বন্যার গ্রাস
এবারের বন্যায় এক পশ্চিমবঙ্গেই, সরকারি হিসেব মতেই, একশ’ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। একমাত্র মালদহ জেলাতেই মানুষ মরেছে দুই শত, আর গৃহপালিত পশুপাখি মরেছে কত তার হিসেব এখনাে হয়নি। বস্তৃত হিসেব নেওয়াও সম্ভব নয়। বিস্তৃত অঞ্চল এখনও বাইরের জগতের সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। একশ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতিটা কেবলমাত্র মাঠের দাঁড়ানাে ফসলের ক্ষয়ের খতিয়ান। আর বাড়িঘর ও সম্পত্তির ক্ষতি কত হয়েছে। হয়তাে কয়েকশ’ কোটির। কেবল পশ্চিম বাংলাতেই নয়, উত্তর প্রদেশের বিস্তৃত অঞ্চলে অনুরূপ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কেবল আমাদের দেশেই নয়, এই বিপুল জলরাশি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বা পূর্ব বাংলাতেই গিয়ে পড়ে। ইতিমধ্যেই সেখানকার আটটি জেলা নাকি ডুবে গেছে। এখানে তবু একটা সরকার আছে। সেখানে জনসাধারণের জন্য ভাববে এমন কোনাে সরকার নেই। আছে সেখানে খানসেনারা—দস্যর দল। তারা হয়তাে আক্কেল দেখছে। মুক্তিবাহিনী সেখানে বিস্তৃত অঞ্চলে অনেকটা ক্ষমতা হয়তাে বাড়িয়ে নিচ্ছে, সরেযাওয়া খান সেনাদের অঞ্চলগুলাে হয়তাে এখন মুক্তিবাহিনীর হাতে। কিন্তু সেখানেও এখন খান সেনারাই একমাত্র শত্রু নয়। বন্যাও শত্রু। বানবন্যা প্লাবনে সেখানকার কোটি কোটি মানুষের যে দুর্গতি তার জন্য দুঃখ করবে না ইয়াহিয়া খান। তাদের জন্য ভাবতে হবে বাংলাদেশের অস্থায়ী স্বাধীন সরকার ও তার মুক্তিবাহিনীকেই। বাংলাদেশের সরকারের বন্ধু হিসেবে ভারতকেও হয়তাে ভাবতে হবে। আমরা ভাবতে পারি, কিন্তু কিছুই করতে পারি না, মুক্তিবাহিনী ও সেখানকার বন্যা ত্রাণের কাজ সামান্যই করতে পারে। শরণার্থীর ঢল হয়তাে বন্যা পেরিয়ে এখন আর তেমন বেগে ভারতে এসে উঠতে পারছে না। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলায় অভাব অনটন দুর্ভিক্ষের আকারে উপস্থিত হবে। দুর্ভিক্ষের তাড়নায় এই বন্যার পরেই আবার শরণার্থীরা লক্ষে লক্ষে আসতে থাকবে।
মােটকথা পশ্চিমবাংলাকে কেবল তার নিজের বন্যাবিধ্বস্ত জেলাগুলাের সমস্যাই বিপন্ন করে তুলছে না, পূর্ববাংলার বন্যাজনিত দুর্ভোগেরও বােঝাও বইতে হবে।
এতবড় বন্যা গত ৩০/৪০ বছরের মধ্যে আসেনি কাজেই যা হােক করে কোনাে প্রকারে এ ধাক্কাটা সামলে নিলে আবার আমরা ৩০/৪০ বছরের মতাে নিশ্চিন্ত হববা এ জাতীয় কথাবার্তা এখনই কর্তৃপক্ষ থেকে শুনতে পাবাে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয়। প্রতিবছর আমরা উত্তরােত্তর বেশি করে বন্যাপীড়িত হচ্ছি। তার কারণ মৌলিক। নদীগুলাে পলিতে ভরে যাচ্ছে জল বয়ে যাবার পথ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে বলেই, স্বাভাবিক বৃষ্টিতে অস্বাভাবিক প্লাবন ঘটায়। তবুও এক সঙ্গে সবদিক থেকে প্লাবন আসে না। এবারে যদি একই সঙ্গে উত্তরপূর্ব সীমান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বান আসতাে, যদি দামােদর ও অজয়ের ক্যচমেন্ট এরিয়াতেও অধিকবৃষ্টি হতাে—তবে কী হতাে? উত্তর ভারতের বৃষ্টিপাতে গঙ্গা থেকে যে জল এসে পড়েছে, বিহারকে ভাসিয়ে, তার চোটেই আমরা প্রায় ডুবু ডুবু। সব দিক থেকে জল এলে আর রক্ষা ছিল না। সারা পশ্চিমবাংলা ও পূর্ববাংলা একদম ডুবে যেতাে।
এই ধাক্কাটা আমাদের নড়বড়ে সরকার ও সংঘবদ্ধ (unorganised) জনসাধারণ কী ভাবে সামলাবে? সামলাবে ছাই, হাজার হাজার লােক মরবে, লক্ষ লক্ষ লােকের ঘরসংসার ধ্বসে যাবে, অর্থনৈতিক দুর্গতি কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তারপর সরকার এসব কথা ভুলে যাবে, খবরের কাগজগুলােও ভুলে যাবে, অথবা অন্য কোনাে সমস্যা নিয়ে পড়বে, কেননা সমস্যাতে আমাদের লেগেই আছে। রাজনৈতিক সমস্যাতাে আছেই। এই বন্যায় আমাদের নােংরা রাজনীতিকেতাে ধুয়ে মুছে নিয়ে যেতে পারবে না। যেই বন্যার জল নেবে যাবে, দেখতে পাবাে, আমরা রাজনীতি নিয়ে, নির্বাচন নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। বন্যাবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের জন্য আমাদের অবশিষ্ট কোনাে ভাবনা বা উদ্বেগ কিছু থাকবে না। বৃহত্তম ও চরম দুর্দিনও আমাদের চৈতন্য ফিরিয়ে আনে না। আত্মরক্ষা ও পুনর্গঠনের জন্য কোনাে একতাবদ্ধ অভিযান আমাদের দিয়ে সম্ভব হয় না। আমরা জোট বাঁধতে পারি, একতাবদ্ধ হতে পারি না, কোনাে সামূহিক বিপদেই। অন্যান্য বারের মতাে কোনাে রাজনৈতিক দলই বন্যার্তদের সেবার জন্য এখনও এগিয়ে আসেনি।
যা হােক, এখন আমাদের কী করা উচিত, অন্তত সেটুকু ভাবা যেতে পারে। হয়তাে এখন আবার একটি ফ্লাড কমিশন বসিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতিটা কি তার বিশ্লেষণ করা উচিত। অতীতের মান সিং (ফ্লাড কমিশনের) এর রায় ও সুপারিশগুলাের কী করা হয়েছে এবং কী কী করা হয়নি এবং তাতে কী ফল হয়েছে তা দেখা দরকার। যেমন দামােদরের ড্যামগুলাে থেকে জল ছেড়ে প্রতি বছর নিম্ন দামােদর অঞ্চলে, হুগলী ও হাওড়ায়, যে দুর্গতি ঘটায় তা কেন একটা অবশ্যম্ভাবী উপদ্রব হিসেবে মানুষ নেবে? যদি প্রতি বছরেই হাওড়া হুগলী বর্ধমানে এভাবে বন্যা হয়, তবে তাে কোনকালেই এ জেলা কটির কোনাে উন্নতি সাধন করা সম্ভব নয়। অতএব দামােদর ময়ুরাক্ষী ও কংসাবতী নদীশাসন সংক্রান্ত কাজগুলাের পুনর্মূল্যায়ন দরকার। হয়তাে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের দিয়েও করানাে দরকার। ওয়ার্লড ব্যাঙ্ক অথবা ইউ-এন-ডি-পি থেকেও বিশেষজ্ঞদের সাহায্য চাইতে পারা যায়। দেশে কি বিশেষজ্ঞ নেই? আছে। কিন্তু সরকার যাদের মনােনীত করবেন, তারা এই সরকারেরই সাফাই গাইবেন এদের ওপরে দেশের লােকের বিশ্বাস নেই। আর যদি ইউ-এন-ডি-পি বা ওয়ার্লড ব্যাঙ্কও কোনাে সুপারিশ করে, তবে তাদের কাছ থেকেও হয়তাে তার জন্য অর্থ সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।
উত্তরবঙ্গের বানবন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে মাস্টার প্ল্যান নাকি আছে বা হচ্ছে, তার কাজ দ্রুতগতিতে শুরু করে দেওয়া দরকার। আর কেন এ কাজ বছরের পর বছর নানা টালবাহানা করে শুরুই করা হয়নি। তার জন্য একটা কৈফিয়ৎ তলব ও জোর আন্দোলন সৃষ্টি করা দরকার। তিস্তা-মহানন্দা প্রকল্প কার্যকরী করার জন্য যেখান থেকে হােক অর্থ সংগ্রহ করা দরকার। এক বছরের বন্যাতেই যদি আশিকোটি টাকার মতাে ফসল নষ্ট হতে পারে, আর একশ’ কোটি টাকার মতাে ঘর-বাড়ি ও সম্পত্তি নষ্ট হতে পারে, তবে তিস্তা-মহানন্দ প্রকল্পটি কার্যকরী করতে যে ৮০৮৫ কোটি টাকা লাগবে বলে ধরা হয়েছে, তা এমন কি বেশি ধরা হয়েছে। বান বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যদি হাজার কোটি টাকার প্ল্যানও নেওয়া হয় (ব্রহ্মপুত্র শাসন সহ) তবুও তা নিতে হবে। এই কাজে পূর্ব বাংলা বা স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গেও সহযােগিতার কথা ভাবতে হবে। ফারাক্কা প্রকল্পের জন্য আর কত সময় নেওয়া হবে? ফরাক্কা প্রকল্পটি অন্তত তার রেলপথ ও তার ফিডার ক্যানালগুলােও আজ সম্পূর্ণ থাকলে উত্তর বঙ্গের এতটা দুর্দশা হতাে না, যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতাে না।
সমস্ত রাজ্যগুলাের উপর একটা ডিসিপ্লিন আনতে হবে, নদীনালা শাসনের ব্যাপারে। বিশেষ করে যে সব নদী একাধিক রাজ্যের উপর দিয়ে যায়। নদীর উৎপত্তিস্থল বা ক্যাচমেন্ট এরিয়াগুলাের উপর প্রতিটি রাজ্য এমনভাবে এক্তেয়ারী করে থাকে যে যতগুলাে ড্যাম বা জলাধার দরকার তা হতে দেয় না, তা ছাড়া নদী নিয়ে (বর্ষার সময় ছাড়া) কি কাড়াকাড়ি ও মারামারিই না সৃষ্টি হয় যেন এক একটি রাজ্য এক একটি আলাদা আলাদা পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন দেশ। এর ফলে সামগ্রিক কোনাে পরিকল্পনা নেওয়াই সম্ভব হয় না। আর কেন্দ্রীয় সরকার রাজনীতির স্বার্থে কোনাে দৃঢ় ও পক্ষপাতহীন নীতিও গ্রহণ করে না। এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
চাষি ভাইদের চিন্তা চেতনাতেও পরিবর্তন আনা দরকার। শস্য পর্যায় বা cropping pattem গুলাের চিরকেলে প্রথার পরিবর্তন করা দরকার বিশেষ করে বন্যায় স্পিলএরিয়াগুলােতে। কোনাে কোনাে বিস্তৃত অঞ্চলে বন্যার দিনে হয়তাে সত্যিই চাষ করা চলবে না, ফসল টিকবে না। সেখানে বানবন্যার অব্যহিত পরেই চাষ শুরু করতে হবে এবং বর্ষাকে বাদ দিয়েও দুটি ফসল তােলবার ব্যবস্থা নিতে হবে। তা সম্ভব যদি প্রচুর নলকূপ বসানাে লক্ষ লক্ষ অগভীর নলকূপ বসানাে হয়। সেগুলাে ডিজেল চালিত না করে বিদ্যুৎ চালিত করা দরকার তার জন্য গ্রামে গ্রামে মাঠে মাঠে বিদ্যুতের প্রসার হওয়া দরকার। বন্যার জল নেবে গেলেও যে জলটা আটকে থাকে এবং ধীরে ধীরে শুষে যায় সেগুলাে উপযুক্ত নালা ও বাঁধ করে দ্রুত বড় বড় বিদ্যুৎ চালিত পাম্প (যেমন সােনারপুর অঞ্চলে আড়া পাঞ্চে বসানাে আছে) এর সাহায্যে জলটা তুলে নদীতে ফেলে দিতে হবে যাতে সত্ত্বর আই-আর-এইট জাতীয় ধান লাগানাে সম্ভব হয়, অথবা একটা ডালের চাষ করেই পরে গমের বিস্তৃত চাষ করা চলে। এবারেও হয়তাে কয়েক কোটি টাকা মঞ্জুর হবে বন্যা প্লাবিত অঞ্চলে ডিজেল পাম্প চালিত অগভীর নলকূপের জন্য। কিন্তু এগুলাে বসাতে হবে প্ল্যান করে এবং সকল জমির সেচ করার জন্য। বলা বাহুল্য এগুলাের জন্য টাকা চাষিদের ঋণ হিসেবেই মিলবে, দান হিসেবে নয়। কিন্তু যাদের পাঁচ হাজার টাকার মতাে ঋণ নেবার শক্তি নেই বা সম্পত্তি নেই এবং এক মাঠে এক জায়গায় ৬ বিঘার মতাে জমি নেই–তারা প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এসব পায় না, পাবে না। এতটা সম্পত্তি দায়মুক্ত সম্পত্তি একত্রে এক মাঠে শতকরা ২/৩ জন চাষিরও নেই—তা ছাড়া চাষির জমি নানা মাঠে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। কাজেই খুব কম লােকেই এ সুবিধা পাবে। আমরা বলি, সবার জন্য নলকূপের ব্যবস্থা করাে। গ্রুপ করে সবাইকে নলকূপ ও পাম্প দাও। জমি দায়মুক্ত কি দায়গ্রস্ত এও দেখতে হবে না। দরকার হয় একটা ট্যাক্স ধার্য করে সবাইকে সেচ দাও। এ যদি না করা হয়, তবে কিছুই করা হবে না। কতগুলাে সুবিধাবাদী লােকই এর সুবিধা নেবে, আর লাভবান হবে অসৎ ব্যবসায়ীরা। টাকার শ্রাদ্ধ হবে অথচ কাজ হবে না।
একটা বিরাট গৃহনির্মাণ প্রকল্প নেওয়া দরকার। ইটের পাকা বাড়ি করানাে দরকার। এর জন্য কয়েকশত কোটি টাকা মঞ্জুর করা হােক। এতে প্রচুর কাজও সৃষ্টি হবে নানা ধরনের বেকার সমস্যার সমাধানও হবে। যে Rural Programme for Employment এর স্কিম ভারত সরকার নিচ্ছেন, তার জন্য কাজ কোথায় তা অনুসন্ধান করতে হবে না। গ্রামে পাকা বাড়িঘর করা ও রাস্তাঘাট তৈরি করার কাজে লক্ষ লক্ষ বেকার কাজ পাবেন।
এসব কাজ করতে হলে চাই একটা এমার্জেন্সি বােধ, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, জনগণের মধ্যে একতা ও একটা দুর্দান্ত অভিযান। পশ্চিমবঙ্গ যে ভাবে নানা কারণে মারের পর মার খেয়ে যাচ্ছে, তাতে কি কোনাে দিনই তার ফিরে দাঁড়াবার স্পৃহা ও পণ দেখা দেবে না?
সূত্র: কম্পাস, ৪ঠ সেপ্টেম্বর ১৯৭১