You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.11 | বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান

৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। এক ঐতিহাসিক ঘােষণা প্রচারিত হলাে ভারত সংসদে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জানালেন, এই উপমহাদেশে আর এক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটল নাম তার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নতুন সরকার হবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এ দেশ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক।
সঙ্গে সঙ্গে আর এক সংবাদ এল ঐ একই দিনে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এই সর্বপ্রথম পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল। এর আগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কত মন কষাকষি, কত বাদানুবাদ, এমনি কি ১৯৬৫ সালে যুদ্ধও হয়েছে। তবুও পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কথা ভাবেনি। কিন্তু, আজ বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান অভিযােগ করল, ঐ স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারটা মূলত পাকিস্তানের প্রতি ভারতের বিদ্বেষপ্রসূত-পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্যই ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
একই দিনে এ দুটি ঘটনার তাৎপর্য অনুধাবন করলে দেখা যায় দুটি চিত্র একদিকে নবজন্ম, আর একদিকে মহামৃত্যু। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের বিলয় চূড়ান্ত হয়ে উঠল। পাকিস্তান এখন মৃত। অবশ্য পাকিস্তানের বিলােপের পালা এ বছর ২৫ শে মার্চ তারিখেই শুরু হয়েছিল যে দিন পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সমস্ত আশা ও আকাভাকে নস্যাৎ করে দিয়ে ও গণতন্ত্রের সমাধি ঘটিয়ে অসহায় ও নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর নির্বিচারে অত্যাচার চালিয়েছিল, যেদিন রাতের অন্ধকারে সমস্ত রকম আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের জাতিধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে মেরে ফেলার এক ঘৃণ্য চক্রান্ত হয়েছিল আর যে চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ড। ঐ হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিবরণ আজও আমাদের অজানা। তবে যে দিন ঐ বিবরণ উদঘাটিত হবে, সেদিন জানা যাবে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ২২টি পরিবার (ধনিক-বণিক গােষ্ঠী) জঙ্গী শাহীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে ধূলিসাৎ করে দিতে।
তবে এটাও ঠিক যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারতকে দীর্ঘ আট মাস কাল বহু ভাবনা, বহু চিন্তা করতে হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হলাে, ২৪শে এপ্রিল তারিখেই বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে চেয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নৈতিক সমর্থন। সেদিন ভারত নৈতিক সমর্থন দেওয়ার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি। ভারতের ধারণা হয়েছিল, তড়িঘড়ি কিছু করে বসলে, পাকিস্তান বলবে, ভারত তার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে। তাই ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশের ব্যাপারে একটা রাজনৈতিক সমাধান আর এক কোটি শরণার্থী মানুষের স্বদেশে পুনর্বাসন। কিন্তু ভারত যখন দেখল বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রগুলাে তাকেই অভিযুক্ত করছে বাংলাদেশের ব্যাপারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের কথাটা কেউই ভাবছে না, কেউই বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে আমল দিতে চাইছে না, তখনই ভারতকে অন্য ধারায় ভাবনা শুরু করতে হলাে।
তাই বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘােষণা করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জানালেন প্রথমত বাংলাদেশের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান ব্যর্থ হওয়ায়, দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের জনসাধারণকে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার ও ভারতের জনসাধারণকে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কারণে উভয় দেশের সাধারণ মানুষ একই আদর্শের সামিল হওয়ায়, তৃতীয়ত বাংলাদেশ সরকার সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধ্যানধারণার ধারক ও বাহক হওয়ায়, এবং চতুর্থত বাংলাদেশের মানুষ “জননী ভূমি” পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করায় ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাছাড়া পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করায় ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী একই আদর্শের ও লক্ষ্যের সামিল হয়ে পড়ায়, বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সরকারের মধ্যে সুদৃঢ় বন্ধন স্থাপনের একান্ত প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে। ত দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এখন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগে তার সৈন্যবাহিনীকে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে একযােগে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে কাজ করতে দিতে পারবে এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ড হতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে উৎসাদনের কাজ ত্বরান্বিত করতে পারবে।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় বিশ্বের অপরাপর রাষ্ট্রে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। বিশেষত পাকিস্তানের সমর্থক রাষ্ট্র গােষ্ঠী ব্যাপারটাকে সুনজরে দেখবে না। তবে এটা ঠিক যে ভারতের পূর্ব সীমান্তে শান্তি ও নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য এবং বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের আশা আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করে একটা জাতীয় মুক্তি অভিযানকে সার্থক ও সফল করার জন্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারত সরকার শুধু যে এক মহান জাতির স্বপ্ন সাধনাকেই স্বীকৃতি দিলেন তা নয়, বিশ্বের আর একটি কোণে গণতান্ত্রিক সমাজবাদ প্রতিষ্ঠিত হবারও স্বীকৃতি পেলাে।
তাই আমাদের বক্তব্য, ৬ই ডিসেম্বর একই লগ্নে দুটি ব্যাপার ঘটলাে। একদিকে নবীন এক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় বহু অত্যাচার, বহু অনাচার, বহু অবিচারের ও মৃত্যুমানের মধ্যে দিয়ে। আর অপর দিকে পুরােনাে দিনের বস্তাপচা ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক এক রাষ্ট্রের আসন্ন অবসান। একদিকে জন্মলগ্নের কান্না, অপরদিকে মৃত্যু যন্ত্রণা।
এর মাঝে আর এক বিচিত্র চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রগুলাে বিচিত্র মনােভাব নিয়েছে রাষ্ট্রসংঘের স্বস্তি পরিষদে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানকে অস্ত্রসংবরণ ও সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে ৫ই ডিসেম্বর। তবে রাশিয়া ঐ প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণ করে ভেটো দেওয়ায় স্বস্তি পরিষদে মার্কিন প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। ৬ই ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মদদ পেয়ে ৮টি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানকে সমসূত্রে গেঁথে উভয়কে যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্যাপসরণের জন্য আহ্বান করে। এবারও সােভিয়েট রাশিয়ার ভেটো প্রয়ােগের ফলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। অপর পক্ষে বাংলাদেশ নিয়ে রাশিয়াও একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। এ প্রস্তাবের মর্মার্থ হলাে, পাকবাহিনীর আক্রমণের ফলেই ভারত-উপমহাদেশে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। এমতাবস্থায়, ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলার আগে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে এবং বাংলাদেশে পাক হানাদারদের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। রাশিয়ার প্রস্তাবও স্বস্তিপরিষদে ভােটের জোরে বাতিল হয়ে যায়। রাশিয়ার প্রস্তাবটির সমর্থক ছিল শুধুমাত্র একটি দেশ পােল্যান্ড।
রাষ্ট্রসংঘের নবীনতম সদস্য-রাষ্ট্র ও ‘এশিয়ার সূর্য চীনের ব্যবহার কৌতুকপ্রদ। চীন যে শুধু রাশিয়ার প্রস্তাবের বিপক্ষে ভােট দিয়েছে তা নয়, চীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করে মার্কিন প্রস্তাবে সায় দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের মূল সমস্যাটাকে এড়িয়ে গেছে। চীন বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাকামী আন্দোলন হিসেবে গণ্য করে ভারত-পাকিস্তানকে একসূত্রে গেঁথেছে। এমন কি বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিকে স্বস্তি পরিষদের বিতর্কে অংশ গ্রহণের সুযােগ দেওয়ার জন্য রাশিয়া যে প্রস্তাব দিয়েছিল, চীন তাতেও আপত্তি জানিয়েছে। চীনের অভিমত এ ব্যাপার ঘটলে রাষ্ট্রসংঘ একটি সদস্য রাষ্ট্রের ঘরােয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে। অবশ্য, বাংলাদেশের ব্যাপারে চীন যে যুক্তি দিয়েছে তা নতুন কিছু নয়। চীনের যুক্তি বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই যুক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐ একই যুক্তির সূত্র ধরে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিধনপর্বের ছবি ছাপিয়েছে এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে ভিক্ষে দেওয়ার জন্য নানা সংঘ, সমিতি ইত্যাদি গড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ যখন পাকিস্তানি হানাদারদের বেয়নেটের খোঁচায় রক্তাক্ত হচ্ছিল, তখন একটা কথাও বলেনি। সেদিন বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের কথা সােভিয়েট রাশিয়া, পােল্যান্ড, যুগােশ্লাভিয়া, পূর্ব জার্মান সরকার, চেকেশ্লোভাকিয়া ছাড়া আর বিশেষ কোনাে রাষ্ট্র বিশেষ কিছু বলেনি। শরণার্থীর জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করে সব কর্তব্য পালন করেছে আর ভারতের ঘাড়ে সব বােঝা চাপিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের জঙ্গী শাহীকে মদদ জুগিয়েছে।
তবে যে যাই বলুক না কেন ইতিহাস তার আপন গতিতে চলবেই। ইতিহাসের যাত্রাপথকে কেউ অবরুদ্ধ করে রাখতে পারবে না। কোনাে ইজ’ দিয়ে, কোনাে বিশ্লেষণ দিয়ে মানবজাতির গণতান্ত্রিক চাওয়া-পাওয়াকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। ভারত পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। সে ভিৎ ধ্বসে গেছে বাংলাদেশের সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে। এখন পাকিস্তানের পশ্চিম দিককার ভিৎও ভেঙে পড়বে বেলুচিস্ত নে, সিন্ধুতে, পাখতুনিস্তানে। বিচ্ছিন্নতাবাদকে রােখার নাম করে বিশ্বের পুঁজিবাদী ও অতি সাম্যবাদী কোনাে রাষ্ট্রই পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক ভিৎকে কংক্রিট-ভিৎ করে তুলতে পারবে না। আমরা জানি, অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের ঐ সব অঞ্চলেও বাংলাদেশের মতাে মুক্তি বাহিনী গড়ে উঠবে। আর ভারতকেও প্রস্তুত থাকতে হবে ঐ সব মুক্তিকামীদের মদৎ যােগাবার জন্য।

সূত্র: কম্পাস, ১১ই ডিসেম্বর ১৯৭১