বাংলাদেশের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে (৮)
শকুন্তল সেন
আমাদের মেজর সাহেব এক বিচিত্র মানুষ। ছােট খাটো বেশ শক্ত সামর্থ্য চেহারা। একদিকে রাইফেল, অন্য কাঁধে একনলা বন্দুক, কোমরে লম্বা তরবারি, অন্যদিকে সংগীন, মালার মতাে ঝুলছে কার্তুজ। মাথায় লাল টুপি–জয় বাংলার প্রতীক। আমার তাে কাজ কাম নাই—ওদের ক্যাম্পে গিয়ে বসি কত লােক আসে তাদের কত কথা। সব কথার মাঝে একটি বক্তব্য বার বার ঘুরে ফিরে আসছে “আচ্ছা ইন্ডিয়া এখনও স্বীকৃতি কেন দিচ্ছে না—রাশিয়াই বা কি করছে। আমাদের অস্ত্র চাই না-শুধু স্বীকৃতি চাই।” কেউ বা প্রতিবাদ করে বলেন, “ইন্ডিয়া ভয় পাচ্ছে। যদি স্বীকৃতি দিলে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে যায়, তাহলে।”
“আরে রাখেন, চীন কোনখান দিয়ে এদিকে আসবে। আর ইন্ডিয়া স্বীকৃতি দিলেই চীনের সঙ্গে যুদ্ধ হবে-এ কেমন কথা।”
মেজর সাহেবের সঙ্গে আলাপ হ’ল ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা। একসময় জিজ্ঞেস করলাম “আপনার দুটি বন্দুক একটি তরবারি, আপনি শত্রু আসলে যুদ্ধ করবেন কী করে।” মেজর সাহেব দিলদরিয়া মেজাজের লােক। হা হা করে হেসে বললেন “আরে মাস্টার সাব আপনি বলেন কী। আমি কি যুদ্ধ করব নাকি। সৈন্য আসবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি উল্টো দিকে দৌড়ব। আমি কেন সকলেই পালাবে। রাইফেল নিয়ে কি মেশিনগান আর তােপের সামনে দাঁড়ানাে যায় কি লাভ। শহরের লােকদের সাহস দেবার জন্যই আমরাও আছি। অস্ত্র নাই, কামান নাই কিছুই নাই কি দিয়ে যুদ্ধ করব। তাহলে আপনি ঘাবড়াবেন না। ওরা এদিকে আসবে না। ওদিকে বাচ্চা কয়েকটি ছেলে বলতে বলতে যাচ্ছে___
“ওরাে বেটা টিক্কা
তােরে দিমু কিকক্যা”
ইয়াহিয়ার কাটা কান
হালারে পাঠাইলাম
আরাকান।” “
আম লীগ দিল ডাক
তােরা সকলে তৈরি থাক।”
দুপুর বেলা একটু বিশ্রাম করছি। হঠাৎ চাকরটা দৌড়ে এসে বলল “পালান পালান, মিলিটারি শিপ আইতাছে।”
অবাক হয়ে উঠে বসি, “কোনাে দিক দিয়ে?”
“ঝালকাঠি পার হইছে। আমি চললাম।” একছুটে বেরিয়ে যায়। আর ভালাে লাগে না। ২৬শে মার্চ থেকে এই চলছে। আজ ২রা এপ্রিল যা কিছু আছে গুছিয়ে নিলাম। জামা প্যান্ট পরে শুধু হাতে নিচে নামবার চেষ্টা করতে গিয়েই বাধা পাই!
হােটেলের গেট বন্ধ, কাউকে বেরুতে কি দিচ্ছে না! হৈ চৈ চীৎকার-কান্না। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। যে যেদিকে পারে দৌড়াচ্ছে। এখান থেকে দৌড়ে কোনাে দিকে পালাবে! আমার পালাবার জায়গাও নেই– ইচ্ছাও নেই। এই কিছুক্ষণ আগে মেজর সাহেব বলেছিলেন “আপনার কোনও চিন্তা নাই—আমি যতক্ষণ আছি।”
আমি কোনও বাধা না মেনে নেমে এলাম। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে দূর, দূর থেকে চীৎকার ভেসে আসছে “পালা, পালা।” সে এক বিস্ময়কর অবস্থা। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম শিপ কোনদিক দিয়ে আসছে। দৌড়াতে দৌড়াতে উনি জবাব দিলেন “কালিজিরার দিক থেকে। একজন বলল ঝালকাঠি, আর একজন কালিজিরা। একটা উত্তরে একটা দক্ষিণে। আরও কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করেও কোনও সঠিক উত্তর পাওয়া গেল না।
অনুমান করতে কষ্ট হ’ল না ব্যাপারটা নিছক গুজব। হােটেলের সামনে বড় রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি কোনদিকে যাব। পাশেই বড় দীঘি। ছেলেমেয়ে নারী পুরুষ সকলেই দৌড়াচ্ছে। হায়রে কি অবস্থা! অবাক হয়ে চেয়ে দেখি ভয়ের চোটে দুজন রাইফেলধারী ঐ দীঘিতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমার সামনে দিয়ে একজন রাইফেল নিয়ে পালাচ্ছে। আর এদের উপরই আমাদের নিরাপত্তার ভার! এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কোনওদিন যুদ্ধ দেখেনি—আর গত কদিন যে অত্যাচারের কাহিনী প্রচারিত হয়েছে— সেটাও অন্যতম কারণ। তাছাড়া এরা রেগুলার আর্মির নােক নয়—ভয় পেলেও দোষের নয়।
যে পালাচ্ছিল তাকে থপ করে ধরলাম
“আরে মিয়া যাও কই।”
“আপনি কি তামাশা করেন। শুনতেছেন না মিলিটারি আইছে।”
“তা তুমি পালাও ক্যান। তুমি না যুদ্ধ করবা।”
“আরে রাখেন যুদ্ধ, মিলিটারির সামনে পড়লে আর যুদ্ধ করতে হইব না।”
“তােমার রাইফেল দিয়েছে।”
বলতে না বলতেই বলে উঠল এই লন আপনাগাে রাইফেল—আমি চললাম।” ছুটতে শুরু করল কিছু দূর গিয়ে আবার দৌড়ে এসেছে “আরে, আপনি তাে বেশ লােক, রাইফেল নিলেন— গুলি রাখলেন না। এই রাখেন।” গুলি ভর্তি থলিটা দিয়ে আবার দৌড়ায়। আমি হতভম্ব একহাতে রাইফেল আর একহাতে গুলি ভর্তি থলি নিয়ে বােকার মতাে দাঁড়িয়ে আছি। জীবনে রাইফেল ধরেও দেখিনি। একটা শীতল রক্ত স্রোত মাথা থেকে পা পর্যন্ত বয়ে গেল। মিনিট কয়েক চেতনা ভাঙল একটা কর্কশ কণ্ঠস্বরে “আরে, আপনি দাঁড়িয়ে করছেন কী। ওদিকে শিপ এসে গেছে বাধা দিতে হবে না।” তাকিয়ে দেখি অল্প বয়সের কয়েকজন যুবক, কাঁধে-রাইফেল। সেই লােকটি যেদিকে পালিয়েছে সেদিক থেকে আরও অনেক রাইফেলধারী ছুটে আসছে বন্দরের দিকে। সকলে ছুটলাম বন্দরের দিকে। মেজর সাহেব তাে আমাকে দেখে অবাক।
“আরে একি ব্যাপার। আপনি রাইফেল পাইলেন কই। কি কাণ্ড। নেন নেন পজিশন নেন!” কোথায় পজিশন, কিসের পজিশন ভােলা বন্দরে নদী থেকে তােপ দাগলে আমার কেন শহরের বহু লােকের পজিশন নেওয়া চিরতরে ঘুচে যাবে। তবে বেশ লাগছিল। উনি আমাকে তাড়াতাড়ি একটা দোকানের পেছনে পজিশন নিতে বললেন। একটু ঘুরে এসে “রাইফেলে গুলি আছে তাে।”
“তাতে দেখিনি।”
“হায় আল্লা।”
মিনিট দেড়েকের মধ্যে আমার রাইফেল ট্রেনিং শেষ করে দিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন।
পরে জানা গেল শরণার্থী ভর্তি একটি জাহাজ খুলনার দিক থেকে আসছিল ঝালকাঠিতে তাকে ওয়ারলেসে জিজ্ঞেস করা হয় কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। ঝালকাঠি ওয়ারলেসে বরিশালকে সতর্ক থাকতে বলে আর সেই থেকেই এই বিপত্তি!
সন্ধ্যার পর থেকেই শহর ফাঁকা হতে শুরু করল। আতঙ্কে বন্দর জনশূন্য। সন্ধ্যার সময় আমি, মেজর সাহেব আরও দু’একজন বসে বসে গল্প করছিলাম। আমাদের কারু মনে এতটুকু আনন্দ নেই! হাবিলদার রহমত, যে সব সময় হৈ চৈ করতে ভালােবাসে আগে ছিল ই, বি আর এ সেও এখন একটু বিমর্ষ।
তার দুঃখ, অস্ত্র নেই—অস্ত্র থাকলে একবার দেখত পাক সেনা কত সাহসী, কত শক্তি ধরে।
মেজর সাহেব সত্যি সত্যিই মেজর। মিলিটারির মেজর ছুটিতে এসেছিলেন তারপর আর ফিরে যাবার। সুযােগ হয়নি। অথচ আমার ধারণা ছিল অন্য রকম। সন্ধ্যার বিমর্ষ মুহূর্তগুলাে তাঁর হালকা চালের কথাবার্তায় পরিবেশ লঘু করে তুলল। বন্দরের উপরেই শামিয়ানার নিচে আমরা কয়েকজন মাত্র। বন্দরে অন্য দিনের সেই প্রাণচাঞ্চল্য নেই। এক ফাঁকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম বর্তমান যুদ্ধ সম্পর্কে। একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু ইতস্তত করে তারপর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন “আমি ভাই মিলিটারি মানুষ, রাজনীতি বুঝি না। তবে অনেক যুদ্ধ করেছি এই সেদিনও কাশ্মীর ফ্রন্টে ছিলাম। আমার কাছে কেন, যে কোনও সৈনিকের কাছে যুদ্ধ যুদ্ধই। যুদ্ধ করতে গিয়ে ক্ষমতা নিতে গিয়ে দয়া, মায়া ভালােবাসা এগুলাে পুরােপুরি বাদ দেওয়াই উচিত। যুদ্ধ করব, জয়লাভ করবার ইচ্ছা আছে অথচ হত্যা করব না, ধ্বংস করব না এতাে হয় না। যেমন আমরা যুদ্ধ করছি অথচ যুদ্ধের ন্যূনতম কৌশলগুলােও অনুসরণ করছি না। সুতরাং এক্ষেত্রে যা হবার আমাদের তা হবে।”
আমরা সকলে এক সঙ্গে বলি কী হবে। “পলাশীতে নবাবের যা হয়েছিল। সেখানে বিশ্বাসঘাতকরা ছিল এখানে বুদ্ধি ও কৌশলের অভাব।” একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন “চট্টগ্রামে, কুমিল্লায়, কুষ্টিয়ায়, ময়মনসিংহে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের মূলনীতি অনুসারে প্রত্যেকটি এরিয়া বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া দরকার। সারাপুল ধ্বংস করে দাও, চালনা, চট্টগ্রাম বন্দর একেবারে উড়িয়ে দাও। ঢাকা, ময়মনসিংহ রাস্তা একেবারে নিশ্চিহ্ন কর। কুমিল্লা চট্টগ্রাম এর যােগাযােগ আপাতত শেষ কর। এগুলাে প্রাথমিক কাজ। তাছাড়া সমতল এলাকা থেকে যুদ্ধের ক্ষেত্র পার্বত্য ও অসমতল এবং নদীমাতৃক অঞ্চলে নিয়ে যেতে হবে। যেমন ময়মনসিংহ গারাে হিলস্, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা। ফলে একদিকে প্রাকৃতিক স্বাভাবিক পরিবেশটাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব। দুটি সুবিধা প্রথমত শত্রু সৈন্য মােকাবিলা পার্বত্য এলাকা থেকে করা যাবে; দ্বিতীয়ত পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযােগ রাখা। যাতে রসদ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সহজেই পাওয়া যায়। আমি ভাই মিলিটারি মানুষ স্পষ্ট কথা হচ্ছে এই যুদ্ধে জিততে হলে আমাদের এমন পথ নিতে হবে যাতে আমরা সীমান্তের ওপার থেকে প্রয়ােজনের সম সাহায্য পাই। ইন্ডিয়া’ এতে ব্রিত হতে পারে কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া পৃথিবীর কোনাে রাষ্ট্রই সশস্ত্র যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি, যেমন কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা এমন কি রাশিয়াও নয়।”
আমরা একটু অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করি তাহলে এ যুদ্ধে?” একটু ম্লান হেসে বললেন “এটা যুদ্ধ নয়— একতরফা আক্রমণ। আর এর ফলাফল সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলবার নেই। বুঝলাম জবাব সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন।
“কিন্তু আমরা হেরে গিয়েও জিতে যাব। মার খাবার এই প্রচণ্ড শক্তি আমরা যে অর্জন করলাম এটা আগামী দিনে আমদের কাজে লাগবে। পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব বাংলার উপর আধিপত্য শেষ হয়ে গেছে; সামরিক শাসন আর এখানকার কতগুলাে ক্রীতদাস কিছুদিনের জন্য রাজত্ব চালাতে পারলেও শেষ পর্যন্ত পারবে না। কিন্তু তার জন্য আমাদের নতুন করে অঙ্ক কষতে হবে। এর মাঝখানে আমাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। সাম্প্রদায়িক দলগুলাে গণ্ডগােল পাকাবার চেষ্টা করবে হতাশা আসবে কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমরাই জিতব। আমাদের ভিতরের শক্তি আমাদের নতুন পথ দেখাবে। আজকের জন্য দুঃখ করে লাভ নেই– আগামীকালের জন্য তৈরি হতে হবে।”
একটু থেমে আবার শুরু করলেন “যুদ্ধে আমরা জিতব সেটা বড় কথা নয়, তার চাইতে বড় বিপদ আর কিছু দিনের মধ্যেই দেখা দেবে। আমাদের বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের হুজুরদের সব কিছুই নির্ভর করে। তাদের বিলাস ব্যসন, খাওয়া দাওয়া, নবাবী আর রাজনীতি। বাংলাদেশে যে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়েছে, পাট চাষ বন্ধ হয়েছে, এটা ঠিক ঠিক চললে এমন দিন আসবে ইয়াহিয়া, ভূট্টো, শেখ সাহেব, তাজুদ্দিন আর নজরুল এমন কি আওয়ামী লীগের জনে জনে পায়ে ধরবে অবশ্য ততদিন যদি পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং পশ্চিমা শিল্পপতিরা ইয়াহিয়া ভূট্টোকে বাঁচতে দেয়। সেই দিনের জন্য সতর্ক হওয়া দরকার। আর কিছু দিনের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান পুরােপুরি বিকল হয়ে যাবে। পশ্চিমী শিল্পপতি ও সামরিক কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশকে একটা প্রচণ্ড আঘাত করলে এরা বশ্যতা স্বীকার করবে আর ওদের শােষণ সেই একই ভাবে চলবে। কিন্তু হিসাবে একটু ভুল হয়ে গিয়েছে! ওরা আমাদের আমেরিকার নিগ্রোদের মতােই মনে করেন, ব্যবহারও সেরকম। এক সময় নিগ্রোদের আমদানি করা হয়েছিল আমেরিকার সাদা মানুষদের সেবা করবার জন্য শ্রমিক ও দাসরূপে। কায়েম হবার পর আমাদের প্রতিও ওরা একই ব্যবহার করে গিয়েছে। ওরা ভুলে গিয়েছে যে আমাদের জন্যই একদিন পাকিস্তান কায়েম হয়েছিল। আমরা উৎপন্ন করি অথচ আমাদের ব্যবহার করতে হয় অনেক বেশি মূল্য দিয়ে আমরা অনেক সময় পাই না। যেমন চন্দ্রঘােনা পেপার মিলের কাগজ। এখান থেকে জাহাজে করে করাচী যাবে, সেখানে হিসাব কিতাব হবে আবার সেই কাগজ এখানে ফিরে আসবে। ওদের চাইতে তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে আমাদের তা কিনতে হয়!” বলতে বলতে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বলতে থাকেন “ওরা আমাদের ঘৃণা করেছে, কোনও দিন ভালােবাসেনি। ওরা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করবে কিন্তু ওদের মেয়ে বাঙালি ছেলেদের কাছে বিয়ে দেবে না। আমাদের মুসলমান বলেই মনে করে না। আজ আমরা ওদের মনে প্রাণে ঘৃণা করি। যদি সব মিটে যায় তাহলেও কলে কারখানায় অফিস আদালতে আমরা এক সঙ্গে চলতে পারব না। মাটির হাঁড়ি ফেটে গেলে জোড়া দেয়া যায় কিন্তু সেটা বেশি দিন থাকে না, দাগও মিলিয়ে যায় না।
“সােজা কথায় আমরা এখন ওদের সঙ্গে পারব না। ওরা শহর দখল করবার দিকে নজর দেবে। বর্ষা আসছে। তার আগেই শহরগুলাে দখল কজায় আনবে। আর তার সঙ্গে একদল মিরজাফর উমিচাদ তৈরি করবার চেষ্টা করবে। তাতে কিছু লাভ হবে না অবশ্য। ওরা কিন্তু আমাদের হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিয়েছে। তবুও চেষ্টা করবে। আজ শেখ সাহেব বা আওয়ামী লীগ নয়, এটা বাঙালির যুদ্ধ, বাঙালির সংগ্রাম, বাংলার লড়াই। আমরা ধর্ম ও ন্যায়ের যুদ্ধ করছি। আল্লাহ তালা বলেছেন আমি তখনই কোননা জাতিকে সাহায্য করি যখন সে নিজে নিজেকে সাহায্য করে। এখন যে লড়াই করছি আমি জানি এটা লড়াই-এর কোনও অংশই নয়। তবুও বাধা দেবার চেষ্টা করছি কারণ বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ ও অত্যাচার কি জিনিস সেটা জানা দরকার। আর সঙ্গে সঙ্গে বহু অসামরিক ব্যক্তিকে আমরা আমাদের সাথে পাচ্ছি, এরা পরবর্তীকালে সৈনিক হবে। ঐ দেখেন ট্রানজিস্টরের সামনে কত মানুষ। ইন্ডিয়ার খবরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ইন্ডিয়া রেডিও যে ঠিক খবর সব সময় দিচ্ছে মুক্তিফৌজ সম্পর্কে, তা নয় তবুও এইসব সাধারণ মানুষ, এরা মনে প্রাণে চায়, বিশ্বাস করে, এদের ভাবতে ভালাে লাগে যে সব জায়গায় মুক্তিফৌজ জিতছে পাক সৈন্য হটে যাচ্ছে। এই মানসিকতারও প্রয়ােজন আছে। এক সময়ে আসর ভাঙল।
সূত্র: কম্পাস, ১২ই জুন ১৯৭১