নববর্ষের নতুন দিগন্ত
নববর্ষের প্রথম দিন থেকেই হাজারে হাজারে আশ্রয় প্রার্থীরা বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছেন। তাদের যাত্রা শুভ হােক। এই শুভযাত্রাই বাংলাদেশের পুণ্যাহ বলে ইতিহাসে লিখিত হােক। দেশ ভাগ হবার পর থেকেই বারে বারে হাজারে হাজারে কখনাে কখনাে লক্ষে লক্ষে এই ছিন্নমূল মানুষের নিষ্ঠুর পারাপার যা এ যাবৎ দেখে এসেছি, তা চিরকালের জন্য যেন শেষ হয়। যে অন্যায় ও সুবিধাবাদী রাজনীতির ফলে নিরপরাধ জনসাধারণ বিনাদোষে এভাবে কঠিন নির্যাতন ভােগ করেছে সেই রাজনীতিরও যেন অবসান হয়। আজ ভারত সরকার ও বাংলাদেশের সরকার মিলিতভাবে এই ঐতিহাসিক ব্যভিচারের সংশােধন করছেন। রাজনৈতিক দল ও কর্মীদেরও একাজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মনপ্রাণ দিয়ে সাহায্য করা উচিত। দেশে ফিরে গিয়ে পুনর্জীবন স্থাপন করতে যাতে তারা মনােবল পান, সকল সংশয়, সকল ভয় দূর করার সাহস পান তার জন্য আমাদের সকলকেই উদ্যোগী হওয়া দরকার। এই মুহূর্তে সকলের সামনে এর চেয়ে কোনাে আশু প্রয়ােজনীয় কর্তব্য নেই।
বাংলাদেশ বলে যে নবীন স্বাধীন গণতান্ত্রিক সেকুলার ও সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্ম হলাে তার সততা ও লক্ষ্যের কষ্টিপাথর হলাে, এই মুহূর্তে, এই এক কোটি শরণার্থীদের সাদরে গ্রহণ ও পুনর্বাসন। এই টেস্ট বা পরীক্ষা তাকে দিতেই হবে। সাড়ে সাতকোটি বাঙালির এই দেশ জগত সভায় নতুন এক আশার বাণী নিয়ে সর্বত্র সমাদৃত হবে কিনা তার প্রমাণ এখুনি তাকে দিতে হবে। তাদের নব লব্ধ স্বাধীনতার মঙ্গল প্রভাতে যদি এই টেস্ট তারা পার হতে পারেন, তবে পৃথিবীর অকুণ্ঠ আর্শীবাদ তাদের মাথার উপরে অঝােরে ঝরে পড়বে সন্দেহ নেই। যদিও কাজটি সামান্য নয়, যদিও দেশের পুনর্গঠন ও পুনঃস্থাপনের বৃহত্তর সমস্যার সঙ্গে এই শরণার্থীদের পুনর্বাসন কর্মকাণ্ড ওতপ্রােতভাবে জড়িত, তবু এই কাজটিকে একটি প্রক্ষিপ্ত বা অবাঞ্ছিত একটি দায় বলে মনে করলে চলবে না। এই পুনর্বাসনের কাজে ভারতকেও মুক্তহস্তে সাহায্য করতে হবে। যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতাে, তবে ভারতকে তাে বরাবরের মতাে এই এক কোটি লােককে এদেশেই বসাতে হতাে। তা যেমন হতাে শতগুণ শক্ত কাজ, তেমনি শতগুণ অসম্ভব কাজ, কেননা ইতিপূর্বে বারে বারে যত শরণার্থী এসেছিল তাদের অনেকেই হয়তাে কয়েক লক্ষ আজ এত বছরেও এদেশে পুনর্বাসন পাননি। বাংলাদেশেই তাদের পুনর্বাসন করা ভারতের পক্ষে অনেক কম খরচ সাপেক্ষ, এবং অনেক বেশি স্বাভাবিক ও সহজ। সুখের বিষয় শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কাজে সাহায্য করার জন্য সােভিয়েত রাশিয়াও অগ্রসর হচ্ছেন, অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলােও ক্রমশ এগিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।
ভারত ও অন্যান্য দেশ অকাতরে সাহায্য করতে এলেও, আসল কাজ বা দায়িত্বটা বাংলাদেশের সরকার ও বাংলাদেশের জনসাধারণেরই। পৃথিবীর এই সমস্যাটা যেন বাংলাদেশকে পরমুখাপেক্ষী করে না তােলে, বাইরে থেকে টাকা পয়সা পাবার সহজ লােভে চরিত্রভ্রষ্ট না করে দেয়। কেননা আমরা এদেশেও দেখেছি, কীভাবে এই জাতীয় সাহায্য বা রিলিফের টাকা নিয়ে একদল দুর্নীতিবাজদের অবাধ ব্যবসাবাণিজ্য চলে। কারাে চৈত্র মাস কারাে পৌষ মাসে পরিণত হয়। গােটা জাতিকে এবং শরণার্থীদেরও ভিক্ষুকে বা ভিক্ষাজীবীতে পরিণত করে। বিজয়উৎসবের ঢক্কা নিনাদের সময় আমরা যেন সকলেই আমাদের চারিত্রিক দুর্বলতার দিক খেয়াল রাখি।
শরণার্থীদের মনােবল ও অভয় মনােভাব ফেরাবার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই কয়েকটি উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন। যে সমস্ত মন্দির, মঠ, আশ্রম, মসজিদ ও গির্জাঘর বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল পাক-বাহিনী ও তার অনুচরেরা, তার পুনঃস্থাপন করার হুকুম দিয়েছেন। এর একটা সাইকোলজিকাল বা মানসিক সুস্থতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনার দিক আছে। যাদের বাড়িঘর জমি জেরাত দখল করে নেওয়া হয়েছিল তা অবিলম্বে ফিরিয়ে দেবার হুকুম হয়েছে। লুটের মাল অবিলম্বে হাজির করতে বলা হয়েছে, এবং তার জন্য তল্লাসি শুরু করে দিয়েছেন মুক্তিবাহিনী। ইদানীংকালে যে সমস্ত সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছে, দলিল সৃষ্টি করে, তা অসিদ্ধ বলে ঘােষিত হয়েছে। তদুপরি যে সমস্ত রাজাকার ও আলবদরের দল এই সব মারপিট খুন জখম ও অগ্নিসংযােগ করেছে, লুটের ভাগ নিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, বন্দি করা হচ্ছে। এই সব খুনী ও লুটেরারা সেদিন পাকবাহিনীর জোরে সে সব অপকর্ম বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যেই করে বেড়াতাে, কাজেই তাদের চিনতে কারাে কোনাে অসুবিধা নেই। শেষ পর্যন্ত তাদের কী সাজা দেওয়া হবে, সাজা লঘু অথবা শুরু হবে কিনা সে কথা পরে হবে, কিন্তু দোষীদের চিহ্নিত করতেই হবে। তারা যাতে রাতারাতি আবার দেশপ্রেমিক হয়ে না পড়তে পারে, নতুন ব্যবস্থায় ঠাই করে না নিতে পারে তা দেখতে হবে। ভারতও কি আমরা দেখিনি কেমন করে ইংরেজদের খয়ের খারা রাতারাতি দেশপ্রেমিক হয়ে দেশ শাসনের ভারটা তারাই নিয়ে নিয়েছিল। আশা করি নবলব্ধ স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরীরা বাংলাদেশে এই ভুল হতে দেবেন না।
কিন্তু শরণার্থীদের গ্রহণ ও পুনর্বাসনটাই আজ বাংলাদেশের প্রধান কাজ নয়, যদিও প্রথম পদক্ষেপ। গােটা জাতটার পুনর্বাসনের বৃহত্তর কর্তব্য তার দুয়ারে উপস্থিত। তার শিল্প বাণিজ্য, রাস্তাঘাট, চাষবাস সব কিছু তছনছ হয়ে আছে। কোটি কোটি লােক দেশের ভিতরেই প্রায় ছিন্নমূল ও বৃত্তিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এই সার্বিক বা টোটাল ধ্বংসস্তুপ আবার সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থায় আনবার বৃহত্তম চ্যালেঞ্জটি আজ উপস্থিত। এই বৃহত্তম কর্মকাণ্ডটি দুর্জয় সাহস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। নইলে শরণার্থীদের সত্যিকার পুনর্বাসনও হতে পারে না। যে সমাজ ব্যবস্থায় অনবরত লােক বৃত্তিহীন কর্মহীন বেকারে পরিণত হয়, দারিদ্র ও অনাচার অত্যাচারে দেশের বেশির ভাগ লােক অনবরত ছিন্নমূল হচ্ছে, তার গােড়াতেই আঘাত করতে হবে। স্বাধীনতা কিছুই নয়, যদি সে বিপ্লব সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত হয়। কেমন করে সেই নবীন জীবনের যাত্রারম্ভ হবে, সেই দৃশ্য দেখার জন্য আমরা আজ সবাই উদগ্রীব ও উনুখ।
দশ পনের লক্ষ লােকের প্রাণহানি ও কোটি কোটি লােকের সর্বনাশ হবার পরে সহসা মানুষ প্রথমে হতচকিত ও বিবশ হয়ে পড়লেও সে আঘাতের ঘাের থেকে বাংলার যুবমানস আবার সম্বিত ফিরে পাচ্ছে বলেই মনে হয়। এই বিস্ফোরণের তাৎপর্য কি ও ঐতিহাসিক নির্দেশ কী তা এখন সবচেয়ে আলােচ্য ও বিবেচ্য বিষয় বলে মনে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় আশা ও ভরসা বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব সমাজ—তারা অকাতরে প্রাণ দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী চিরন্তন প্রাণের যাদুস্পর্শ পেয়েছেন। তারা এবারে দিকে দিগন্তরে গ্রামে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ন। এই বিস্ফোরণে যে শক্তি উদ্ভাসিত হয়েছে, সেই শক্তিই তাদের শক্ত করবে সন্দেহ নেই, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একটা বলিষ্ঠ অভিযান গঠন মূলক অভিযানের দিকে ধাবিত করবে।
হাজার টাকা বেশি কারাে বেতন হবে না, কি সরকারি কি বেসরকারি ব্যবসায়ী কোনাে প্রতিষ্ঠানে, এই নির্দেশ যেন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়, বেতনের সাথে উপরির পথ যেন একদম বন্ধ করতে পারেন মুক্তিবাহিনী ও নওজোয়ানেরা। দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরা যেন সৃষ্ট হয়। আমরা জানি ও দেখেছি কেমন করে সকল আইন সকল সরকারী শুভেচ্ছাকে তলে তলে ফাক করে দেয়, ঘুষখােরেরা, দুর্নীতিবাজরা। উঠতি বা ডেভলপিং জাতি সমূহের মেরুদণ্ডে ঘুণ ধরিয়ে দেয় ঘুষবাজী পারমিট লাইসেন্স রাজ। কন্ট্রাকটারের স্বর্গে পরিণত না হয় যেন বাংলাদেশ। নরম রাষ্ট্র বা Soft Govt এর ট্রেডিশান যেন তৈরি না হয়। একটা শাণিত উদ্যত খড়গের মতাে সদা জাগ্রত যুব চেতনা যেন বাংলাদেশকে দুর্নীতিবাজদের হাত থেকে রক্ষা করে।
ব্যাঙ্ক, পাটশিল্প, চা বাগান, পাট ও চায়ের ব্যবসা, কাগজকল, সিমেন্ট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলােকে অবিলম্বে রাস্টায়ত্ করার পথ নিয়েছেন বাংলাদেশ সরকার। এ কাজ করতে তাদের কোনােই অসুবিধা হয়নি। কেননা এগুলাের মালিকানার প্রায় সবটাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। বাংলাদেশকে লুটেপুটে ইতিপূর্বে যা তারা নিয়ে গেছে তাে গেছে, কিন্তু যা পড়ে আছে তা এক্ষুণি রাষ্ট্রায়ত্ত করে নিলে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পথের পাথেয়ও মন্দ হবে না। গােটা দেশের অর্থনৈতিক কমান্ডিং ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে হস্তগত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এইসব জাতীয়কৃত ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও বাণিজ্যের কর্মকাণ্ডটি যেন ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের স্বর্গরাজ্য হয়ে না পড়ে, যেমন পড়েছে ভারতে। এখানে জাগ্রত যুবশক্তির কাছে আমরা অনেক কিছু আশা করি। প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যেন আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, কোথাও ফাকি না থাকে। কাজ করার জন্য যেন একটা উদগ্র আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ভারতের মতাে কাজ না করে মাহিনা মাগগি ভাতার দাবিকে প্রগতি বলে ধুয়াে না তােলা হয়। কাজে ফাঁকিবাজদের যেন ঘুষখােরদের মতােই সাজা দেওয়া হয়।
সৃজনশীল চিন্তা ও কর্মপ্রচেষ্টার এতবড় অপূর্ব সুযােগ যেন নষ্ট না হয়। এই বিরাট বৈপ্লবিক গঠনপর্বে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সক্রিয় সহযােগিতা ও সক্রিয় চিন্তাচেতনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বাংলাভাষাকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ও সর্বজনীন সহযােগিতার একটি প্রধান পদক্ষেপ বলে মনে করি। একদিন বাংলাভাষার দাবি নিয়েই এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। আজ স্বাধীনতা এল বলে বাংলাভাষার প্রয়ােজনটা যেন উবে না যায়। ইংরেজি এসে যেন স্বাধীনতা সঙ্কীর্ণ ও মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীদের কুক্ষিগত সম্পত্তি না হয়ে পড়ে। উর্দুর বদলে ইংরেজির স্থান যেন অপ্রতিহত না হয়। ইংরেজি না ব্যবহার করলে জাতির শিক্ষা দীক্ষার মানটা পিছিয়ে পড়বে এমন মনে করার কোনাে কারণ নেই। যদি একটু পিছিয়েও যেতে হয় তবু এ পেছানাে নয়, পশ্চাদবর্তী বা পিছিয়ে পড়া জনগণের সঙ্গে ঐক্য স্থাপন ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সামগ্রিক অগ্রগমনের জন্য আজ বাংলাভাষাকেই একমাত্র ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা দরকার। তাতে বাংলা ভাষার দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা দশ বছরেরই দূর হয়ে যাবে এবং অগ্রগামী ইউরােপীয় ভাষার সঙ্গে সমপর্যায়ে এসে যাবে। জাপানিরা, রুশিয়রা যদি তাদের নিজ নিজ ভাষাতেই এত বড় জাত হতে পারে, কেন বাঙালিরা বাংলা ভাষার সাহায্যেই প্রথম শ্রেণীর একটি জাতি হতে পারবে না? জনসাধারণের সক্রিয় সহযােগিতা, সমাজ ও দেশগঠনের ব্যাপারে, রাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের একমাত্র পথ আজ বাংলাভাষাকেই আশ্রয় করা। মুষ্টিমেয় মেধাবী গবেষকরা যে কোনাে ভাষায় গবেষণা কাজ করেন করুন, কিন্তু আজ সমস্যাটা মুষ্টিমেয়দের নয়, জনসাধারণের। কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটিই এখানে বড় কথা। শিল্প বাণিজ্যির উৎপাদনই হােক, আর শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারেই হােক কোয়ান্টিটেটিভ দাবি ও প্রয়ােজনটাই সব চেয়ে বড় কথা। সৌখিন বিলাসিতার পণ্য তৈরি নয়, মােটা ভাত কাপড় ও কাজ চাই সকলের জন্য যেমনি, তেমনি মাতৃভাষায় সকলের জন্য শিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূর করাই চাই, গুটিকয়েক ডকটরেট বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি করা নয়। তাছাড়া আজকের বাংলাদেশের সরকার ও নব জাগ্রত যুব সমাজ জনগণের মধ্যে যে ফাঁক বা গ্যাপগুলাে আছে তা সত্বর পূরণ করে দেবার একটি মাত্রই মিডিয়াম আছে সে হলাে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাভাষার ব্যবহার। এর ফলে যত বড় ডেমক্রেটিজেসন বা গণতান্ত্রিক হবে সমাজ, পঞ্চাশটা সাধারণ নির্বাচন করেও তা হবে না। নব জাগ্রত জনসাধারণের সৃজনশীল প্রতিভারও মুক্তি মিলবে এই পথে বাংলা ভাষার পথে। সমগ্র জাতি ও তার জনসাধারণ জাগবে।
পরিকল্পিত উপায়ে দেশ ও সমাজ গঠনের উদ্যোগের ক্ষেত্র কত বিরাট ও কত গভীর। গােটা বাংলাদেশের জন্য যেমন অবিলম্বে চাই একটি প্ল্যানিং কমিশন, তেমনি প্রতিটি জেলা ও প্রতিটি গ্রামের জন্যই চাই প্ল্যানিং সেল। ভারতের মতাে যেন ভুল না করা হয় একটিই মাত্র প্ল্যানিং কমিশন যেখানে সর্ব ভারতের জন্য পরিকল্পনা রচনা করেন যার সঙ্গে নিচের দিকের কোনাে সংযােগ ও সহযােগিতা নেই। উপর ও নিচ থেকে একই সঙ্গে সক্রিয় পরিকল্পনা পরিষদ চাই এবং সে সব পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডকে বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর করার জন্য স্টেটুটারি স্যাংসান থাকা দরকার। নিচে থেকে এই পরিকল্পনাগুলাে জনসাধারণ নিজেরাই করবেন, নিজেদের ভাষায়, নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এ জাতীয় পরিকল্পনা কার্যকর করার প্রেরণাও তখন জনসাধারণের স্বাভাবিকভাবেই আসবে। কোনাে সিদ্ধান্তই কাগজে আর ফাইলে আবদ্ধ হয়ে থাকবে না।
শরণার্থী পুনর্বাসনের সাথে সাথে দেশের বর্তমান শিল্প-বাণিজ্যের পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডটির কাজ চলতে থাকাকালে, বাংলাদেশের বৃহত্তম দিগন্তের দিকেও দৃষ্টি প্রসারিত করা দরকার। দেশভাগের পরে, পূর্ব পাকিস্তানকে তার স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এতকাল পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করার ফলে তার প্রতিবেশী দেশ ভারত ও ব্রহ্মদেশ এর সাহচর্য থেকে বঞ্চিত করা হয়। একটা বিকৃত বা ডিসটরটেড অর্থনীতি গড়ে তােলার চেষ্টা হয়। এর ফলে এই অঞ্চলের ঔপনিবেশিক অধীনতার চরিত্র বেড়ে যায়, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানি অর্থনীতিরই শুধু লেজুড় হয়ে পড়ে তা নয়, ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবও বেড়ে যায়। পূর্ব ভারত ও ব্রহ্মদেশের স্বাভাবিক অগ্রগতিরও বিঘ্ন ঘটে। এর সামগ্রিক ফলশ্রুতি হলাে সমগ্র পূর্বদেশের অবরুদ্ধ ও বিকৃত অধােগতি যার জন্য সমগ্র পূর্বভারত অপেক্ষাকৃতভাবে পিছিয়ে পড়তে থাকে। একটা ক্রনিক অবক্ষয় ও অসন্তোষের ও হতােদ্যমের ক্ষেত্র হয়ে পড়ে যার জন্য আজ বাঙালিকে সবাই দোষ দেয়। কিন্তু আজ পূর্বদেশের পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পর সহযােগিতার যে এক অপূর্ব সুযােগ পেতে চলেছে, তার দিগন্তপ্রসারী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নবীন নেতৃত্বের দৃষ্টিপাত হােক। আগামী বিশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলটি পৃথিবীর একটি অতি উন্নতিশীল অগ্রগামী অঞ্চল হয়ে ওঠো খুবই স্বাভাবিক। টোকিও থেকে কাইরাে পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগে কলিকাতা হলদিয়া চট্টগ্রাম চালনা ঢাকাকে কেন্দ্র করে এই শিল্প বাণিজ্যের বিস্তৃত ক্ষেত্রটি এমন একটি জাগ্রত কর্মকাত্রে বেগ হবে যার কোনাে তুলনা নেই। মালয়, ইন্দোনেশিয়া, ব্রহ্মদেশ, ইন্দোচীন, এই সব দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের শিল্প বাণিজ্যের একটি প্রধান উৎসমুখ ও যােগাযােগ কেন্দ্র হবে এই পূর্বদেশ। কলিকাতা, আসাম, বাংলাদেশের মধ্যকার নাব্য নদী নালা ও পুনর্গঠিত রেল ও রাস্তাব্যবস্থা এই দুই দেশের শিল্প কেন্দ্রগুলােকে একটা স্বাভাবিক স্বয়ংসম্পূর্ণ পরস্পর নির্ভরশীল যােগাযােগ ব্যবস্থা সৃষ্টি করবে সেগুলাে সমবেতভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সমুদ্র পথ ও সমৃদ্ধির পথ খুলে দেবে। যে ক্রনিক ডিপ্রেসন আজ পূর্ব ভারতকে একটা ভিক্ষুকের ও দরিদ্রের অঞ্চলে পরিণত করেছে তা অদূর ভবিষ্যতে একটি বিরাট কর্মক্ষেত্র ও সৃষ্টিধর্মী প্রতিভার সীমাহীন ক্ষেত্র রচনা করে দেবে। এই বিরাট ও দিগন্তপ্রসারী সুন্দর ভবিষ্যতের কথা যদি আজকের নবীন যুব সমাজের চোখের সামনে ধরে না দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ নামক যে নতুন সূর্যের উদয় হলাে তার পরিপূর্ণ তাৎপর্য বােঝাতে সক্ষম হবাে না। এবং এটা কোনাে স্বপ্ন নয় এটাই এই যুগের ভিসান বা লক্ষ্য। আঞ্চলিক কূপমণ্ডুকতা ও কৃপণদৃষ্টিভঙ্গিতে যদি আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়ি তবে দেখা যাবে যে অদূর ভবিষ্যতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আজ যে সৌহার্দ্যের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে তা নষ্ট হয়ে গিয়ে বিরােধ ও হতাশায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র: কম্পাস, ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২