ওরা কিভাবে লড়াই করছে
সত্যাগ্রহ এবং অসহযােগ—তার পরই মুক্তিযুদ্ধ-পৃথিবীর সংগ্রামের ইতিহাসে এ যেন এক নতুন সংযােজনা— এ যুদ্ধ কতদিন চলবে? কিভাবে লড়াই করছে ওরা?
তাই দেখার আশায় এ-বাংলার সীমান্ত পার হয়ে ও-বাংলার নয় মাইল ভেতরে খুলনা জেলার ছােট্ট শহর সাতক্ষীরায় গেলাম। এটা কোনাে রণাঙ্গন নয়-তবে যে কোনাে মুহূর্তে শত্রুসৈন্যর আক্রমণ হতে পারে তাই সকলে শঙ্কিত। আওয়ামী লীগ সদস্য জনৈক মুক্তিযােদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলাম-“এখান থেকে রণাঙ্গন কতদূর?”
“প্রায় তিরিশ মাইল হবে।”
“সেখানে কি এখন যাওয়া যেতে পারে?”
“কি করে যাবেন যানবাহন নেই- এতােখানি পথ…?…!”
“যাগে মুক্তিসেনারা কিভাবে লড়াই করছে কিছু বলতে পারেন?”
কেন পারব না গতকালই আমি ফায়ার করে এসেছি। শত্রুসৈন্যর ছাউনিগুলােকে আমরা অবরােধ করে রেখেছি যাতে তারা ছাউনি থেকে বের হয়ে এসে শহরের নাগরিকদের ওপর অত্যাচার করতে না পারে। আমাদের গােলাবারুদ খুব কম তাই একটা গুলিও অযথা খরচ না হয় তার জন্য আমরা সজাগ। অভাব থ্রি নট থ্রি কার্টিজের—ওটা রাইফেলও চলবে এবং লাইট মেসিন গানেও ব্যবহার করা যাবে…” আরও অনেক প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে থেকে যেটা বােঝা গেল তা-হলাে— আত্মরক্ষার জন্যই তাদের এ লড়াই আক্রমণাত্মক কোনাে প্রস্তুতি নেই। এবং মেশিনগান, অটোমেটিক রাইফেল কামান, উচ্চশক্তি-সম্পন্ন বােমা, স্যাবার জেট, প্যাটন ট্যাঙ্ক ইত্যাদি মারাত্মক মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে যে পরিমাণ অস্ত্রের প্রয়ােজন- সদ্য স্বাধীন বাংলার মুক্তিসেনাদের তার বিশেষ কিছু নেই। একমাত্র ভরসা বিদ্রোহী ই-পি-আর বাহিনীর শিক্ষিত সৈন্যরা আর তাদের সামান্য অস্ত্র। এছাড়া মুক্তিসেনার আছে তীর ধনুক ও দোনলা বন্দুক। তাই অস্ত্র চাই।
জনৈক ই-পি-আর বাহিনীর মুক্তিসেনা বললেন, “স্বাধীন বাংলার জন্য আমরা মৃত্যুপণ করেছি। কিন্তু এ মৃত্যু সুখের হবে যদি আমরা লড়াই করে মরতে পারি মনটা আমাদের ঠিক আছে তবে রাইফেলের কার্টিজ চাই আপনারা আমাদের সাহায্য করুন।”
কথা শেষ হতে না হতেই একটা জিপ প্রচণ্ড শব্দ করে এসে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালাে তার ওপর থেকে উত্তেজিত ভাবে একজন বললেন; “একটা পাকিস্তানি সৈন্য বােঝাই গাড়ি এদিকে আসছে—সকলে তৈরি থাকুন।” বলেই চলে গেলেন তিনি।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কথাটা ছড়িয়ে পড়লাে চারিদিকে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল রাস্তা ফাঁকা। থানার সামনে গিয়ে দেখি একজন অফিসারের ইঙ্গিতে কয়েকজন ই-পি-আর বাহিনীর মুক্তি সেনা দৌড়ে পথের দুপাশে “পজিশন নিয়ে বসলেন। মিনিট দশেক পর আরও চারজন বয়স্ক মুক্তিসেনাকে ডবল ব্যারেল-গান নিয়ে শত্রুদের সাথে মােকাবিলা করার জন্য ওৎ পেতে বসতে দেখলাম। আমরাও নিরাপদ স্থান থেকে ঘটনাটি কি দাঁড়ায় পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই ঘটলাে না। পরে জানা গেল খবরটা ঠিক নয়। তা-না হােক লড়াই এর ময়দানে সতর্কতাই একমাত্র সম্পদ। এ সম্পদ সাতক্ষীরার মানুষদের আছে। লড়াই করার মতাে জঙ্গী মনােভাবেরও অভাব নেই। কিন্তু শূন্য তাদের হাত। যে হাতে অস্ত্র থাকলে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের আরও নতুন পরিচয় পাওয়া যেতে পারত। কিন্তু তা না থাকার জন্য অসহায়ের মতাে এগলি-সেগলি ছুটে বেড়াচ্ছে মুখে তাদের বিরক্তির ছাপ।
তবু উৎসাহের অভাব নেই
চৈত্রের কাঠফাঠা রােদে পুড়ে দশ মাইল পথ দৌড়ে চলে আসছে সীমান্তের ধারে-অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এ পার থেকে কোনাে সাহায্য আসবে কিনা? এ পারের লােকদের কাছে তাদের আবেদন “একেবারে খালি হাতে আসবেন না কিছু না কিছু একটা নিয়ে আসুন। থ্রি-নট-থ্রি কার্টিজের ভীষণ প্রয়ােজন, তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে কিছু তুলাে, ব্যান্ডেজ, ওষুধ-পত্ৰ কিম্বা পেট্রোল নিয়ে আসবেন। তাও যদি সম্ভব না হয় তবে হাতে করে একটা ওয়াটার বটুল আনতে ভুলবেন না”।
আরও শক্তিশালী প্রস্তুতি চাই
সকাল থেকে সন্ধে গড়িয়ে পড়লাে। সমস্ত শহরটা ঘুরলাম। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে শিক্ষণ শিবির নজরে পড়লাে না। যেটা এই অঞ্চলের সবচাইতে প্রয়ােজনীয় বস্তু।
কাগজে পড়ে এবং ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত সংবাদ শুনে বেশ বুঝতে পারছি স্বাধীন বাংলার প্রাথমিক পর্যায়ের লড়াই অর্থাৎ এলােমেলাে ‘মব-ফাইটের দিন শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের লড়াইটা এবার সামরিক-বিজ্ঞান সম্মত করা দরকার। প্রথম পর্যায়ের লড়াই এলােমেলাে অগােছােলা আবেগপূর্ণ আচরণের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে এবার গেরিলা যুদ্ধের নীতি ও কৌশল গ্রহণের প্রয়ােজনটিই বেশি। এখনও যে সমস্ত শহরে ও গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রবেশ করতে পারেনি সেই সব স্থানে এই সুযােগে মুক্তিসেনাদের গেরিলা যুদ্ধে সুশিক্ষিত করে তােলা দরকার। আক্রমণ-দ্রুততা, পশ্চাদ্ধাবন, হঠাৎ আক্রমণ, সংঘর্ষ, ও পশ্চাদপসারণ, রাত্রিবেলায় যুদ্ধ জোরালাে জায়গা এড়িয়ে গিয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত ইত্যাদি গেরিলা কৌশলগুলােকে এখনি রপ্ত করা দরকার। কেননা ইয়াহিয়া খাঁর বিশাল সমর-শক্তির প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই লড়াই এ অভ্যস্ত, সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত বলেই লড়াইটা দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলার সম্পদ হলাে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা। এ ঘৃণা বাইশ বছর ধরে ধরে তিলে তিলে মানুষের মানসিক গঠনকে এমন দৃঢ় করে দিয়েছে যে জঙ্গীশাসনকে আর তারা মানবে না। তাই চূড়ান্ত সফলতা পাওয়ার জন্য সমর ক্ষেত্রে না হলেও এ লড়াই চলবেই। অবশ্য ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী ও নৌবহরের মধ্যে একাংশের বিদ্রোহটা যদি আরও দানা বেঁধে ওঠে তাহলে অন্য কথা।
আমরা কী করতে পারি
কিন্তু স্বাধীন বাংলার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য যে লড়াই চলছে তাতে প্রতিবেশী হিসেবে আমাদেরও অনেক কর্তব্য আছে। আজ বার দিন হয়ে গেছে—আমরা সমবেদনা ও সমর্থন জানিয়ে একদিনের হরতাল পালন করেছি। আবার হাজার হাজার সাধারণ মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যা পেরেছেন তাই নিয়ে স্বাধীন বাংলার জনগণকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু এই সাহায্য তাদের বর্তমান চাহিদার তুলনায় সমুদ্রে বারিবিন্দু বিশেষ। এবং সত্যাসত্যের পরােয়া না করে নির্বিচারে নানা ধরনের ছবি ছাপিয়ে, কাগজ মারফত রঞ্জিত অতিরঞ্জিত কথা বলে বাজার গরম করে নিবুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছি। স্বাধীন বাংলার মুক্তি ফৌজের সাফল্যটাকে বড় করে দেখে অন্ধকার দিকটাকে এড়িয়ে চলেছি। যুদ্ধটা একটা বিজ্ঞান। রাজনীতিক তামাশা বা সাম্প্রদায়িক ঈর্ষা প্রণােদিত দাঙ্গা লড়াই নয়। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠাই এ লড়াই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। কোনাে সম্প্রদায় বা জাতিগত স্বার্থসিদ্ধি নয়। সব সময় মনে রাখা দরকার লড়াই চলেছে ইয়াহিয়া খার জঙ্গী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলার গণতন্ত্রী জনগণের বাঙালিদের সাথে পাঞ্জাবী পাঠানদের নয়।
শ্যামল পাল
সূত্র: কম্পাস: ১০.৪.১৯৭১