ট্রভাষিক প্রশ্ন থেকে বাদ দেওয়া যায়। বাকি থাকে বাংলা। আমাদের যে বিকলাঙ্গ’ পূর্ব-পাকিস্তান, সে-পাকিস্তানেও বাংলাভাষীর সংখ্যা পাঁচ কোটির মতাে। সিলেটের গণভােটে আমাদের জয় হলে এবং সীমা-নির্ধারণ কমিশনের রায়ের ফলে আপাত-নির্দিষ্ট পূর্ব-পাকিস্তানের সংলগ্ন মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলাে এর সঙ্গে সংযুক্ত হলে পূর্ব-পাকিস্তানের লােকসংখ্যা দাঁড়াবে পাঁচ কোটির কিছু বেশি। এই পাঁচ কোটির প্রায় সকলেই বাংলাভাষী। পশ্চিম-পাকিস্তানের জনসংখ্যা কিছু কমবেশি তিন কোটি, এবং ভাষা হিসেবে এই তিন কোটি লোেকও আবার প্রধান চার ভাগে বিভক্ত।*
পাকিস্তানের সব থেকে বেশি লােকে কথা বলে বাংলা ভাষায়। এই হিসেবে পাকিস্তানে প্রচলিত ভাষাসমূহের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা হবার দাবি সবচেয়ে বেশি বাংলা। শুধু পশ্চিম-পাকিস্তানে প্রচলিত ভাষাগুলােরই নয়, সমগ্র ভারতের যে-কোনাে ভাষার সাহিত্য থেকে বাংলা সাহিত্য শ্রেষ্ঠতর। বাংলা সাহিত্যের মতাে ভারতের আর কোনাে সাহিত্যই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেনি, পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির সাহিত্যগুলাের পর্যায়ে ভারতের একমাত্র বাংলা সাহিত্যই স্থান পেতে পারে। যে-কোনাে সাহিত্যের বিকাশ কেবল প্রতিভা সমাজ-ব্যবস্থা অর্থব্যবস্থা ইত্যাদির ওপরই নির্ভর করে না, খানিকটা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তির ওপরও নির্ভর করে। ভারতের বা পাকিস্তানের যে কোনাে সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করলে প্রমাণিত হয় বারতের তথা পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা হচ্ছে বাংলা।
অতএব পাকিস্তানের-কেবল পূর্ব-পাকিস্তানের নয়, পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় পাকিস্তানকে নিয়ে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার যােগ্যতা সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষার। লােকসংখ্যার দিক দিয়ে এবং সেই সঙ্গে গণতন্ত্রের দিক দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার দাবি সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষার; এমনকি, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার যােগ্য একমাত্র বাংলা ভাষাই।।
তবুও আমাদের দেশে এখনও অনেকে আছে, যারা হয়তাে বাংলা ভাষার এই দাবি স্বীকার করতে চাইবেন না। তাঁরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলতে পারেন। | বলা বাহুল্য, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার সপক্ষে উর্দুর দাবি অত্যন্ত কম। পশ্চিম-পাকিস্তান বা পূর্ব-পাকিস্তান, কোনাে অংশেরই প্রধান ভাষা উর্দু নয়, এবং যদিও সমগ্র ভারতে উর্দু-ভাষীদের সংখ্যা অনেক তবু পশ্চিম বা পূর্ব কোনাে পাকিস্তানেই তাদের সংখ্যা বাংলাভাষীদের চেয়ে বেশি নয়। এবং ভাষাগত উৎকর্ষ ও সাহিত্য সৃষ্টির দিক থেকে উর্দুর চেয়ে বাংলা ভাষাই শ্রেষ্ঠতর। অতএব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর দাবি বাংলার চেয়ে অনেক কম।
তবু যদি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তবে তা অত্যন্ত অবিবেচনার মতাে কাজ হবে। কেননা পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের আট কোটি লােকের জন্য এমন একটা ভাষা নেওয়া হবে যা তাদের মাতৃভাষা নয়। এর ফল অত্যন্ত অশুভ হবে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নিলে তার ফল আমাদেরবাংলাভাষীদের পক্ষে কি রকম দাঁড়াবে, তা বিবেচনা করে দেখলেই ব্যাপারটা বােঝা যাবে।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা করলে সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানের পাঁচ কোটি লোেক সরকারি চাকরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে যিনি প্রথম শ্রেণীর প্রথম হয়ে বাংলায় এম.এ. পাস করবেন তিনিও যদি বাংলা সাহিত্য ও ভাষা নিয়ে গবেষণা করে তিনি পৃথিবীর অন্যতম পণ্ডিত বলেও গণ্য হন, বা সাহিত্য সাধনার ফলে তিনি যদি নােবেল প্রাইজও পান, তবু আইনগত তিনি সরকারি চাকরির উপযুক্ত বলে গণ্য হবেন না, উর্দু যদি তিনি না জানেন। পক্ষান্তরে, কেবলমাত্র উর্দু জানার জন্য একজন ম্যাট্রিক পাস উর্দুভাষীও তাঁর চেয়ে চাকরির অধিকতর উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন। অবশ্য পদমর্যাদার দিক দিয়ে একথা বলছি না; একজন ম্যাট্রিক পাস উর্দুভাষী অন্তত পিওনও হতে পারবে, কিন্তু উর্দু-অজ্ঞ বাংলায় প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থান অধিকারী একজন এম.এ. চাকরির কোনােই অধিকার পাবে না যেমন ইংরেজি না জানলে বর্তমানে কারাে চাকরির অধিকার নেই। এইটাই হলাে স্বাভাবিক-এইটাই হলাে আইনত ন্যায়ের কথা। ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা বলে বর্তমানে আমাদের যেমন নিম্ন প্রাইমারি থেকে এম.এ. পর্যন্ত ইংরেজি শিখতে হচ্ছে এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য আয়ত্ত করার জন্য সাধনা করতে হচ্ছে, এবং কতখানি আয়ত্ত করতে পারি তার ওপর চাকরির মান, বেতন, উন্নতি এবং সামাজিক মর্যাদা নির্ভর করছে, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তখনও তেমনি আমাদের নিম্ন প্রাইমারি থেকে এম.এ. পর্যন্ত উর্দু ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হবে, আয়ত্ত করার জন্য সাধনা করতে হবে এবং কতখানি আয়ত্ত করতে পারি, তার ওপর আমাদের চাকরির মান, বেতন, উন্নতি, এবং সামাজিক মর্যাদা নির্ভর করবে। পক্ষান্তরে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকরির যােগ্যতা লাভ করবেন, এবং প্রত্যেকটি বাংলাভাষীই চাকরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন।
রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দরুন উর্দু সংবাদপত্রের মর্যাদাই হবে সবচেয়ে বেশি, যেমন বাংলা সংবাদপত্রের চেয়ে বর্তমানে ইংরেজি সংবাদপত্রের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। এবং এ ক্ষেত্রে প্রভাবের দিক দিয়ে উর্দুভাষীদের সঙ্গে আমরা কখনােই পারব না; যেমন ইংরেজ-পরিচালিত পত্রিকার সঙ্গে আমাদের পারা সম্ভব হয়নি। উর্দুভাষীপরিচালিত সংবাদপত্রের মতাে উৎকৃষ্ট এবং প্রভাবমুক্ত আমাদের পরিচালিত উর্দু সংবাদপত্র হবে না। আইন পরিষদে উর্দুভাষীদের মতাে উর্দু আমরা বলতে পারব না, অতএব সেখানে আমাদের প্রভাব হবে অত্যন্ত কম। মােটের উপর পাকিস্তানে উর্দুভাষীর সংখ্যা নগণ্য হলেও তাদের হবে সবদিক দিয়েই সুবিধা, কিন্তু সবদিক দিয়েই অসুবিধা হবে আমাদের। ঠিক এইরকম ব্যাপার পশ্চিম-পাকিস্তানের অনউর্দুভাষীদের বেলায়ও হবে।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করলে পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের অধিবাসীদের উপর কিরূপ অবিচার হবে তাই শুধু আমি দেখলাম। নইলে উর্দুর প্রতি আমার, বা আমার বিশ্বাস অন্য কোনাে বাংলাভাষীরই বিতৃষ্ণা নেই, বরং শ্রদ্ধাই আছে। ভারতে ব্রিটিশ আমলে যারা স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি-আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা উর্দুতে তাঁদের বক্তব্য বলে গেছেন: শিবলী নােমানী, সৈয়দ আহমদ, হালী, ইকবাল-এদের সাধনায় উর্দুভাষায় একটা বিরাট সাহিত্য গড়ে উঠেছে। অতএব উর্দু সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধাই আমাদের স্বাভাবিক। কিন্তু তবু বর্ণিত কারণসমূহের জন্য উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত নয়, এবং তা করলে পাকিস্তানের প্রায় সব নাগরিকের ওপরই অবিচার করা হবে, শুধু সেই কথাই আমার বক্তব্য।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করলে আমাদের সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতি শুধু ব্যাহত হবে না, রুদ্ধ হয়ে যাবে। কেউ কেউ বলতে পারেন, ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা হওয়া সত্ত্বেও যদি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধি সম্ভব হয়ে থাকে তবে উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলেও বা তেমনি হবে না কেন?
এর জবাব এই যে, আমরা সব সময় জানতাম ইংরেজি বিদেশী ভাষা, সাম্রাজ্যবাদের ভাষা, আমাদের ভাষা নয়। অতএব, তার প্রভাবে বাংলা ভাষার ও সাহিত্যের অগ্রগতি রুদ্ধ হতে পারেনি। বরং দ্রুততরই হয়েছে। কেননা ইংরেজির মধ্যে দিয়ে আমরা বহির্বিশ্ব সম্বন্ধে বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গী লাভ করেছি, আমাদের কুপমণ্ডুকতা ঘুচে গেছে, এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধই হয়েছে। কিন্তু সাহিত্য হিসেবে উর্দু সাহিত্য ইংরেজির থেকে তাে নয়ই, বাংলা সাহিত্য থেকেও শ্রেষ্ঠতর নয়। অথচ উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তার প্রভাব বাংলা সাহিত্যের উপর পড়বে; যে সাহিত্য শ্রেষ্ঠতর নয় তার প্রভাব পড়বে শ্রেষ্ঠতর সাহিত্যের উপর, এবং তার ফলে বাংলা সাহিত্য লাভবান না হয়ে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তারপর, ইংরেজিকে বিদেশী ভাষা বলে জানতাম বলে এর প্রভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সত্তা হারিয়ে ফেলতে আমরা দেইনি, কিন্তু যেহেতু উর্দু বিদেশী ভাষা নয়, এবং এই ভাষা ও সাহিত্যকে আমরা শ্রদ্ধা করি, এমনকি বােধ হয় কেউ কেউ বাংলার থেকেও বেশি শ্রদ্ধা করি, সেহেতুই বিপদ আরাে বেশি। এতে এমন সম্ভাবনাও আছে যে, আমরা সম্পূর্ণভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বর্জন করে সম্পূর্ণভাবে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যকে গ্রহণ করব; বাংলা সাহিত্যের আসর থেকে আমরা চিরবিদায় নেব। যেহেতু আমরা উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি কৃতজ্ঞ, এবং শ্রদ্ধান্বিত, সেহেতু সেই কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধার বশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকেই হয়তাে আমরা একদিন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বিলুপ্ত করে দিতে পারি, যার অর্থ হবে আমাদের মৃত্যু। এই সম্ভাব্য পরিণতি সম্বন্ধে আমদের সকলকে-বিশেষত সাহিত্যিকদের সচেতন হতে হবে, এবং বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ না করার আরাে একটা বড় কারণ আছে। আমরা স্বাধীনতা পেতে যাচ্ছি। স্বাধীনতা যদি সবদিক দিয়েই না পাওয়া যায় তবে সে স্বাধীনতাকে পূর্ণ স্বাধীনতা বলা যায় না। অতএব, অন্যান্য স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাষাগত স্বাধীনতাও পাওয়া দরকার। যে-ভাষাগত স্বাধীনতা পেলে আমরা আমাদের মনােভাব সুষ্ঠরূপে প্রকাশ করতে পারব, সে স্বাধীনতা যদি আমরা না পাই, তবে আমাদের মুখ আংশিকভাবে বন্ধ করে রেখেই স্বাধীনতা দেওয়া হবে নাকি?
অবশ্য, উর্দু যে আমরা শিখবাে না, তা নয়; বরং এখনকার থেকে আরাে শিখবাে এর সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যের জন্য, উর্দুভাষীদের জানবার জন্য। কিন্তু তাঁদের জানা কি শুধু আমাদেরই কর্তব্য, আমাদের জানা তাঁদের কর্তব্য নয়? কিন্তু আমাদের জানতে হলে আমাদের ভাষা শেখা এবং আমাদের সাহিত্য পাঠও তাদের অবশ্য কর্তব্য।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা এখনাে কেউ বলতে পারেন না, কিন্তু কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষা হতে পারে তা বলবার অধিকার সকলেরই আছে, এবং কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করলে ফল কিরূপ হবে, তাও বলবার অধিকার। সকলেরই আছে। আশাকরি এ সম্বন্ধে কার কি মতামত তা জানতে পারব।
আরাে একটি কথা সত্য যে, পূর্ব-পাকিস্তানের পাঁচ কোটি লােকের অন্তরকে যদি জানতে হয়, তবে পশ্চিম-পাকিস্তানের নাগরিকগণকে পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা ও সাহিত্যকে বাধ্যতামূলক ভাবে জানতে হবেই। এক অংশের নাগরিক যদি অন্য অংশের নাগরিকদের না বুঝেন, তবে এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থাকার অর্থ কিছুই থাকে। অতএব, পূর্ব-পাকিস্তানকে অন্তরঙ্গভাবে জানতে হলে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করা পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিকেরই অবশ্যকর্তব্য এবং বাধ্যতামূলক কর্তব্য রূপে গণ্য না হয়ে পারে না। তাই যদি হয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যই যদি তাঁদের অধ্যয়ন করতে হয়, তবে পশ্চিম-পাকিস্তানেরও রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলাকে গ্রহণ করতে আপত্তি কি? পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলাকে গ্রহণ করতে আপত্তি কি? পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে, এতে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। পশ্চিম-পাকিস্তানেরও রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে শুধু তিন কোটি লােককে নতুন ভাষা শিখতে হয়, কিন্তু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করলে প্রায় আট কোটি লােককেই নতুন একটা ভাষা শিখতে হবে।
………………………………………………………………………………………………
* জনসংখ্যার এসব উল্লেখ তখনকার আন্দাজী হিসেবের ভিত্তিতে। স্পষ্টতই পূর্ব-পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি ধরা হয়েছিল। তবে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে বােধ হয় এটা অস্বাভাবিক ছিল। তখন চূড়ান্তভাবে সীমারেখা নির্ধারিত না হওয়ায় পূর্ব-পাকিস্তানের আয়তন এখনকার তুলনায় বৃহত্তর হবে বলে মনে করা হতাে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ৩রা জুনের ঘােষণা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়া জেলা পূর্বপাকিস্তানের (এবং খুলনা জেলা পশ্চিমবঙ্গের) অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। (পাদটীকা ১৯৭৫)
………………………………………………………………………………………………
সূত্র: আজাদ, ৩০শে জুন ১৯৪৭