বাংলাদেশে সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে (৬)
শকুন্তল সেন
এদের সঙ্গেই আশ্রয় ছুটে গেল। হলাে না কুমিল্লা দিয়ে সীমান্ত পার হওয়া! ভাবছি আর ভাবছি। আর্থিক সংগতি নেই—তাছাড়া যে অবস্থা তাতে কোনও সীমান্তের কাছাকাছি যাওয়াও অসম্ভব। দ্রিাহীন রাত কেটে গেল।।
৩১শে মার্চ। সকাল ৮টা নাগাদ এলাম চাঁদপুর এর টার্মিনালে। যদিও অপেক্ষাকৃত পরে এ শহরটাই নিরাপদ তাহলেও আমার পরিকল্পনা হলাে যশাের খুলনার সীমান্তের কাছাকাছি যাবার। হাজার হাজার শরণার্থীর চাপে চাঁদপুর শহর ভারাক্রান্ত। আমলীগ এর স্বেচ্ছাসেবকরা সাধ্য মতাে তাদের জন্য চেষ্টা করছে। আমলীগের নির্দেশে লঞ্চ চলেছে শরণার্থীদের নিয়ে রেল, বাস বন্ধ।
বহু কষ্টে ঘাটে এলাম। একটা লঞ্চ প্রায় খালি শুনলাম বরিশাল যাবে। যাত্রী খুব কম। উঠতে যেতেই বলল পাঁচটাকা লাগবে। কয়েকজন মিলে নাকি এটা ভাড়া করেছে। ঠিক আছে তাই দেব। আমার সম্বল মাত্র একটাকা আর সামান্য কিছু খুচরা! দৌড়ে গেলাম কাছের দোকানগুলাের দিকে। আর কোনােদিন যা করিনি- ভাবিনি, তাই করতে হলাে। দামী একটা টেরী উলের প্যান্ট ছিল। অনেক অনুরােধের পর সেই নতুন প্যান্ট যার দাম প্রায় একশ টাকা-বিক্রি করলাম সাত টাকায়।
কেউ কিনতে চায় না হাতে পায়ে ধরে বিক্রী করা গেল। অন্যদিকে তাকাবার সময় নেই। দৌড়ে লঞ্চে উঠলাম। যাত্রী আমাকে নিয়ে জনা পঞ্চাশ হবে। একটু অবাক হলাম। এত যাত্রী ঘাটে অথচ এই সামান্য সংখ্যক যাত্রী নিয়ে এটা যাচ্ছে। যাত্রীরা সকলেই সমর্থ যুবক। লঞ্চ ছেড়ে দিল। বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা কি! কেমন যেন সব চুপচাপ।
আস্তে আস্তে চাদপুর শহর পেরিয়ে এলাম। লঞ্চে টিকিট কাটবার কেরানী বাবু নেই সারেংও দেখতে পাচ্ছি না।
এত বড় লঞ্চে আমরা কয়েক জন মাত্র! তারপর শুরু হলাে ফিসফিস গুঞ্জন! আমি নিচতলা থেকে উপর তলায় ঠিক সারেঙ্গের কোঠার পেছন দিকে বসলাম। লঞ্চ তখন দরিয়ায় এখনও চাঁদপুর বন্দর পুরােপুরি ছেড়ে আসেনি। দু-জন যুবক লঞ্চ চালাচ্ছে। কি যেন বলছে! কান পেতে থাকি। গােড়া থেকেই এদের ভাবগতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। এখানে ওখানে কয়েকটি রাইফেল! জিনিসপত্র খুব সামান্যই।
“আমি তাে আগেই বলেছি লঞ্চ চালাতে পারি না। রাস্তাও আমার চেনা নেই।”
ফিসফাস ক্রমশ গুঞ্জনে, তারপর গর্জনে পরিণত! সর্বনাশ, আবার কিসের পাল্লায় পড়লাম! ফ্রম ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার ‘ কি একেই বলে! ছিলাম নিরাপদে চাদপুরে; কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতাে না ভেবে চিন্তে উঠলাম লঞ্চে! এখন দেখা যাচ্ছে এরা ই, পি, আর, এর পলাতক সৈনিক। সকলেই বরিশাল যাবে। এই লঞ্চ ভাড়া তাে দূরে কথা বলেওনি! স্রেফ চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে। এত লােকের মাঝ থেকে কী করে যে এই কাণ্ডটা করল। জানা গেল, ভাড়ার কথাবার্তা বলেছে গতকাল রাতে। সেই সূত্রেই, আলাপ করেছে কয়েক জন সেই সূত্রেই লঞ্চে রাত্রি বাস করেছে। আজ সকালে সকলে এক হবার পর এই কারবার। দলের সকলে এটা জানেও না কয়েক জনের প্ল্যান। সর্বনাশের তখনও কিছুটা বাকি। তেল নেই—যা আছে তাতে বরিশাল তাে দূরের কথা তার অর্ধেক পথ যাওয়াও সম্ভবপর নয়।
না! বাঁচার আর পথ নেই দেখছি। ভয় দুটো। প্রথমত এরা যদি নিজেরা উত্তেজিত হয়ে মারামারি শুরু করে যা রকম সকম তাতে সেটা এমন কিছু বিচিত্র নয় স্বাভাবিক ভাবেই তখন গুলি ছুড়বে। আর এই মাঝ দরিয়ায় পালাবার পথ নেই! দ্বিতীয়টা আরও মারাত্মক যখন চাঁদপুর বন্দরে লঞ্চের খোঁজ পড়বে তখন! স্পিড বোেট নিয়ে আমলীগের সেচ্ছাসেবক এবং মালিক যদি পিছু ধাওয়া করে তাহলে! হাজার হাজার শরণার্থীকে এভাবে বঞ্চিত করে এই প্রচণ্ড সংকটে আমরা কয়েক জন পালিয়ে যাচ্ছি। গুরুতর পরিস্থিতি।
হেলে দুলে এঁকে বেঁকে লঞ্চ চলছে। যে দুজন চালাচ্ছিল তাদের পরামর্শ দাতা আমরা এখন সকলেই এমন কি আমিও! কেউ আবার বলছে বাঁয়ে বাঁয়ে, ডাইনে চাড় বলছে। এই বায়ে আর ডাইনে নিয়েই লেগে গেল ধুন্দুমার কাণ্ড! সকলের মনে এক ভয় যদি ধরা পড়ি। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি তত দেরী! এগিয়ে গেলাম এছাড়া পথও নেই।
বললাম “আপনারা কাজটা খুব খারাপ করেছেন। এখন যা হবার তা হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মধ্যে রাস্তা কে চেনে? একজন বৃদ্ধ মতাে লোেক এগিয়ে এল। তাকে বসিয়ে দিলাম যে দুজন চালাচ্ছিল তাদের পাশে। সবাইকে নেমে যেতে বললাম নিচ তলায়। এবার লঞ্চ মােটামুটি চলছে। একটু পরেই শুনি তেল পাস করছে না! এ আর এক বিপদ। দেখা গেল, যে ট্যাঙ্কে তেল থাকবার কথা সেখানে তেল নেই_পাস করবার কথাই ওঠে না। কী ব্যাপার! একজন অন্যজনকে দোষারােপ করছে। তেলের জন্য নাকি ষাট টাকা দেওয়া হয়েছিল! সে বলছে তেল সে ঠিকই ভরেছে কিন্তু রাত্রে ব্যাটারা অর্থাৎ লঞ্চের মালিকরা সব তেল সরিয়ে ফেলেছে। এই নিয়ে আবার চীৎকার চেঁচামেচি। দুই দল হয়ে গেল। একদল বলছে তেল আদৌ ভরা হয়নি, অন্য দল তার তীব্র প্রতিবাদ করছে। মাঝ দরিয়ায় এই মেঘনা নদীর বুকে আমাদের চীৎকারে আশে পাশের নৌকাগুলাের মানুষেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
নেমে এলাম নিচে। খুঁজে খুঁজে একটা ছােট মতাে ড্রামে কিছু তেল বের করে ইঞ্জিনে দেওয়া এক বিরাট সমস্যা। আমার তাে এ বিষয়ে কোনও আইডিয়াই নেই। দেখা গেল আমার মতাে সকলেই। কথায় আছে বিপদে বুদ্ধি বাড়ে। অনেক কসরৎ করে তাে একটা ব্যবস্থা করা গেল ঠিকমতাে হলাে। অনেক কষ্টে লঞ্চ চলছে।
এখন সকলেই একটু ঠাণ্ডা শুধু আমার মাথায় চিন্তা। রাস্তাঘাট চিনি না পরিচিত কেউ নেই—পরিবহন নেই। সঙ্গে রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমুনিস্ট পার্টির (মাঃ লেঃ) গােপন প্রচার পুস্তিকা-প্রচার পত্র। এরা তাে সকলেই আমলীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। যদিও আমার সঙ্গে শেখ সাহেবের রেকর্ডখানা, স্বাধীন বাংলার পতাকা ও আমলীগের কিছু কিছু কাগজ আছে, তা হলেও এরা কমুনিস্ট পার্টির প্রচার পুস্তিকাগুলাে কোনাে দৃষ্টিভঙ্গিতে নেবে কে জানে। যদি আমার পােটলাটা হঠাৎ খুলতে বলে তাহলেই আমি আর নেই। এরা যতদূর দেখছি সকলেই একদলের। রাইফেলের সংখ্যা ছয়। গুলিও রয়েছে।
এই সফরে যা দেখছি এতদিন ধরে, কমুনিস্ট পার্টি বা উগ্রপন্থীদের সম্পর্কে তত ভালাে ধারণা কারাে নেই কয়েকটি পকেট ছাড়া—তাও খুব সামান্য। আমাকে যদি ভুল করে যা দেখছি এক মুহূর্ত চিন্তা না করে আমাকে গুলি করে মাঝ দরিয়ার ফেলে দিলেই বা কে দেখছে। এখন এসব চিন্তা করার কোনােই অর্থ নেই।
বেলা বেড়ে চলেছে। লঞ্চ আর চলে না! আমরা পদ্মায় পড়েছি, দিগন্ত বিস্তৃত। বিরাট বিরাট ঢেউ! একূল ওকূল দেখা যায় না। সকলের পরামর্শ মতাে লঞ্চ ডানদিকে তীর বরাবর নিয়ে যাওয়া হলাে। আর তাে লঞ্চ চলে না। যে জায়গাটায় এলাম, শুনলাম এখান দিয়ে ভােলা যাওয়া যায়, বাঁদিকে হিজল। একসময় লঞ্চ থেমে পড়ল নােঙ্গর ফেলা হলাে! বেলা প্রায় এগারােটা। সীমাহীন মাঠ বিস্তৃত নদী। কোথায় যাবে। তারপর জানা গেল আরও ভালাে কথা -এ অঞ্চল ডাকাতের আড্ডা। আমরা বরিশাল জেলায়! অনেক হাঁকাহাঁকির পর এক বৃদ্ধ মাঝি এল তার নৌকা নিয়ে।
“ও মাঝি আমাদের পার কর।” সমস্বরে আমরা চীকার করে বলি।
“কোথায় যাবেন।”
“আমরা মুক্তিফৌজ। যাবাে লঞ্চের তেল আনতে। শীগগির পার কর।” মুক্তিফৌজ শুনে মাঝি আর কথা বলল না। কয়েকবার খেপ দিয়ে আমাদের পার করে দিল।
মাঝি জিজ্ঞেস করে “আপনারা সকলেই নেমে গেলেন দেখছি, লঞ্চ দেখবে কেডা!” ক্যান, তুমি!” “আমি লঞ্চ পাহারা দিমু। আমার মাছ ধরা আছে না।” “ওসব রাখ এখন। ঠিক মতাে পাহারা দাও একটু ক্ষতি হইলে মরবা।” বিরস বদনে মাঝি নৌকা লঞ্চের গায়ে বেঁধে উঠে বসে!
নৌকায় যে জায়গায় নামিয়ে দিল সেটা চষা মাঠ। কাদা আর জল। এখান থেকে এক মাইল মতাে হেঁটে গেলে হিজল। হাঁটতে পারছি না কাদায় হাটু পর্যন্ত ডেবে যাচ্ছে! এত কষ্টও ছিল। চাষিরা প্রশ্ন করছে “কোথা থেকে এলেন, কোথায় যাবেন, ঢাকার খবর একটু বলে যান। শেখ সাহেবের খবর কি জানেননি কিছু। শুনলাম শেখ সাহেবের বড় ছেলে কামালকে নাকি গুলি করছে পাক সৈন্যরা।” এই ধরনের অসংখ্য প্রশ্ন। আমি চুপচাপ চলছি। চলতে পারছি না—তবুও চলতে হচ্ছে। লঞ্চেই ওরা পাঁচ টাকা নিয়েছে। মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য, নিচে কাদা জল। এক মাইল এর মতাে পথ হেঁটে একটু ভালাে রাস্তা পাওয়া গেল! এখান থেকে আমাদের হাঁটতে হবে অন্তত ১৪ মাইল। পৌছব মুলাদি বন্দরে! জানিনা সেখান থেকে কিভাবে যাবাে বরিশাল। আপাতত লক্ষ্য মুলাদি। প্রখর সূর্যের তাপে শরীর ঝলসে যাচ্ছে। সামান্য বােঝাও ভারী মনে হচ্ছে। ক্লান্তি ও শ্রান্তিতে পা ভেঙে আসছে তবুও চলতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ছােট খাল এক বাঁশের সাঁকো কোনােদিন পার হইনি। যদি পিছলে পড়ি তাহলে! কোনাে কোনাে গ্রামের লােকেরা পানি দিচ্ছে খেতে কেউ বা আনছে ডাব।
চলেছি গ্রামের মেঠো পথ ধরে। আম, সুপারী, নারকেল বাগানের মধ্য দিয়ে। সকলেই দ্রুতগতিতে হাঁটছে। আমার সঙ্গের সকলেই মুসলিম, আমি একমাত্র ব্যতিক্রম। আমার পরনে লুঙ্গি আর হাফসার্ট! আজ ঘটনাচক্র অন্যরকম নয়তাে এ পথ দিয়ে চলতে গেলে দিনের বেলাই লুট হয়ে যায় জিনিসপত্র। চলতে চলতে নানারকম কথাবার্তা বলছে। এদের বেশির ভাগ ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জের। দু-তিন জন বাদে সকলেই ই, পি, আর। আগেই সকলকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তাহলে বলতে যে ভােলা যাবার লঞ্চ আমাদের নামিয়ে দিয়েছে। দ্রুতগতিতে হাঁটবার আর একটি কারণ আমাদের ধরা পড়বার ভয়!
পর পর দুটি খেয়া পার হয়ে আমরা যখন মুলাদি এসে পৌছলাম তখন বেলা প্রায় আড়াইটা। বহু লােক এসে আমাদের ঘিরে ধরল। আমার এতটা পথ হেঁটে এসে কথা বলবার মতাে শক্তি এতটুকু অবশিষ্ট নেই। হাঁপাচ্ছি পায়ে অসম্ভব যন্ত্রণা। এদের মধ্যে অনেকেই হােটেলে ভাত খেয়ে নিল। এখান থেকে আরও প্রায় পঁচিশ মাইল গেলে বরিশাল। এরা হেঁটেই রওনা দেবে। আওয়ামী লীগের লােকেরা চিড়া গুড় দিলেন। আমার খাবার সামান্যতম ইচ্ছাও নেই। চুপ করে বসে আছি। অসম্ভব রােদ আর গরমে শরীর ভেঙে আসছে! এক গ্লাস জল নিয়ে মুখ ধােবার জন্য বাইরে বেরিয়েছি তারপর সব অন্ধকার। শুধু শুনলাম পড়ে গেল ধর ধর।” কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। জ্ঞান ফিরতে দেখি একটা চৌকিতে শুয়ে আছি! বহু লােক ঘিরে আছে। কেউ পাখার বাতাস দিচ্ছে, কেউ মাথায় জল দিচ্ছে। গা, হাত, পা টিপছে কেউ কেউ। চোখ মেলে তাকাতেই এক জ্বলােক এক গ্লাস দুধ সামনে ধরলেন। কথা বলতে পারছি না খাবারও ইচ্ছা নেই। হাত নেড়ে দুধ খাব না বললাম। ভদ্রলােক শুনলেন না জোর করে খাইয়ে দিলেন। শরীরের বিভিন্ন অংশে জ্বালা করছে।
এখন একটু সুস্থ বােধ করছি। যিনি আশ্রয় দিয়েছেন তিনি স্থানীয় একটি ব্যাঙ্কের চীফ ক্যাশিয়ার। ভদ্র, সজ্জন। এঁর এক ভাই এই গােলমালের কয়েকদিন আগে ঢাকায় গিয়েছেন এখনও তার কোনাে খোঁজ নেই। এই পরিবারের অকুণ্ঠ সেবায় আমি ব্ৰিত বােধ করছিলাম। তিনি বললেন “আপনার মতাে আমার ভাইও হয়ত আজ যদি বেঁচে থাকে এমনি করে পথে পথে ঘুরছে। আমার একমাত্র ছােট ভাই।” তাঁর চোখের কোণে জল। আমি বললাম “আল্লার কাছে দোয়া করেন-ভালয় ভালয় ফিরে আসুক।” “মাস্টার সাহেব আপনার জন্য আপনার বাড়িতে আজ কি অবস্থা আমারও সেই অবস্থা। এক বছরও হয়নি বিয়া দিয়েছি। বৌটা সব সময় কান্নাকাটি করছে।”
সন্ধ্যার মুখে দুজনে সামনেই বড় নদীতে স্নান করতে গেলাম। আমার সঙ্গীরা সব চলে গেছে। এখন আমি একা! কি বিচিত্র ভাগ্য! কোথায় কলকাতা আর কোথায় বরিশাল জেলার এই ছােট বন্দর মুলাদি। কলকাতা তাে অনেক দূরের পথ-ঘরের কাছে চাঁদপুর বরিশাল আমার পক্ষে এখন অনধিগম্য। বড় বড় টাউনে অথবা জনতার সঙ্গে একসঙ্গে চললে, থাকলে, ভয়ের বিপদের আশঙ্কা কম। কিন্তু এই রকম ছােট্ট অঞ্চলে থাকার অসুবিধা অনেক সুবিধাও আছে। ছােট জায়গা বলে খুব তাড়াতাড়ি ঘনিষ্ঠতা হয় স্বাভাবিক কারণেই একজন হিন্দুর পক্ষে সব সময় মুসলমানদের অভিনয় করে যাওয়া খুবই অসুবিধাজনক। বাস্তব কতগুলাে অসুবিধা আছে। তাছাড়া আমার পরিচয় খুলনা অঞ্চলের একজন শিক্ষক। সুতরাং আমার নিশ্চয়ই ধর্মসংক্রান্ত সবকিছু জানা উচিত পালন করি বা না করি অনেকেই করছেন না।
ভয় ও আশঙ্কা আছে। যদিও দেশে এখন স্বাধীনতার সংগ্রাম চলছে কিন্তু একথা মানা অসম্ভব যেসব লােক খাটি সােনা হয়ে গেছে অথবা সকলেই একেবারে ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অনুগত।
যে কোনাে সময়ে যে কোনাে ব্যক্তি আমাকে ধরিয়ে দিয়ে হাজার হাজার টাকা ইনাম ও সেই সাথে গুছিয়ে নিতে পারে ভবিষ্যত। ২৬শে মার্চ থেকে পাক বেতার থেকে নিয়মিত প্রচার করছে হিন্দুস্থানের স্পাইরা দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসমূলক কাজকর্মে লিপ্ত, তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে প্রচুর পুরস্কার। নিকটবর্তী মার্শাল ল কর্তৃপক্ষের নিকট যােগাযােগ করুন।” আমি স্পাই নই কিন্তু একবার ধরতে পারলে কে কার কথা শােনে! মানুষের মনে লােভ নেই একথা জোর করে বলা যায় না। তাছাড়া আমার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল)-এর নিষিদ্ধ পুস্তক প্রচারপত্র ইত্যাদি রয়েছে। বিপদ অনেক দিক থেকেই। আর সেই বিপদেই পড়লাম এখানে।
সূত্র: কম্পাস, ২৯শে মে, ১৯৭১