ডক্টর সুফিয়া আহমদ
ড. সুফিয়া আহমদ ১৯৫০ সাল এবং তৎপরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মিছিলের পুরােভাগে যারা ছিলেন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একজন অধ্যাপিকা। ছাত্রীজীবনে তিনি ছিলেন একজন কৃতীছাত্রী। তাঁর গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। পিতা বিচারপতি মােহাম্মদ ইব্রাহীম ঢাকা হাইকোর্টের একজন প্রখ্যাত বিচারক ছিলেন। সুফিয়া আহমদ ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেছেন। প্রথমে ‘সেন্ট ফ্রান্সিস এবং অতপর ‘কার্সিং ডাওহিলস্ কনভেন্টের’ ছাত্রী ছিলেন। তবে প্রাইভেটে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। বরিশাল ব্রজমােহন কলেজ থেকে আই.এ. পরীক্ষা দিয়ে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে লেটার নম্বরসহ ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রথম বিভাগে অষ্টম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে বি.এ. অনার্স ও এম.এ. পাস করেন। এম.এ-তে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ড. সুফিয়া আহমদ চলে যান গবেষণার জন্য। তাঁর থিসিস লেখার বিষয় ছিল ‘মডার্ন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’। ১৯৬১ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনার কাজে যােগ দেন। ড. সুফিয়া আহমদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। স্বামী জনাব ইশতিয়াক আহমদ একজন নামকরা ব্যারিস্টার এবং সাবেক এটর্নি জেনারেল।
প্রশ্ন : বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা উচিত এ মানসিকতা আপনার মধ্যে কিভাবে গড়ে ওঠে?
উত্তর : ছােটবেলা থেকে যদিও আমি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেছি তবে বাংলা ভাষার প্রতি আমার একটা সহজাত আকর্ষণ ছিল। তবে সত্যি কথা হলাে, আমার পিতার অপরিসীম উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমি বাংলা এবং সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হই। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের আগমন হতাে হলে। তাদের সাথে আলােচনা হতাে। কখনাে ‘উর্দু আরবি হরফে বাংলা প্রচলন প্রসঙ্গ, কখনাে ‘উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে impose করার প্রসঙ্গ ইত্যাদি নানা প্রকার আলােচনা। এসব আলােচনা সমালােচনা ও বিতর্ক হয়তাে অলক্ষ্যে মনের মধ্যে ছাপ রেখেছিল। আমার পিতা ছিলেন খুবই liberal minded। বাংলা ভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের অধিকারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন এবং অনুভূতিপ্রবণ। সুতরাং মাতৃভাষার প্রতি সহজাত আকর্ষণ ছাড়াও পারিবারিক পরিবেশ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে আমার মানসিকতা গড়ে তুলেছিল।
প্রশ্ন : বাংলা ভাষার প্রতি অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ এবং একটা সহজাত আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও আপনাকে ছােটবেলা থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানাের কারণ কি?
উত্তর : এ ব্যাপারটা হয়তাে আপনার কাছে peculiar মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলার প্রতি কোন অনীহার দরুন নিশ্চয়ই আমাকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে দেয়া হয়নি। হয়তাে বাংলা মাধ্যমে ভালাে স্কুল ছিল না, নতুবা আমার পিতা ভেবেছিলেন ইংরেজি মাধ্যমে আমার পড়াশুনা ভালাে হবে। অবশ্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমার পিতা নিজের তত্ত্বাবধানে আমাকে বাংলা শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। বস্তুত পিতার প্রচেষ্টা এবং উৎসাহের ফলেই বাংলায় আমার ত্রুটি বিচ্যুতি কাটিয়ে ওঠে, বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হই।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তকালীন সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানি মনােভাব সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তর : সরকারি মনােভাব তাে অযাচিতভাবে হঠকারী ছিলই। এ সম্পর্কে নতুন করে বিস্তারিত বলার তেমন কিছুই নেই। তবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনােভাব ছিল একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। কারণ তাদের ধারণা ছিল সারা পাকিস্তানে একটি ভাষা না হলে ‘ইনটিগ্রিটি’ বিপন্ন হবে। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি চালাক, আর তাই তারা চেয়েছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে ধীরে ধীরে আমাদের আইডেন্টিটি ভুলিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা আমাদের আইডেন্টিটি’ ভুলতে যাব কেন? প্রশ্ন : তবে কি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের ‘ইনটিগ্রিটির বিরুদ্ধে ছিল? উত্তর : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের domination এর বিরুদ্ধে ছিল। পাকিস্তানের জন্য বাঙালি মুসলমানেরা কম sacrifice করেনি।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের সাথে আপনি কখন থেকে জড়িত হন?
উত্তর : ১৯৫০ সালে আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়ি।
প্রশ্ন : আপনিতাে হলে থাকতেন না। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ বা কর্মতৎপরতার প্রশ্নে কোনাে পারিবারিক বাধা আসত না?
উত্তর : আমি হলে (ইউনিভার্সিটি ওমেন্স রেসিডেন্ট) থাকতাম না। এবং একমাত্র
আমিই সম্ভবত হলের বাইরে থেকে আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলাম। এ ব্যাপারে আমার পিতা কখনাে আমাকে প্রশ্ন করেননি। আমি একে নীরব সমর্থন মনে করতাম।
প্রশ্ন : ড. শাফিয়া আপনাদের ‘ওমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ভি.পি. ছিলেন তাই ? তাঁর কর্মতৎপরতা সম্পর্কে কিছু বলুন না।
উত্তর : হঁ্যা, তিনি ওমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ভি.পি. ছিলেন। ছাত্রীদের সংগঠিত করার ব্যাপারে তিনিই পুরােভাগে থেকে সব কিছু করতেন। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রথম দু’জন দু’জন করে মিছিল নিয়ে বের হন।
প্রশ্ন : ড. শাফিয়া তাে বললেন প্রথম ব্যাচে ছেলেরা বের হয়, তৃতীয় ব্যাচে তিনি মেয়েদের নিয়ে বের হন।
উত্তর : (একটুখানি ভেবে) না, মেয়েরাই তাে আগে বেরুলাে। শাফিয়া আপাই তাে আগে বের হলেন। আমার তাই স্পষ্ট মনে পড়ছে। রাখুন আমি শামসুনকে (শামসুন্নাহার আহসান) জিজ্ঞেস করি। [এই বলে তিনি কার সাথে যেন টেলিফোনে যােগাযােগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু টেলিফোন এনগেজড থাকায় পুনরায় আলােচনায় রত হলেন।
প্রশ্ন : আপনি কাকে টেলিফোন করতে চাইলেন?
উত্তর : শামসুন্নাহার আহসানকে। ও আমার ক্লাসমেট। ছােটবেলায় আমরা একত্রে পড়েছি। আমার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সেও মিছিলের পুরােভাগে ছিল। সে বােরখা পরে মিছিলে অংশ নিয়েছিল এবং অন্যদের সাথে চরম দুরবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। বর্তমানে সিদ্ধেশ্বরী ওমেনস কলেজে অধ্যাপনা করছে। [ কথার মাঝেই ড. সুফিয়া আবার শামসুন্নাহারকে টেলিফোন করে এবার পেয়ে গেলেন। এবং জিজ্ঞেস করলেন, … আচ্ছা শামসুন ২১ শে ফেব্রুয়ারি মিছিলে মেয়েরা আগে বেরিয়েছিল না? শাফিয়া আপা নাকি বলেছেন প্রথম দুই ব্যাচে ছেলেরা আগে বেরিয়েছে। তাের মনে আছে … হ্যা, তাই তাে শাফিয়া আপারাই তাে আগে বের হলাে। তারপর আমরা…।’ কিছুক্ষণ টেলিফোনে কথা হলে ড. সুফিয়া, শামসুন্নাহার আহসানের নিকট ঢাকা ডাইজেস্টে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত সাক্ষাৎকারের কথা বললেন।]
প্রশ্ন : মিসেস আহসান কি বললেন?
উত্তর : আমি যা বলছি, শামসুনও তাই বলছে। ছেলেরা আগে যাবে কি করে; তাদেরকে তাে বের হতেই দিচ্ছিল না। শাফিয়া আপারাই আগে মিছিল নিয়ে বের হয়েছিলেন। আপনি তার সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় বিস্তারিত জিজ্ঞেস করবেন।
প্রশ্ন : আপনি বটতলার মিটিং- এ উপস্থিত ছিলেন কি? উত্তর : হ্যা, ছিলাম।
প্রশ্ন : আপনারা কখন বের হলেন?
উত্তর : মিটিং-এর পর দু’জন দু’জন করে বের হয়ে অ্যাসেম্বলি পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলাে। শাফিয়া আপারা প্রথমে একরকম বিনা বাধায় এগিয়ে গেলেন। তারপর আমরা বের হলাম। আমরা বের হতেই দেখি ইউনিভার্সিটি গেটের সামনে পুলিশ কর্ডন করে দাঁড়িয়ে আছে। কর্ডনের পাশেই ঢাকার সিটি এস.পি. মাসুদ মাহমুদও দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা থমকে দাঁড়ালাম।
প্রশ্ন : ইউনিভার্সিটি গেইটে তখন সিটি এস.পি. মাসুদ মাহমুদ দায়িত্বে ছিলেন এ ব্যাপারে আপনি কি confirmed? আপনি কি তাকে চিনতেন?
উত্তর : হ্যা, আমি confirmed. মাসুম মাহমুদকে আমি ভালােভাবে জানতাম। আমার পিতা যখন বরিশালের ডিস্ট্রিক্ট জজ ছিলেন তখন মাসুদ মাহমুদ লাকুটিয়ায় ট্রেনিং-এ গিয়েছিলেন। তখন থেকেই আমি মাসুদকে চিনি। কেন যে অনেকে ইদ্রিস সাহেবের কথা বলে বুঝি না। আমার স্পষ্ট মনে আছে মাসুদ মাহমুদ তখন পুলিশ কর্ডনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঢাকার ডি.সি. ছিলেন সম্ভবত মি. কোরাইশী।।
প্রশ্ন : আপনারা তখন কিভাবে এগিয়ে গেলেন?
উত্তর : প্রথমে কিছুটা সংকোচ ও দ্বিধা হচ্ছিল এই ভেবে যে মাসুদ মাহমুদসহ পরিচিত পুলিশ অফিসারগণের মাধ্যমে আমার মিছিল করার খবরটি বাসায় পৌছে যাবে। যদিও এ ব্যাপারে আমার পিতা কখনাে বিরূপ মন্তব্য করেননি তবও খানিকক্ষণ কেন জানি এমনি ধরনের অনুভূতি বিরাজ করছিল। মুহুর্তের মধ্যে আমরা (আমি, শামসুন্নাহার, সারা তাইফুর) কৰ্ডনের নিচ দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ কয়েকজন সামনে এগিয়ে গেলাম।
প্রশ্ন : আপনাদের সাথে আর কারা ছিলেন?
উত্তর : আরাে অনেকে ছিলেন। সবার নাম স্মরণ করতে পারছি না। রওশন আরা বাচ্চু ছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের সাথে ছিলেন না, শাফিয়া আপাদের সাথে ছিলেন ঠিক মনে নেই। তিনি লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন।
প্রশ্ন : সেদিন পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতা দেখে কিছু ঘটবে বলে আপনারা ধারণা করেননি?
উত্তর : পরিস্থিতি এমন হবে এ আমার ধারণা হয়নি। কেউ ভেবেছে কিনা জানি , কিন্তু ভাষার প্রশ্নে দাবি জানাতে গেলে গুলি বর্ষিত হবে— এ ছিল আমাদের ধারণার বাইরে। আমি ভেবেছি বড়জোর আমাদের গ্রেপ্তার করতে পারে। কর্তৃপক্ষ এমন হঠকারী ‘অ্যাকশন’ নেবে এ আমরা ভাবতে পারিনি। ভাষার দাবিকে জেনুইন’ দাবি মনে করতাম বলেই হয়তাে আমাদের এমন ধারণা ছিল।
প্রশ্ন : আপনারা তাে পুলিশের কর্ডন ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাই না? তারপর কি ঘটল?
উত্তর : আমরা কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরই কাঁদানে গ্যাস ও পুলিশের লাঠি চার্জের ফলে পরিস্থিতি বিভীষিকাময় হয়ে উঠলাে। ঐ দিকে ছেলেরাও দেয়াল টপকে মিছিলে যােগ দিচ্ছিল। কেউ বা পুলিশের সাথে ইটপাটকেল ছুঁড়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছিল। আমরা ছুটে গেলাম ড. ওসমান গণির বাসার দিকে। বর্তমান সাইন্স বিল্ডিংএর বাউন্ডারিতে তার বাসা ছিল, কাঁটা তারের বেড়া ফাঁক করে অনেক কষ্টে আমরা সেখানে আশ্রয় নেই। ইতিমধ্যে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে যায়। ফরমান উল্লাহ তখন আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। আপনি এসব কথা শামসুনের কাছে জানতে পারবেন।
প্রশ্ন : মিছিল করে কোথায় যাওয়া আপনাদের উদ্দেশ্য ছিল?
উত্তর : পরিষদের সামনে গিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। বর্তমান জগন্নাথ হল ছিল তখন পরিষদ ভবন। কিন্তু সেদিকে ছিল কঠোর পুলিশ রক্ষা ব্যবস্থা।
প্রশ্ন : কতক্ষণ পর্যন্ত আপনারা ড. গণির বাসায় অবস্থান করেছিলেন?
উত্তর : আমরা ডা. গণির বাসার ভিতরে যাইনি। বাইরেই আমরা বসেছিলাম। পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং নিরাপদ হওয়া পর্যন্ত আমরা সেখানেই অবস্থান করি। পরে সারা তাইফুরের ফার্স্ট এইডের জন্য বের হয়ে আসি।
প্রশ্ন : আমতলার মিটিং-এ বা অন্যান্য ছাত্রসভাতে বরকতের উপস্থিতি কখনাে লক্ষ্য করেছেন কি?
উত্তর : আমি বরকতকে চিনতাম না। তাই ছাত্রসভাগুলােতে তার উপস্থিতি ছিল কিনা বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয় কি?
উত্তর : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তাে যথেচ্ছ বিকৃত হচ্ছে। যারা এ আন্দোলনের ধারে-কাছেও ছিলেন না, তাঁরা আজকাল এ সম্পর্কে রেডিও, টিভির সাক্ষাৎকারে অংশ নিচ্ছেন। যারা সত্যিকারে জড়িত ছিলেন, তাঁদের অনেকের খোঁজও কেউ নিচ্ছে না। এই দেখুন, শামসুন্নাহারের কথা কেউ কোনােদিন বলছে না। [কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর] আমি বুঝি না ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে শেখ মুজিবকে অতাে সন্দেহ করা হয় কেন?]। প্রশ্ন : আন্দোলনের ব্যাপারে শেখ মুজিবের সাথে আপনার পূর্ব পরিচিতি বা যােগাযােগ ছিল কি?
উত্তর : (মৃদু হেসে] না, যদিও আমাদের বাসায় তার আনাগােনা ছিল, তবু আমার সাথে কোনাে আলাপ হয়নি কখনাে। একবার আবদুল হামিদ সাহেব (যিনি আমাদের ফরমান উল্লাহ নয়, অন্য কেউ তখন সুফিয়া আহমদ, শামসুন্নাহার ও অন্যদের কাঁটা তারের বেড়া পার হতে সাহায্যে করেছিলেন। সুফিয়া আহমদ হয়তাে তাকে ভালােভাবে মনে রাখতে পারেননি। ফরমান উল্লাহ তখন ফেনী থেকে ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। দেশের লােক এবং MLA এসে বললেন শেখ মুজিব আমার সাথে দেখা করতে চান এবং আলাপ করতে চান। এর জন্য দিনও ঠিক হয়েছিল। শেখ মুজিব সেদিন ঠিকই এসেছিলেন, কিন্তু আমাকে হঠাৎ বাইরে বের হয়ে যেতে হয়েছিল বলে আর তাঁর সাথে দেখা হয়নি, আলাপও হয়নি। এ জন্য আবদুল হামিদ সাহেবের সাথেও ভুল বুঝাবুঝি হয়ে সম্পর্ক নষ্ট হয়। শেখ মুজিবও হয়তাে মনঃক্ষুন্ন হন। তাঁর সাথে আমার কোনাে দেখা বা আলাপ হয়নি। আর তাই তিনি কেন দেখা করতে চেয়েছিলেন সে কথাও আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না। আমার মনে হয় আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলাম বলে রাজনৈতিক কিছু আলােচনার জন্যই হয়ত তিনি এসেছিলেন। আপনি আবদুল হামিদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: এপ্রিল, ১৯৭৮
সূত্র : সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল