You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.27 | মুক্তাঞ্চলের একটি কেন্দ্রচিকিৎসা | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তাঞ্চলের একটি কেন্দ্রচিকিৎসা

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে মুক্তাঞ্চল রচিত হয়েছে এবং ঐ সব মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রশাসন কার্য, চিকিৎসার ব্যবস্থা, খাদ্য সরবরাহ, কৃষিকার্য প্রভৃতি চালু করতে পেরেছেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পেলাম সেদিন মুক্তিবাহিনীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের সিলেট জেলার কোনাে এক মুক্তাঞ্চলে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল পরিদর্শন করে। পঞ্চাশ বেডের একটি সম্পূর্ণ হাসপাতাল। এতে রয়েছে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড, সার্জিকেল ওয়ার্ড, মেডিকেল ওয়ার্ড, অপারেশন টেবিল, এক্স-রে ব্যবস্থা এবং রয়েছে শবব্যবচ্ছেদাগার (Post Mortem hall)। বাংলাদেশকে যারা স্বীকার করে না, বাংলাদেশে প্রশাসন নেই বলে যারা গলাবাজি করে, পাকিস্তানি প্রচার যন্ত্রের প্রােপাগাণ্ডা যারা সত্য বলে মনে করে তারা যদি একবার ঐ হাসপাতালটি মাত্র দেখে আসেন তবেই বুঝতে পারবেন বাংলাদেশ বাস্তব সত্য।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা রােগীরা স্বচ্ছন্দে শুয়ে আছেন অথবা যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলােচনা করছেন। স্বেচ্ছাসেবীরা এদিক ওদিক কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। একজন মুক্তিযােদ্ধার সাথে আলাপের জন্য বেডের দিকে এগিয়ে যাই, সঙ্গে ছিলেন মুক্ত বাংলার সাপ্তাহিক সংবাদপত্র “সােনার বাংলার প্রতিনিধি। উভয়কেই উক্ত মুক্তিসেনা সহাস্য অভ্যর্থনা জানালেন, তার নাম তজমুল, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, সিলেটের কোনাে এক গ্রামে নিবাস ছিল, পাকিস্তানি জল্লাদদের নরহত্যা ও অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে তজমুলের মুখমণ্ডলে বিষাদের ছায়া নেমে এল। একটু পরে সহজ অথচ কঠিন কণ্ঠে বলল “গত চব্বিশ বছর ধরে জালেমের দল আমাদের উপর যে নির্যাতন চালিয়েছে তা থেকে যে কোনাে উপায়ে যে কোনাে ত্যাগের বিনিময়ে আমাদেরকে মুক্তি পেতেই হবে। যুদ্ধের মাধ্যমেই মাতৃভূমিকে স্বাধীন করা সম্ভব। যুদ্ধ করেই দেশকে মুক্ত করতে হবে এবং এটাই শেষ পথ। বৈদেশিক সাহায্য বলতে শুধু সমর্থন ও অস্ত্র চাই। কোনাে প্রত্যক্ষ বা সক্রিয় সাহায্য নেওয়া ঠিক হবে না।…বাংলাদেশে এখন দখলদার পাক বাহিনী ও রাজাকারদের মনােবল বলতে কিছুই নেই, ওরা সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়েছে। ওদেরকে বাংলার সবুজ প্রান্তর থেকে চিরতরে উৎখাত করতে আমাদের খুব একটা দীর্ঘ সময়ের প্রয়ােজন হবে না। পাঠান, বালুচ ও রাজাকারদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হচ্ছে। এটা হতে বাধ্য।” আহত যুক্তিযােদ্ধা তজমুল আমাদের প্রশ্নের উত্তরে বলল— “গত ৯ই অক্টোবর শাবাজপুর সেক্টরে দুশমন সেনাদের সাথে লড়াইয়ে আহত হয়েছিলাম, মর্টারের গুলি লেগেছিল, এখন তা সেরে যাচ্ছে, হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ হলেই ফ্রন্টে গিয়ে আবার যুদ্ধ করবাে। কিন্তু আমি হসপিটাল থেকে কখন ছাড়া পাব এখন শুধু তাই ভাবছি।”
নির্বাকারভাবে কথাগুলাে বলে তজমুল আমাদের দিকে তাকাল, তার চোখে বিমর্ষ হারিয়ে একটি উজ্জ্বল ও তীক্ষ আলাে ইস্পাতের মতাে চকচক করে উঠলাে। সেই তীব্র আলােয় ভেসে উঠলাে বাংলার ভবিষ্যৎ। আগামী দিনের বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা আকাঙ্খর সার্থক প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠলাে তজমুলের নয়নে। তজমুলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার পথে একজন নার্সের সাথে আলাপ, নার্সটি বলল-“হাসপাতাল স্থাপিত হবার পর থেকেই আমরা কজন এখানে কাজ করছি, হাজার হাজার জোয়ান যেখানে জীবন বিপন্ন করে মৃত্যুর সাথে সর্বক্ষণ পাঞ্জা লড়ছেন, অকাতরে রক্তদান করছেন দেশের জন্য; যেখানে আমরা তাদের কতটুকু সেবা করতে পারি। কাজের মধ্যে যে আত্মগৌরব আছে সেই আত্মগৌরব অনুভবের ছাপ তার মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে রয়েছে। বিদায় নেবার আগে তার নামটাও জেনে নিলাম। শিরিনা খাতুন। বাড়ি সিলেটের কোনাে এক এলাকায়। শিরিনা খাতুন আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে আবার আসতে অনুরােধ জানায়। আমরাও শুভেচ্ছা জানিয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
নীতিশ ভট্টাচার্য্য

সূত্র: কম্পাস, ২৭শে নভেম্বর ১৯৭১