ভাষা শহীদ আবুল বরকত
রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অমর ভাষাশহীদ বরকত। পুরাে নাম আবুল বরকত। ডাক নাম ‘আবাই…।
১৯২৭ সালের ১৬ জুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শামসুজ্জোহা, মাতা হাসিনা বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন বরকত। বরকতেরা ছিলেন দুই ভাই, তিন বােন।
বরকত শৈশবে ভর্তি হন বাড়ির পাশে বহড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি ভর্তি হন বাবলা গ্রাম থেকে দেড় কিলােমিটার দূরে তালিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে।
শৈশব থেকে শান্ত-শিষ্ট, ধীর স্থির প্রকৃতির ছেলে ছিলেন। লেখাপড়ায়ও ছিলেন মেধাবী। তালিবপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ সালে মেট্রিক পাস করেন প্রথম বিভাগে। ১৯৪৭ সালে রহমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
১৯৪৭ সালে ভারতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ বিপন্ন হয়ে উঠলে বাবা। শামসুজ্জোহা ছেলেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেন। ১৯৪৮ সালে বরকত ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে ওঠেন মামা আবদুল মালেকের বাসায়। আবদুল করিমের বাসাটি ছিল পুরানা পল্টন লেনে বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে। মামা-মামির স্নেহছায়ায় থেকে আবুল বরকত ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। মামার বাসা থেকে সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতেন। ছােটবেলা থেকে শান্ত, নম্রভদ্র, বিনয়ী এবং মেধাবি ছিলেন বরকত। অল্প দিনেই ক্যাম্পাসে ভালাে ছেলে এবং ভালাে ছাত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পড়াশােনা ছাড়া অযথা সময় নষ্ট করতেন না। তবে খেলাধুলা তাঁর প্রিয় ছিল। প্রায়ই বিকেলে পল্টন থেকে সাইকেল চালিয়ে সেগুনবাগিচা মাঠে চলে আসতেন খেলতে, ঘুরতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পরীক্ষায় বরকত সেকেন্ড ক্লাস ফোর্থ হন।
বরকত প্রত্যক্ষভাবে কোনাে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।। তবে রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বরকত ছাত্রদের মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার দাবির আন্দোলন সংগ্রামের খবর রাখতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে বরকত বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে রওনা দেন। রওনা হওয়ার আগে তিনি মামিকে বলেন, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় গণ্ডগােল হতে পারে ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে ছাত্ররা তা মানছে না। ভঙ্গ করবে বলে তর্ক চলছে। ১৯৫২ সালে বরকত এম, এ ক্লাসের ছাত্র। তিনি ক্লাস মিস দিতে চাচ্ছিলেন না। চলে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এসে দেখেন তুলকালাম। সকাল থেকেই ছাত্ররা খণ্ড খণ্ড দলে আলাপ আলােচনা করছে, সভা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শত শত পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। দুপুরের পর ছেলেরা মিছিল করে সংসদ অভিমুখে রওনা দিল। সেখানে কিছুক্ষণ পর শুরু হবে পূর্বপাকিস্তানের বাজেট অধিবেশন। ছাত্রদের লক্ষ্য বাজেট অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে স্পিকারকে তাঁদের দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে ছিল সংসদ ভবন। ছাত্ররা মিছিল করে মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত পৌঁছালে বাধা। পায় পুলিশের পুলিশ বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে টিয়ার গ্যাস ছােড়ে। ছাত্ররা প্রতিরােধ হিসেবে পুলিশের প্রতি ইট পাটকেল ছোড়ে।
বরকত ছাত্রদের সাথে মেডিক্যাল পর্যন্ত চলে আসেন। তিনি মেডিক্যালের পাশে ব্যারাকের বারান্দায় দাড়িয়ে উভয় পক্ষের খণ্ড যুদ্ধ দেখছিলেন। হঠাৎ মিছিলে এক বন্ধুকে দেখে এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ছররা গুলির একটি এসে বরকতের তলপেটে ঢুকে যায়। তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। তাঁর গায়ে তখন ছিল নীল রঙের হাওয়াই হাফশার্ট, পরনে ছিল খাকি প্যান্ট, পায়ে কাবলি সেন্ডেল। কয়েক বন্ধু ছুটে এলেন তাঁর কাছে। ততক্ষণে রক্তে ভিজে গেছে। তার পরনের জামা প্যান্ট। পুলিশ তাকে নিয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বরকতের লম্বা দেহটাকে একজন কাঁধে তুলে নিলেন। পা দুটো এক, আর একজন মাথাটাকে ধরে তুলে চললেন মেডিক্যালের ইমার্জেন্সির দিকে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে মাটিতে। আবুল বরকত কষ্ট করে ক্ষণস্বরে বললেন সকলের উদ্দেশ্যে ‘খুব। কষ্ট হচ্ছে, আমি বাঁচবাে না। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন পুরানা পল্টনে আমার মামার বাসায় একটা খবর পৌঁছে দেবেন। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে আনা হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলেন ডাক্তার। এই সময়ে স্ট্রেচারে করে আর একজনের লাশ নিয়ে আসা হলাে। তিনি ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন। দ্রুত ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। দেখলেন গুলির সঙ্গে সঙ্গে রফিকউদ্দিন নিহত হয়েছেন তাঁর মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। মগজ অর্ধেক রাজপথে রয়ে গেছে আর খানিকটা মগজ পেছনের খুলিতে ঝুলছে।
কী নিদারুণ।
কী হৃদয়বিদারক।
রফিকের প্রাণহীন দেহ পরীক্ষা করার পর কর্তব্যরত ডাক্তাররা আবুল বরকতকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এর এখনাে প্রাণ আছে। যে করেই হােক এঁকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু তলপেট থেকে গুলিও বের করা গেল না রক্তক্ষরণও বন্ধ হচ্ছে না। বসে জীবনে লড়াই করে বরকত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রাত ৮টায়। শহীদ হয়ে গেলেন আরাে একজন।।
আবুল বরকতের মামা এবং অন্য আত্মীয়রা মর্গে এসে অনেক দেনদরবার করে পুলিশের কাছ থেকে বরকতের লাশ উদ্ধার করেন। এবং সে রাতেই কড়া পুলিশ পাহারায় আজিমপুর গােরস্থানে দাফন করা হয়।
মামা মালেক সাহেবই কবরের জায়গা কেনার টাকা এবং দাফন কাফনের খরচ বহন করেন। পরবর্তী সময় শহীদ বরকতের কবরটি তাঁর আত্মীয়স্বজনরা বাধাই করে রাখেন। তাই বরকতের কবরের চিহ্ন রয়েছে বাঙালি জাতির কাছে।
বরকতের আহত হওয়া লাশ গ্রহণ এবং দাফন সম্পর্কে তার মামার ভাষ্য :
বিকেল চারটার দিকে বাসায় খবর আসে। আমি খবর পাই অফিস থেকে ফিরে। পাঁচটায়। শুনি পুলিশের গুলিতে বরকত গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পড়ে আছে। আমি তক্ষুনি মেডিকেলে ছুটে যাই। কিন্তু পুলিশ বাধা দিচ্ছে দেখে আমি ফিরে আসি এবং আমার পরিচিত স্বাস্থ্য দফতরের ডেপুটি সেক্রেটারি ডা. আবুল কাসেমকে সঙ্গে নিয়ে মেডিকেলে যাই। সেখানে আমার পরিচিত ডা. কর্নেল গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বরকতকে অপারেশন করেছেন। তিনি আমাকে দেখেই কান্নাস্বরে বলে ওঠেন—‘খুবই দুঃখের বিষয়, অনেক চেষ্টা করেও ওকে বাচাতে পারলাম না। আহত অবস্থায় ওর মুখে আপনার নাম শুনে আমি তাকে চিনতে পারি।….
আমি বরকতের লাশ নিয়ে আসতে চাইলে পুলিশ জানালাে লাশ আমাদের হাতে দেবে না। এ ব্যাপারে ডা. আবুল কাশেম এবং মেডিকেল কলেজের সেক্রেটারি রশিদ সাহেবসহ চেষ্টা করেও বিফল হই। লাশের দায়িত্বে ছিলেন ওবায়দুল্লাহ নামক একজন উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ অফিসার। তিনি জানালেন, দাফনের সময় আত্মীয়স্বজন সব থাকতে পারবে। আমি বললাম, দাফনের ব্যবস্থা আমরা নিজেরা করব। খয়রাতি’ কাফনে বরকতকে দাফন করব না। পুলিশ কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবি মেনে নেয় এবং আমাদের কাছ থেকে কবরের জায়গা। কেনার টাকা এবং কাফনের খরচের টাকা গ্রহণ করে।
রাত একটা থেকে দুটোর মধ্যে লাশ দাফনের জন্য আজিমপুর গােরস্থানে নেয়া হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য ছাড়া আমার সাথে ছিলেন ডা. কাশেম এবং মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ডা. হাবীব উদ্দিন।
বরকতকে যখন কবর দেয়া শেষ হয় তখন ফজরের আজান শােনা যায়। এমনি করে আবুল বরকত ভাষা শহীদের তালিকায় এসে যােগ হন।
পরবর্তী সময় যারা বরকতকে কাছে থেকে দেখেছেন তারা অনেকে স্মৃতি চারণ করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমান বলেছেন, বরকত আমার বন্ধু স্থানীয় ছিল। আমার সাথে সেও পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স ভর্তি হয়েছিল। বরকত অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। কোনাে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে আমার জানা নেই।
সূত্র : একুশের সংকলন-৮০ : বাংলা একাডেমি।
ভাষা শহীদ আবুল বরকতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশের পদক দেয়া হয়েছে কিনা তেমন কোনাে তথ্য খুঁজে পাইনি। তবে ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়ের জহিরুল হক হলের পাশে নির্মিত হয়েছে ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার এবং বরকতের জন্মভূমি বাবলা গ্রামের বরকতের নামে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম