You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনকারীর সাক্ষাৎকার- কাজী গােলাম মাহবুব - সংগ্রামের নোটবুক

কাজী গােলাম মাহবুব

কাজী গােলাম মাহবুব ১৯৪৮ সাল থেকে প্রত্যক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরােধা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের তিনিই ছিলেন আহ্বায়ক। এই কর্মপরিষদের নেতৃত্বেই ১৯৫২ সালে সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হয়।
কাজী গােলাম মাহবুব বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার কাজী কসবা গ্রামে ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম কাজী আবদুল মজিদ ছিলেন বরিশালে কৃষক আন্দোলনের (রায়ত আন্দোলন) প্রতিষ্ঠাতা।
জনাব মাহবুব গ্রামের টক স্কুলে পড়াশুনা আরম্ভ করেন এবং ১৯৪২ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে মেট্রিক পাস করেন। তারপর তিনি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। কাজী গােলাম মাহবুব ১৯৪৭ সালে কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে বিএ, পাস করেন। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের ফলে তিনি গ্রেফতার হন। তাই আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পরে ১৯৫১ সালে আইন পাস করেন।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি ‘মিনিয়াল স্ট্রাইক’, ১৯৫০ সালের ‘ফুড ডেমােনস্ট্রেশন’, ‘শাসনতন্ত্র আন্দোলন’ প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বরিশালে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এ সময় তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা-জেনারেল সেক্রেটারি এবং প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৫২ সালে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘকাল কারাজীবন ভােগ করেন। মুক্তি পেয়ে পুনরায় জননিরাপত্তা আইনে ৩ মাস পটুয়াখালী সাবজেলে আটক থাকেন। ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় আইন-ব্যবসা শুরু করেন।
প্রশ্ন : আপনি কোন সময় থেকে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন?
উত্তর : ১৯৪৮ সালে যখন ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে তখন থেকেই আমি এ
আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি।।
প্রশ্ন : আপনি তাে কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন কখন?
উত্তর : হ্যা, আমি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলাম। ১৯৪৭ সালের
নভেম্বরের দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ. (ল) ক্লাসে অ্যাডমিশন নেই।
প্রশ্ন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরই কি আপনি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন?
উত্তর : না, তখনও ছাত্র রাজনীতি পুরােপুরিভাবে সংগঠিত হয়ে ওঠেনি। সবেমাত্র পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে। সবার দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে সবেমাত্র জাতীয় রাজনীতি সংগঠিত হতে শুরু করেছে। ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহলে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলাপ আলােচনা চলছে। আমরা কলিকাতা থেকে আগত ছাত্রদের হল সমস্যা, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, ছাত্রদের রিডিং রুম, লাইব্রেরি প্রভৃতি সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ছাত্র সমস্যা সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ছাত্রদের মাথা ঘামানাের প্রয়ােজন তখনাে আসেনি। পরে বিকাশমান রাজনীতির এ ধারায় আমরা ক্রমে ক্রমে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। পরে অবশ্য ছাত্রদের যাবতীয় সমস্যা এবং দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে প্রগতিশীল ছাত্রদের একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। নঈমুদ্দীন ও অলি আহাদকে কনভেনার করে একটি কনভিনিং কমিটিও গঠিত হয়। কমিটি এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে সেদিন। যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন— (জাস্টিস) আবদুর রহমান চৌধুরী, নঈমুদ্দীন, অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, আজিজ আহমদ, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, মােল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল হামিদ (ফরিদপুর) প্রমুখ। এই কনভিনিং কমিটির মিটিং-এর সময় সম্ভবত আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম।
প্রশ্ন : কিভাবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে? এর উদ্যোক্তা কারা ছিলেন?
উত্তর : সরকারি তরফ থেকে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার তৎপরতা, বাংলার পরিবর্তে উর্দু বর্ণমালা এবং আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের চেষ্টা আমাদের শংকিত করে তােলে। তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন জনাব ফজলুর রহমান, প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী জনাব আবদুল হামিদ এবং শিক্ষা সেক্রেটারি ফজলে এসব তৎপরতার স্বপক্ষে বিভিন্ন বুকলেট প্রচারের ব্যবস্থা করতেন। সরকার এবং বিশেষ মহলের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। আমরা মনেপ্রাণে চাইতাম বাংলাও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হােক। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ভাষা বাংলা। আর এই বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা আমাদের আশাহত এবং বিক্ষুব্ধ করেছিল। Economic, social এবং religious exploitation থেকে মুক্তিলাভের জন্য যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে, সে পাকিস্তানে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে জনগণের বিক্ষুব্ধ হওয়ার কথা। তাই মনে রাখা দরকার ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিক গুরুত্ব বুঝতে হলে এবং এর সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে উপমহাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পটভূমি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়ােজন। যে economic এবং social exploitation থেকে মুক্তিলাভের জন্য পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সে একই কারণেই ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামও হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তমদ্দুন মজলিশই প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি উত্থাপন করে। পরে ছাত্ররা সংঘবদ্ধভাবে এই দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। মূলত ভাষা আন্দোলন ছিল ছাত্রদের আন্দোলন। ছাত্ররাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি।
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন economic এবং social exploitation থেকে মুক্তিলাভের প্রেরণাই ভাষা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। এ মুক্তি কি পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামাের ভেতর থেকে? না স্বাধীন কোনাে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আপনারা দেখেছিলেন?
উত্তর : অবশ্যই তা পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামাের ভেতর থেকে। তখন ভিন্ন কোনাে চিন্তার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ পাকিস্তান আন্দোলন ছিল আমাদের গভীর বিশ্বাস এবং একাগ্র সংগ্রামের ফল। সে সম্পর্কে আপনাকে পরে বলছি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হলে আমরা আবার exploited হবাে, আমাদের এ আশঙ্কা অত্যন্ত সঙ্গত ছিল। তাছাড়া পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানেরাই সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করেছে এবং তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হবে না, এ ছিল ন্যায়নীতি এবং যুক্তির সম্পূর্ণ বিরােধী।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনে আপনাদের (ছাত্রদের) প্রথম সাংগঠনিক পদক্ষেপ কি ছিল এবং তা কখন নেয়া হয়?
উত্তর : ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ছাত্রদের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই সংগ্রাম পরিষদে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম, নুরুল হক ভূঁইয়া, আবদুল গফুর, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, কামরুদ্দীন, নঈমুদ্দীন, লিলি খান, নুরুল আলম (টাঙ্গাইল), শামসুল আলম (টাঙ্গাইল), নুরুল হুদা (ইনজিনিয়ারিং কলেজ) এবং আমি। শামসুল আলমকে এই পরিষদের কনভেনার করা হয়। এই পরিষদের অধিকাংশ ছিল ছাত্র।
প্রশ্ন : সংগ্রাম পরিষদের সাংগঠনিক মিটিংগুলাে কোথায় অনুষ্ঠিত হতাে? উত্তর : ফজলুল হক হলের ক্যাফেটেরিয়াতেই পরিষদের অধিকাংশ সাংগঠনিক মিটিং অনুষ্ঠিত হতাে। আর ফজলুল হক হলই ছিল তখন ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। প্রশ্ন : আপনাদের এ সংগ্রাম পরিষদের উদ্দেশ্য এবং প্রাথমিক তৎপরতা কি ছিল?
উত্তর : রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করা এবং জনমত গড়ে তােলাই ছিল এ পরিষদের উদ্দেশ্য। প্রথমে আমরা ৪ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করি। আমাদের এ তৎপরতা শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট উল্লেখযােগ্যভাবে সফল হয়নি। তবে আমরা এ পদক্ষেপের ফলে ‘অরগানাইজড’ হয়েছিলাম।
প্রশ্ন : জনগণের মাঝে এর কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
উত্তর : জনগণের মাঝে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ঢাকার অধিবাসীরা এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে ছিল। তাদের মনােভাব ছিল, পাকিস্তান সবেমাত্র দুধের বাচ্চা, আর তােমরা এর মুখের দুধের বােতল নিয়ে টানাটানি শুরু করেছাে? তাই ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে প্রাথমিক তৎপরতাগুলাে তারা ভালাে চোখে দেখত না। অনেক শিক্ষিত লােকের মাঝেও এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল।
প্রশ্ন : ৪ মার্চের পর আপনাদের পরবর্তী উল্লেখযােগ্য তৎপরতা কি ছিল?
উত্তর : ৪ মার্চের পর ১১ মার্চের জেনারেল স্ট্রাইক’ ছিল আমাদের উল্লেখযােগ্য তৎপরতা। সম্ভবত আমরা ৫ মার্চ সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ১২ মার্চ জেনারেল স্ট্রাইক’ ডাকা হবে এবং সেভাবেই কর্মসূচি প্রণয়ন করা হলাে। প্রভিনসিয়াল অ্যাসেম্বলির সেশনকে সামনে রেখে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়।
প্রশ্ন : ১১ মার্চের তৎপরতা সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন না।
উত্তর : ১১ মার্চের্চ প্রধান কর্মসূচি ছিল জেনারেল স্ট্রাইক’, পরিষদের সামনে ‘ডেমােনস্ট্রেশন’ এবং সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং করে সরকারি কর্মচারীদের অফিসে যাওয়া থেকে বিরত রাখা। সকাল দশটা থেকে আমরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে পিকেটিং শুরু করি। পিকেটিং এর সময় পুলিশ ছাত্রদের বেদমভাবে প্রহার শুরু করে এবং বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করতে থাকে। পিকেটিং-এ যাঁরা অংশ নেন তাঁদের মধ্যে খালেক নেওয়াজ, অলি আহাদ, মাে. বায়তুল্লাহ, শামসুল হক এবং শেখ মুজিব উল্লেখযােগ্য। পিকেটিং করতে গিয়ে শেখ মুজিব সম্ভবত প্রথমেই গ্রেফতার হয়ে যান। আমি সেক্রেটারিয়েটের সেগুন বাগিচার গেইটে পিকেটিং-এ ছাত্রদের সংগঠিত করতে যাই। তখন পুলিশের আইজি জাকির হােসেন গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা তাকে বাধা দিয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়ি। পুলিশ এসে আমাদের মারধাের শুরু করে। আইজি-র রক্ষী পুলিশ আমাকে চুল ধরে টেনে তুলে বেদম প্রহার করে। এ পর্যায়ে আইজি-র সাথে আমার ধাক্কাধাক্কি হয়। এর জন্য পরে কোতওয়ালী থানায় আমার নামে আইজি জাকির হােসেন সুনির্দিষ্ট মামলা করেন। ঘটনাস্থলে ডিআইজি, চেথাম ও সিটি এসপি, গফুর সাহেব ছিলেন। গফুর সাহেব আমাকে গ্রেফতার করে তাঁর জিপে নিয়ে যান।
প্রশ্ন : আপনারা সেদিন মােট কতজন গ্রেফতার হয়েছিলেন? পরে কবে মুক্তি পেলেন?
উত্তর : আমরা পঁয়ষট্টি জনের মতাে গ্রেফতার হই। ১১ তারিখ পর্যন্ত জেলে ছিলাম। পনেরাে তারিখে আমরা মুক্তিলাভ করি।
প্রশ্ন : আপনারা কি প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৭ দফা চুক্তির ফলেই মুক্তিলাভ করেছিলেন?
উত্তর : হ্যা, তাই। আমার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা ছিল বলে আমার মুক্তির ব্যাপারে জটিলতা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত আইজি-কে আমার কেসটা উঠিয়ে নিতে হয়। তবে এ চুক্তি ছাড়াও আমাদের মুক্তির আরাে কারণ রয়েছে পার্লামেন্টের ভেতর নাজিমুদ্দিন সরকারের বিরােধী এমএলএ-গণ ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হচ্ছিল। এ ছাড়া কায়েদে আযম পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসছিলেন। সুতরাং এমন মুহূর্তে নাজিমুদ্দিন চাচ্ছিলেন ব্যাপারটা আপসে মিটিয়ে ফেলে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে। এ কারণগুলােও আমাদের মুক্তিকে প্রভাবিত করেছিল।
প্রশ্ন : পরিষদে কারা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখতেন? তারা কি কোনাে গ্রুপ হিসেবে পরিচিত ছিলেন?
উত্তর : খয়রাত হােসেন, আনােয়ারা খাতুন, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আহমদ খান (বিচারপতি মােরশেদের পিতা), খান সাহেব ওসমান আলী, তােফাজ্জল আলী, মাে. আলী, ডা. মালেক (পূর্ব পাকিস্তানের শেষ গভর্নর) প্রমুখ রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখতেন। পরিষদের ভেতরে এরা সােহরাওয়ার্দী সমর্থক বলে পরিচিত ছিলেন। তাই বলে এঁদের সবাই যে মনপ্রাণ দিয়ে পরিষদের অভ্যন্তরে ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখতেন তা নয়। এঁদের অনেকে ভাষা আন্দোলনকে সামনে রেখে নাজিমুদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রন্ট গঠনে তৎপর হন। কেউ কেউ আবার পরবর্তী সময়ে নাজিমুদ্দিনের সাথে নেগােসিয়েশন’ করে ক্ষমতা লাভের চেষ্টা চালান এবং ভাষা আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে পরিষদের অভ্যন্তরে ৬৪ জন এমএলএ. নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ফ্রন্ট গড়ে তােলেন। এই ফ্রন্টের উদ্দেশ্য ছিল ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার পতন ঘটানাে। সােহরাওয়ার্দী সমর্থক বলে। পরিচিত এই ফ্রন্ট গড়ে তােলার ব্যাপারে শেখ মুজিবও তৎপর ছিলেন। কারণ শেখ মুজিব ছিলেন সােহরাওয়ার্দী সাহেবের ‘ফ্যানাটিক’ সমর্থক। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য, এই ফ্রন্ট রাষ্ট্রভাষাকে ইস্যু হিসেবে নিয়ে মুসলিম লীগ এমএলএ-দের তাদের দলে ভিড়াবার চেষ্টা চালায়। এছাড়া পরিষদে নাজিমুদ্দিন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ব্যক্তিগত পদ এবং ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্য ও এক শ্রেণীর এমএলএ-র মধ্যে কার্যকর ছিল। আরাে নির্মম সত্য এই যে, এই গ্রুপের যারা ভাষা আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পদ লাভ করেছেন পরবর্তীকালে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের মতাে ব্যক্তিত্বও তাদের সাথে হাত মিলিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ করেছেন। সেদিন মহান ভাষা আন্দোলনকে ব্যবহার করে তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ করেছেন। সেদিন মহান ভাষা আন্দোলনকে ব্যবহার করে তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ‘টাউটইজমের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন, সােহরাওয়ার্দীর মতাে নেতাও পরবর্তীকালে তাদের সাথে কমপ্রােমাইজ করেছেন। এটা আজো আমার কাছে দুঃখজনক বলে মনে হয়। বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের রাজনৈতিক জীবনে ‘টাউটইজমের’ এ ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। জাতিকে অবশ্যইষ এই ‘রাজনৈতিক টাউটইজমের’ কবল হতে মুক্তি লাভ করতে হবে।
প্রশ্ন : আমাদের রাজনীতিতে আজো ‘টাউটইজমের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এর দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?
উত্তর : রাজনীতিতে ‘টাউটইজমের ধারা অব্যাহত রয়েছে এই জন্য বলছি যে, যারা আদর্শ ও নীতিচ্যুত হতে পারছে, তারাই আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সমাদৃত হচ্ছে। কয়েকটি উদাহরণ পেশ করলেই তা বুঝতে পারবেন। যে মােহাম্মদ আলী (বগুড়া) পদের লােভে নীতিচ্যুত হয়ে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের গ্রুপ ত্যাগ করলেন, তার ক্যাবিনেটেই সােহরাওয়ার্দী সাহেবের মতাে নেতা পরবর্তীকালে ল’ মিনিস্টার হিসেবে যােগদান করেন। যে (খান বাহাদুর) আবদুল ওহাব খান পাকিস্তানের বিরােধিতা করেছেন এবং পরে ভাষা আন্দোলনেরও বিরােধিতা করেছেন, তিনিই ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের টিকিট থেকে বঞ্চিত হয়ে যুক্তফ্রন্টে ভিড়লে সােহরাওয়ার্দী-হক সাহেবের আশীর্বাদে যুক্তফ্রন্টের মনােনয়ন পান। তিনি ছিলেন হক সাহেবের ভাগ্নী জামাতা। হয়তাে এই যােগ্যতার বলেই তিনি মনােনয়ন পেয়েছেন। ঠিক এমনি ধরনের ব্যাপার ঘটে ১৯৭০ সালে। শেখ মুজিব তার ভগ্নিপতি সেরনিয়াবাতকে আওয়ামী লীগের মনােনয়ন দেন। অথচ সেরনিয়াবাত কোনােদিন আওয়ামী লীগ করতেন না। রাজনীতিতে, যখন ‘ডেডিকেশন’ এবং সিনসিয়ারিটির মূল্য দেয়া হয় না, তখনই এতে ‘টাউটইজমের’ অনুপ্রবেশ ঘটে, আর ‘রাজনৈতিক টাউটইজম’ থেকে সৃষ্টি হয় ন্যাশনাল ক্রাইসিস’।
প্রশ্ন : নাজিমুদ্দিন মুন্ত্রিসভার সাথে নেগােসিয়েশন করে যেসব এমএলএ পদ লাভ করেছেন, তারা কারা?
উত্তর : তােফাজ্জল আলী, মােহাম্মদ আলী, ডা. মালেক প্রমুখ। সােহরাওয়ার্দীর সমর্থক বলে পরিচিত আরাে অনেক এমএলএ রং বদল করেছেন। অথচ সােহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁদের সাথেই পরবর্তীকালে হাত মিলিয়েছেন।
প্রশ্ন : ১১ মার্চের কর্মসূচি সম্পর্কে আরেকটা বিষয় জানা হয়নি। সেদিন পরিষদের সামনে ডেমােনস্ট্রেশন হয়েছিল কি?
উত্তর : হ্যা, ছাত্ররা পরিষদের সামনেও গ্রুপে গ্রুপে ডেমােনস্ট্রেশন করেছিল। আমি সেক্রেটারিয়েটের গেইটে পিকেটিং করতে আসার সময় ছাত্রদেরকে অ্যাসেম্বলির সামনে সংঘবদ্ধ হতে দেখেছি।
প্রশ্ন : কায়েদে আযমের সাথে ছাত্র প্রতিনিধি দলের যে সাক্ষাৎকার হয়েছিল তাতে কি আপনি উপস্থিত ছিলেন?
উত্তর : না, আমি উপস্থিত ছিলাম না। ১১ মার্চে গ্রেফতার হয়ে ১৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা জেলে ছিলাম। এরই মধ্যে কারা কায়েদে আযমের সাথে সাক্ষাৎ করবেন তাদের নাম ঠিক হয়ে যায়। সুতরাং আমার সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণের প্রশ্ন ওঠে না।
প্রশ্ন : কার্জন হলে কায়েদে আযমের মন্তব্যের বিপক্ষে কারা প্রতিবাদ জানিয়েছিল?
উত্তর : এ প্রসঙ্গে অনেক অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। কারা প্রতিবাদ করেছে, এ প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর। কারণ কায়েদে আযম উর্দুর স্বপক্ষে মন্তব্য করার পর সম্মিলিতভাবে ‘নাে, নাে’ প্রতিবাদ উঠেছিল। সেখানে কোনাে ছাত্রের নেতৃত্ব দেয়ার কথা সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত। কোন্ কোন্ ছাত্র ‘নাে-নাে’ বলে কণ্ঠ মিলিয়েছিল তা চিহ্নিত করা সম্পূর্ণ হাস্যকর। ননা, নাে প্রতিবাদের পর পরই কায়েদে আযম- it is my view সংযােজন করে তাঁর বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করেন।
প্রশ্ন : কায়েদে আযমের রেসকোর্সের জনসভায় কোনাে প্রতিবাদ হয়েছিল কি?
উত্তর : না, সেখানে কোনাে প্রতিবাদ ওঠেনি। সেখানে প্রতিবাদ হয়েছিল বলে যেসব তথ্য পরিবেশিত হয়েছে তা সঠিক নয়।
প্রশ্ন : উর্দু ভাষার স্বপক্ষে কায়েদে আযমের মন্তব্য এবং উপমহাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কায়েদে আযম সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
উত্তর : কায়েদে আযম ছিলেন বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি একজন ‘লিবার্যাল ডেমােক্রাট’ ছিলেন। নইলে উপমহাদেশের অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গভর্নর জেনারেল হয়েও পূর্ব পাকিস্তানে এসে ছাত্র নেতাদের খোঁজখবর নিয়ে তিনি সাক্ষাৎকারে মিলিত হতেন না এবং কার্জন হলে তিনি ‘it is my view সংযােজন করে গণতান্ত্রিক মনােভাবের পরিচয় দিতেন না। কার্জন হলের এ প্রতিবাদের পর কায়েদে আযম রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আর কোনােদিন কোনাে বিতর্কমূলক মন্তব্য করেননি। আমার বিশ্বাস তিনি বেঁচে থাকলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আন্তরিকভাবে মেনে নিতেন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যথাযােগ্য মর্যাদা পেতাে। অনেকে হয়তাে জানেন না যে, কায়েদে আযমই প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তানি ছেলেদের (বাংলাদেশী) প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের জন্য সুপিরিয়র সার্ভিসে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কোটা নির্ধারিত করে যান। পূর্ব পাকিস্তানি ছেলেরা শিক্ষা-দীক্ষা এবং যােগ্যতায় অনগ্রসর বলেই তিনি এই ব্যবস্থা করে গেছেন। এমন মহান নেতার বিরূপ এবং মিথ্যা সমালােচনা অনুচিত। কায়েদে আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়ে আজ আবেগে অনেকে অসত্য এবং অতিরঞ্জিত বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, উপমহাদেশের দু’একজন মুসলিম নেতা ছাড়া আর তখন এমন কেউ ছিলেন না, যে কায়েদে আযমের চোখে চোখ রেখে কথা বলার যােগ্যতা রাখতেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বলুন আর যে কোনাে mighty নেতার কথাই বলুন, কায়েদে আযমের সম্মােহনী ব্যক্তিত্বের সামনে চোখ অবনত করে কথা বলতে হতাে সবাইকে। সুতরাং ভাবাবেগে সত্যের অপলাপ করে কোনাে লাভ নেই।
প্রশ্ন : তােয়াহা সাহেবের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, ভাষা আন্দোলনে গােলাম আযম সাহেবও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। গােলাম আযম সাহেব তখন কি ছিলেন? তাঁর কথা কিন্তু তারা কেউ বলেননি।
উত্তর : হঁ্যা, গােলাম আযম, (মৌলবী) ফরিদ আহমদ এঁরা অনেকে প্রত্যক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনে অবদান রেখেছেন। কিন্তু কে কার কথা বলে বলুন? অন্যের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার মতাে হৃদয়বৃত্তি আমাদের আছে কি? আমরা তাে সবাই আত্মপ্রচারে ব্যস্ত। অরবিন্দ বােস ছিলেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের V. P. এবং গােলাম আযম ছিলেন G. S.। অত্যন্ত চরিত্রবান এবং আদর্শ প্রকৃতির ছাত্র ছিলেন তিনি।
প্রশ্ন : ১১ মার্চ সম্পর্কে আরাে কিছু জানা প্রয়ােজন। পরে কি ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত দিবস হিসেবে উদযাপিত হতাে?
উত্তর : হঁ্যা, ১১ সংগ্রামী দিবস হিসেবে উদযাপিত হতাে কিন্তু পরে এ দিবস পালনের উৎসাহ অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কি ছিল?
উত্তর : বামপন্থীদের ভূমিকা থাকবে কোথা থেকে? তখন কমিউনিস্ট পার্টি তাে ‘ব্যান্ড’ ছিল। তাদের কোনাে ভূমিকা পালনের প্রশ্ন ওঠে কি করে?
প্রশ্ন : কেন, তােয়াহা সাহেব, অলি আহাদ সাহেব এঁরা কি বামপন্থী ছিলেন না?
উত্তর : তােয়াহা সাহেব তখন গণতান্ত্রিক শক্তির সাথেই কাজ করতেন। নেপথ্য
থেকে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে কি নির্দেশ দিত জানি না। তবে বাহ্যত তিনি আমাদের কাছে সে পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন না। আর অলি আহাদ সাহেব কিসের বামপন্থী ছিলেন? বামপন্থীরা নেপথ্য থেকে তাকে কাজে লাগাতাে। তিনি ছিলেন ‘হাইলি অ্যামবিশাস’। এ জন্য বামপন্থীরা প্রয়ােজন মতাে তাঁকে ‘ইউটিলাইজ করত। তিনি বামপন্থী ছিলেন না। বরং বলা যায়, তিনি বামপন্থীদের ট্র্যাপের মধ্যে ছিলেন। এ ছাড়া আর যারা বামপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন– যেমন মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, তাসাদুক, গাজীউল হক তাঁদের সবার স্ব স্ব ভূমিকা ততা দৃশ্যপটে আছেই। আপনি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখুন আন্দোলনে থেকেও বামপন্থীরা পদ ও সুযােগ লাভের জন্য অধিকতর তৎপর ছিল আর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির সদস্যরা তাে শুধু ‘সাফার’ করেছেন।
প্রশ্ন : ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ কখন গঠিত হয়? এই পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য কি ছিল?
উত্তর : ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। বিভিন্ন হল পরিষদ থেকে দু’জন করে সদস্য নিয়ে এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে এই রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। আমি এই পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হই। পরিষদের কার্যক্রমকে জাতীয় রূপ দেওয়ার জন্যই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়। এই পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন আবুল হাশিম, মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, কামরুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, মজিবুল হক, শামসুল আলম, আবদুল মতিন, খালেক নেওয়াজ প্রমুখ। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল হিসেবে ২৭ জানুয়ারিতে পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনরায় ঘােষণা করেন। নাজিমুদ্দিনের ঘােষণা ছাত্র সমাজকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে। এমনি পরিস্থিতিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের ওপর গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব ন্যস্ত হয়।
প্রশ্ন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোথাও ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কোনাে ইউনিট গঠিত হয়েছিল কি?
উত্তর : না, আর কোথাও ইউনিট গঠিত হয়নি। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অনৈক্য সৃষ্টি হতে পারে, যার যার ইচ্ছামতাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে— এ আশঙ্কায়ই আমরা আর কোনাে কমিটি গঠন করতে দেইনি।
প্রশ্ন : ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের উদ্যোগে আপনারা কি পদক্ষেপ নেন? উত্তর : এই কর্মপরিষদ গঠনের পর পরই সারা দেশে এই কমিটি গঠনের জন্য ইশতেহার পাঠিয়ে দিই। বার লাইব্রেরি হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করি। সে সভায় মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেন। নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। আহবায়ক হিসেবে কর্মপরিষদের উদ্দেশ্য এবং সংগ্রামের লক্ষ্য সম্পর্কে আমি বক্তব্য রাখি।
প্রশ্ন : সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদই কি একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়?
উত্তর : হঁ্যা, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদই একুশের কর্মসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রশ্ন : একুশে ফেব্রুয়ারিকে সফল করার জন্য এর পূর্বে কি কি তৎপরতা চালানাে হয়?
উত্তর : ৪ ফেব্রুয়ারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন, ১১ ফেব্রুয়ারি জেনারেল স্ট্রাইক, ১৩ এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি ফ্লাগ ডে পালন— এ সব তৎপরতাই ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিকে সফল করার জন্য।
প্রশ্ন : একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়? কোথায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়?
উত্তর : ৯৪ নং নবাবপুরের আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আবুল হাশিম সাহেবের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং ধীরে স্থিরভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২১ ভােট ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে এবং ৪ ভােট ভঙ্গের পক্ষে ছিল। এরূপ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এবং যেভাবেই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে প্রদেশব্যাপী সাধারণ হরতাল আহবান করা হয়।
প্রশ্ন : আপনারা কেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন? এর পেছনে কি যুক্তি ছিল?
উত্তর : আমরা ভাষা আন্দোলনকে সারা দেশে জনগণের মধ্যে বিস্তৃত করে পর্যায়ক্রমিকভাবে দুর্বার আন্দোলনের রূপ দিতে চেয়েছিলাম। যার ফলে ভাষা আন্দোলন এমন রূপ নিত যে, এর সামনে যে কোনাে প্রশাসনিক বা সরকারি প্রতিরােধ চুরমার হয়ে ধ্বসে পড়ত। তাই সেদিনই আমরা চরম সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে পর্যায়ক্রমিকভাবে দুর্বার গতি দিতে চেয়েছিলাম। আমাদের আশঙ্কা ছিল, চরম সিদ্ধান্ত নিলে সরকারি স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপও চরমে উঠবে এবং আমাদের আন্দোলনের মূল কাঠামাে বা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হবে। প্রকৃতপক্ষে সরকার সে সুযােগের জন্যই ওঁত পেতে ছিল। আর বাস্তবে তাই ঘটেছিল।
প্রশ্ন : আপনি এর পূর্বে বরকতকে দেখেছেন কি? ছাত্রদের কোনাে মিটিং-এ
তাঁকে লক্ষ্য করেছেন কি?
উত্তর : আমি এর পূর্বে আর কখনও ছাত্রসভায় বরকতকে দেখেছি বলে মনে হয়। বরকত আমার নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল।
প্রশ্ন : বরকত পুলিশের ‘ইনফরমার’ ছিল বলে অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেব যে তথ্য পরিবেশন করেছেন সে সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
উত্তর : অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেব পুলিশ অফিসারের নিকট শুনেছেন। সুতরাং পুলিশের রক্ষিত রেকর্ডপত্র থেকেই এ তথ্যের সঠিক প্রমাণ আহরণ করা যেতে পারে। তবে বরকত যা-ই হউক না কেন, আমরা তাঁকে শহীদ মনে করি। কারণ ঘটনার অনিবার্য পরিণতি তাঁকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছে।
প্রশ্ন : তখন ছাত্রদের মধ্যে পুলিশের ‘ইনফরমার থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন কি?
উত্তর : হঁ্যা, থাকতে পারে। কারণ, পরিষদের এম.এল.এ-গণ যখন ভাষা আন্দোলনকে পুঁজি করে নেপথ্যে পদ লাভের চেষ্টা চালাতে পারেন, তখন ছাত্রদের মধ্যেও সরকারি এজেন্ট বা পুলিশের ‘ইনফরমার থাকা বিচিত্র কিছু নয়। সকল মহান আন্দোলনের পেছনেই স্বার্থান্বেষী শক্তির ‘স্যাবােটাইজ’ মূলক কারসাজি থাকতে পারে।।
প্রশ্ন : একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার মিটিং-এ আপনি উপস্থিত ছিলেন কি? ঐ সভায় কে সভাপতিত্ব করেন?
উত্তর : হ্যা, আমি উপস্থিত ছিলাম। গাজীউল হক সাহেব ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন।
প্রশ্ন : আপনাদের কর্মপরিষদের সিদ্ধান্তগুলাে সভায় কে ঘােষণা করেন?
উত্তর : কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে সভায় শামসুল হক বক্তব্য রাখেন।
প্রশ্ন : আপনাদের ঐ ছাত্রসভায় প্রাক্কালে পুলিশ কি কোনাে উস্কানিমূলক কিছু করেছিল, যার ফলে পরিস্থিতি অবনতির দিকে যায়?
উত্তর : হঁ্যা, পুলিশ উস্কানিমূলকভাবে ইউনিভার্সিটি গেইটের সামনে অবস্থান করছিল। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররাও তাদের উপস্থিতি সহ্য করছিল না, এইভাবেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সূত্রপাত ঘটে।
প্রশ্ন : গুলিবর্ষণের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
উত্তর : ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে।
প্রশ্ন : আপনি কি গুলিবর্ষণ হওয়ার পর বরকতকে দেখেছেন?
উত্তর : মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসার পর আমি বরকতের মৃতদেহ দেখতে পাই।
প্রশ্ন : আপনাদের ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার সিদ্ধান্তকে অনেকে আন্দোলন হতে পিছু হটে আসা এবং এক প্রকার ‘বিট্রেয়াল’ বলে আখ্যায়িত করেন। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তর : তা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা এ ধরনের মন্তব্য করেন। তাঁরা পরিস্থিতির অপব্যাখ্যা করে সস্তায় প্রশংসা কুড়াতে চাচ্ছেন মাত্র। হালকা ‘সেন্টিমেন্ট বা উচ্ছাসের উপর নির্ভর করে কোনাে মহান জাতীয় আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া যায় না। আমরা পর্যায়ক্রমিকভাবে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমরা কত সংগঠিত এবং সঠিক পন্থায় এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, পরবর্তী ঘটনাক্রমের আলােকে বিচার করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। একুশের পর পরিস্থিতি এমন হয় যে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত হরতালের পরও পুলিশ এবং সরকারি প্রশাসন নির্মম অত্যাচারের স্টিমরােলার চালাতে থাকে। সরকার বাংলা ভাষাকে নীতিগত স্বীকৃতি দিলেও যারা জীবনমরণ প্রচেষ্টায় এই মহান আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, তাঁদের উপর নির্যাতন বন্ধ করেনি। আমরা যারা প্রায় দেড়টি বছর জেলে ছিলাম, তাদের মুক্তির জন্যও তেমন কোনাে প্রচেষ্টা চলেনি। যারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা সম্পর্কে সােচ্চার হয়ে মন্তব্য করেন তাঁদের অনেককে কিন্তু সেদিন চরম মুহুর্তে পাওয়া যায়নি।
প্রশ্ন : এ ঘটনার পরের দিনগুলােতে কি হরতাল পালিত হয়েছিল?
উত্তর : হঁ্যা, হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারি যে হরতালের আহ্বান করে পরবর্তী তিন দিন তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই জনাব ওসমান আলীর (এম.এল.এ.) বাড়ি লুট হয়, নারায়ণগঞ্জের মর্গান স্কুলের হেড মিস্ট্রেস চরমভাবে নির্যাতিত হন। এমনি ধরনের বহু ঘটনা ঘটতে থাকে এবং তা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় নিয়ে আসে।
প্রশ্ন : আপনাদের পরবর্তী তৎপরতা কি ছিল? ঘটনাপ্রবাহ কিভাবে এগিয়ে যায়?
উত্তর : ২২ ফেব্রুয়ারি আমাদের নয় জনের নামে হুলিয়া বের হয়। স্বরাষ্ট্র (স্পেশাল) বিভাগ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত ঢাকা গেজেটে (এক্সট্রা অর্ডিনারি) আমাদের নামের তালিকা প্রকাশ করে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ দিনের মধ্যে নিজ নিজ জেলা প্রশাসনের নিকট হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। যাদের নামে হুলিয়া বের হয় তাঁরা হলেন— কাজী গােলাম মাহবুব (আহবায়ক, রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ), খালেক নেওয়াজ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ), শামসুল হক (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ), অলি আহাদ (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ), আবদুল মতিন (আহবায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ), সৈয়দ এম. নুরুল আলম, আজিজ আহমদ, আবদুল আউয়াল এবং মােহাম্মদ তােয়াহা। আমরা পালিয়ে পালিয়ে আবার আন্দোলনকে ‘রিভাইব করতে চেষ্টা করি। বিভিন্ন স্থানে ঘরােয়া মিটিং করি। ২৪ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেই ৫ই মার্চ রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে এবং পুলিশী নির্যাতন ও ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ই মার্চ হরতাল আহ্বান করা হলাে। সংগঠিত তৎপরতার অভাবে কিন্তু হরতাল সফল হলাে না। ঘটনাপ্রবাহ ক্রমাগতভাবে আন্দোলনের প্রতিকূলে যাচ্ছিল। তার সাথে সরকারি নির্যাতনের মাত্রাও বাড়ছিল। এই পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা পুনরায় আন্দোলনকে সংগঠিত করতে চেষ্টা করি এবং ৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮২, শান্তিনগরে এক ঘরােয়া মিটিং-এ মিলিত হই। এই ঘরােয়া বৈঠকে আমি ছাড়া আর যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন: অলি আহাদ, আবদুল মতিন, মীর্জা গােলাম হাফিজ, মােহাম্মদ তােয়াহা, মজিবুল হক (সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ), হেদায়েত হােসেন চৌধুরী (সাধারণ সম্পাদক, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ), মাে. সাদেক খান, হাসান পারভেজ ও আনিসুজ্জামান (বর্তমানে ডক্টর আনিসুজ্জামান)। তােয়াহার অপ্রয়ােজনীয় দীর্ঘ বক্তৃতার জন্য বৈঠকের কাজ শেষ করতে দেরী হয়ে যায়। সভার কাজ প্রায় শেষ এমন সময় পুলিশ এসে ৮২ নম্বর শান্তিনগরের বাসাটি ঘেরাও করে। পালাবার আর কোনাে পথ নেই দেখে সকলে পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য কেউ ঘরের চাকর সাজে, কেউ খাটের নিচে আত্মগােপনের ব্যর্থ চেষ্টা করে। অলি আহাদ তাড়াতাড়ি ঘরের এক কোণে রাখা মশলা-বাটার পাটা নিয়ে ঘরের কাজে ব্যস্ত রয়েছে এমন ভাব দেখায়। কিন্তু পুলিশের তীক্ষ্ণ নজরকে ফাঁকি দেওয়া কারাে পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমি অবশ্য ঘরের বাঁশের মাচার উপর উঠে অন্ধকারে পােকামাকড়ের কামড় সহ্য করে এমনভাবে শুয়েছিলাম যে, পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও সে যাত্রায় আমাকে খুঁজে পায়নি। হাসান পারভেজ ও আনিসুজ্জামান ছাড়া বাকি সবাই গ্রেফতার হন। আনিসুজ্জামান ও হাসান পারভেজ গ্রেপ্তার না হওয়ার ব্যাপারটি তখন আমাদের কাছে রহস্যজনকই মনে হয়েছে। আনিসুজ্জামান ৮২, শান্তিনগরে অলি আহাদকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। কারণ অলি আহাদ বৈঠকের ঠিকানা জানতেন না। এছাড়া আমরা শুনেছি বশির নামে আনিসুজ্জামানের একজন আত্মীয় আই.বি. ইন্সপেক্টর ছিলেন। তাই আনিসুজ্জামানের গ্রেপ্তার না হওয়ার কারণে আমাদের স্বভাবতই সন্দেহ হয় যে আনিসুজ্জানের মাধ্যমে পুলিশ আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ভালােভাবে জেনে বাড়ি ঘেরাও করেছিল। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আমি গভীর রাতে ৮২ নম্বর শান্তিনগরের বাসাটি থেকে বের হয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে আত্মগােপন করি। কিন্তু পুলিশ এমনভাবে পিছু লেগেছিল যে শেষ পর্যন্ত
স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করতে বাধ্য হই।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কারা গ্রেফতার হয়েছিলেন?
উত্তর : সবার নাম তাে মনে নেই। তবে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে জনাব আবুল হাশিম, জনাব মওলানা ভাসানী, খন্দকার মুশতাক, জনাব আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, জনাব ওসমান আলী, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক সুনিল দে, জনাব আজিজ আহমদ, মাে. তােয়াহা, জনাব অলি আহাদ, জনাব খালেক নেওয়াজ প্রমুখের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে।
প্রশ্ন : আপনি তাে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন, আপনার গ্রেফতারের পর কি কর্মপরিষদে ভেঙ্গে যায়?
উত্তর : আমার গ্রেফতারের পর কর্মপরিষদের কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য জনাব আতাউর রহমান খান আহবায়কের কার্যভার লাভ করেন। কিন্তু এর পর তারা তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে পারেননি। আমাদের মুক্তির ব্যাপারেও কিছু করতে পারেননি।
প্রশ্ন : একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারের নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ এবং পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন এমন কোনাে স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের কথা জিজ্ঞেস করলে আপনি কার কথা বলবেন?
উত্তর : জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন-এর কথা বলব। সে দিনের নিদারুণ সরকারি
নির্যাতনের প্রতিবাদে আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব সাহসিকতার সাথে পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। তার সে দিনের সাহসিক ভূমিকা আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
প্রশ্ন : রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মানসিক পটভূমি আপনার কিভাবে গড়ে ওঠে? পরবর্তী জীবনে যেসব আন্দোলনে আপনি অংশগ্রহণ করেছেন তাতে সে মানসিকতার প্রতিফলন হয়েছে কি?
উত্তর : ১৯৪৩ সালে বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে সময় আমি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজের ‘সেকেন্ড ইয়ার’ আই, এ-র ছাত্র। দুর্ভিক্ষের করালগ্রাস মানুষের জীবনে যে কি নিদারুণ এবং ভয়াল পরিণতি আনতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একদিকে উপরতলার মানুষের বিলাসী জীবনযাপন অন্যদিকে তাদের উচ্ছিষ্ট নিয়ে বুভুক্ষু ও অসহায় মানুষ আর কুকুরের কাড়াকাড়ি, এসব দৃশ্য কোনাে দিন ভােলার নয়। আর সমাজের এই হতভাগ্য চরম অবস্থায় পতিত মানুষের শতকরা পঁচানব্বই জনই ছিল মুসলমান। বাঙালি মুসলমানেরাই ছিল তখন সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত, শােষিত এবং নিরন্ন। দুর্ভিক্ষের করালগ্রাস এবং মুসলমানদের নিদারুণ পরিণতি আমার যুবকমনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। আর তাই একদিকে যেমন ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শােষণের প্রতি চরম ঘৃণা জন্মে তেমনি অগ্রসরমান হিন্দু সমাজের কবল হতেও বাঙালি মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মুক্তির জন্য মানসিক পটভূমি গড়ে ওঠে। এই মানসিক অনুভূতিই আমার পরবর্তী জীবনে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং আমাকে পাকিস্তান। আন্দোলনে অংশ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
প্রশ্ন : পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যে যে মুসলমানদের মুক্তি অর্জন করা যাবে এ বিশ্বাস আপনার কেন জন্মালাে?
উত্তর : আপনাকে পূর্বেই বলেছি তখন মুসলমানেরাই ছিল সর্ব নিম্নস্তরে। সমাজে তাদের করুণ পরিণতি বুঝতে হলে তখনকার সামাজিক পটভূমি তুলে ধরা প্রয়ােজন। উপমহাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে আমাদের গভীর বিশ্বাস জন্মেছিল যে, মুসলিম লীগের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমেই মুসলমানদের মুক্তি অর্জন সম্ভব। এতদিন পর্যন্ত মুসলমানদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে হিন্দুদের সেই সাম্প্রদায়িক শােষণ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য পাকিস্তান আন্দোলনই যে অনিবার্য এবং সঠিক পথ সে কথা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। এই আন্দোলনকে আমি Human Rights-এর মহান struggle বলে মনে করি। And it was the struggle for human rights of those people who were Muslims and who were being subjugated and economically exploited.
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আপনার আর কোনাে বক্তব্য আছে কি?
উত্তর : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আলােচনা করার সময় এ কথা মনে রাখতে হবে যে, কোনাে ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠান এর একক কৃতিত্বের দাবিদার নয়। সকল শ্রেণীর জনগণ তথা সমগ্র জাতি এ আন্দোলনকে সফল করার দাবিদার। সেদিন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বলেই ভাষা আন্দোলন মহান জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। আজ এ মহান আন্দোলন সকল অবিচার অত্যাচার আর শশাষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মে, ১৯৭৮, ডিসেম্বর, ১৯৮৬,
সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল