বদরুল আলমের জীবনকথা
অধ্যাপক আফজালুন্নেসা
জন্ম, পারিবারিক পরিচিতি ও শিক্ষা
১৯২৮ সালের ৮ এপ্রিল বদরুল আলমের জন্ম পিতার কর্মস্থল শেরপুরে। পিতা আলহাজ্ব মৌলভী নাসিরুদ্দিন তখন ইন্সপেক্টর অব স্কুলস্ হিসেবে কর্মরত। তিনি তখনকার সময়ের গ্রাজুয়েট। বদরুল আলমের মাতার নাম তহুরুন্নেসা। তিনি ছিলেন খান বাহাদুর খালেক সাহেবের ছােট বােন। ঐতিহাসিক সােনারগাঁয়ে ছিল তাদের পৈত্রিক নিবাস এবং পূর্বপুরুষের ভিটা। তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল গর্ব করার মতাে। এলাকায় জমিদার পরিবার হিসেবে তাদের পরিচিতি ছিল। মাত্র ১ বছর বয়সে বদরুল মাতৃহারা হন। পরে তার পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
বদরুল আলমের পরিবারের সাথে আমার পরিচিতি ঘটে সেই বাল্যকাল থেকেই। বদরুলের দাদার বাড়ি ছিল আমার মায়ের নানার বাড়ি। আলম ছিল দূর সম্পর্কে আমার মায়ের ভাই (মামা)। সেই সুবাদে মায়ের কাছে তাদের পরিবারের কথা জানতে পারি।
বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক নগরী পানাম শহরটা ছিল আলমের বাড়ির নিকটেই। আলমের পূর্বপুরুষরা ছিল সােনারগাঁয়ের জমিদার। প্রজারা জমিদার বাড়ির কাচারি ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় জুতা হাতে নিত, ছাতা খুলে ফেলত এবং বাড়ির উদ্দেশ্যে সালাম জানাত। জমিদার বাড়ির লােকজন বাজারে যেত না, বাজারে গেলে প্রজাদের ছোঁয়া লেগে যাবে সেই ভয়ে। প্রজাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু। দেশ ভাগের পর হিন্দু প্রজাদের অনেকেই ভারতে চলে যায়। পানাম নগর জনশূন্য হয়ে যায়। ১৯৫০ সনের দিকে জমিদার প্রথা উচ্ছেদ হয়ে যায় এবং জমিদার পরিবারগুলাে ধীরে ধীরে চাকরি ও ব্যবসায় মনােনিবেশ করেন। ছােটবেলায় মায়ের এই আত্মীয়ের বাড়ি অর্থাৎ বদরুল আলমের পূর্বপুরুষদের ভিটায় বেড়াতে গিয়ে আমি নিজেও তাদের শান-শওকত প্রত্যক্ষ করেছি। বাড়িতে থােপা, নাপিত, পালকি, বেহারা ও লাঠিয়াল ছিল। জমিদারদের ক্ষয়িষ্ণু রূপ তখনও চোখে পড়ত।
চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের যথেষ্ট সুনাম ছিল। বদরুল আলম এই স্কুলেই ভর্তি হন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে। ১৯৪৪ সনে গণিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে। মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে ১৯৪৭ সনে আইএসসি পাস করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
ঢাকা মেডিকেল কলেজের জীবন বদরুল আলমের জীবনের সবচেয়ে সােনালি অধ্যায়। সে ছিল এই কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ঢাকা মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয় দেশ বিভাগের এক বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে। প্রথমে এর কোনাে নিজস্ব ভবন ছিল না। ১৯০৫ সালে স্থাপিত অস্থায়ী সামরিক হাসপাতাল ছিল এটি। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে এক মহান ও বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়েই শুরু হয়েছিল এর পথচলা, তবু প্রথম ব্যাচে প্রায় একশত মেধাবী ছাত্র ভর্তি হয়েছিল। বদরুল আলম ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ঐতিহাসিক যাত্রার প্রথম ছাত্র। তখন কলেজের নিজস্ব কোনাে ছাত্রাবাস ছিল না। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকত। আলমের পিতা তখন আজিমপুর সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার সুপারিনটেনডেন্ট। তারা কোয়ার্টারে থাকতেন। আলম সেখানে থেকে এসে ক্লাস করতেন। সে সময়ে বেশ কিছুটা অর্থকষ্টে তার দিন কাটে।
তৎকালীন ফ্লাইট ল্যাফটেন্যান্ট মহিউদ্দিন ছিলেন তাঁর বড় ভাই। তিনি করাচিতে এয়ারফোর্সে চাকরি করতেন। তিনি মাসিক ২০ টাকা পাঠাতেন। বাকি টাকা বাবার কাছ থেকে নিতে হতাে। বাবা অনেক কষ্টে তাঁর এই খরচ যােগাতেন। সারাদিন ব্যারাকের হােস্টেলে থাকলেও সেখানে আহার করত না। বন্ধু-বান্ধবের সাইকেল ধার করে নিয়ে চলে আসত ব্যারাকে ও আজিমপুরের বাসায়। সাইকেল না পেলে হেঁটেই চলে আসত এবং খেয়ে আবার হােস্টেলে যেত। দুপুরে এবং রাত্রে দু’বেলাই তাকে এভাবে বাসা ও ব্যারাকে ছুটাছুটি করতে হতাে। বই কিনে পড়া তার ভাগ্যে জোটেনি। লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করত। আমি ১৯৫১ সনে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই এবং হােস্টেলে থাকি। তখন আমরা খুবই কাছাকাছি তবু সে সপ্তাহে একদিনের বেশি আমরা সাথে দেখা করত না। শত কাজ নিয়ে তাঁর ব্যস্ততা।
দেশ বিভাগের পর অনেক হিন্দুরা পাকিস্তান থেকে চলে যাবার পর অফিসআদালত, স্কুল, কলেজ সর্বত্রই একটা শূন্যতা বিরাজ করে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও স্থবিরতা এসে যায়। এ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ‘শিল্পীসংঘ’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত সংগঠনকে তৎকালীন সাংস্কৃতিক শূন্যতা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দেশ বিভাগের পর এটাই ছিল পথিকৃৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন। যারা এই সংঘের সদস্য ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাজেদুল রহমান মাস্তানা, এস. এম. মতিয়ার রহমান, আবুল হাশেম, ইয়াহিয়া, কাজী শাহজাহান হাফিজ, মিরাজ উদ্দিন আহমদ, জিয়া হাসান, সাইফুদদৌলা এবং বদরুল আলম। আরও অনেকের নাম মনে করতে পারছি না। বদরুল আলমএই সংগঠনের হয়ে একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। একটি নাচের দলও গঠন করা হলাে। এর মধ্যে কয়েকজন মেয়েকেও অন্তর্ভুক্ত করা হলাে। তারা হলেন— তাজ, রােজি (নজরুলগীতি গায়িকা ফিরােজা বেগমের ভাগনি), আয়েশা, মঞ্জু (গােলাম মােস্তফার নাতনী) ও অঞ্জলি।
সাজেদুল রহমান মাস্তানা ভাইয়ের পরিচালনায় নিয়মিত প্রাণচঞ্চল থাকত এই নাচের দলটি। মাস্তানা ভাই বদরুল আলমকে নিয়ে একটি ভাঙ্গাচোরা সাইকেলে চড়ে ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনি পয়সায় নাচ শেখাতেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা নাচের দল নিয়ে যেতেন এবং নাচ পরিবেশন করতেন। বদরুল আলম ছিলেন এ কাজের অন্যতম সহযােগী।
বদরুল খুবই ভালাে স্কেচ অঙ্কন করতে পারত। হল, ব্যারাক, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বাইরের নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে আলম মঞ্চ সাজানাে ও পােস্টার আঁকার দায়িত্ব পালন করত। মেডিকেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন হলে অনিবার্যভাবেই বদরুল আলমের ডাক পড়ত পােস্টার লেখা ও বিভিন্ন অঙ্কনের কাজে। সে সময় কোনাে প্রফেশনাল আর্টিস্ট ছিল না। নাটকের মঞ্চ সাজাতে ও উইন্ডস্ক্রিনের সফল অঙ্কন বদরুল আলমের হাতের স্পর্শে ফুটে উঠত। ডিজাইন এবং ছবি সবগুলােই বদরুল আলম করে দিতেন। ১৯৪৮ সনে সে মেডিকেল কলেজের কেন্দ্রিয় কমিটির নির্বাচনে অ্যাপায়ন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরে উক্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়।
বদরুল আলমের আঁকাআঁকির হাতে খড়ি ছােটকাল থেকেই। স্কুলে পড়ার সময় সিনেমা হলের সামনে বিজ্ঞাপনের ছবি দেখে সে থমকে দাঁড়াত। অবাক হয়ে দেখত বিচিত্র ছবি ও রঙের খেলা। উদ্যোগী হয়ে ছুটে যেত শিল্পীর কাছে, কাছে। দাঁড়িয়ে গভীরভাবে লক্ষ্য করত শিল্পীর তুলির ব্যবহার।
ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে অঙ্কনে সে ছিল সবার সেরা। উক্ত স্কুলের চারুকলার শিক্ষক তাকে ভীষণ পছন্দ ও আদর করত। এই শিক্ষকের উৎসাহ-উদ্দীপনায় সে অঙ্কনের ব্যাপারে আরও মনােযােগী হয়ে যায়। তিনি বদরুল আলমকে তাঁর ব্যবহৃত তুলি ও আঁকার অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সহযােগিতা করেছিলেন। পরে আমি এসব সংরক্ষণ করে রাখি। এর মধ্যে সেই শিক্ষকের দেয়া কোনাে সরঞ্জাম থাকতেও পারে। কার্জন হলে তারাশংকরের নাটক ‘দীপান্তর’, মঞ্চায়িত হয়েছিল বার্ষিক সাংস্কৃতিক আয়ােজনে। মেডিকেল কলেজের শিল্পীসংঘ এবং আপ্যায়ন কমিটি উদ্যোক্তার ভূমিকায় ছিল। ছেলেরা মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করত। দন্তচিকিৎসক ডা. ফকরুজ্জামান সবসময় মেয়ের অভিনয় করতেন। বদরুল অভিনয়ে অংশ নিত আবার ব্যবস্থাপনায়ও অগ্রণী ছিল।
শিল্পীসংঘের শিল্পীদের নিয়ে তিন মাস পর পর অর্থাৎ বছরে ৩/৪ বার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করত। দর্শকের খুব ভিড় হতাে। শিল্পী নির্বাচন কমিটি ছিল। শিল্পীদের বেছে নেয়া হতাে। এই বাছাবাছির কর্মকাণ্ডে মেয়েদের পাওয়া যেত না। বাধ্য হয়ে উদ্যোক্তারা পেশাদার মহিলা যাত্রাশিল্পীদের ভাড়া করত।
১৯৫৭ সাল। তারাশংকরের ‘আরােগ্য নিকেতন’ মঞ্চস্থ হবে মেডিকেল কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আমি তখন ডাক্তারি পাস করেছি। আমরা তিনজন ডা. আবেদা, ডা. রােকেয়া এবং আমি নাটকের অভিনয়ে অংশ নিতে এগিয়ে এলাম। জীবনে কখনও অভিনয় করিনি। আমি তখন বদরুলের স্ত্রী।
আমাদের বিয়ে এবং পেশােয়ারের দিনগুলাে
এমবিবিএস পাস করার পর বদরুল বেশ কিছুদিন চাকরির জন্য ঘােরাঘুরি করেছে, কিন্তু হচ্ছিল না চাকরি। হতাশ হৃদয়ে বদরুল যাচ্ছিল ভাগ্যকূলের দুলাভাই, তৎকালীন এসডিও মনসুরুজ্জামান এর কাছে। পথে ট্রেনের কামরায় এক ভদ্রলােকের সাথে দেখা, কথায় কথায় জানা গেল পশ্চিম পাকিস্তানে বহু পদ খালি আছে। বদরুল ঢাকায় ফিরে একটি চাকরির দরখাস্ত করল।
পাশে বসা ভদ্রলােকের প্রশ্ন: ‘মশাইর কি করা হয়’? বদরুলের উত্তর: ‘আমি ডাক্তার, কিন্তু আপাতত বেকার, বােনের অন্ন ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছি…। ভদ্রলােক ক্ষেপে উঠে বললেন, আপনাদেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাবকালে দরকার। বদরুল চমকে উঠলেন! বাঙালিরা সব সময় ঘরকুননা, দেশ ছেড়ে বিদেশে যাবে না, আরে মশায় পশ্চিম পাকিস্তানে শত শত চাকরি পড়ে আছে। ওখানে দরখাস্ত করে দেখেন কালই চাকরি হয়ে যাবে, অথচ ঢাকায় তখন ডাক্তারদের জন্য সেনাবাহিনীতে কিছু চাকরি ছাড়া অন্য কোথাও কোনাে চাকরি ছিল না।
বােনের বাড়ি থেকে বদরুল তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরে আসে এবং দরখাস্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরির জন্য। কয়েকদিন পরই চাকরির নিয়ােগপত্র এল। এটি ছিল পেশােয়ার থেকে ১০ মাইল উত্তরে। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে একদিন রওয়ানা দিল বদরুল। করাচি থেকে রেলে আবােয়াল যাবার পথে মাঝখানে খাইবার স্টেশনে দেখা বাঙালি বন্ধুদের সাথে। তাদের পরামর্শ আধােয়ালে না গিয়ে পেশােয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে যােগ দিলে, খাইবার মেডিকেল কলেজে চাকরি সরকারি চাকরির চেয়ে খারাপ কিসে? আধােয়ালে মন খুলে কথা বলার লােক জুটবে না। বদরুল আর আঘােয়ল গেল না, পেশােয়ারে চাকরির আবেদন করতেই চাকরি হয়ে গেল। এভাবেই শুরু হলাে বদরুলের কর্মজীবন।
পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার আগেই আমাদের আকদ হয়ে যায়। দিনটি ছিল ২০ জানুয়ারি, ১৯৫৭। আমি ঢাকায় থেকে গেলাম ইন্টার্নিশিপ করার জন্য বদরুল পেশােয়ারে। ৬ মাস পর ঢাকায় আমাদের রিসেপশন হলাে—তারপর দুজন একসাথে পেশােয়ারে গেলাম। বিয়ের আনন্দানুষ্ঠান হবার দুদিন পরই আমরা রওয়ানা হলাম পেশায়ারের উদ্দেশে। ঢাকা। থেকে কলকাতায় গেলাম ট্রেনে। আড়াইদিন লেগেছিল কলকাতা থেকে পেশওয়ার পৌছাতে। পথে উল্লেখযােগ্য দর্শনীয় স্থানে নেমে পড়তে মন চেয়েছে। কিন্তু উপায় নেই। ট্রানজিট ছিল কিন্তু প্রবেশাধিকার ভিসা ছিল না। ভিসা থাকলে আমরা আগ্রাতে প্রবেশ করে তাজমহল দেখার চেষ্টা করতাম। লম্বা এই ভ্রমণে ভারতের বড় বড় স্টেশন জংশন দেখে দেখে যাওয়া গেল। এক এক অঞ্চলের শিল্প কর্মের দেখাও মিলল। কৃষ্ণনগরে হাতে গড়া ছােট ছােট মূর্তি দেখলাম। নানা ফুল টুকরি ভর্তি করে নিয়ে এসেছে, কত রকমারি ফল, ঝাল, মিষ্টি খাবার সবই বিক্রি হচ্ছে। লােকজনে ভাষা এবং বেশভুষা লক্ষ্য করে মজা লাগছিল। মনে হচ্ছিল যাবার মাঝে কিছুদিন করে থাকার সুযােগ যদি পেতাম তাহলে পৃথিবীর কত মানুষকে জানা হতাে।
পেশােয়ার লেল স্টেশনে যখন পৌছে গেলাম তখন সকাল দশটা বা এগারটা। জিন্নাহ ক্যাপ পরা এক ভদ্রলােক এগিয়ে সালাম দিলেন। উনি খুশি। হলেন এই বলে যে বাঙালি দুজন বেড়ে গেল। দুজন নয় আমরা ছিলাম তিনজন। আমার বড় বােনের দেয়া ২২/২৩ বছরের ছেলে কফিলুদ্দিন ছিল আমাদের সাথে। তাকে বড় বােন ফজিলাতুন্নেসা আমাদের সাথে যােগ দেয়— ঘরের কাজের জন্য। আমি রাঁধতে পারি না, বিশেষ করে রান্নার প্রয়ােজনে তাকে আমরা আনন্দের সাথে নিয়েছিলাম। কমিলাকে নিয়ে যে কি আনন্দে আমার দিন কাটল। আমাকে চাকরি পাবার আগে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। তারপর চাকরি হয় লেডি রিডিং হাসপাতালে। বাসে চেপে হাসপাতালে যাওয়া-আসা করতাম। তারপর চাকরি হয়, Cantonment General Hospital-এ যেখানে আমি কোয়ার্টার পেলাম। ক্যান্টনমেন্ট জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে, কাজের চাপ ছিল আমার। সকালে-বিকালে আউটডােরে কাজ করতে হতাে ৪ ঘন্টা করে ১০ বেডের ওয়ার্ডের মহিলা রুগীদের চিকিৎসা দিতে হতাে। মহিলা রুগীরা হাসপাতালে, মহিলা চিকিৎসক ছাড়া অন্য কোথাও যেত না। ৪০ গজ কাপড়ের তৈরি বােরকা পরিহিতা মহিলারা দূর থেকে আসত। সকালে আউটডােরে প্রচুর ভিড় হতাে। ভাষার সংকট হতাে। দুই অ্যাংলাে ইন্ডিয়ান সিস্টার আমাকে প্রচুর সাহায্য করত। আমি অর্থ বুঝে নিয়ে তা খাতায় লিখে নিতাম। এমনি করে কিছুদিনের মধ্যে সাধারণ কিছু কথা শিখে নিয়েছিলাম। তােমাদের কি কষ্ট? ‘গাে তাকলিক দে, কতদিন তােমার কষ্ট?– সুমরা মােদা সুয়ে দে তা তাকলিক দে?
রুগী এসে বসেই বলত ‘আলা লাগাও মানে স্ট্রোথােস্কোপ লাগাও। ধাক্কাধাক্কি করে আগে দেখানাের প্রতিযােগিতা সামলানোে বড় মুশকিল হতাে। সবরকমের রােগের চিকিৎসা দিতে হতাে, জটিল রােগে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি পুরুষ হয় তবে তার কাছে পাঠালেও যেত না তারা। যথেষ্ট খাটুনির মধ্যে দিন কাটছিল। তবু ভালােই ছিলাম। এর মধ্যে এল সন্তান। ৭ মাস পার হয়ে গেছে। কাকে দেখাব এখনও ঠিক করিনি। এমনিতে কোনাে অসুবিধা হচ্ছিল না। কাজকর্মও চালিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু বদরুল চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমাকে ঢাকায়। পাঠানাের উপায় সে দেখছে না, আমার বাবার বাড়িতে বা শ্বশুর বাড়িতে স্থান সংকুলান সমস্যা ছিল। তাছাড়া বৃদ্ধ বাবা-মাকে গুরু দায়িত্ব দেয়াটা সমীচীন নয়। আমি কিন্তু তেমন কোনাে চিন্তা করছি না। চিন্তা-ভাবনা করে বদরুল ঠিক করল রাওয়ালপিন্ডি সেনা হসপিটালে আমি চিকিৎসা পাওয়ার দাবিদার যেহেতু আমি চাকরি করি। সেই মতাে ব্যবস্থাও হয়ে গেল। পেশােয়ার টাউনে জেনারেল হাসপাতালে নিজেকে দেখিয়েছি গাইনি কনসালটেন্ট ডা. সাফকাত মুনিরকে। তিনি মত দিলেন বাচ্চা নরমাল পজিশনে নাই সুতরাং পিন্ডি হাসপাতালে রেফার করে চিঠি দিলেন ডা. সাফকাত মুনির, নির্ধারিত তারিখের ৭ দিন আগে বদরুল পিন্ডিতে তার বন্ধু ডাক্তার কর্নেল সাইদুল হকের বাসা চাকলালায় আমাকে নিয়ে উঠল।
মেজর ওয়াজিয়া হাসান, আমার ডাক্তারে কাছে পৌছে গেলাম যেদিন ব্যথা উঠল। তিনি কনসালট্যান্ট গাইনি ব্রিগেডিয়ার মিয়াকে আমার দিকে লক্ষ্য রাখার বার দিয়ে ডা. ওয়াজিয়া হাসান লাহােরে যান বান্ধবীর বিয়েতে যােগ দিতে। ব্রিগেডিয়ার মিয়া এসে অপারেশন থিয়েটার প্রস্তুত করার হুকম দিল। দুপুর ১২ টায় সিজার হলাে। গাইনির সার্জেন না থাকায় মিয়া যে পন্থায় সিজার করল তা একটু পুরানাে পন্থার সিজার, (২য় ও ৩য় বাচ্চা হবার সময় লন্ডনের ডাক্তাররা ভুলটা লক্ষ্য করে আমাকে নানা প্রশ্ন করে বসে) ছেলের জন্মের দিন ৯/১১/ ৫৯ ইং। এনাসখাসিয়া দিয়েছিল বাঙালি ডাক্তার, ছেলের জন্মের পর বদরুলের কান্না থামিয়ে ঢাকায় ১১টা টেলিগ্রাম করে সুসংবাদ পৌছাল সবাইকে। ৭ দিনের পর সাইদুল হকের বাসা, সেখান থেকে পেশােয়ার।
পেশােয়ারের তিন বছরের জীবনে আমাদের পাঠান মুলুক সম্বন্ধে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে উপজাতি এলাকা, পেশােয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পাহারা দিত দিনে-রাতে ২০০ গার্ড। এরা সবাই পাঠান। ক্ষেতে- খামারে, রাস্তাঘাটে, কোনাে স্থানে কোনাে বয়ােপ্রাপ্ত পাঠানকে বন্দুক ছাড়া দেখা যেত না। পাঠানের বন্দুকের গুলির দাম আছে—একটা গুলির বিনিময় হলাে অথচ প্রাণ গেল না- এমনটি হবার নয়, পাঠানদের গর্বিত দাবি। পরাভূত ইংরেজ সৈনিকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্র খুলে পার্টসগুলাে আলাদা করে হুবহু নকল অস্ত্র তৈরি করে ফেলত তারা। পাহাড়ের গুহার ভিতরে শত শত অস্ত্র কারখানা- ছােট ছােট কুটির।
পাঠানি মেয়েরা দেখতে সুন্দর, লম্বা চুল। গােত্রে গােত্রে পাঠানদের ভীষণ রেষারেষি। ক্ষতির বদলা নেয়া চাই সম্পর্কটা এমন। পাঠানরা পাঞ্জাবিদের পছন্দ করত না বাঙালিদের পছন্দ করত। আমরা বাঙালিরা কোনাে বাড়িতে একত্রিত হলে পাঞ্জাবিরা নালিশ করত। বদলা নেবার যে লােমহর্ষক কাহিনি শােনা যেত তাতে মাঝে মাঝে শঙ্কিত হয়ে পড়তাম। কিন্তু বাঙালিরা পাঠানদের হাতে ছিল অনেক নিরাপদ। একদিন সকালে ‘খট’ গুলির শব্দ শুনে বদরুল জানতে চাইল, ফকির চাঁদ কিসের শব্দ। এর উত্তরে গার্ড ফকির চাঁদ বলল— কৈ কোনাে গুলির শব্দ নয় কারণ গুলি খরচ হয়েছে প্রায় যায়নি এমনকি হবার নয়। পাঠানরা অতিথিপরায়ণ। ডাক্তারদের খুব শ্রদ্ধা করত। বাবুর্চি ফকিল উদ্দিন আমাদের সাথে দুই বছর থাকার পর সে বাংলাদেশে চলে আসে, সে থাকাতে আমার কিছু চিন্তা ছিল না, সে ভালাে রাধত। তাকে কাজের কথা বলে দিতে হতাে না।
এরপর আমরা বাংলাদেশ থেকে আনিয়ে ছিলাম ছােকরা বয়সের নূরু-কে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে মাঠে দৌড়ত। বাচ্চাকে নিয়ে সে মাঠে যেত। মাঝে মাঝে পেরাম উল্টে যেত বাচ্চা পড়ে যেত, ছােট বাচ্চা ছেলে নুরুকে কিছু বলা যেত না।
পাঠান মুলুকে আমাদের প্রথম বছরটা কেটেছে খুব লাফালাফির মধ্যে। দুজনেই ছিলাম ফুর্তিবাজ। রবিবার এলেই বেরিয়ে পড়তাম, সারাদিন বাইরে থেকে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতাম। সকালে ১০টা থেকে ১টার সিনেমা শাে দেখে ঢুকতাম হােটেলে আবার মেটিনিতে সিনেমা হলে। সেখান থেকে বেরিয়ে মজা করে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরতাম, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঘুরাফিরা স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। বাইরে উপজাতি এলাকায় যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। পেশােয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সাথে কয়েকবার লাভিকোটালে গেছি। অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমান তখন পেশােয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, কয়েকবার তিনিও সস্ত্রীক গিয়েছেন, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী দলের সাথে দেখা হয়ে যেত কদাচিৎ। ওখানে আমরা যেতাম বাজারে শপিং করতে। কিছু বিদেশী জিনিস পাওয়া যেত।
পাঠানরা অতিথির জন্য জান কবুল করতে পারে। কিন্তু তাদের গােত্রে গােত্রে শত্রুতার রূপ ভয়ঙ্কর। ক্যান্টনমেন্ট বাের্ডের করণিক আলী শের ছিলেন পাঠান। তার আসন্ন সন্তান প্রসবা পুত্রবধূকে এনে ভর্তি করল হাসপাতালে। সাথে আনা টাঙ্গা বন্দুকধারী গার্ড অপেক্ষায় থাকল। পুত্র সন্তানের জন্ম হলাে। পরদিনই আলী শের তার পুত্রবধূ এবং সদ্যজাত নাতিকে নিয়ে যাবে বাড়ি। আমি বাধা দিলে সে উত্তর দিল তা হলে তার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় বন্দুকধারী গার্ড পাহারা দেবে যতক্ষণ তারা বাড়ি না পৌঁছে। গার্ড না থাকলে রাস্তায় তাদেরকে প্রাণে মেরে ফেলবে তাদের শত্রু গােত্রের লােকেরা। বদলা নিতে পাঠানদের কোনাে উস্কানি দরকার হয় না। প্রাপ্তবয়স্ক যুবক বৃদ্ধ প্রতিটি পুরুষের হাতে বন্দুক গলায় কার্তুজের মালা থাকবেই। শস্য ক্ষেত্রে কাজ করছে তারও অস্ত্র কাছাকাছি কোথাও রক্ষিত আছে। অতিদরিদ্র, জীর্ণ পােশাকধারী পাঠান বন্দুক ও কার্তুজের মালিক, পাঠানরা ছিল ধনী ভূস্বামী। কিন্তু সাধারণ লােক ছিল দরিদ্র চাষি। আফিমের চাষ ছিল পাঠানদের প্রধান জীবিকা। ঘরে মেয়েদের প্রধান কাজ রান্না নয়, আমার মনে হয়েছে রান্নার কাজে মেয়েরা তেমন সময় ব্যয় করত না। যতটা করত সূচি কাজে। খুব অল্প রান্না করত। তন্দুর থেকে রুটি করিয়ে নিয়ে আসত। খুব সহজে খানা প্রস্তুতে তারা অভ্যস্ত। পাঠান নারীর সৌন্দর্য দেখবার মতাে, টকটকে গায়ের রং।
শীতকালে পাঠানেরা চায়ের আসর বসাত। গ্রামের বড় গাছতলায় সকালের দিকে আসর বসত, অবিরত চা সেদ্ধ হচ্ছে। চীনামাটির কেটলি থেকে ছােট পাত্রে আস্তে অল্প করে চা ঢেলে বার বার পান করছে। সাথে অন্য কোনাে খাবার থাকে। ঐ আসরে চায়ের পরিবেশনা দেখবার মতাে। এগুলাে বিচিত্র কায়দায় চীনামাটির কেটলি কটি জোড়া লাগানাে। এমন জোড়ালাগানাে অথচ দেখতে সুন্দর। পাত্র দেখে কৌতুক বােধ হতাে। এমনটি আর কোথাও দেখিনি। যদিও এটি দরিদ্রের লক্ষণ। আর একটি ঘটনার কথা শুনেছিলাম সিস্টার মিসেস লালদিনের মুখে। আমাকে যে কোয়ার্টার দেয়া হয়েছিল সেখানে আমার পূর্বে ছিলেন এক খান এবং তার স্ত্রী, খ্রিস্টান লেডি ডাক্তার। তাদের দুই বাচ্চা। রাতে বাচ্চাকে নিয়ে টয়লেটে যাবেন লেডি ডাক্তার। দেখলেন খাটের নিচে একজন লােক, তিনি স্বামীকে সজাগ করেন। স্বামীর সাথে লুকিয়ে থাকা লােকটির হাতাহাতি শুরু হতেই ভেন্টিলেটার দিয়ে দুই পাঠান ঘরে ঢুকে খানকে গুলিতে মেরে ফেলে, এমন ভয়ঙ্কর গল্প শুনে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। কোন দোষে এমন মৃত্যু ঘটলাে তা আর জানা হয়নি।
একদিন হাসপাতালের লাউঞ্জে বসে শুনতে পেলাম এক নাগাড়ে বেশ কটা গুলির শব্দ। সিস্টার লালদিনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল বাজারের কাছে এক বাড়িতে কয়জন লােককে গুলি করে মেরে ফেলেছে। এমন গােত্রগত শত্রুতার গল্প যতই শুনতাম ততই ভয় পেতাম।
পেশােয়ারে আমাদের বাঙালি ডাক্তাররা যথেষ্ট সম্মান পেয়েছেন। ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে আমি একাই ছিলাম লেডি ডাক্তার, আমাকে সম্মান করত- যে কোনাে প্রয়ােজনে তারা সহযােগিতা করত, হাটে বাজারে গেলে সসম্মানে বসিয়ে খাতির করে তৈজসপত্র বাজার কোয়ার্টারে পৌছে দিত, পাওনা টাকার জন্য পরােয়া করত না, যখন সুবিধা তখন পাওনা পরিশােধ করা যেত।
পেশােয়ারে খাইবার মেডিকেল কলেজে খুব সুন্দর কোয়ার্টার পেলাম Campus-এর ভিতরেই কোয়ার্টার। হেঁটে কলেজে এ যাওয়া যেত। দেশ থেকে বাবুচি নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার আলম লােকজন খাওয়াতে খুব পছন্দ করত। তাই প্রায়ই বন্ধু-বান্ধব দাওয়াত করে খাওয়াত, এর মধ্যে আছে মেডিকেল- এর অধ্যাপক আলী রেজা খান, অধ্যাপক ফিদা মােহাম্মদ দুজই পাঠান। খুব আড্ডা জমত। আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের অনেক ডাক্তার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিল। তারা আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া করত। পাঞ্জাবিরা, পাঠান ও বাঙালিদের বিদ্বেষী ছিল। সমস্ত দুর্গম জায়গায় বাঙালি ও পাঠানদের চাকরি দিত এবং পাঞ্জাবিদের হাতে সব ক্ষমতা ছিল। কিছু বলার উপায় ছিল না।।
আমরা দুজন কপােত-কপােতির মতাে ঘুরে বেড়াতাম, ক্যাম্পাস দেখতাম হােটেলে পাঠান খাবার, টিক্কা ও নানরুটি আমাদের খুব প্রিয় ছিল। তখন ঢাকায় এগুলাে পাওয়া যেত না।
খাইবার মেডিকেল কলেজ-এ এসে বদরুলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে ছিল ধার্মিক। মেয়েরা বােরখা পরত এবং গানবাজনা করত। ডা. বদরুল ছেলেমেয়েদের মধ্যে নাট্যচর্চার গুরুত্ব সম্পর্কে অভিভাবকদের বাসায় গিয়ে বােঝালেন। সে কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং Local Drama উপস্থাপন করলেন কলেজ প্রাঙ্গণে। তাতে ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করেছিল এটা খুব প্রশংসিত হয়েছিল। ডা. বদরুল আলম ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। সবাই খুব উপভােগ করেছিল। এর ৪ দিন আগে বাসায় আসেননি। এক অনুষ্ঠানের দিন এক ছাত্রকে পাঠিয়ে ছিলেন আমাকে বাসা থেকে নিয়ে যেতে।
ডা. বদরুল আলম অ্যানাটমি জাদুঘরের কিউরেটর ছিলেন। শরীরের নানা প্রকার অঙ্গ-প্রতঙ্গের স্প্যাসিম্যান দিয়ে এ জাদুঘর সাজিয়েছিলেন এবং অনেক মডেল বানিয়েছিলেন যা তৎকালীন রয়েল কলেজ অব সার্জন-এর প্রেসিডেন্ট Prof. Last ১৯৬০ সালে খাইবার মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন করতে এলে তিনি এই জাদুঘর পরিদর্শন করেন এবং জাদুঘরের কিউরেটর বদরুল আলমের প্রশংসা করেন।
পাকিস্তানে তখন বাঙালির প্রতি দমন নীতি: চালু ছিল। বাঙালি ডাক্তারদের দেশ বিদেশে পড়তে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতাে না। No Objection Certificate সেটা রাওয়ালপিন্ডি থেকে দেওয়া হতাে। আমার স্বামী ওখানে একজন বাঙালি Secretary- কে অনুরােধ করার পর ওনার N. O. C হলাে কিন্তু আমাকে দিল না। যাই হােক আমি Housewife হিসেবে ১৯৬১ মাসের অক্টোবরে London-এর উদ্দেশে রওনা হলাম।
লন্ডনে ৫ বছর
পােস্ট গ্র্যাজুয়েশন এর জন্য লন্ডনে যাবার ইচ্ছা বদরুলের। পাকিস্তান সরকার N. 0. C দেবে না। করাচিতে সচিব পূর্ণমর্যাদায় একজন বাঙালি। তার স্মরণাপন্ন হওয়া গেল। আমরা দুজনই N. 0. C প্রার্থী। কিন্তু শুধু বদরুলকে N. 0. C দেয়া হলাে। ঠিক হলাে, আমি যাব Housewife হিসেবে। পেশােয়ারের প্রায় ৪ বছর চাকরির পর আমরা লন্ডনে পাড়ি জমাই। আমাদের একমাত্র পুত্রসন্তান স্বপনের বয়স তখন ২ বছর।
লন্ডন যাবার পথে জেনেভায় আমাদের যাত্রাবিরতি ছিল; বিমানবন্দর কাউন্টার থেকেই swiss ঘড়ি কিনল বদরুল। লন্ডনে হিথরাে বিমান বন্দরে সদ্য কেনা ঘড়িটা দেখে ৫ পাউন্ড জরিমানা দিতে হলাে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। নতুন কেননা কোনাে সামগ্রী নিয়ে ইংল্যান্ডে প্রবেশে নিষেধ ছিল। এমন অদ্ভুত নিয়ম আমাদেরকে বেশ বড় ধাক্কা দিল, হিথরাে বিমান বন্দরে আমরা অভ্যর্থনা পেলাম দেবরের। সে আমাদেরকে হােটেলে পৌছে দিল। পিআই-এ-র কর্মকর্তা এই দেবরটি ওখানে না থাকলে লন্ডনে আরাে কত ধাক্কা খেতাম কি জানি। দেবরের নাম মাহবুব আলম (সাঈদ)। একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম Earls Court-এ। সপ্তাহে ৫ গিনি ভাড়া। দুই মাস আমরা আয়হীন। দরখাস্ত করে যাচ্ছি। ছােট বাড়ির সন্ধানে সিলেটি হােটেল মালিকের স্মরণাপন্ন হয়ে আড়াই পাউন্ডের বাসায় চলে এলাম। পয়সা শেষ হয়ে এসেছে। ক্রিসমাসের সময়ে চিঠি বিলি করার কাজ করছে ছাত্ররা। ঐ কাজ ডাক্তারের জন্য নয়, ছাত্রের জন্য। বদরুল লজ্জা পেয়ে ফিরে এল। লজ্জার মাথা খেয়ে এক হােটেলে থালাবাসন পরিষ্কারের কাজে লেগে গেল বদরুল। দরখাস্ত পাঠানাে অব্যাহত থাকলেও কোথা থেকেও সাড়া মিলে না, ইন্টারভিউ কার্ড আসে না। অবশেষে ডা. লাস্টের ঠিকানা যােগাড় করে রয়েল কলেজে গিয়ে তার সাথে দেখা করল বদরুল। ডা. লাস্ট অতিথিকে পেয়ে এক সময় শুনলেন বদরুলের করুণ অবস্থার কথা। ডা. লাস্টের পরামর্শ অনুযায়ী দরখাস্তে লাস্টের নাম দেয়া যাবে। তিনি বেশ কিছুকাল লন্ডনের বাইরে অস্ট্রেলিয়ায় থাকবেন পরীক্ষা নেয়ার কাজে, তড়িঘড়ি দরখাস্ত করা হলাে ডা. লাস্ট এর রেফারেন্স দিয়ে, ইন্টারভিউ কার্ড এল, তর তর গতিতে সব হয়ে গেল, ডা. লাস্ট এর মধ্যে একদিন আমাদের এক চা-চক্রে তার বাড়িতে ডাকলেন। ছোেট বাচ্চা স্বপনকে নিয়ে আমরা দুজন হাজির। স্বপনকে কোল থেকে ছাড়া মাত্র। বাঁদরের মতাে লাফিয়ে লাফিয়ে সােফা ও খাটের গাটি পরখ করতে শুরু করল। ডা. লাস্টের বাড়িতে এমন কেউ নাই—কখনও ছিল এমনও মনে হয় না। পরে চা পান করে চলে আসি। প্রফেসর আর. জে. পেলিস্টার ছিলেন কমনওয়েলথ ডাক্তারদের উপদেষ্টা। আমরা দুজন গেলাম তার কাছে। অবস্থা জানালাম। বউবাচ্চাসহ বদরুল কোন সাহসে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছে এই বলে তিনি তিরস্কার করে পরামর্শ দিলেন বউ-বাচ্চাকে দেশে পাঠিয়ে দাও। আমরা ভগ্ন হৃদয়ে বাড়ি ফিরলাম। দু-একদিনের মধ্যে মরিয়া হয়ে বদরুল হােটেলে ডিশ ওয়াশের কাজ নিল।
ডা. লাস্টের রেফানেন্সে চাকরির ইন্টারভিউতে ডাক এল- বদরুল ছুটল বার্মিংহাম। সেখানে দুজন সাদা আর বদরুল কালাে ডাক্তার ইন্টারভিউপ্রার্থী। ইন্টারভিউ বাের্ড বদরুলকে প্রশ্ন করলেন ডা. লাস্টের সাথে সে কীভাবে পরিচিত। বদরুল ঘটনা বলল, দুই সাদা ডাক্তারের চাকরি হলাে না। বদরুল পেয়ে গেল চাকরি। বার্মিংহামে বাসা হলে আমি কিছুদিন পর স্বপনকে নিয়ে চলে এলাম সেখানে। নিশ্চিন্তে দিন যাচ্ছে। কিছুদিন পর একটি চাকরি খালি হলাে, বদরুল আমাকে রাজি করাল সেই চাকরির আবেদন করতে, সে আলাপ করল সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধান ডা. টমাস এর সাথে আবেদন করতে বলবে। চাকরি হলাে, দুরু দুরু বুকে কাজে যেতে শুরু করলাম, প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। কাজ করতে করতে এক সময়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম। ছেলে স্বপনকে চাইল্ড মাইন্ডারের কাছে দিলাম। কাজ ভালােই চলছে সংসার স্বাচ্ছন্দ্য বেশ, চাইল্ড মাইন্ডার’ মিসেস রবিনসনকে পেলাম পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে। শনি-রবি দুদিন ছেলে আমার কাছে থাকত বাকি পাঁচদিন সে মিসেস রবিনসন- এর কাছে। শনিবার রবিনসন স্বপনকে দিয়ে যেত— সােমবার সকালে আবার নিয়ে যেত।
১৯৬২ সাল, বড় দিনের উৎসব। ইস্ট বার্মিংহাম হাসপাতালে ডাক্তারদের বাসস্থান কমপ্লেক্সে বড়দিনের পার্টি। এই পার্টিতে সস্ত্রীক কনসালট্যান্টরা নিমন্ত্রিত ছিলেন। ছবি একে দেয়ালে পােস্টার আকারে টানিয়েছিলেন আলম, ডাইনিং হলে ঢুকে সবার দৃষ্টি ছবিগুলাের দিকে এবং সবার প্রশ্ন এই ছবিগুলাে কার আঁকা? এগুলাে ডাক্তার আলমের কীর্তি একথা জেনে সিনিয়র কনসালট্যান্ট সার্জন সি ক্লার্ক এবং মেডিসিনের চিকিৎসক ক্লেচ ফোর্ড দুজনেই দাবি করে বসলেন ডা. আলম ‘আমার হাউস ফিজিসিয়ান’ আমার ‘হাউজ সার্জেন’। ঐ সন্ধ্যায় সবাই পােস্টারের ছবিগুলাে চুটিয়ে দেখে খুব প্রশংসা করলেন। দু-একজন সিনিয়র ডা. আলমকে বললেন— তুমি কমার্শিয়াল আর্ট চর্চা করলে লাখ লাখ পাউন্ড কামাই করতে পারবে, ডা. আলম উত্তরে বলল, আমি আঁকা ছেড়ে দেব।
ইস্ট বার্মিংহামের জীবনে ডক্টরস রেসিডেন্স-এ আমাদের থাকা-খাওয়া এই দুটি ব্যাপারে কখনও কোনাে চিন্তা করতে হয়নি। পুরাে ফার্নিশড় স্যুট এক বেড, এক ড্রইং ডা. আলমের এবং আমার পাশাপাশি। খাওয়া-ধাওয়া ছিল বেশ উন্নতমানের, সকালে খেতাম বেড রুমেই, তারপর ডাক্তারি ড্রেস পরে চলে যেতাম ডাইনিংরুমে নাস্তা করে চলে যেতাম হাসপাতালে, দুপুরে ইংরেজি খাবার। বিকেলে চা খেতাম স্যুটে বসেই, রাতে ডিনারের জন্য আসতাম ডাইনিং হলে।
খাবার পয়সা বেতন থেকে কেটে নেয়া হতাে। এ ব্যবস্থা রেসিডেন্ট ডক্টরদের জন্য বাধ্যতামূলক, আমরা দুজনই ছিলাম রেসিডেন্ট ডকটর। মােট ২৬ জন ডাক্তার রেসিডেন্ট ছিল। ঐ হাসপাতালে ৮ জন ব্রিটিশ, ৮ জন্য অন্য। ডাইনিং এ খাওয়া শেষ হবার পর বহু খাবার পড়ে থাকত। এবং খাবারগুলাে সংরক্ষণ করা হতাে না। উঠিয়ে বিনে ফেলে দেয়া হতাে। এটা দেখে আমার খুব কষ্ট হতাে। এত খাবার দেয় কেন, আবার ফেলে দেয়ইবা কেন। আমি হাসপাতালের ভিতরে কোয়ার্টার পাই। চাইল্ড মাইন্ডার থেকে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার পর আমরা কমন ডাইনিং এ খেতে যেতাম না। কোয়ার্টারে আমরা পাক করে নিতাম। ছেলেকে দেশে পাঠানাের পরও আমরা সেই কোয়ার্টারে ছিলাম।
আমাদের বার্মিংহামের বাসায় ধনুকবের ও সমাজপতি আর পি সাহা এবং কন্যা জয়াপতি সাহার আগমন ছিল আমার জীবনের উল্লেখযােগ্য ঘটনা।
আমি ভালাে রেজাল্ট করে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। আমার বাবা ঘােষণা দিয়ে দিলেন, তার এই কন্যাটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবে, দরখাস্ত লেখা হলাে। বাবার এক ছাত্রকে দরখাস্তটা যথাস্থানে পৌছে দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হলাে। যথাসময়ে ভর্তির তালিকা প্রকাশিত হলে দেখা গেল আমার নাম নেই, খোঁজ পাওয়া গেল দরখাস্তটি যথাস্থানে পৌঁছেনি, কি করা! ধরা গেল এম. এন. এ আনােয়ারা খাতুনকে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন আর পি সাহার কাছে। তিন মাস দেরি হয়ে গেল আমার ভর্তি হতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ভর্তির খরচ পাওয়া গেল বড়বােন ফজিলাতুন এর কাছে। ভর্তি তাে হলাম। কলেজের বেতন ও হােস্টেল ফি মিলে প্রতি মাসে প্রায় ৮০ টাকা। বাবা কিছুই দিতে পারবেন না। বাবা চিন্তা করছিলেন টাকার উৎস কি কি হতে পারে। বাবার বুদ্ধিদাতা ছিলেন মামা জনাব আজহারুল ইসলাম। তিনি মাস্টার্সে ১ম শ্রেণী পাওয়া মুসলমান ব্যক্তি। এই সময় মামাই খবর দিলেন আর পি সাহা বৃত্তি দিচ্ছেন। মামা, আমি, আনােয়ারা খাতুন হাজির হলাম আর পি সাহার সামনে। আর পি সাহা সাদা ধুতি পরিহিত। আমাদের কথা শুনার পর দরখাস্ত চেয়ে নিয়ে লিখে দিলেন ৫০/- টাকা মাসিক ভাতার কথা, পরীক্ষায় ফেল করলে ভাতা বন্ধ হবে। মনে আবার সংশয় মেডিকেল কলেজের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী ফেল করে। সিনিয়র ক্লাসে উঠে ফেল করার কারণে বৃত্তি বন্ধ হলে বিপদ। আর পি সাহাকে মামা বললেন, ফেল করলে আপনাদের ভাতা বন্ধ হয়ে গেলে ওর পড়া বন্ধ হয়ে যাবে, সিনিয়র ক্লাসে উঠে এমনটা হলে ওর ক্যারিয়ারটাই নষ্ট হবে, একথা শুনে নতুন আর একখানা দরখাস্ত লিখিয়ে নিয়ে তার উপর আর পি সাহা লিখে দিলেন— মেডিকেল কলেজের ডিগ্রি পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বৃত্তি পাবে। মেডিকেল কোর্সের তখন ৬ মাস মাত্র বাকি। বৃত্তির পাঁচ বছর হয়ে গেছে। একটা পরীক্ষায় ফেল করাতে আমি ছয় মাস পিছিয়ে গেছি। বৃত্তি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন উপায়?
সােজা চলে গেলাম আর পি সাহার কাছে তার নারায়ণগঞ্জের অফিসে। তিনি বললেন আর পাবে না বৃত্তি, পরীক্ষায় ফেল করেছাে, আমি জানালাম, আমার দরখাস্তে লেখা ছিল পাস না করা পর্যন্ত বৃত্তি বন্ধ হবে না, আর পি সাহা ফাইল থেকে আমার দরখাস্ত বের করে সেটি পড়ে দেখলেন এবং বললেন, ঠিক আছে। তুমি বৃত্তি পাবে। আমি আজ পাস করা ডাক্তার। আমার এই সাফল্যের পেছনে স্মরণীয় ব্যক্তি হলেন আর পি সাহা। টেলিফোনে জয়াপতিকে বললাম তার পিতা আর পি সাহাকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে একবেলা খেতে। রবিবার ছুটির সকালে পিতা ও কন্যা এলেন। অতি অমায়িক আড়ম্বরহীনভাবে এলেন আমাদের অতিথি। সেদিন আমাদের আলােচনার প্রাধান্য পায় আমরা তখন কি করছিলাম, কি করার ইচ্ছা আছে ইত্যাদি। আমরা শুনেছিলাম আর পি সাহা সেই সময়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন উনার সদ্য চালু করা হাসপাতালের জন্য উপযুক্ত কোয়ালিফাইড ডাক্তার নিয়ােগের উদ্দেশ্যে। উনি প্রস্তাব করে বসলেন, তুমি চাকরি ছেড়ে ফেলােশিপ কর, সব খরচ আমি দেব- তারপর দেশে এসে আমার হাসপাতালে যােগ দাও। প্রস্তাবটি আমার জন্য লােভনীয় ছিল— এতে কোনাে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সংগ্রাম করে চলেছি। ছেলেটি কারও কাছে রাখতে পারছি না। এমন অবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি চলে যাবস্বামী একলা তার সংগ্রাম চালাবে— এ কথাটি আমি চিন্তা করতে পারিনি। উনি যদি সেদিন আমাদের দুজনেরই কোনাে ভালাে ব্যবস্থা দিতে পারতেন তাহলে হয়ত আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারতাম না।
আমরা ইস্ট বার্মিংহাম হাসপাতালে চাকরি করি ১৯৬১ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৬৫ সালের জুলাই পর্যন্ত। তারপর আমরা দুজন একই জায়গায় দুই হাসপাতালে যােগদান করি।।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং ঢাকায় আমাদের ব্যস্ত জীবন
লন্ডনের গ্লাসগােতে শিশুরােগ বিষয়ে ডিপ্লোমা নেন বদরুল। আমি অ্যানেসথিয়াতে ডিপ্লোমা নিয়েছিলাম লন্ডনে। ১৯৬৭ সনে দেশে ফিরে বদরুল যােগদান করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে রেজিস্ট্রার হিসেবে। আমি সহযােগী অধ্যাপক হিসেবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। আমাকে অবশ্য এর পূর্বে ৮ মাস ডিউটিতে কাজ করতে হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। বদরুল দুই বছর পর সহযােগী অধ্যাপক হিসেবে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যােগদান করেন। বদরুল থাকত আমার মায়ের বাসার কাছে ভাড়া বাড়িতে।
আমি একা ময়মনসিংহ থাকতাম। ৮ মাস পর আমি ঢাকায় সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে সহযােগী অধ্যাপক হিসেবে যােগদান করি। ১৯৬৭ সনের ১২ জুলাই লন্ডনের জীবন চুকিয়ে ঢাকায় ফিরছিলাম কল্পনার বয়স তখন দেড় বছর এবং আল্পনার বয়স ৬ মাস। ছেলের বয়স তখন ৮ বছর। ৪/৫ বছর সে কাটিয়ে দিল বড় খালার কাছে। আমরা ঢাকায় ফিরে স্বপনকে আমার বােনের কাছ থেকে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। স্বপনের স্কুল জীবন শুরু হয়েছে। ১৯৬৭ সালে সে সেন্ট জোসেফ স্কুলে ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। সকালে তাকে স্কুলে পৌছে দিয়ে আমরা দুজন মিটফোর্ডে ছুটতাম। শুধু ছেলেকে নয় মেয়েরা যখন স্কুলে ভর্তি হলাে তখন তাদেরকেও স্কুলে পৌছে দিতাম হাসপাতালে পৌছার আগে। বদরুল নিজেই গাড়ি চালাত। নিজের হাতে গাড়ির যত্ন করত।
মিটফোর্ড হাসপাতালের ওটিতে অস্ত্রোপচার শুরু হতাে সকাল সাড়ে আটটা থেকে। শৈল্যবিদদের কাজের আগে আমার কাজ শুরু হতাে। সুতরাং তাদের আগে আমাকে হাজির হতে হতাে। শহরের রাস্তায় আজকের মতাে যানজট ছিল বলে সকাল ৮টার আগে আমরা কার্যালয়ে পৌছতে পারতাম। আমাদের কাজ শেষ হতে দুপুর দুটোয়। তার অনেক আগেই বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হতাে। মেয়েরা মাঝে মাঝে খেলা করে সময় কাটিয়ে দিত। কখনও দেখা যেত তারা কাঁদছেসঙ্গী-সাথীরা কেউ স্কুলে নেই। সােবহানবাগে সরকারি বাড়িতে পৌছে গােসল খাওয়া ঝটপট সারতে হতাে।
প্রায়ই টেলিফোন এসে যেত ক্লিনিক থেকে অপারেশন আছে— অ্যানাসথাশিয়া দিতে যেতে হবে, অমুক ক্লিনিকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখে কিছু দিয়ে ছুটতাম। ক্লিনিক থেকে গাড়ি না আসলে স্কুটারে ছুটতাম। অ্যানাসথাশিয়াবিদ হিসেবে আমি প্রায় আট বছর বিলাতে সাহেব ডাক্তারদের কাছে কাজ শিখেছি। বাংলাদেশে আমার দক্ষতার চাহিদা ছিল। মিটফোর্ড থেকে ফেরার পথে বেশিরভাগ সময় আমি বাজার করতাম নিউ মার্কেটে। আলমও গাড়ি রেখে মাছ কিনত। আর বাড়ি এসে সে বিছানায় ফটাস শুয়ে পড়ত অপেক্ষা করত মাছ। রান্না হলে খাওয়ার জন্য। বিকেলে বাসাতেই রােগী দেখতে বসে যেত। বাচ্চারা তার তদারকিতে থাকত। আমি হয়তাে বাইরে কোথাও অ্যানাসথাশিয়ার কাজে আছি। আমার কাজ শেষ হলে বাড়ি এলে দেখতাম বদরুল তখনও রুগী দেখছে বাচ্চারা পড়াশুনার টেবিলে বসে গেছে। বাচ্চাদের কিছু খাইয়ে নিজে না খেয়ে বদরুলকে রােগী দেখার ফাঁকে একটু চা খাইয়ে হারমােনিয়াম টেনে নিয়ে বসে যেতাম। নিজের মনে গান তুলতাম, কাজ শেষে বদরুল যােগ দিত আমার সাথে। ছুটির দিনে বাচ্চাদের নিয়ে গান শিখাতে বসে যেতাম দুজনেই।
মেয়েদের গান শেখানাে দরকার মনে করে একদিন চলে এলাম ওস্তাদ সুধীন দাসের বাড়িতে। সুধীন দাস ও নীলিমা দাসের বাসা সােবহানবাগেই ছিল। দুজনাই বেশ ব্যস্ত। সুধীন দাসের সময় নেই নতুন কোনাে শিক্ষার্থী তিনি নেবেন। না। আমি একটু মিনতি করতে তিনি বললেন, আপনার মেয়েদের গলা দেখব, একদিন আমি যাব আপনার বাসায়। একদিনের মধ্যে সত্যি সত্যি তিনি বাসায় এসে মেয়েদের গলা পরীক্ষা করে রায় দিলেন তাদের তিনি গান শিখাবেন। ওরাও গানের জগতে পা ফেলল। আমরা যখন বাংলাদেশে ফিরি তখন আমি অ্যানাসথেসিস্ট হিসেবে ৮ বছর ইংল্যান্ডের হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল আমার। সুতরাং ডাক পড়ত যথেষ্ট। কোনাে ডাক ফিরিয়ে দেইনি। আলম কখনও বিরক্ত হয়নি। বাচ্চাদের অনেক কাজ সে করে দিত। আমাকে ও বাচ্চাদেরকে নিয়ে সে এর মধ্যেই আনন্দ-ফুর্তি করে সময় কাটাতে চাইত। কোনাে ‘কল’ এ গিয়ে আমার ফিরতে দেরি হচ্ছে সে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে আমার প্রতীক্ষায় বসে থাকত। আমার ছেলে ইন্টারমিডিয়েট সাইন্স পাস করার পর পিতার ইচ্ছায় ডাক্তারি পড়তে ছুটছিল। ওর ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারং পড়া, আলম সেটা পছন্দ করেনি। সফল ডাক্তার হয়ে ছেলে আমার ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে ধরেছিল সাংবাদিকতা, বিদেশে সাংবাদিকতা করছে।
বড় মেয়ে কল্পনা মাসুদা নার্গিস আলম আইএসসি পাস করে নিজের ইচ্ছায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিল, ভর্তি হলাে। ২ বছরের কোর্স শেষ করে সে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিল, ভর্তি হলাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতশাস্ত্রের ছাত্রী হয়ে। স্নাতক এবং মাস্টার্স উভয় ডিগ্রিতে সে প্রথম শ্রেণী অর্জন করল। এখন সে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যবসায়ী, ঘরে বসে ইন্টারনেটে তার ব্যবসা চলে। সে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গান গায়।
মেডিকেল ছাড়ার আগেই তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। আমাদের পছন্দ হয়— বিয়ে হয়ে যায়। আল্পনা সাহিদা নার্গিস পড়াশুনায় তেমন মনােযােগ ছিল না। কিন্তু কষ্টে একমাস মনযােগ দিয়ে পড়ে ২য় বিভাগে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হয়। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে। মনােবিজ্ঞানে এম এ পাস করল ১৯৮৮ সালে। কল্পনার বিয়ে হয়ে গেছে ৭ বছর আগে। আল্পনারও বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন রান্নাবিদ। টিভিতে রান্নার ক্লাস পরিচালনা করে। ঘরে বসে রান্না খাবার সরবরাহ করে অর্ডার মাফিক। শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে বাসায় রান্নার ক্লাস করে।
সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগকে বদরুল আলম এক নতুন রূপে সজ্জিত করে দেন। সেখানে তার কক্ষে সব সময় ভিড় লেগে থাকত। শিশু বিভাগে নানা রকম চিত্র অঙ্কন করে শিশুদের জন্য আনন্দময় পরিবেশ গড়ে তুলেন। কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মূল কাণ্ডারি হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। কলেজের তৎকালীন সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিকে চিকিৎসক, হাসপাতালের কাজ অন্যদিকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা। মাঝে মাঝে নাওয়া, খাওয়া ও বাড়ির কথা ভুলেই যেতেন। ডা. আলম তৎকালীন পূর্ববাংলার শিশুরােগ চিকিৎসার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারই উদ্যোগ ও সক্রিয় সহযােগিতায় পেডিয়াট্রিক ডক্টরস অ্যাসােসিয়েশন গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানের সচিব পদে নির্বাচিত হন। ৩ বছর পর উক্ত সংগঠনের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে এই সংগঠনের উদ্যোগে শিশুরােগের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বদরুল আলম কঠোর শ্রম নিয়ােগ করে উক্ত সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করেন।
সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে থাকাকালীন বদরুল আলম শিশু চিকিৎসার উন্নয়নে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সে সরকারের কাছে সুপারিশ করে শিশু বিভাগের জন্য সিলেবাস ও পাঠ্যক্রম রচনা করার ব্যবস্থা করেন। মেডিকেল পরীক্ষায় শিশু রােগ বিষয়ে প্রশ্ন রাখার ব্যাপারে তার ভূমিকা রয়েছে। শিশু রােগের অ্যাসােসিয়েশনের মাধ্যমে সে বহুবার সচিবালয়ে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যােগাযােগ করে শিশুরােগ বিভাগে অধ্যাপকের পদ সৃষ্টির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮০ সনে এই পদে সৃষ্টি হয় এবং নিয়ােগ কার্যক্রম শুরু হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়। বদরুল আলম ‘অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় তখন সে দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। ইতিমধ্যে ১০ বছর অত্যন্ত সফলতা ও সুনামের সাথে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে চাকরি করার পর তাকে সহযােগী অধ্যাপক পদে ঢাকা মেডিকেল কলেজে বদলি করা হলাে।
সলিমুল্লাহ’তে থাকা অবস্থায়ই সে অসুস্থ হয়ে যায়। এই ভগ্ন শরীর এবং অসুস্থতা নিয়েই সে শিশুরােগ বিভাগের উন্নয়ন এবং অধ্যাপকের পদ সৃষ্টির জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করে যায়। এমতাবস্থায় তার চিকিৎসার জন্য আমি তাকে নিয়ে লন্ডনে যাই। সেখানে হ্যামারস্থিথ হাসপাতালে ভর্তি করা হলাে। সবকিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করে ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিলেন বদরুল আর মাস দেড়েক বাঁচতে পারে, তাঁকে দেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হােক। তাঁর হার্টের আর্টারি ব্লকের জন্য অপারেশন করাও সম্ভব নয়। তাছাড়া কিডনির অবস্থাও খারাপ। এ অবস্থায় বদরুলকে নিয়ে দেশে ফিরে এলাম। দেশে ফেরার মাস দেড়েক পর ১৯৮০ সনের ১০ সেপ্টেম্বর বদরুল আলম শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
বদরুল আলমের মৃত্যুর ৭ দিন পর সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে অধ্যাপক পদের ‘ইন্টারভিউ কার্ড এল। দুর্ভাগ্য! যে পদের জন্য জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও লড়াই করে গেছেন সে পদে আবেদন করেও পরীক্ষা দিতে পারেননি। তাঁর লড়াইয়ের ফসল তিনি ভােগও দেখে যেতে পারেননি। বাংলাদেশে আজ শিশুরােগ চিকিৎসার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু এই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সূচনায় বদরুল আলমের ত্যাগ ও শ্রম জড়িয়ে আছে।
বদরুল আলমের মৃত্যুর ৩০ বছর পর অর্থাৎ ২০১০ সনে বাংলাদেশ শিশুরােগ সমিতির উদ্যোগে বদরুলকে মরণােত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে শিশুরােগ বিভাগের উন্নয়নে বদরুলের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পদক প্রদান করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়।
আলমের ক্রেস্টটি আমার হাতে দেয়া হয়। সেদিনের অনুষ্ঠানে বক্তারা ডা, আলমের অবদানের ওপর বিস্তারিত আলােচনা করেন। তাঁরা বলেন, পেডিয়াট্রিক বিদ্যা বিভাগের সম্পূর্ণতা লাভ করে ডা. আলমের হাতে। এই বিদ্যার সিলেবাস প্রণয়ন, পরীক্ষা ব্যবস্থা, পােস্ট তৈরি করাসহ সামগ্রিক ব্যাপারে নিয়ে তিনি চিন্তা করেছেন এবং কাজ করেছেন।
ডা. আলমের মৃত্যুর সময়ে আমার বড় ছেলে আশফাক আলম স্বপন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র, বড় মেয়ে কল্পনা তখন অষ্টম শ্রেণীতে, আল্পনা ৭ম শ্রেণীতে হলিক্রস স্কুলে। ছেলে ১৯৮৪ সালে ডাক্তারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, ১৯৮৬ সালে BCS পরীক্ষা দিয়ে চাকরি করে কুমিল্লার কোনাে এক গ্রামে। পুরাে এক বছর পর তার পােস্টিং হয় ডিএমসি এর চর্মরােগ বিভাগে, বছরখানেক ছিল সেখানে। তারপর ডাক্তারি ছেড়ে জার্নালিজম পড়তে চলে যায় ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে। জার্নালিজমে ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে সে India West পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। বাবার ইচ্ছায় ডাক্তারি পড়ে আমার ছেলে। তার নিজের ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, কিন্তু পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে যায়নি। ডাক্তারিতে মানব সেবা এবং সততা বজায় থাকবে। এটাই ছিল ডা. আলমের অভিপ্রায়।
স্মরণীয় স্মৃতি
লন্ডনে যাওয়া এবং Royal College-এর President Prof R. J. Last- এর রেফারেন্সে ডা. বদরুল আলমের প্রথম চাকরি হওয়াটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। চাকরি না পেলে ছেলেকে নিয়ে দেশে চলে আসতে হবে। সৃষ্টিকর্তা ছিলেন আমাদের সহায়।
আমরা নিজের খরচে লন্ডনে যাই। সাথে আমাদের আড়াই বছরের ছেলে স্বপনকে নিয়ে যাই। সেই দেশ সম্বন্ধে আমাদের কোনাে ধারণা ছিল না। ওখানে যাবার পর আমার দেবর (মাহবুব আলম PTA-তে কাজ করত) আমাদের জন্য হােটেল ভাড়া করে রাখে। সেখানে একদিন থেকে, পরের দিন Earls Court একটা বাসায় উঠে আসি। সপ্তাহে ৫ গিনি বাড়ি ভাড়া। তারপর, দরখাস্ত করতে থাকি নানা জায়গায়। ২ মাস পার হওয়ার পরও কোনাে ইন্টারভিউ কার্ড আসে। সত্যি বলতে কি আমাদের দেশের Professor-দের দেওয়া Certificate-এর কোনাে দাম দেয় না।
Prof. R. J. Last তখন Royal College-এর সভাপতি পেশােয়ারে ১৯৬১ সালে যাইবার মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন কলেজের স্বীকৃতির ব্যাপারে। আমার স্বামী তখন অ্যানাটমির প্রভাষক এবং অ্যানাটমি জাদুঘরের কিউবেটর দেখলেন এবং অবাক হয়ে গেলেন, এত সুন্দর Anatomy Specimen দেখে উনি জিজ্ঞেস করলেন, এগুলাে কে বানিয়েছে? এত সুন্দর Specimen আমার Royal College এ নেই। তখন ওনাকে বােঝালেন কীভাবে তৈরি করেছেন। Prof. Last বদরুল আলমের খুব প্রশংসা করলেন। এবং ওনাকে বললেন তুমি পড়াশুনা করতে লন্ডনে গেলে, কোনাে অসুবিধা হলে আমার সাথে দেখা করবে আমি তােমাকে সাহায্য করব।
এদিকে ছেলেকে নিয়ে Dr. Rj. Palliser ওনার সাথে দেখা করতে গেলাম। উনি বাচ্চাসহ আমাদের দেখে রেগে আগুন। বললেন বহু ডাক্তার চাকরি পাচ্ছে।
, আর তােমরা বাচ্চা নিয়ে এসেছে? এক্ষুণি বউ, বাচ্চা দেশে পাঠিয়ে দাও। বিফল মনােরথ হয়ে চলে এলাম। তারপর ডা. আলম Royal College এ Prof. R. J. Last-এর সাথে দেখা করতে গেলেন। উনি ডা. আলমকে আগ্রহের সাথে গ্রহণ করলেন এবং Royal College-এর Anatomy Museum দেখালেন, তখন ডা. আলম Dr. Last- কে বললেন। এখানে এসে দুমাস হয়ে গেল চাকরি পাচ্ছি। না, রেফারেন্স হিসেবে তােমার নাম দিয়ে আমার খুব উপকার হবে। উনি খুশি 261 701679, ‘I will be very glad to be your Reference, but I am going to take examination in Australia after fifteen days. So you can apply for fifteen days and give my name as reference.পরদিন ওনার বাসায় আমাকে ছেলেসহ চা-এর নিমন্ত্রণ করলেন, আমরা পরদিন ওনার বাসায় গেলাম এবং আমাদের খুবই সমাদর করলেন।।
দুরু দুরু মনে বাসায় ফিরে এলাম। প্রথম আবেদন করলেন East Birmingham Hospital-এ। পরদিনই Interview-এর জন্য চিঠি এল। বদরুল আলম পরদিনই Interview দিতে গেলেন। ওখানে গিয়ে দেখেন ৩ জন সাদা (ব্রিটিশ) ডাক্তার ও একজন কালাে চামড়ার (ডা. আলম) অলিখিত নিয়ম আছে, সাদা ডাক্তার থাকলে কালােদের চাকরিতে নেয় না। বদরুলের মন খারাপ হয়ে গেল। ইন্টারভিউ শেষ হলে ডা. বদরুল আলমের ডাক পড়ল। সাদা ডাক্তাররা রাগে অস্থির। পরীক্ষক বদরুলকে জিজ্ঞেস করলেন, By the way. How do you know Prof. R. J. Last! He has written a page about you. Orta oparts স্বামী Khyber Medical College-এর অ্যানাটমি জাদুঘরে স্পেসিম্যান বানানাের কথা বলল ডা. আলমের এ চাকরি হয়ে গেল। ডা. আলমের চাকরির দেড় মাস পর আমারও সেখানে চাকরি হয়ে গেল। আমরা Prof. Last এর কাছে। চিরকৃতজ্ঞ। আর আমাদের ফিরে তাকাতে হয়নি।
স্মৃতিস্তম্ভ থেকে শহীদ মিনারের ইতিকথা: প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আজ আমরা এক নামে যে শহীদ মিনারকে চিনি, শব্দটি মনে এলেই তার যে অবয়ব ভেসে ওঠে মনে, সেই শহীদ মিনারের শুরুটা কিন্তু মােটেও সে রকম ছিল না। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতেই শহীদদের তাৎক্ষণিক মূল্যায়নের তাগাদায় রাতের অন্ধকারে অসমাপ্ত কলেজ বিল্ডিংয়ের মিস্ত্রিদের সহায়তায় এবং ইট, বালু ও সিমেন্ট দিয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছিল প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্মৃতিস্তম্ভের আইডিয়া ও ডিজাইন সবই ছিল তাৎক্ষণিক, কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত ছিল গভীর আবেগ ও ভালােবাসা। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বর্তমান কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারকে চেনে, হামিদুর রহমানকে চেনে, কিন্তু জানে না শহীদ মিনারের অঙ্কুরােদমের ইতিহাস এবং শহীদ মিনারের স্থপতির নাম। তাঁরা বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা জানে, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই প্রথম শহীদ মিনার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। আমরা যারা সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী, তাদের কাছে সেই স্মৃতি আজও উজ্জ্বল। ২১ ফেব্রুয়ারি এবং এর পরবর্তী দিনগুলাের ঘটনা আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছিল। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্রী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় স্থান। এছাড়া সবচেয়ে গৌরবের বিষয় হচ্ছে যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজেই বাংলাদেশের জন্মের বীজ বপন করা হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের মধ্য দিয়ে।
ভাষা নিয়ে আন্দোলন-সম্বন্ধে প্রথম ধাক্কা খেলাম যখন দেশ স্বাধীনের পর, জিন্না সাহেব প্রথম ঢাকায় এলেন ১৯৪৮ সালে। সমস্ত স্কুল-কলেজে ঘােষণা দেয়া হলাে, জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় আসছেন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ক্লাস নাইন ও টেন-এর ছাত্রছাত্রীদের পুরান বিমান বন্দর যেতে হবে। সরকারি হুকুম, আমরা তখন ইডেন স্কুলের ছাত্রীরা কামরুন্নেসা স্কুলের সাথে ক্লাস করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আখতার ইমাম, তখন শিক্ষকতা করতেন। তার নেতৃত্বে আমরা সবাই সাদা সালােয়ার-কামিজ পরে, বিমান বন্দরে দারুণ উত্তেজনা নিয় গেলাম। বেলা আনুমানিক ১২টা হবে, একটা ছােট মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। জিন্নাহ সাহেব তখন ওখানে উঠলেন। মুহুর্মুহু করতালি। তারপর উনি ছােট্ট করে ওনার ভাষণ দিলেন, এরপর রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তিনি বললেন, ‘As far as State Language is Concerned that should be olny one, and that is Urdu.’
সবাই চমকে উঠল ওনার ঐ ভাষণে। আমার মনে হলাে আমার বুকে কেউ তীর বিধিয়ে দিল। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমাদের কোনাে দাম নেই। তার মধ্যে মুষলধারায় বৃষ্টির কারণে সবাই মন খারাপ করে চলে এলাম। ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক ও আইএসসি ১৯৫১ সালে পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। আমি ছিলাম ১৯৫২ সালের একুশের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে কী ঘটেছিল? আমরা তখন কলেজ বিল্ডিংয়ের উল্টো দিকে মেয়েদের হােস্টেল থাকি। সারাদিন মেডিকেল কলেজের রাস্তায় চলছে মিছিল আর স্লোগান। শুনলাম, ছেলেরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। মন্ত্রীদের অ্যাসেম্বলি হলে আসতে দেবে না। অ্যাসেম্বলি হল তখন মেডিকেল কলেজের খুব কাছে ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ এবং তার সামনের রাস্তায় তখন দারুণ উত্তেজনা, স্লোগান, পুলিশের ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া এবং ইট, পাটকেল ছোড়াছুড়ি চলছে। হঠাৎ বেলা তিনটার দিকে গুলির শব্দ শােনা গেল। ছাত্র-জনতা যেদিকে পারল, আতঙ্কিত হয়ে ছুটতে লাগল। আমরা মেয়েরা হােস্টেল থেকে বের হয়নি। হােস্টেলের বারান্দা থেকে সব দেখা যাচ্ছিল। তখন ডিসেকশন হলের পিছনের বারান্দায় ছেলেরা ডেডবডি নিয়ে এসেছিল। একজনের মাথার মগজ বেরিয়ে গিয়েছিল মনে আছে। তখন তাদের পরিচয় জানতে পারিনি। এখন মনে হয় তা ছিল শহীদ রফিকের লাশ। আমরা মেয়েরা শশাকে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। একজন সাদা কাপড় পরা বৃদ্ধ এবং একজন অল্প বয়সী মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এর পিছনের বারান্দার দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল হােস্টেলের সামনে দিয়ে। এই প্রথম স্বাধীন দেশে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের মন অসহ্য ঘৃণায় ভরে উঠল। ছেলেদের হােস্টেল তখন বাঁশের ব্যারাকে ছিল। গুলির পর জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই আন্দোলনে যােগ দিলে তার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। ২২ ফেব্রুয়ারি দারুণ উত্তেজনা, দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেল। সমস্ত এলাকা জুড়ে চলতে থাকে মুহুর্মুহু স্লোগান এবং ছেলেদের হােস্টেলে অবিরাম জ্বালাময়ী বক্তৃতা। রাত জুড়ে তা চলতে থাকল। সেদিনও গুলি চলল। গায়েবানা জানাজা হলাে। ছাত্র-জনতা বিশাল শােক মিছিল করল। মেডিকেল কলেজের কন্ট্রোল রুম তখন আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এসব ঘটনা আমার চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আমরাও আন্দোলনে জড়িত হলাম। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে দারুণ উত্তেজনা। ব্যারাকে ছাত্রদের জটলা। সর্বত্র একটাই আলােচনা ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ করতে হবে। সেদিন ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। বাইরের লােকজন ছুটে আসছে মেডিকেল কলেজের ব্যারাকে। ছাত্র-জনতার মধ্যে একটা প্রচণ্ড ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে। আমরা খুবই মর্মাহত হলাম।
সে সময় বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে তেমন একটা খবর জানতাম না। পরে শুনেছি আমার সতীর্থ বন্ধুদের কাছে এবং যারা একুশের আন্দোলন এবং শহীদ মিনার নির্মাণে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাদের কাছ থেকে। ২৩ তারিখ ঢাকা মেডিকেলে ব্যারাকের ছাত্ররাই তাৎক্ষণিক এবং স্বতস্ফূর্তভাবে সিদ্ধান্ত নেয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য। শহীদ মিনার নির্মাণ করতে হলে নকশার দরকার। কে করবে নকশা? ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন ভিপি গােলাম মাওলা এবং জি, এস শরফুদ্দিন ঠিকই মনে আছে বদরুল আলমের নাম। কারণ তখন বদরুল আলমের ভালাে চিত্রশিল্পী হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল। তাঁর আঁকার হাত ভালাে ছিল বলেই তাকেই শহীদ মিনারের নকশা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন গভীর রাত। গােলাম মাওলা বললেন, বদরুল আলমকে ডাকা হােক। বদরুলকে ঘুম থেকে তুলে আনা হলাে। শুরু হলাে নকশা তৈরির কাজ। বদরুল আঁকতে শুরু করল। একটা খসড়া তৈরি হলাে, মনমতাে হলাে না, আবার তৈরি করল। এভাবে বহুবার চেষ্টার পর চূড়ান্ত নকশা তৈরি করল এবং ছাত্র ইউনিয়নের অনুমােদন নেয়ার পর শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। বদরুল আলম অন্যান্য মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সাথে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজে সহযােগিতা করল। কলেজ ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল। মােতালেব কন্ট্রাক্টর ও পিয়ারু সর্দারের ইট, বালু আর সিমেন্টের গুদাম ছিল পাশেই। ছাত্ররা পিয়ারু সর্দারের কাছ থেকে চাবি এনে গুদাম খুলে সব মালমশলা বের করে আনল। ছাত্ররা হাতে হাতে ইট বহন করে পৌছে দেয় স্তম্ভ তৈরির স্থানে। পানি, বালু, সিমেন্ট মিলিয়ে নিজেরাই ইটের গাঁথুনি দিতে লাগল। কাজ চলতে লাগল ঝড়ের বেগে। সামনে নকশা রেছে নির্দেশ দিচ্ছেলেন ইঞ্জিনিয়ার নামে খ্যাত শরফুদ্দিন। রাতের অন্ধকারে কেটে ভােরের আলাে ফুটে উঠেছে। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। তাড়া এল ‘তাড়াতাড়ি কর’ ভােরের আগেই কাজ শেষ করতে হবে। ভােরে স্তম্ভ তৈরির কাজ শেষ হলাে।
২৪ তারিখ সকালবেলা। আমার পাশের মহিলা হােস্টেলে থেকেও টের পাইনি ব্যারাকের ছাত্ররা এমন একটি ঐতিহাসিক কাজ করে ফেলল।
আমাদের হােস্টেল থেকে ২০০ গজ দূরে যেখানে শাহাদাতবরণের ঘটনা ঘটেছে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়েছে এবং তাতে সবাই ফুল দিচ্ছে। আমরা মেয়েরাও গিয়ে ফুল দিয়ে আসলাম। একজন সােনার চেইন খুলে দিল। সে কী দারুণ উত্তেজনা। ছাত্র আন্দোলন আরাে জোরদার হলাে। শহীদ শফিউর রহমানের পিতা স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন আবার স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করলেন। শহীদ মিনারটি খুবই সুন্দর ছিল। ছিল ১০ ফুট লম্বা ও ৬ ফুট চওড়া আর চারদিকে দড়ি দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। নিচের অংশ লাল সালু কাপড় দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। উপরের অংশে হাতে লেখা দুটি চমৎকার পােস্টার সেঁটে দেয়া হয়। একটিতে লেখা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, দ্বিতীয়টিতে লেখা ছিল ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক।’ দুটোই আমার স্বামী বদরুলের আঁকা পােস্টার।।
জনতা ও ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী ট্রাক ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে এসে আমাদের চোখের সামনেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙ্গে ফেলে এবং ইটপাটকেল ইত্যাদি ট্রাকে করে নিয়ে যায়। তবে বাঁশের খুঁটি ও দড়ি দিয়ে সে জায়গাটি অনেক দিন ঘিরে রাখা হয়। ১৯৫৩ সনেও বদরুল আলম, জিয়া হাসান ও অন্যদের পরিচর্যায় একই জায়গায় আমরা ফুল দিয়ে প্রভাতফেরি করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। | ১৯৫৭ সালে আমি চলে যাই তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে থেকে পড়াশােনা করার জন্য যাই ইংল্যান্ডে। দেশে ফিরে আসি ১০ বছর পর ১৯৬৭ সালে। এসে দেখি একুশের ভাষা-আন্দোলন তখন অনেক জোরদার হয়েছে।
১৯৬৭ সালে ঢাকায় এসে যে শহীদ মিনার দেখলাম সেটি ১৯৫৭-৫৮-তে তৈরি হয়। স্থপতি হামিদুর রহমানের নকশা এবং তার তত্ত্বাবধানে এটি তৈরি হয়। এই প্রকল্পটি আদিতে যেমনটি ছিল তা পুরােপুরি নির্মিত হয়নি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা এই শহীদ মিনার ভেঙ্গে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। বাংলাদেশ হবার পর আবার পুননির্মিত হয়। এটিও অসম্পূর্ণ হামিদুর রহমান এর বক্তব্য অনুযায়ী।
ভাস্কর হামিদুর রহমান শহীদ মিনার সংলগ্ন একটি জাদুঘর রাখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তার নকশাতে জাদুঘরটি ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়নি। ১৯৭১ সালে পাকি বাহিনী শহীদ মিনার গুড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ সরকার এটি পুনর্নির্মাণ করে। তবে হামিদুর রহমানের আসল নকশা অনুযায়ী এটিতে কিছু কাজ বাদ পড়ে যায়। কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার আজও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে এটা খুবই দুঃখজনক।
শহীদ মিনার আজ আমাদের জাতীয় সম্পদ। প্রথম শহীদ মিনার থেকেই আজকের কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার। অথচ প্রথম শহীদ মিনারের ইতিহাস আজ আমরা ভুলতে বসেছি। প্রথম শহীদ মিনার এবং এর স্থপতির কথা আমরা ক’জন মনে রেখেছি। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস পৌঁছে দেয়া হয়নি।
১৯৭১ সালে একদিন, তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে, আমার ছেলেকে উদয়ন স্কুল থেকে আনতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল ডা. মাের্তজার সঙ্গে আমাদের দেখে তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে দৌড়ে এলেন। তখন তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি মেডিকেল অফিসার, তিনি ছিলেন ভাষা-আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। তিনি আমার স্বামীকে বললেন, বদরুল ভাই, একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছি। আপনি যে প্রথম শহীদ মিনারের নকশা করেছেন এবং আপনার আঁকা নকশা অনুসারে প্রথম শহীদ মিনার গড়ে তােলা হয়েছিল, সে কথা আপনার পারমিশন না নিয়ে আমার বইয়ে লিখে ফেলেছি।’ বইয়ের নাম ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আমার স্বামী হাসতে হাসতে বললেন, আমি কিছু মনে করিনি।’ ডা. শহীদ মাের্তজা আজ নেই। অনেক খুঁজেও তাঁর সেই বইটি পাইনি। আমার স্বামী প্রচারবিমুখ ছিলেন। আমাকে জীবনে কোনাে সময়ই সেই প্রথম স্মৃতিস্তম্ভের ব্যাপারে কিছুই বলেননি।
সদ্য প্রয়াত ভাষাসৈনিক অলি আহাদ আমার ভগ্নিপতি। একদিন ওনার সাথে দেখা। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শহীদ মিনারের নকশা কে করেছিল? উনি বললেন, ‘আরে বদরুল আলম না থাকলে শহীদ মিনারই হতাে না।
এছাড়া আমাদের একটা মেডিকেল কনফারেন্সে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী এসেছিলেন। তিনি তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সােনারগাঁও হােটেলে আমরা সবাই ওনাকে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। উনি ঢুকলেন, আমাকে সামনে পেয়ে হঠাৎ সবার সামনে বলে উঠলেন- এই যে আপনার স্বামী শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন।
আমার ক্লাসমেটরাও প্রায় আমাকে বলতেন বদরুল না হলে শহীদ মিনারই হতাে না। অথচ তার নামটি কেউ উচ্চারণ করে না।
আজ প্রথম শহীদ মিনার কেমন করে হলাে, সে কথাই বলব আমার স্বামীর ভাষায়। আমার স্বামীর একটি সাক্ষাৎকার ড. রফিকুল ইসলাম ১৯৮০ সালে আমার সােবহানবাগের বাসায় গিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁদের আলাপ শুরু হয় প্রথম শহীদ মিনারের স্থপতি কে ছিলেন তাই নিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে আমি যেখানে উপস্থিত ছিলাম। ২০ বছরের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এই প্রথম তার মুখ থেকে শহীদ মিনার সম্বন্ধে শুনলাম, তার একটাই কারণ ছিল আমার স্বামী ডা. বদরুল আলম সারাক্ষণ পড়াশােনা ছেড়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত থাকতেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিল্পীসংঘের সে মেম্বরে হয়। পরে এন্টারটেইনমেন্ট সেক্রেটারিও হয়। তাই মেডিকেল কলেজের সমস্ত সাংস্কৃতিক কাজে তাঁকে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হতাে। আঁকাআঁকি তার নেশা ছিল। ইলেকশনের পােস্টার, নাটক এবং মেডিকেল কলেজের ছােট ছােট অনুষ্ঠান ওকে ছাড়া হতাে না। তখন পেশাদার শিল্পী ছিল না। ইলেকশনের সময় ওকে ধরে নিয়ে যেত হলের ছাত্ররা। তাই ওর পরীক্ষার ফল ভালাে হতাে না। সে জন্য ছাত্রী অবস্থায় আমি ওর ওপর খুব বিরক্ত ছিলাম। তারপর একদিন খুব বকুনি দিলাম, বললাম, রংতুলি ফেলে দিয়ে ভালাে করে পরীক্ষা দাও এবং পরীক্ষায় পাস কর। তাই আমাকে কোনােদিনও শহীদ মিনারের কথা বলেনি।
পরে বদরুলের কাছে শুনেছি প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের বিস্তারিত ঘটনা। বদরুল জানাল, ২৩ ফেব্রুয়ারিতে মিছিল-সভা আর পােস্টার আঁকা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। রাতে ক্লান্তিতে ঘুমে বিভাের ছিলাম হােস্টেলে। হঠাৎ মধ্যরাতে, কয়েকজন বন্ধু আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলল। বলল, তােমাকে মওলা ভাই (তৎকালীন ভিপি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদ) ডাকছেন। আমার আকার হাত ভালােই ছিল। তাই মওলা ভাই ও আরও কিছু ছাত্র আমাকে বললেন, ‘ভাষার জন্য ছেলেরা রক্ত দিল, এটা ধরে রাখার জন্য একটা স্মৃতিস্তম্ভের নকশা বানিয়ে দাও।’ তখন এত রাতে আমার মাথায় কিছুই আসছিল না। হঠাৎ মনে হলাে, ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম, ওখানে খুব সুন্দর ইট বাঁধানাে সব স্তুপ ছিল। বাবা বললেন, এটা স্মৃতিস্তম্ভ। কেউ মারা গেলে তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এটা বানানাে হয়। সেই স্থূপ কল্পনা করে একটি নকশা করলাম। কারও তেমন পছন্দ হলাে না। পরে ভিক্টোরিয়া পার্কে সিপাহি বিদ্রোহের যে স্মৃতিস্তম্ভ আছে, সেটির আদলে একটি নকশা বানালাম। অধ্যাপক মির্জা মাজহারুল ইসলামের ঘরে বসে বানাই সেটা। সবার পছন্দ হলাে। রাতেই ইট, সিমেন্ট, বালু ও রাজমিস্ত্রি জোগাড় হয়ে গেল। ভাের পাঁচটার মধ্যে ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট প্রস্থের শহীদ মিনার তৈরি হলাে। ২৩ ফেব্রুয়ারি সেই রাতে হােস্টেলের সবাই অংশগ্রহণ করেছিল শহীদ মিনারটি তৈরি করতে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হতাে না।
আমার এ সংক্ষিপ্ত লেখাটি ২০০৮ সালে দৈনিক প্রথম আলাে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের এই সত্য ইতিহাস তুলে ধরার জন্য অনেকেই আমাকে ধন্যবাদ জানায় এবং এ ব্যাপারে বই প্রকাশের অনুরােধ জানান।
প্রথম শহীদ মিনার এবং এর স্থপতি বদরুলকে নিয়ে আমার অনেক দুঃখের স্মৃতিও জমা আছে। ১৯৯২ সনে আমি এ ব্যাপারে প্রথম একটি প্রবন্ধ লিখি দৈনিক সংবাদে। স্মৃতিস্তম্ভ’ থেকে শহীদ মিনার’ শীর্ষক প্রবন্ধে ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারে ইতিহাস তুলে ধরি। এতে অনেকে প্রশংসা করেন আবার কিছু শিক্ষিত লােক আমার সাথে বিরূপ আচরণ করেন।
১৯৮০ সনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-অর-রশীদ একদিন। ফোনে আমাকে একটি ছবি দিতে বলেন। তারা ছবিটি কয়েক বছর সংরক্ষণ করে রেখেছিল কিন্তু পরে এর কোনাে অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়নি। কোনাে পাঠ্যপুস্তক বা বইপত্রেও প্রথম শহীদ মিনারের ইতিহাস তেমনভাবে স্থান পায়নি। বর্তমানে এতগুলাে মিডিয়া থাকা সত্ত্বেও প্রথম শহীদ মিনার এবং এই মিনারের স্থপতি বদরুল আলমের নামটি তেমনভাবে উচ্চারিত হয়নি।
ভাষা-আন্দোলন এবং শহীদ মিনার বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর উপর বহু গবেষণাধর্মী লেখা হয়েছে কিন্তু দুখের বিষয় আদি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ সম্বন্ধে সামান্য যা কিছু লেখা এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তাতে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে অনেক। আমার একান্ত ইচ্ছা ইতিহাসের এই বিশেষ ঘটনাটিকে যথাযথ বর্ণনায় বিস্তৃত করা হােক এবং এই স্তম্ভটির নির্মাণের বিভিন্ন কাজের সাথে। যারা জড়িত ছিলেন তাদেরকে মর্যাদার সাথে চিহ্নিত করা হােক।
কিছুদিন আগে সম্ভবত ৫ এপ্রিল, ২০১১ ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে আদি স্মৃতিস্তম্ভের একটি রেপ্লিকা স্থাপিত হয়েছে। এটিতে একটি ভুল ধরা পড়েছে। সংশােধিত আর একটি রেপ্লিকা কলেজ চত্বরে বর্তমান শহীদ মিনারে অদূরে স্থাপিত হােক এবং ইতিহাসটি এর সাথে উৎকীর্ণ হােক।
ভাষা-আন্দোলন ও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রথম শহীদ মিনারের রূপকার ডা. বদরুল আলমের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। সিটি কর্পোরেশন অনেকের নামে সড়কের নামকরণ করেছে কিন্তু তার নামে কোনাে সড়কের নামকরণ এখনও বাস্তবায়ন করেনি। আমি বাহান্নোর ভাষা-আন্দোলনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রথম শহীদ মিনারের রূপকার ডা. বদরুল আলমের সহধর্মিণী হিসেবে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, তাঁর নামে অন্তত একটি সড়কের নামকরণ করা হােক।
একুশের স্মৃতি স্মারক যে শহীদ মিনার আজ সারা বিশ্বে সেই প্রথমত শহীদ মিনারের স্থপতি বদরুল আলমকে একুশে পদকসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হােক। বর্তমানে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে প্রথম শহীদ মিনারের একটি মডেল রেপ্লিকা স্থাপন করা হােক।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, ডা. বদরুল আলমের স্ত্রী
সূত্র : প্রথম শহীদ মিনারের স্থপতি ডা: বদরুল আলম স্মারকগ্রন্থ