পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় আলােচনা হচ্ছে। কেউ বলছেন রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত বাংলা, কেউ বলছেন উর্দু, আবার কেউ ইংরেজির কথাও বলছেন।
রাষ্ট্রভাষা রূপে এদেশে ইংরেজির অবস্থান যে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না সে বিষয়ে কোনােই সন্দেহ নেই। এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম স্তম্ভ ছিল ইংরেজি ভাষা। নিজেদের সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু ভাষা থাকা সত্ত্বেও বিদেশী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা জাতীয় সম্মানের পক্ষে হানিকর। অতএব এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনে তাদের ভাষার আধিপত্যেরও অবসান করতে হবে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার পক্ষে উর্দুর দাবি জোরালাে হলেও, বাংলা ভাষার দাবির চেয়ে জোরালাে নয়। সমগ্র পাকিস্তানের তিন ভাগের দুই ভাগ অধিবাসী পূর্ব-পাকিস্তানে বাস করে, এবং তাদের সকলেরই মাতৃভাষা বাংলা। পক্ষান্তরে পশ্চিম-পাকিস্তানের বাকি এক ভাগ অধিবাসীরও সকলের মাতৃভাষা উর্দু নয়। তাদের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি (পাঞ্জাবি) সিন্ধী (সিন্ধু), ব্রাহুই (বেলুচিস্তান), এবং পশতু (সীমান্ত) তাদের মধ্যে উর্দুভাষী লােকও আছে, বিশেষত পশ্চিমপাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে। এই ভাষাগুলাের কোনােটিই এক কোটির অধিক লােকের ভাষা নয়, কোনাে কোনােটি আবার কয়েক লক্ষ লােকের ভাষা। অতএব এগুলাের কোনােটিকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা চলে না। কিন্তু যেহেতু পাকিস্তানের তিন ভাগের প্রায় দুই ভাগের অধিবাসীরই মাতৃভাষা বাংলা, সেহেতু রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবি সর্বাপেক্ষা প্রবল বাংলা ভাষার।
কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানের অধিবাসীগণ বাংলা ভাষার সঙ্গে প্রায় সম্পূর্ণ অপরিচিত। অতএব বাংলা ভাষাকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করলে তাঁদের অসুবিধা হবে। প্রদেশ হিসেবে তাঁদের ভাষা বিভিন্ন হলেও উর্দুর সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ।
এই কারণে বাংলা এবং উর্দু এই দুই ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা সঙ্গত। সুইজারল্যান্ড, কানাডা প্রভৃতি দেশে একাধিক ভাষা রাষ্ট্রভাষা রূপে গৃহীত হয়েছে, পাকিস্তানেও গ্রহণ না করার কারণ নেই।
আমাদের নারী-সমাজ সাহিত্যের দিক দিয়ে অত্যন্ত পশ্চাদপদ। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তারা আরও পশ্চাদপদ হয়ে যাবেন। অতএব পূর্ব-পাকিস্তানে যাতে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা রূপে গৃহীত হয়, সেজন্য আমাদের নারীসমাজ সর্বত্র আন্দোলন করবেন আশা করি। এ বিষয়ে পাকিস্তান গণপরিষদস্থ পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণের বিশেষত মহিলা প্রতিনিধির গুরুতর কর্তব্য রয়েছে।
সূত্র: বেগম, ৩রা আগস্ট ১৯৪৭