ডক্টর শাফিয়া
ডক্টর শাফিয়া ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম নেত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৫০-৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ‘ওমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের জিএস, (জেনারেল সেক্রেটারি) এবং ১৯৫১-৫২ সালে ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) ছিলেন। সুতরাং ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের সংগঠিত করার ব্যাপারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডক্টর শাফিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযােগী অধ্যাপিকা এবং শিক্ষা মনােবিজ্ঞান ও নির্দেশনা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৩১ সালে কোলকাতায় ডক্টর শাফিয়া জন্মগ্রহণ করেন। বাড়ি রংপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার বিন্নাগাড়ী গ্রামে। বাড়ি রংপুর হলেও ছােটবেলা কোলকাতায় কাটিয়েছেন। পিতা মরহুম আজগর আলী ছিলেন নামকরা অ্যাডভােকেট। তিনি কোলকাতায় প্র্যাকটিস করতেন। ১৯৪৬ সালে ডক্টর শাফিয়া কোলকাতার ‘সেন্ট মার্গারেট স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ‘লেডী ব্রাবাের্ন কলেজ থেকে আইএ এবং পরে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং পরে এম, এড ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা মনােবিজ্ঞানে তিনি পি-এইচ,ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট শিক্ষা গবেষণা বিভাগের রিডার পদে কিছুকালের জন্য কর্মরত ছিলেন। ডক্টর শাফিয়ার শিক্ষা ও কর্মজীবন খুবই কৃতিত্বপূর্ণ। প্রশ্ন : কোন সময় হতে আপনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন? উত্তর : ১৯৫০ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করি।
প্রশ্ন : এ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য আপনি কারাে দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কি?
উত্তর : না, কারাে দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিনি। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। এর পেছনে কোনাে রাজনৈতিক বা দলীয় কারণ ছিল না।
প্রশ্ন : প্রথমে কিভাবে এ আন্দোলন আপনার মনে রেখাপাত করে? আপনি এর প্রতি কেন আকৃষ্ট হন?
উত্তর : ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটি একজন সচেতন ছাত্রী হিসেবে স্বাভাবিক নিয়মেই আমার মনে রেখাপাত করেছিল। সমগ্র ছাত্রসমাজকেই এ দাবি আন্দোলিত করেছিল। ছাত্রী সংসদের ভি. পি. হিসেবে আমি চেয়েছিলাম, এ আন্দোলনে ছাত্রীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত। এই সচেতন অনুভূতি থেকেই আমরা ছাত্রীরা এই আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হই।
প্রশ্ন : কোন সময় আপনি ছাত্রী সংসদের ভি.পি. ছিলেন?
উত্তর : ১৯৫১-৫২ শিক্ষাবর্ষে আমি ছাত্রী সংসদ বা ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি ওমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নে ভি.পি. ছিলাম। এর পূর্বে ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে জি.এস. ছিলাম।
প্রশ্ন : তা হলে দেখা যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আপনি ছাত্রীসমাজকে নেতৃত্ব দান করেছিলেন।
উত্তর : নেতৃত্ব বলুন আর যাই বলুন, সমগ্র ছাত্রসমাজের সাথে সংগঠিত হয়ে আমরা ছাত্রীরাও ভাষা আন্দোলনে কর্তব্য পালনের চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : আপনারা তখন কোন হলে থাকতেন? তখনকার সমাজ তাে খুবই রক্ষণশীল ছিল। সুতরাং এসব আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণে কোনাে বাধা আসতাে না কি?
উত্তর : আমরা ছাত্রীরা তখন ‘চামেরী হাউস’ (বর্তমানে রােকেয়া হলের পাশে) বলে পরিচিত ‘ইউনিভার্সিটি ওমেন স্টুডেন্স রেসিডেন্সে’ থাকতাম। এছাড়া ছাত্রীদের জন্য অন্য কোনাে হল বা আবাসস্থল ছিল না। প্রথমে হাইকোর্টের পাশে তােপখানা রােডের চামেরী হাউসে ছাত্রীদের হােস্টেল ছিল। পরে তা বর্তমান রােকেয়া হলের পাশে ‘হুদা হাউসে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু চামেরী হাউসের নামানুসারেই ‘হুদা হাউস’ ও পরবর্তীকালে ‘চামেরী হাউস’ নামে পরিচিত হয়। সে যাক্। আপনি বলছিলেন আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণে সামাজিক বাধার কথা- সেসব প্রতিকূলতা তাে ছিলই। আমরা যারা বাইরে বেরুতাম তাদেরকেও খানিকটা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হতাে। যেসব ছাত্রী হলের বাইরে থেকে ইউনিভার্সিটিতে পড়তাে, তাদের মধ্যে তেমন কেউ এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করত না বা তার সুযােগ পেতাে না। অবশ্য সুফিয়া (বিচারপতি ইব্রাহীমের কন্যা ব্যরিস্টার ইশতিয়াক আহমদের স্ত্রী) ছিল। এদের মধ্যে ব্যতিক্রম। সুফিয়া হলের বাইরে থেকেও আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
প্রশ্ন : তখন ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রীদের সংখ্যা কত ছিল? সবাই কি আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়েছিল?
উত্তর : পুরাে ইউনিভার্সিটিতে তখন আশি-পঁচাশিজন ছাত্রী ছিল। তখনকার পরিবেশের তুলনায় এ সংখ্যা কম ছিল না। আন্দোলনে কি সবাই অংশগ্রহণ করে? কেউ কেউ ‘ইনঅ্যাকটিভ ছিল।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে ১১ মার্চকে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালন করা হতাে, তা নয় কি?
উত্তর : হ্যা, ১১ মার্চকে মর্যাদার সাথে পালন করা হতাে। সে সম্পর্কে আমি তেমন কিছু বলতে পারব না। কারণ আমিতাে ১৯৫০ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এসেছি। সম্পর্কে তােয়াহা সাহেব, অলি আহাদ সাহেব, গাজীউল হক সাহেব— এদের কাছে সঠিক তথ্য পেতে পারেন।
প্রশ্ন : পরবর্তী পর্যায়ে কোন সময় হতে ভাষা আন্দোলন দুর্বার গতি লাভ করে?
উত্তর : নাজিমুদ্দিন সাহেবের ঘােষণার পর হতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ বিক্ষোভের সূত্র ধরেই আন্দোলন ক্রমে ক্রমে দুর্বার গতি লাভ করে।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলন কোন প্রকৃতির আন্দোলন ছিল বলে আপনি মনে করেন? এ আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করতে চান?
উত্তর : ভাষা আন্দোলন ছিল মাতৃভাষাকে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার একটি জাতীয় আন্দোলন। মূলত এটা ছিল ছাত্র আন্দোলনের ফসল। রাজনৈতিক দল- যে যাই দাবি করুক, ছাত্ররাই জীবনপণ করে এ আন্দোলনকে গড়ে তুলেছিল। পরে আন্দোলন সামগ্রিক রূপ লাভ করলে পুরাে জাতিই এর সাথে জড়িয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : আমতলায় যেসব ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হতাে তাতে আপনারা ছাত্রীরা কি অংশগ্রহণ করতেন?
উত্তর : হ্যা, অধিকাংশ সময়ই আমরা অংশগ্রহণ করতাম। তবে এখনকার মতাে এমন প্রত্যক্ষভাবে ছেলেদের সাথে একত্র হয়ে সভা-সমিতি করার অবকাশ তখন ছিল না। তখন ইউনিভার্সিটিতে কোন ছাত্র কোন ছাত্রীর সাথে কথা বলতে হলেও প্রােক্টরের অনুমতি লাগত। এবার বুঝতে পারছেন তখনকার পরিবেশটা কেমন ছিল।
প্রশ্ন : একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রশ্নে আগের দিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের যে সভা হয়েছিল, তাতে কি আপনি উপস্থিত ছিলেন?
উত্তর : না, ঐ সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম না আর অন্য কোনাে ছাত্রীরও উপস্থিত থাকার কথা নয়। তবে ঐ সভার সিদ্ধান্ত এবং ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে যে কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল তা আমাদের ছাত্রীদেরকেও জানানাে হয়েছিল। পরদিন আমতলার মিটিং-এ সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল।
প্রশ্ন : একুশে ফেব্রুয়ারিকে সফল করার জন্য এর আগের দিন কোনাে তৎপরতায় আপনারা অংশগ্রহণ করেছিলেন কি?
উত্তর : ‘ওমেনস স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ভি.পি. হিসেবে আমি শুধু ছাত্রীদের সংগঠিত করার দায়িত্বই পালন করতাম। ছাত্রীদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে মেয়েদের স্কুলে পাঠাই। তখন ছাত্রীদের মাঝেও এমন উৎসাহ লক্ষ্য করেছি যে, তা কোনােদিন ভুলবার নয়। পায়ে হেঁটে মেয়েরা বাংলা বাজার গার্লস স্কুলে গিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির আমতলার সভায় যােগ দেয়ার জন্য ছাত্রীদেরকে সংগঠিত করেছে। একুশের আন্দোলনকে সফল করার পেছনে। এসব তৎপরতা অপরিসীম অবদান রেখেছে।
প্রশ্ন : আন্দোলনকে সাথে জড়িত ছিলেন মেয়েদের মধ্যে এমন কার কার নাম এ মুহূর্তে আপনার মনে আসছে?
উত্তর : সুফিয়া আহমদ, শামসুন্নাহার, রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর মাহমুদ (ইতিহাসের ছাত্রী), মাহফিল আরা (অর্থনীতির ছাত্রী) ও খােরশেদী খানম (বাংলার ছাত্রী) এদের নামই এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। এছাড়া আরাে অনেকেই ছিলেন যাদের নাম আজ ভুলে গেছি।
প্রশ্ন : এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত ঘটনাগুলাের কথা বলুন না। উত্তর : বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সভা আরম্ভ হয়। এর পূর্বেই বাইরে থেকে ছাত্র ছাত্রীরা এসে ইউনিভার্সিটির আমতলায় জড়াে হয়। ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষেই অত্রনেতারা বক্তব্য রাখেন। অর্থাৎ পূর্বদিনের সিদ্ধান্তই ছাত্রনেতাদের বক্তব্যে প্রকাশ পাচ্ছিল। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিতর্কমূলক যুক্তির অবতারণা হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে ছাত্রনেতারা চারজন চারজন করে দূরত্ব বজায় রেখে মিছিল বের করার পক্ষপাতি ছিলেন। এর মধ্যে দুএকজন হয়তাে ব্যতিক্রম থাকতে পারেন। আমি কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে অনড় ছিলাম।
প্রশ্ন : তখন আপনার প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
উত্তর : আমি বললাম, এভাবে চারজন চারজন করে দূরত্ব বজায় রেখে মিছিল করা যাবে না। স্বাভাবিকভাবেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তার চেয়ে এখনই আমাদের স্থির সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গব। এবং এভাবে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে সৃশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে গেলে আমাদের কেউ প্রতিরােধ করতে পারবে না। আর তা না হলে সিদ্ধান্তহীনভাবে আমরা এগিয়ে যেতে পারি না। আমরা ছাত্রীরা এভাবে বিশৃঙ্খলার মধ্যে এগিয়ে যাব না। এ বলে আমি স্থির সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বপক্ষে সভা বর্জন করে ছাত্রীদের নিয়ে মেয়েদের কমনরুমে চলে যাই।
প্রশ্ন : আপনার বক্তব্যে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ঐতিহাসিক ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি, তা নয় কি?
উত্তর : হ্যা, তাই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, চার জন চার জন করে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদ মিছিল এগিয়ে যাবে। তাতে ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের আইনগত অভিযােগ আনা যাবে না। অথচ আমাদের বিক্ষোভ মিছিলের উদ্দেশ্য সফল হবে। কিন্তু আমি ছাত্রীদের নিয়ে এ ধরনের দুর্বল সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিলাম। আমার বক্তব্য ছিল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাব। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের লক্ষ্য নিয়ে আমাদের রাজপথে নামা উচিত। মাতৃভাষার দাবির প্রশ্নে মিছিলে নেমে ১৪৪ ধারা রক্ষা করার চিন্তা করা আমাদের উচিত নয়। এটা ভীরুতা ও সিদ্ধান্তহীনতারই লক্ষণ। আমতলার সভায় চারজন চারজন করে মিছিল করার সিদ্ধান্তকে কোনােক্রমেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত বলা চলে না। আজ যদি কেউ নিজেকে ‘সংগ্রামী প্রতিপন্ন করার জন্য ভিন্ন কথা বলেন, তা হবে সত্যের অপলাপ। মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এ ধরনের অসত্য তথ্য সংযােজিত হওয়া উচিত নয়। সেদিন আমতলার সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছাত্র নেতৃবৃন্দ স্থির সিদ্ধান্ত নেননি বলেই আমরা সভা বর্জন করে মেয়েদের কমনরুমে চলে গিয়েছিলাম। পরে বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে যেভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয় তা ছিল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামী মনােভাবের ফল। আমতলার সভার সিদ্ধান্তের জন্য তা হয়নি। আমতলায় সভার চারজন চারজন করে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেউ মেনে চলেনি বা চলতে পারেনি।
প্রশ্ন : তখন আপনার কেন এটা মনে হয়েছিল যে, স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে গেলে আপনাদের কেউ প্রতিরােধ করতে পারবে না?
উত্তর : ছােটবেলা থেকে তাে কলকাতায় কাটিয়েছি। যদিও ‘কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের সময় ছােট ছিলাম, তবুও যা দেখেছি এবং শুনেছি, তাতে আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, লক্ষ্যে স্থির, সুশঙ্খল ও সংঘবদ্ধ জনতাকে পুলিশ বা সামরিক বাহিনী ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। যথেচ্ছ আক্রমণও চালাতে পারে না।
প্রশ্ন : পরিশেষে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে?
উত্তর : আমরা তাে আমতলা মিটিং বর্জন করে ছাত্রীদের কমনরুমে চলে এলাম। এরপর বেশ কয়েকবার ছাত্ররা এসে আমাদের ফিরে যাওয়ার জন অনুরােধ করতে লাগলাে। আমরা পূর্ব মতামত ব্যক্ত করলাম। পরিশেষে কয়েকজন এসে বলল, সিদ্ধান্ত যাই হয়েছে ছাত্রঐক্যের স্বার্থে আপনারা আসুন, দূরে থাকবেন না। ছাত্রঐক্যের প্রসঙ্গ উঠায় আমরা ছাত্রীরা আর দূরে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম-ঠিক আছে যা হয়, We will face it together.
প্রশ্ন : তখন কি পুলিশ ইউনিভার্সিটি এরিয়ার আশেপাশে অবস্থান নিয়েছিল?
উত্তর : হঁ্যা, ইতিমধ্যে পুলিশ ইউনিভার্সিটি এরিয়ার চারদিকে অবস্থান নিয়েছে এবং রাস্তায় টহল দিয়ে ফিরছে।
প্রশ্ন : কিভাবে আপনারা মিছিল করলেন?
উত্তর : আমতলার মিটিং শেষে চারজন চারজন করে বের হওয়ার জন্য ব্যাচ করা হলাে। আমরা ছিলাম ৩য় ব্যাচে। ছাত্ররা বের হতেই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। ছাত্রদের দু’টি গ্রুপকেই গেইটের বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ট্রাকে তুলে নেয়। তারা মিছিল করে এগিয়ে যেতে পারেনি। আমরা ছাত্রীরা চারজন চারজন দূরত্ব রেখে বের হলাম। গেটের পাশে পানিভর্তি একটা বালতি রাখা ছিল। সবাইকে বলা হয়েছিল, রুমাল ভিজিয়ে নেয়ার জন্য। কাঁদানে গ্যাস হতে চোখ রক্ষার জন্য প্রয়ােজন হতে পারে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ এগিয়ে আসছিল বাধা দেয়ার জন্যে। পাশে থেকে ওদের কোনাে অফিসার বােধ হয় বললেন, ‘ছােড় দো’। আমরা বাধা পেলাম না। ইতিমধ্যে বেশ কিছুদূর এগিয়েছি। কিছুটা মিছিলের আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ আমাদের ছাত্রীদের ব্যাচ-ই প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এগিয়ে যায়। মিছিলের মাঝে মাঝে মেয়েদের সাথে বােধ হয় কিছু ছেলেও ঢুকে গিয়েছিল। আরেকটু এগিয়ে আমরা মধুর রেস্তোরার পাশে (বর্তমান মেডিকেল কলেজের পূর্ব দিকের বাউন্ডারি দেয়ালের কাছে) এসেছি, এমন সময় একজন পুলিশ আমার পেছন দিয়ে এসে আমাকে আঘাত না করে আমার পাশে বারাে-তেরাে বছরের একটি ছেলেকে সজোরে লাঠির আঘাত হানলাে এবং পরে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিল। এ সময় আমাদের মিছিলের রওশন আরা বাচ্চু লাঠির আঘাত পায়। পেছনেও লাঠির আঘাতের ফলে মিছিল বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এলােমেলাে হচ্ছিল। এ বাধার মধ্যে আমরা বর্তমান মেডিকেল কলেজের মেইন গেইটের কাছে এসেছি এমন সময় আমাদের ওপর টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া শুরু হলাে। টিয়ার গ্যাসের একটা শেল আমার পায়ের সামনে এসে পড়ে। টিয়ার গ্যাসের ফলে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কে যেন আমাকে ধরে নিয়ে রাস্তার অপর দিকের পানের দোকানের কাছে নিয়ে চোখে পানি ছিটা দিচ্ছিল। কিন্তু টিয়ার গ্যাস খুব সিরিয়াসলি এফেক্ট’ করেছিল। তখন কে একজন আমাকে মেডিকেলে ‘ফাস্ট-এইডে’র জন্য নিয়ে গেল। ‘ফার্স্ট-এইড’ নিয়ে সুস্থির হলে দেখতে পেলাম এই পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশের আঘাতপ্রাপ্ত রক্তাক্ত অবস্থায় অনেককে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসা হয়েছে। দু’একজন আহত অবস্থায়ও এমন বিক্ষুব্ধ ছিল যে, তাদেরকে বিছানায় চেপে রাখা যাচ্ছিল না। আমি মেডিকেল থেকে বের হয়ে আবার মেয়েদের সংগঠিত করার চেষ্টা করলাম। মেয়েদের সংগঠিত করতে এসে দেখি বর্তমান শহীদ মিনারের পেছন হতে ছাত্ররা (অধিকাংশই স্কুলের ছাত্র) ইটের টুকরা নিক্ষেপ করে পুলিশের সাথে রীতিমতাে প্রতিরােধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আমি এ দৃশ্য দেখে ভাবলাম, এভাবে বিক্ষিপ্ত আক্রমণ থেকে ওদেরকে নিবৃত্ত করে সংগঠিতভাবে মিছিল করা প্রয়ােজন। কিন্তু ইতিমধ্যে আমার ফার্স্ট এইড নেয়ার কালে যে গুলি হয়ে গেছে এবং পরিস্থিতি যে খুবই সংগীন হয়ে পড়েছে তা আমি উপলব্ধি করতে পারিনি। এ পরিস্থিতিতেও আমরা কিছু ছাত্রী সংগঠিত হলাম। সুফিয়া, রওশন আরা বাচ্চু এরা কখন যে কে কোথায় ছিটকে পড়েছে খোঁজ করতে পারিনি। পরে শুনেছি, ওরা ছুটে গিয়ে ড. ওসমান গণির বাসার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিল। বর্তমান সাইন্স অ্যানেক্সের পাশে তখন ড. গণির বাসা ছিল। যাক সে কথা, তারপর আমরা কিছু মেয়ে সংগঠিত হয়ে মিছিল বের করি। বর্তমান সাইন্স এনেক্সের পাশ দিয়ে টিএসসি, ঘুরে রেসকোর্সের পাশ ঘেঁষে আমরা শ্লোগানমুখর মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাই।
প্রশ্ন : পুলিশ বা সামরিক বাহিনী আপনাদের বাধা দেয়নি? মিছিল কোথায় এসে শেষ হয়?
উত্তর : না, বাধা দেয়নি। শুধু আমাদের মিছিলের কিছু স্কুলের ছাত্রীকে পুলিশ ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি ওদের টঙ্গি নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওরা রেল লাইন ধরে হেঁটে নিজ নিজ বাড়ি পৌঁছে। স্কুলের ছাত্রীদের তুলে নিয়ে গেলেও আমাদের মিছিল বন্ধ হয়নি। সামনে এগিয়ে চলে। বাংলা একাডেমির (সে সময় নূরুল আমীনের সরকারি বাসভবন) সামনে দিয়ে মিছিল আবার মেডিকেলের মেইন গেইটের পাশে এসে শেষ হয়। আমরা এসে দেখি এ যেন একটা বিধ্বস্ত এলাকা। টিয়ার গ্যাসের অন্ধকার চারিদিক ছেয়ে আছে। এরপর আমরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং অবসন্ন। অবস্থায় হলে প্রত্যাবর্তন করি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : এপ্রিল, ১৯৭৮, জানুয়ারি, ১৯৮৭,
সূত্র : সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল