বাংলাদেশ ও ভারতের ভবিষ্যৎ (১)
জয়প্রকাশ নারায়ণ
বর্ষার অবসান হতেই ক্ষমতাসীন নেতৃবর্গ সােচ্চার হয়ে উঠছেন এবং রীতিমতাে কলরব শুরু করেছেন। সবচেয়ে সামরিক ঢং-এর কলরব করেছেন আমাদের সুযােগ্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। কিন্তু এর দ্বারা তিনি এদেশের জনসাধারণের বুদ্ধির অবমাননা করেছেন আর নিজেকেও পৃথিবীর লােকের কাছে হাস্যাস্পদ করে তুলছেন। জলন্ধরে তিনি নাকি বলেছেন-“পাকিস্তানের প্রায় অর্ধেক তাে খতম হয়ে গেছে। ভারতের আর লড়াই করবার দরকার না-ও হতে পারে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী তাদের প্রাধান্য স্থাপন করে চলেছে আর বিশ্বের মতামতও ক্রমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সবচেয়ে বিচিত্র উক্তি হলাে-“মুক্তি বাহিনী আর একটি মুষ্ঠাঘাত করলেই বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে যাবে!”
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে শ্রীজগজীবন রাম নিশ্চয়ই অন্যের চাইতে ভালাে জানেন। তিনি জানেন বাংলাদেশে গেরিলারা কত সামান্য হাতিয়ার নিয়ে লড়ছে তাদের নিয়মিত সংগ্রাম করার বাহিনী কত ছােট, আগ্নেয়াস্ত্রে তাদের কী শােচনীয় স্বল্পতা রয়েছে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং ভারী সামরিক সরঞ্জাম তাদের প্রায় কিছুই নেই। এত সামান্য শস্ত্রশক্তি এবং অর্ধশিক্ষা নিয়ে তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের পাঁচ ডিভিসন সৈন্যকে ঘায়েল করতে পারবে এ রকম আশা করা মনে অতিবড় মূর্খের স্বর্গে বাস করা। আরও খারাপ কথা হলাে—এ দেশের জনসাধারণ যাদের ভাগ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাগ্য অবিচ্ছেদ্য রূপে বাঁধা হয়ে গেছে, এ ধরনের উক্তি তাদের শােচনীয় রূপে বিভ্রান্ত করবে। আজ যখন জনগণের মধ্যে এরূপ মানসিকতা সৃষ্টি করা জরুরি প্রয়ােজন যাতে সগ্রামী চেতনায় তারা শিরদাঁড়া সােজা করে দাঁড়াতে পারে, নিজেদের মধ্যেকার সবরকম ভেদাভেদ ভুলে যেতে পারে, কর্মের প্রতিক্ষেত্রে সর্বাধিক উদ্যম নিয়ে আত্মনিয়ােগ করতে হবে, জাতীয় স্বার্থকে এক ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা করবার জন্য যে কোনাে প্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হতে হবে, তখন আর কেউ নয় স্বয়ং প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই মারাত্মক আত্ম-সন্তুষ্টির মধ্যে জগতকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছেন, যে বিনা সাহায্যে বাংলাদেশের সৈন্যরাই কাজ খতম করে দিতে পারবে।
একথা অবশ্যই সত্য বাংলাদেশের মুক্তির জন্য বাংলাদেশের লােকদেরই লড়াই করতে হবে। কিন্তু যেহেতু বাঙালি মুক্তিযােদ্ধারা সাহসী, সংকল্পবদ্ধ এবং অনন্যনিষ্ঠ, সেইহেতু তারা নিজেরাই পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে এ ধরনের কথা বলে আমাদের নিজেদেরকে এবং বিশ্ববাসীকে প্রতারণা করা নিরর্থক। তাদের সাহায্যে কাউকে আসতে হবে। ভারত ছাড়া সে ক্ষমতা এবং সে-উদ্বেগ আর কার আছে? এটা যদি কেবল আর্তপ্রতিবেশীকে সাহায্য করার প্রশ্ন হতাে তাহলে এ যুগের জাতি-রাষ্ট্রের অনৈতিক নৈরাশ্যকর ও হৃদয়হীন রীতি অনুসরণ করে নিজের দোরগােড়ার বাইরেই লুঠতরাজ, নারীধর্ষণ ও বিধ্বংসী কার্যকলাপ সম্পর্কে চোখ বুজে থাকলেও হয়ত ভারতের পক্ষে তা যুক্তিযুক্ত হতাে। আমাদের বিবেককে বাঁচাবার জন্য আমরা কানে তুলাে দিয়েও থাকতে পারতাম যাতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাপালয়ে বন্দি হতভাগিনী বাঙালি তরুণীদের হৃদয়ভেদী নৈশআর্তনাদ আমাদের শুনতে না হয়। বাংলাদেশের লােকদের হিন্দুপ্রবণ’ সংস্কৃতি ধ্বংস করে, কী করে খাঁটি মুসলমান হতে হয় তা তাদের শিক্ষা দিয়ে বাংলাদেশে একটি জারজ জাতি সৃষ্টি করার স্পর্ধিত পাকিস্তানি উক্তি সম্পর্কেও আমরা বধির থাকতে পারতাম। তাদের পূর্বাংশের উপনিবেশটিকে অমুসলমান বিশেষ করে হিন্দু শূন্য করা, যথেষ্ট সংখ্যায় বাঙালি মুসলমানকে খুন করে বা বিতাড়িত করে তাদের জায়গায় যথেষ্ট সংখ্যক ‘অনুগত’ পাকিস্তানী আমদানি করে বাঙালিদের সংখ্যালঘুতে পর্যবসিত করা এবং তার দ্বারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিষ্ক্রিয় করে তােলা, মুসলিম জগতের সর্বোত্তম সাংস্কৃতিক উজ্জীবনকে ব্যর্থ করে দেখা, বাঙালি দেশপ্রেমিকদের কবরে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে চাপা দেওয়া এবং সর্বশেষ দ্বিজাতি তত্ত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও আমরা আমাদের মনের দরজায় খিল দিয়ে রাখতে পারতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হল বাংলাদেশ ভারতের পক্ষেই এক জীবন-মরণের প্রশ্ন। শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় এক কোটিতে পৌছেছে এবং সেই যে ন্যক্কারজনক পৌনঃপুনিক উক্তি “বাংলাদেশে এমন পরিবেশের সৃষ্টি করতে হবে যাতে শরণার্থীরা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে তা সত্য করে তুলবার জন্য বিশ্বের দুই ভাগ্যবিধাতা রাশিয়া এবং আমেরিকা যদি পাকিস্তানকে সম্মত করাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কালক্রমে শরণার্থী সংখ্যা আরাে এক কোটি কিম্বা বেশি হতে পারে। কিন্তু এ শুধু শরণার্থী বহনের প্রশ্ন নয়। লােকস্ফীতি ও দারিদ্র পীড়িত আমাদের দেশের ওপর ক্রমাগত এত বেশি শরণার্থীর চাপে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কী পরিণাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে তা অতিবড় নির্বোধও উপলব্ধি করতে পারে।
সােজাসুজি সমস্যাটির মুখােমুখি হয়ে বুঝতে হবে পৃথিবীতে অন্তত মুখরক্ষার মতাে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে ভারত টিকে থাকবে কিনা, বাংলাদেশ প্রশ্নটি তার চাইতে কিছু কম নয়। নিক্সন এবং পদগণী যদি না-ও জানেন নয়াদিল্লীর এখন জানা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম জাতিতে পরিণত না হলে একজন শরণার্থীও অন্তত একজন অ-মুসলমান কিম্বা রাজনীতি সচেতন মুসলমানও ফিরে যাবেন না। তথাকথিত বিশ্বসমাজ যতই বােঝন বা চাপ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিতে কোনাে রাজনৈতিক সমাধান ইয়াহিয়া খান মেনে নেবেন কখনও তার কোনাে সম্ভাবনা নেই। এই ধরনের বুঝানাে পড়ানাে ও পীড়াপীড়ির ফল কী হয়েছে তা ইয়াহিয়া খান নিজেই তার বহু প্রতীক্ষিত ১২ই অক্টোবরের বিবৃতিতে বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে দিয়েছেন। অনুমান, রাশিয়া এবং আমেরিকা উভয়েই রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম ধাপ হিসেবে শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেবার জন্য পাক-প্রেসিডেন্টের ওপর চাপ দিচ্ছেন। তার উত্তরও ইয়াহিয়া খান দিয়েছেন: তিনি বলেছেন সামরিক ট্রাইবুনালের যে প্রহসনটি তিনি খাড়া করেছেন তা যদি শেখ মুজিবকে নির্দোষ না বলে তাহলে তিনি একজন ‘দেশদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতেও প্রস্তুত নন। যে মানুষটি অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের নির্বাচনে এক বিস্ময়কর জয়ের গৌরব অর্জন করেছেন এবং সমগ্র পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তার দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছেন, জনমত যাচাই করে তবে তার ভাগ্য নির্ণয় করা হবে- এ কথা বলতেও ইয়াহিয়া খানের মুখে আটকায়নি। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও চেষ্টা চরিত্রের এই হচ্ছে নিট ফল। এই রাজনৈতিক সমাধান’ বস্তুটিকেও ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। অবশ্য তার একটি বক্তব্য খুবই স্পষ্ট, সেটি হলাে অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে থেকে সমাধান।
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভের জন্য আমেরিকাও সংগ্রাম করেছে, কিন্তু সে অনেকদিনের কথা নিউইয়র্ক বন্দরে স্ট্যাচু অব লিবার্টি (স্বাধীনতার মর্মরমূর্তি) ছাড়া সেই উপনিবেশবাদ বিরােধী আদর্শের আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রকৃতপক্ষে আজ আমেরিকা নিজেই একটি বৃহৎ ঔপনিবেশিক শক্তি। অন্যদিকে রাশিয়া বরাবর উপনিবেশকিতা বিরােধী সমস্ত মুক্তিসগ্রামে উচ্চকণ্ঠে তার পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আসছে বটে কিন্তু তার তাবেদার রাষ্ট্রগুলাের ওপর তার দখল শিথিল করবার কোনাে ইচ্ছাই দেখাচ্ছে না: নিতান্ত ভদ্র ভাষাতেই এগুলাে তাবেদার, আসলে এই রাষ্ট্রগুলাে সেই পুরাতন উপনিবেশরই মতন। এই দুই মহাশক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বিশ্বের ভবিতব্যের মুঠি ধরে রয়েছে। এবং তা কোনাে নৈতিক ক্ষমতায় নয়, সংহারের ভীষণতম হাতিয়ার হাতে থাকার জোরে। বাংলাদেশের পক্ষে নিদারুণ বেদনার যে, পাকিস্তানের ‘আভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে এই দুই শক্তির দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রুশ ভারত চুক্তি সত্ত্বেও কোনাে মৌলিক তফাৎ নেই। নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ অনুসারে এই দুইদেশই পাকিস্ত েিনর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বন্ধন যতই ঢিলে হউক না কেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিপর্যয়ের মধ্যে কী কী প্রশ্ন নিহিত রয়েছে অন্তত ভারতের সে বিষয়ে কোনাে ভ্রান্ত ধারণা থাকা উচিত ছিল না। ভারতের তাে কোনাে ঔপনিবেশিক উচ্চাশা নেই, আর ভারত সরকারের আজও কিছু সদস্য আছেন যারা নিজেরা এক সময়ে স্বাধীনতার জন্য সগ্রাম করেছেন। গােড়া থেকেই এটা পরিষ্কার যে, ‘পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটেছে তা কোনাে জাতির বিচ্ছিন্নতা নয়। তা হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য উপনিবেশ বিরােধী সংগ্রাম। অত্যন্ত বেদনার কথা অনেক বেশি শস্ত্রশক্তি সম্পন্ন একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে সাত মাসের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের পরও, সার্বভৌম স্বাধীনতার কম কোনাে কিছু তাদের এবং তাদের জনগণের কাছে কদাচ গ্রহণীয় হবে না বাংলাদেশের ন্যায্য সরকার স্বয়ং বারম্বার এই ঘােষণা করার পরও, ভারতের নেতৃবৃন্দ আলােচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে চলেছেন। এর চেয়ে অন্তঃসারশূন্য আর কিছু কল্পনা করা কঠিন। গত সাত মাসের অভিজ্ঞতার পরও তারা কী করে আশা করতে পারেন, যে, পাকিস্তানি সামরিক শাসকগােষ্ঠীকে তাদের পূর্বাংশের কলােনি হাতছাড়া হওয়ার ক্ষতি স্বীকারে চাপ দিয়ে, রাজি করানাে যেতে পারে। বিশেষ করে যখন তার কিছু শক্তিশালী বন্ধু জুটেছে? না কি আমাদের শাসকরা নিজেরাই পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা পােষণ করেন, তাই যদি হয়, ঈশ্বর এই দেশকে রক্ষা করুন।
সূত্র: কম্পাস, ২৭ নভেম্বর ১৯৭১