স্বাধীন বাংলার মুক্তিসংগ্রামে গেরিলা যুদ্ধের স্থান
প্রফুল্ল কুমার গুপ্ত
দেশপ্রেমের আদর্শে সাধারণ কার্যসূচির মধ্যে দিয়েই গেরিলাদল জনগণের সঙ্গে এক হয়ে মিশে যায় এবং শত্রুর সম্মুখে দেশব্যাপী সর্বাত্মক প্রতিরােধের প্রাচীর তুলে ধরতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধু মুজিবরের নেতৃত্বে সারা পূর্ববাংলায় যে দেশাত্মবােধ জেগে উঠেছিল, সেই দেশাত্মবােধকে জাগিয়ে রাখতে পারলে তবেই অধিকৃত অঞ্চলগুলােতে পাক হানাদারেরা কখনােই শিকড় গেড়ে বসতে পারবে না, বা তাদের জয়ের সুবিধাগুলােও তারা ভােগ করতে পারবে না। আমরা এখন পর্যন্ত যতটুকু জেনেছি, তাতে পূর্ববাংলার শহরগুলাের প্রায় অধিকাংশই পাক হানাদারেরা দখল করে নিয়েছে, কিন্তু গ্রামগুলাে এখনও অনেক মুক্তিফৌজের দখলেই আছে। শহর অঞ্চলে এখনও যারা আছেন তারা অধিকাংশই হয়তাে মুসলিমলীগ পন্থী অথবা জামাত-এ ইসলামী; সুতরাং পাকজঙ্গীসাহী এখন হয়তাে চেষ্টা করবে তাদের অধিকৃত অঞ্চলগুলােকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামােকে নিজেদের মতাে করে গড়ে তুলে তাদের পূর্বের শােষণকার্য চালিয়ে যেতে। কিন্তু জনসাধারণ যাতে হানাদারদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামােকে মেনে না নেয় গেরিলাদের সেদিকে নজর দিতে হবে। সব সময়ে মনে রাখতে হবে যে, গেরিলাযুদ্ধের সেটাই হচ্ছে নীতি (strategy)। পাক ফৌজ স্বাধীন বাংলাদেশের শহরগুলাের অনেকাংশ দখল করে নিয়েছে এবং এামের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে হতাশ হয়ে পড়েছেন; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, সত্যই কি তারা শহরগুলাে “জয়”-করতে পেরেছে? উত্তর হচ্ছে—পারেনি। কিন্তু সেই চেষ্টাই এখন তারা আরম্ভ করেছে সেইজন্য বীর মুক্তি ফৌজের গেরিলাদের কাজই হবে অনবরত আক্রমণ এবং প্রতিআক্রমণ চালিয়ে পাকফৌজকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে ব্ৰুিত করে রাখা। নিজেদের অক্ষমতার কলঙ্ক ঢাকার জন্য পাক জঙ্গীশাহী কিছু মিরজাফর খাড়া করে ওখানে একটা দর্শনধারী শাসন ব্যবস্থা খাড়া করতে চেষ্টা করছে এবং হয়তাে শেষ পর্যন্ত সক্ষমও হতে পারে। কিন্তু এই মিরজাফর বা বিভীষণরা যাতে কিছুতেই রক্ষা না পায় সে কাজ গেরিলাদের করতেই হবে। তাতে বিশ্বাসঘাতকদের মনােবল নষ্ট হয়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে আর কোনাে বিশ্বাসঘাতক খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজশাহী, কুষ্টিয়া প্রভৃতি জেলাগুলােতে গেরিলা যােদ্ধারা এখন সেই কাজই আরম্ভ করেছেন এবং তাতে ভালাে ফল পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রথম অবস্থাটা ছিল, ই,পি, আর, বাহিনী, আনসার বাহিনী, পুলিশ, অর্থাৎ এক কথায় বলা চলে, অস্ত্র শিক্ষায় শিক্ষিত বিদ্রোহী বাহিনীর ওপরে নির্ভরশীল। যার জন্য পূর্বেই বলেছি যে, মুক্তিযােদ্ধারা Pitched Battle and Frontal attack স্থিতি যুদ্ধের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন এই দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামকে জয়ের অভিমুখে চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে এই যুদ্ধকে People’s war জনযুদ্ধে রূপান্তরিত করতে হবে। কিন্তু তা করতে হলে সব সময়েই মনে রাখতে হবে যে, মেয়ে, পুরুষ, ছেলে, বুড়াে সকলকেই রাজনৈতিক চেতনায় জাগিয়ে তুলতে হবে। সকলকে রাইফেল ছােড়ার কায়দা ও সামরিক নিয়মকানুন শিখিয়ে দিতে হবে। তাহলে দেশ রক্ষার প্রয়ােজনে, নিজেদের ঘর-বাড়ি ও মা বােনের সম্মান বাঁচাবার তাগিদে দলে দলে মানুষ এগিয়ে আসবে। এইভাবে সকলেই দেশ ছেড়ে, ঘর-বাড়ি ছেড়ে, স্ত্রী-পুত্র খুইয়ে লাখে লাখে মানুষ এপার বাংলায় এসে আশ্রয় নেবে না।
আক্রমণের মুখে ঘরবাড়ি ছেড়ে, যথাসর্বস্ব হারিয়ে যারা এপার বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদেরও নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার সময় নেই। তাঁদেরও অনেক কাজ আছে। তাদেরকে সব সময়ে মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা রণক্ষেত্র থেকে রিট্রিট করেছেন, কিন্তু পরাজিত হননি। নতুন উদ্যমে, নতুন শক্তি সঞ্চয় করে সু-সংগঠিত হয়ে আবার শত্রুকে আঘাত হানতে হবে। শত্রুকে প্রতিনিয়ত উদ্ব্যস্ত রাখা এবং হাতে যত না পারা যায়, তার চেয়ে বেশি ভাতে মারার কৌশল অবলম্বন করা গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম প্রধান রণকৌশল।
স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দান, তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র সহ সর্ব প্রকার সাহায্য দেওয়ার পক্ষে সকলেই কথা বলেছেন দাবীও জানিয়েছেন সেটার প্রয়ােজনও আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, অস্ত্র-শস্ত্র গােলা-বারুদ সাহায্য দেওয়াটাই সব নয়। কারণ আধুনিক যুদ্ধের প্রকৃতি যাঁরা লক্ষ করেছেন, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, Material Strength অর্থাৎ সমর সম্ভার এবং অস্ত্র-শস্ত্র বেশি হলেই যেমন যুদ্ধে জয়লাভ হয় না, তেমনি ব্যাপক সর্বাত্মক এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জয়লাভ শুধু স্থায়ী সেনাবাহিনীর সাহায্যেও সম্ভব নয়। ভিয়েতনাম তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। অতীতে চীনের মুক্তিযুদ্ধও সেই কথাই বলছে।
এখনকার যে যুদ্ধ সে হচ্ছে সামগ্রিক যুদ্ধ। ইচ্ছেয় হােক আর অনিচ্ছাতেই হােক, এখনকার যুদ্ধে দেশের শতকরা ৯৫ জন মানুষই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। কারণ দেশের কৃষি শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য, জমি-জমা, বাড়ি-ঘর, সবই তাে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সুতরাং আমি আমার বিষয় সম্পত্তি নিয়ে যে দেশ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি, সে দেশ ও রাষ্ট্র যদি শক্রর দখলে যায়, তা হলে আমার সম্পত্তির উপরে, আমার জীবন যাপনের উপরে, বিজেতার জুলুম এসে পড়বে। অতএব সেই দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব তখন আপনা থেকেই এসে পড়ে। যুদ্ধও তখন ব্যাপক হয়ে পড়ে। একদিকে দলে দলে সেনাবাহিনীতে এসে লােকে যােগ দেয়, আর একদিকে চাষি মাঠে মাঠে অতিরিক্ত চাষ করে, যােদ্ধাদের রসদ যােগায়, কলকারখানার শ্রমিক উপরি খেটে অস্ত্র-শস্ত্র তৈরি করে, কিন্তু তার চেয়ে বড় যে কাজ, সেই কাজটি হচ্ছে দেশের মধ্যে যে সব পঞ্চম বাহিনী বা বিশ্বাসঘাতকের দল আছে, যারা টাকার বিনিময়ে দেশের সর্বনাশ করে, তাদের নির্মূল করতে সাহায্য করে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে যে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, গত নয় এবং ১২ই মে তারিখে মুক্তিফৌজের গেরিলাবাহিনী রংপুরের কাছে এবং রাজশাহীতে যথাক্রমে সাতজন এবং বারাে জন মীরজাফরকে খতম করেছে। এছাড়া ওখানে কয়েকজন সমাজবিরােধীকেও হত্যা করেছে।
আরও একটি সংবাদে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে যখন একজন মুসলীম লীগ নেতা গুপ্তচরের কাজে লিপ্ত ছিল, মুক্তিফৌজের গেরিলাবাহিনী তাকেও খতম করেছে। এ সব কাজ রাজনৈতিক সচেতন গেরিলাবাহিনীর দ্বারাই সম্ভব। সুতরাং সব সময়েই মুক্তাঞ্চল এবং অধিকৃত অঞ্চল সর্বত্রই জনসাধারণের রাজনৈতিক চিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য এবং আদর্শ পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। জঙ্গীশাহী শুধু ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তাদের নৃশংসতাই সীমাবদ্ধ রাখেনি, তারা জনসাধারণের মধ্যে একটা ব্রাস সৃষ্টি করে তাদের নৈতিক বল ভেঙে দিতে চেষ্টা করছে। নিরীহ গ্রামবাসী, বুড়াে-বুড়ি, শিশু, ভিখারী এমন কি পাগলকে পর্যন্ত তারা রেহাই দিচ্ছে না। কিন্তু রাজনৈতিক সচেতন জনসাধারণের মনােবল শত্রু ভাঙতে পারে না। অজস্র মানুষের রক্ত আর চোখের জলের মধ্যে দিয়ে যে, স্বাধীন রাষ্ট্র, নতুন লােকায়ত্ত সরকারের আবির্ভাব হয়েছে, তাকে রাজনৈতিক সচেতন জনসাধারণই রক্ষা করতে পারেন।
এতদিন বর্বর পাক সেনারা এক তরফা মার দিয়েছে। হাজারে হাজারে লাখে লাখে মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্ত পার হয়ে এপার বাংলায় চলে এসেছেন, সর্বস্বান্ত হয়েছেন। সুদীর্ঘ প্রায় দু’মাস হতে চলছে, এখন জনসাধারণ বিভিন্ন রণাঙ্গনে ধীরে ধীরে সু-সংগঠিত হচ্ছেন। এবার মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে আরম্ভ হবে। পাকিস্তানি সামরিক শক্তি কিন্তু যুদ্ধের সূচনাকাল থেকেই এই দীর্ঘস্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে সচেতন। সেইজন্য তারা ত্রাস সৃষ্টির জন্য নিরস্ত্র জনসাধারণকে হত্যা করেছে, কলকারখানা বাড়িঘর ধ্বংস করেছে, তেমনি নজর রেখেছে কোথাও যেন সশস্ত্র গেরিলাবাহিনী দানা বাঁধতে না পারে কিন্তু গেরিলাযুদ্ধ যত ব্যাপক এবং তীব্র হবে, জঙ্গীশাহীর বেতনভুক্ত বর্বর সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের ধার তত বেশি ভোতা হয়ে যাবে।
সূত্র: কম্পাস, ৫ই জুন ১৯৭১