বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায়
গত ১৯ শে মে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের একটি বিস্তৃত মুক্ত এলাকায় সফর করে এলাম। আমার এই সফরের আওতায় পড়েছে তিনটি রেলস্টেশন (যদিও রেল চলছে না), দুইটি মাঝারী ধরনের বাজার সহ ১৫টি গ্রাম।
ভারত সীমান্তে গাড়ি রেখে সীমান্ত ঘাঁটি (মুক্তি ফৌজের দখলে)পার হয়ে সাত মিনিট পায়ে হাঁটার পর মুক্তি ফৌজের সাহায্যকারী পর্যবেক্ষক দলের একটি জিপ। সেই জিপে করে প্রথমে বাংলাদেশের একটি মাঝারি ধরনের বাজার। সেই দিন বাজারের তারিখ না থাকলেও বাজারে লােকজন এবং দোকানপাট খােলা; তবে বিমান আক্রমণের সতর্কতা হিসাবে ব্ল্যাক আউট চলছে; তখন সন্ধ্যা প্রায় ৭টা হবে। ঐ সময়ে দেখলাম কিছু স্বেচ্ছাসেবক “আগুন লাগলে কী করা উচিত।” সে সম্পর্কে জনসাধারণকে বক্তৃতা দিয়ে বােঝাচ্ছেন এবং সে সম্পর্কে ছাপানাে প্রচার পত্র বিলি করছেন।
পর্যবেক্ষক দলের মারফত ওখানকার জনসাধারণ আমার পরিচয় জানার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কিছু উত্যল্প যুবক আমাকে ধরে বসলাে, নিকটে তাদের একটি আয়ােজিত জনসভায় যেতে। গেলামও তথায়। জনসভায় ঐখানকারই এক স্কুলের প্রভাবশালী প্রধান শিক্ষক এবং প্রাদেশিক পরিষদে নব নির্বাচিত প্রতিনিধি বক্তৃতা দিচ্ছেন-“ইয়াহিয়া খানের চরদের ধরায়ে দিন। ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সংগ্রামে ঝাপায়ে পড়ন। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয় দেবেন না।” সভায় ঘন ঘন জয়বাংলা ধ্বনি। সেখান থেকে ৩ মাইল রাস্তা হরপুর বাজার ও রেলওয়ে স্টেশন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জিপ গিয়ে তথায় পৌছলাম। যাবার সময় পথিমধ্যে বেশ কিছু যুবক কি জানি কি লিফলেট বিলি করছে। জিপ হতে হাত বাড়িয়ে দুটো নিলাম। দেখি মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ময়মনসিংহ হতে ২২ শে এপ্রিল ১৯৭১ সালের প্রদত্ত ছাপানাে বৃিতি। (এই সংখ্যায় দেওয়া হল)।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ পৌছলাম হরসপুর রেলওয়ে স্টেশনে। এখানে দেখলাম বেশ কিছু যুবক টর্চের আলাে দিয়ে স্টেশনের দেওয়ালের গায়ে কি যেন লাগাচ্ছেন। দেখি “পাক দস্যুদের জুলুমবাজী নিমূল করতে মুক্তি ফৌজকে মদদ দিন” শিরােনামায় বড় বড় হরফে লেখা পােস্টার।
স্টেশন প্ল্যাটফর্মে প্রায় ২০ মিনিট বসে চা খাওয়া ও বিশ্রামের এক ফাঁকে একজন যুবক ঐখানকার স্টেশন মাস্টারকে পরিচয় করিয়ে দিল। বয়স খুব বেশি হলেও ৩৬/৩৭ এর বেশি নয়। আলাপ পরিচয়ে জানলাম স্টেশন মাস্টারের দেশ আমার ছেড়ে আসা গ্রামেই। তার পর রাত প্রায় ৯ ঘটিকায় বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চল পরিত্যাগ করার পূর্বে মুক্তি ফৌজের একটি “বেইজ ক্যাম্প” এ দেখি দুইজন লােককে চোখ, হাত ও পা বাঁধা অবস্থায়। ক্যাম্প অধ্যক্ষকে জিজ্ঞাসা করলাম এর কারণ! ক্যাম্প অধ্যক্ষ বললেন ওরা সাম্প্রদায়িকতার উস্কানী দিচ্ছিল ও লুটপাট করছিল, তাই এ অবস্থা মাঝ রাত পর্যন্ত। তারপর ওদের পরিবারদের নিকট ওদের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
ঠিক রাত সাড়ে ৯টায় ভারত সীমান্তে এসে গন্তব্য স্থানে আসতে আসতে ভাবছি বাংলাদেশের কথা। সে দেশ ছেড়ে আমরা সাম্প্রদায়িকতার ভয়ে চিরতরে পরিত্যাগ করে এসেছি, তখন কি এটা ভেবে ছিলাম যে, ওরাও একটা ইতিহাস তৈরি করতে গিয়ে কাতারে কাতারে প্রাণ দেবে? যদি ভাবতাম, তবে আমরাও তাদের এই আন্দোলনে শরিক হতেম।
কেশব চন্দ্র শূর
সূত্র: কম্পাস: ২৫/৫/১৯৭১