নতুন বাংলাদেশ : দেশ গঠনের সমস্যা
অসিত ভট্টাচাৰ্য্য
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ বাস্তব সত্য। পৃথিবীর কোনাে তর্কসভা বা তার সুপারিশ, কিম্বা কোনাে মহাশক্তির নির্বোধ হম্বিতম্বি, স্বাধীন বাংলাদেশের এই গৌরবময় আত্মপ্রকাশকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে না। করতে পারবে না। স্বভাবতই এ-পার ওপার দু-পার বাংলার মানুষই আজ অনাস্বাদিত আনন্দের আবেগে বিহ্বল ও আত্মহারা। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাঙালি জাতির জীবনে এক দীর্ঘ তমসাময়ী কাল-রজনীর অবসান হলাে দুই বাংলার জনসাধারণই তা আজ নিজেদের অনুতে অনুতে দুই বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে অনুভব করছেন। তাই আজ দুই বাংলার পথে পথে গ্রামে-গঞ্জে শহরে-বন্দরে স্বতঃস্ফুর্ত উল্লাস- যার তুলনা বাঙালি জাতির ইতিহাসে মেলে না।
কিন্তু এই আনন্দ বিহ্বল মুহূর্তেও বাস্তব পরিস্থিতি বিস্মৃত হলে ভুল করা হবে। মনে রাখতে হবে যে, উত্তেজনার পর অবসাদ আসে। আবেগ বিহ্বলতার পরেই জাগে জিজ্ঞাসা। অচিরেই বাংলাদেশের জনসাধারণ জিজ্ঞাসা করবে রক্তের বিনিময়ে আমরা কী পেলাম?’ এর আগেও তাে তারা একবার শুনেছিল যে তারা স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সেটা যে কত বড়াে প্রতারণা তাও তারা অচিরকালের মধ্যেই বুঝতে পারে। জনসাধারণের সরল প্রশ্ন ও সঙ্গত দাবীকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে ও সদম্ভে দাবিয়ে রাখতে গিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি নিজেই নিজের কবর খুঁড়ে তাতে শায়িত হলাে। সেই অভিজ্ঞতা জনসাধারণের স্মৃতিতে নিত্য জাগরুক। একথা মনে রেখেই “বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেতাদেরও তার বন্ধু রাষ্ট্র ভারতকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রয়ােজনের দিকে সজাগ ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দিয়ে প্রথম থেকে দেশ গঠনের পথে অগ্রসর হতে হবে। এখন শুধু অতীত শােষণের কথা বললে চলবে না। এমনকি শত্রুর নারকীয় নির্মম হামলা ও হানাদারির কথা বলে জনসাধারণের সংগ্রামী চেতনাকে জাগ্রত করে রাখা-ই যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে সঙ্গে দরকার বাংলাদেশের বাস্তব প্রয়ােজন কী, সে বিষয়ে অবহিত থেকে সেসব প্রয়ােজন পূরণের জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করা এবং সে কাজে জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে, জনসাধারণের সক্রিয় সহযােগিতা অর্জন করা।
আজকের বাংলাদেশের বাস্তব প্রয়ােজন কী, তার বিচার করতে গেলে প্রথমে দিশাহারা লাগে। গত চব্বিশ বছরে এক অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তার ওপর কায়েম করা হয়। চারিপাশের সঙ্গে বাংলাদেশের যােগাযােগ-যাতায়াত শিল্পবাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক যােগসূত্রগুলাে ইচ্ছে করে বলপূর্বক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করা হয়। তার ওপর গত নয় মাসের হানাদারী হামলা ও তারই অনিবার্য ফলস্বরূপ অন্তযুদ্ধ ও যুদ্ধে যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে, তার একটা প্রাথমিক খতিয়ান (estimate) ও আমাদের জানা নেই। কত মাইল রেলপথ ও সড়ক ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কত রকম সেতু উড়ে গেছে তাদের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ এবং ভারবহন ক্ষমতা জলযান সমেত সামগ্রিক পরিবহন ক্ষমতা কতটা নষ্ট বা অকেজো হয়ে গেছে, টেলিফোন সমেত যােগাযােগ ব্যবস্থা (communication channels) কতটা বিপর্যস্ত হয়েছে তাও আমরা জানি না। এছাড়া কতগুলাে গ্রাম ও শহর হানাদাররা ধ্বংস করেছে, কি পরিমাণ এলাকায় চাষ হয়নি বা এবার ফসল পাওয়া যাবে না, কলকারখানা, গ্যাস ও পাওয়ার স্টেশন ও লাইন এবং নদী ও সাগর বন্দর, চা-বাগিচা, পাট গুদাম ও অন্যান্য সঞ্চিত ও সম্পদ কতটা নষ্ট ও লুষ্ঠিত হয়েছে তারও হিসেব নেই। এবং সবচেয়ে বড়াে কথা, অত্যাচারিত হয়ে কতাে লােক কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে কতাে পরিবার অনাথ হয়েছে, কার সম্পত্তি কে হস্তগত করেছে, এ সবই প্রকাণ্ড এক একটি প্রশ্নের খড়গ হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রতরণীর কর্ণধারদের মাথার উপরে ঝুলছে। এমনকি দেশের মুদ্রা ব্যবস্থা বলতেও কিছু নেই এখন। সমস্তই অনিশ্চিত। সবই অস্থির।
এই অবস্থায় প্রয়ােজনের হিসেব করতে বসলে, সে হিসেব এক জীবনেও শেষ হবে বলে মনে হয় না। প্রকাণ্ড একটা তালিকা তৈরি করে লাভও নেই কিছু। আমাদের বিশ্লেষণের প্রয়ােজনে এবং কাজের সুবিধার্থে আমরা বাংলাদেশের প্রয়ােজনগুলােকে (needs) তিন ভাগে ভাগ করবাে। (১) আশু ও অব্যবহিত (২) পরবর্তীকালীন বা মধ্যবর্তী (৩) দীর্ঘ মেয়াদী।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিশ্লেষণের খতিয়ানে এগুলাে যতই স্বতন্ত্র দেখাক, বাস্তবে অনেকটাই পরস্পর-সংলগ্ন, অনেক ক্ষেত্রে একাকার।
আশু প্রয়ােজন
বাংলাদেশের আশু ও অব্যবহিত প্রয়ােজন কী? নিঃসন্দেহে তা হলাে (১) বাস্তুহারা ও বিতাড়িত জনসাধারণের পুনর্বাসন। যে এক কোটি লােক সাম্প্রতিক হামলায় ভারতে শরণার্থী হয়ে এসেছেন তাদের স্বগৃহে পুনর্বাসন তাে বটেই বাংলাদেশের ভিতরেই যারা খান সেনাদের অত্যাচারে বা দৃষ্টি এড়াবার জন্য স্বগৃহ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন, তাঁদেরও পুনর্বাসনের সমস্যা আছে। উভয়ত অনেকের-ই গৃহ ভস্মীভূত ও লুণ্ঠিত গ্রাম শ্মশান। এছাড়া পুনর্বাসন সমস্যার আরাে একটি দিক আছে। এই হামলার আগে গত ১৯৭০ এও লক্ষাধিক মানুষ ইয়াহিয়া সরকার ও তার দালালদের অত্যাচারে এদেশে শরণার্থী হয়ে আসতে বাধ্য হন। সুতরাং কোন সময় থেকে আগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন দেবার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করবেন, সেটা গােড়া থেকেই স্পষ্ট থাকা দরকার। তা না থাকলে, নতুন রাষ্ট্র ও সরকার একটা অসম্ভব পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন। এ বিষয়ে স্পষ্টত কিছু জানা না গেলেও শােনা যায় যে, বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ আলােচনা কালে এরকম মত জ্ঞাপন করেছেন যে, তাঁরা ১৯৬৪ ও তার পরবর্তী বছরগুলােতে আগত শরণার্থীদের মধ্যে যারা ফিরে যেতে চান তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে পারেন। এটা যদি সত্য হয় তাহলে এই সিদ্ধান্তকে আমরা অভিনন্দন জানাবাে। শুধু এক্ষেত্রে যা করণীয় মনে করি তা হলাে যারা যত শেষে এসেছে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাদের তত অগ্রাধিকার (Priority) দেওয়া। অর্থাৎ আগে ১৯৭১ তারপর ১৯৭০ এইভাবে ১৯৬৪ পর্যন্ত আগত শরণার্থীদের দেশে ফেরার সুযোেগ দেওয়া। দ্বিতীয়ত শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন যাতে একটা অনিয়ন্ত্রিত, বিশৃঙ্খল জনতার প্রতিস্রোত (counter current তথা uncontrolled counter migration) সৃষ্টি না করে সেটা দেখা একান্ত দরকার। এর জন্য এ দেশেই একাধিক শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার এবং যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ কিছুদিন নিয়ন্ত্রিত রাখা কর্তব্য। নির্দিষ্ট চেক পােস্ট দিয়ে প্রত্যাবর্তনের যে ব্যবস্থা সম্প্রতি গৃহীত হয়েছে তা খুবই সঙ্গত। যারা যারা ফিরে যাবেন তাদের নাম-ধামের রেকর্ড ভারত ও বাংলাদেশ উভয় সরকারের প্রতিনিধিদের কাছেই প্রথম থেকে একসঙ্গে রাখার ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত দরকার। তা না হলে ভবিষ্যতে এই নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত পুনর্বাসন সমস্যার একটি রাজনৈতিক দিক আছে, প্রথম থেকেই বাংলাদেশ সরকারকে তা দৃঢ়তার সঙ্গে মােকাবিলা করতে হবে মনে করি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মাননীয় কামরুজ্জামান সাহেব সবল কণ্ঠে বলেছেন যে, শত্রুর সঙ্গে যারা সহযােগিতা করেছে অথবা তাদের দালাল হিসেবে কাজ করেছে এমন অফিসারদেরও আলাদা আলাদা করার জন্য Screening Commitee বসবে এবং সমস্ত দালালদের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের জন্য বিশেষ ট্রাইবুন্যাল চালু করা হবে। পুনর্বাসন সমস্যার সঙ্গে অপরাধী ও দালালদের শাস্তি বিধানের ও বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের সমস্যাটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কারণ যে সব শয়তান ব্যক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে গত কয়েক বছরে নানা অত্যাচার অনুষ্ঠান করে নিরীহ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে অথবা গ্রামের যে সব কুলাক ও তাদের টাউট শ্রেণীর লােক সম্পত্তির লােভে নানাভাবে দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টি করে মানুষকে বাস্তুহারা করেছে তারা যদি নতুন যুগে, নতুন সরকারে নতুন ব্যবস্থাপনাতেও বুক ফুলিয়ে চলে বা চলার সুযােগ পায় তাহলে বাস্তুহারা ও শরণার্থীদের পুনর্বাসন কখনাে নির্বিঘ্ন বা সম্পন্ন হবে না। দেখা যাবে যে এইসব ব্যক্তিই গত নয় মাসেও হানাদারদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছে লুঠেরাদের ভুক্তাবশিষ্ট নিজেদের পাতে পড়বে এই আশায়। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার যদি এদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা নিতে অগ্রসর হন তাহলে তারা দেখবেন এবং আমরাও দেখব যে, অপরাধী ও অপরাধপ্রবণ আমলা অফিসার কুলাক ও টাউটদের জনসাধারণের থেকে আলাদা করে ফেলা সম্ভব হবে। পুনর্বাসন নির্বিঘ্নে ও দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করতে হলে, এই কাজে তাদের এখনই হাত দিতে হবে।
শিক্ষাজগতে ও সংবাদপত্রে যে সব পশ্চিম পুঁজির দালাল অনুরূপভাবে শত্রুর সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহযােগিতা করেছে এবং নাগরিক জীবনের নানা স্তরে প্রভাবশালী অবস্থায় থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যান্য কুৎসিত গণবিরােধী ভাব প্রচার করে আসছে সেই সব ব্যক্তিদের স্ব স্ব ক্ষেত্ৰ উৎখাত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে তবেই জনসাধারণের মনে সত্যকার আশা ও উৎসাহের সঞ্চার হবে এবং নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ যে ধর্ম-নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে নয়া-জীবন গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদের যাত্রারম্ভ করেছেন সেই নয়া জীবনও বাস্তবে ত্বরায় রূপ নিতে পারবে।
পুনর্বাসনে রাজনৈতিক দিকটি নিয়ে একটু বিশদভাবেই আলােচনা করা প্রয়ােজন মনে করি, কারণ আরম্ভে নতুন সরকার যে প্রশাসনিক কাঠামাে ও তার চেয়েও বড়াে কথা যে প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও কর্ম প্রণালী গড়ে তুলবেন, তার উপর তাদের ভবিষ্যৎ সার্থক হবে কি না, তা বহুলাংশে নির্ভর করছে। মুসলিম লীগের দেউলিয়া, গণবিরােধী কার্যত বাঙালি জাতির পথে মৃত্যুবাহী দুঃশাসননীতি তার শুরু থেকেই ফুটে ওঠে এবং তার প্রতি জনসাধারণের বিরােধিতা ও দেশভাগের অল্প কালের মধ্যেই প্রত্যক্ষ হয়। কে না জানে নুরুল আমিন সেই কারণেই প্রায় শুরু থেকে সমস্ত উপনির্বাচন বন্ধ রেখেছিল? আশা করা যায় যে, নতুন সরকার প্রথম থেকেই সতর্ক ও সজাগ থাকবেন এবং কোনাে ক্ষেত্রেই নিজেদের ঘােষিত নীতি থেকে এতটুকু বিচ্যুতি ঘটতে দেবেন না। যে সব যুবক মুক্তিবাহিনী গঠনে সাহায্য করেন, এ সব কাজে তাদের সাহায্য সহযােগিতাও তারা গ্রহণ করতে পারেন।
পুনর্বাসনের জন্য অন্যান্য যে জিনিস ও ব্যবস্থাগুলাে অব্যবহিত প্রয়ােজন তা হলাে-
১. যােগাযােগ ও যাতায়াতের একটি প্রাথমিক ব্যবস্থা চালু করা। এর মধ্যে ডাক তার, টেলি
যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং তাছাড়া রেল, স্টিমার এবং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার প্রশ্নটি প্রধান।
২. দ্বিতীয়ত কতকগুলাে অত্যাবশ্যক পণ্যের সরবরাহ এখনই চালু করা দরকার। এর মধ্যে চাল, ডাল, কাপড়, চিনি, নুন, কেরােসিন তেল, সর্ষের তেল এবং বাড়ির টিন উল্লেখযােগ্য। অবশ্য সরবরাহ সর্বত্র চালু করার আগেই রেল, স্টিমার ও সড়ক ব্যবস্থা চালু করা দরকার। বাংলাদেশ সরকার রেডিও মারফৎ জানিয়েছেন (১৫ কি ১৬ ডিসেম্বর) যে, তারা নানা অঞ্চলে ন্যায্য মূল্যের দোকান খােলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু শুধু ন্যায্য মূল্যের দোকান খুললেই সেটা যথেষ্ট হবে না এর জন্যে সুনির্দিষ্ট রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার প্রয়ােজন। স্মরণ রাখতে হবে যে রেশনিং দুরকমের হতে পারে (ক) প্রথমত যাতে বিক্রীত পণ্যের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকে। যেমন এদেশে চাল গম সরবরাহের ক্ষেত্রে হয়। (খ) দ্বিতীয়ত যেখানে প্রতি ব্যক্তিদের মােট ক্রয় (total purchase) নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত হতে দেওয়া হয় না।
একমাত্র এই ব্যবস্থাতেই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। তাছাড়া কেবল এই ধরনের রেশনিং ব্যবস্থাতেই ধনী ব্যক্তিরা তাদের অতিরিক্ত সম্পদের সুযােগ নিয়ে দুষ্প্রাপ্য কিন্তু অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় পণ্যসামগ্রী অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনে প্রথম ধরনের রেশনিংকে কার্যত অচল করে দিতে পারেন না। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় একাধিক যুরােপীয় দেশে এই দুই ধরনের রেশনিং চালু ছিল। বস্তৃত ব্যক্তির মােট ক্রয় নিয়ন্ত্রিত না হলে রেশনিং ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও এই দুই ধরনের রেশনিং চালু করা কর্তব্য- তা না হলে বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত বদনামের ভাগী হবেন।
৩. এই প্রসঙ্গেই মুদ্রা ব্যবস্থার পুনগঠনের প্রশ্ন ওঠে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী পাক-মুদ্রা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এখন আর চালু নেই। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বত্র এটা এখনই সত্য হওয়া সম্ভব মনে হয় না। কারণ ক্রয়বিক্রয় সেখানে কিছু কিছু নিশ্চয়ই ঘটছে। এবং পাক মুদ্রা চালু না থাকলে অন্য কোনাে মুদ্রা ব্যবহার করছেন তাঁরা? সীমান্তবর্তী অঞ্চলে হয়তাে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহৃত হতে পারে কিন্তু অন্যত্র? যাই হােক অবিলম্বে এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়ােজন। মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার না হলে কোনাে অর্থনৈতিক কার্যসূচী ৰূপায়নের কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হবে না। যেহেতু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্জিত স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা আজ পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সঞ্চিত কিম্বা গত ন’মাসের ঘৃণিত সামরিক সন্ত্রাস-সৃজনে অপব্যয়িত, সেই হেতু ভারত সরকারের কর্তব্য হবে পূর্ববঙ্গ সরকারকে নিজস্ব মুদ্রা চালু করার ব্যাপারে উপযুক্ত ভারতীয় বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করা এবং বন্ধু রাষ্ট্রগুলােকে অনুরূপ সাহায্য দিতে অনুরােধ করা। নতুন মুদ্রা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কিং এর কার্যসূচি রূপায়নের জন্যেও উদ্যোগী হতে হবে।
৪. হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করাও আশু ও অব্যবহিত কার্যসূচির অঙ্গ। এর জন্যে প্রয়ােজনীয় ওষুধপত্র, ব্যান্ডেজ ইত্যাদির সরবরাহ অবিলম্বে চালু করা উচিত। বিভিন্ন জায়গায় অবিলম্বে চিকিৎসা কেন্দ্র খােলার কাজে ভারতীয় বাহিনীর চিকিৎসকদের কাজে লাগানাে সম্ভব
এবং আমাদের তা করা কর্তব্য।
৫. দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে যথা সত্বর খুলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দ্রুত কার্যকরী
অবস্থায় আনা দরকার। প্রথমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খােলা প্রয়ােজন এবং সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ। স্মরণ রাখতে হবে যে, দেশের শত্রু ব্যতিত আর কেউ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অচল করে আনন্দ পায় না। তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা যতদিন অচল থাকবে দেশের তরুণ ও যুব সমাজও তত দিন লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হবেন। দেশ গঠনের অন্যান্য যে কোনাে অঙ্গের মতােই শিক্ষা ব্যবস্থাকেও প্রথম থেকে গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্যে অবশ্য উপযুক্ত পাঠ্য পুস্তক ও পাঠ্যক্রম নির্ধারণের সমস্যাই জরুরি। বিশেষত আধুনিক বাংলার ও ভারতের ইতিহাসের পাঠ্যসূচি। গত দুই দশকে যেসব পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যান্য ঘৃণিত ও দূষিত ধারণা ও কুসংস্কার পরিবেশন করা হয়েছিল সেগুলােকে অবিলম্বে বরবাদ ও বাতিল করা দরকার। পরিবর্তে নতুন পাঠ্য, পাঠক্রম ও পাঠ্য-পুস্তক চালু করার জন্য এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়ােজন। অবশ্য, গণিত ও বিজ্ঞান সমস্যার ক্ষেত্রে এ সমস্যা নেই। কিন্তু Liberal Arts বা Humanities এর শিক্ষার ক্ষেত্রে এ সমস্যা আছে। বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। এদিকেও শুরু থেকে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
মধ্যবর্তী সমস্যা
আমি কতকগুলাে সমস্যা আশু ও অব্যবহিত বলেছি এবং অন্যান্য সমস্যাকে তৎপরবর্তী ও কতকগুলােকে দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা বলে উল্লেখ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলেছি যে সমস্যাগুলাে পরস্পর জড়িয়ে আছে, আমাদের উপরােক্ত বিভাজন আমাদের বিশ্লেষণের সুবিধার্থেই কৃত। বক্তব্যটি একটু ভেবে দেখা যাক।
রেল যােগাযােগের ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে বাংলা রাষ্ট্রের ১৫০০ মাইল রেল পথের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে (যমুনা ও মেঘনার পূর্ব তীরে অবস্থিত রেলপথগুলাে মিটার গেজে; অবশিষ্টাংশের প্রায় সবটাই হলাে ব্রড গেজ। বিশেষত ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী রেলপথ আজও একটি Single track metre gauge লাইন হয়ে পড়ে আছে। (যদিও 0. H. K Spate তার ভারত, পাকিস্তান ও সিংহল এর ভূ-বৃত্তান্তে দুই দশক পূর্বেই এই রেলপথটিকে অন্তত double track করে পুনর্গঠনের আবশ্যকতার কথা বলেছিলেন কিন্তু পাক সরকার সে কথায় কোনােদিন-ই কর্ণপাত করেনি।) আজকে গত নয় মাসের হানাদারী হামলা ও তার প্রতিরােধের সূত্রে এই রেলপথটির বিস্তর ক্ষতি হয়েছে। রেল যােগাযােগ চালু করার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে পুরনাে মিটার গেজ লাইনটি সংস্কার করা হবে না, তার পরিবর্তে ব্রড গেজ লাইন বসানাে হবে। এর জন্যে Comparative estimate এখনই পাওয়া দরকার। হয়তাে দেখা যাবে যে, পুরনাে মিটার গেজ ট্র্যাক নতুন করে বসাতে যে খরচ পড়বে, তার চেয়ে নতুন ব্রড গেজ লাইন বসাতে খরচ তেমন বেশি হবে না। যদি ব্রড গেজের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে ভবিষ্যতে (বা এখনই) ডবল ট্র্যাক লাইন বসবে এই ভিত্তিতে railway embankment বা রেল বাঁধ, সেতু, সিগন্যাল ও স্টেশন ইত্যাদির ব্যবস্থা করা দরকার। (এই সবের প্রকৃতিও আবার গেজ কী হবে তার উপর নির্ভর করে)। দৃষ্টি কৃপণের মতাে কেবল আশু খরচ বাঁচাবার আশায় যেন কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া না হয়। স্মরণ রাখতে হবে যে, চট্টগ্রাম বন্দরটির ভবিষ্যৎ উন্নতি শুধু পূর্ববঙ্গের সঙ্গে নয়, আসামের বর্হিবাণিজ্যের বন্দর হিসেবে কাজ করার উপরেও জড়িত। অতীতে দেশ ভাগের পূর্বে সেইভাবেই চট্টগ্রাম বন্দরটি বিকাশ করার কথা চিন্তা করা হয়েছিল এবং এটি যে রেলপথের দ্বারা যুক্ত তার পুরনাে নাম হলাে A. B. R বা আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে। আজ যখন আসামের উন্নতির জন্য সেখানকার রেলপথ ব্যবস্থাকে ক্রমে ব্রডগেজে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে তখন বাংলারাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ রেলপথকে ব্রডগেজে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না কেন? একই সঙ্গে ঢাকা-ভৈরব বাজার আখাউড়া লাকসাম চট্টগ্রাম রেলপথটি এবং শিলচর-করিমগঞ্জআখাউড়া চাঁদপুর এবং লাকসাম-চাঁদপুর লাইন দুটি ব্রডগেজে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত। এতে কাছাড় ও ত্রিপুরার উন্নয়নও দ্রুত হবে। এই একটি ব্যাপার থেকেই আমরা দেখি যে যাকে আশু ও অব্যবহিত কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে সে বিষয়েও দূর প্রসারী সিদ্ধান্তের অবকাশ রয়েছে।
এই ভূমিকার পর অব্যবহিত সমস্যার পরবর্তী করণীয় সমস্যাগুলাের একটি রেখাবয়ব নেওয়া যাক।
(১) বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহর ব্যবস্থা চালু করা। সঙ্গে সঙ্গে-কারখানাগুলাে বিশেষত রপ্তানি বাণিজ্যের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ পাট-শিল্প কারখানা, কাগজের বাের্ড ও নিউজপ্রিন্ট, কারখানা (খুলনা) ইত্যাদি চালু করা, সার (ফেঞ্চুগঞ্জ সিলেট) সিমেন্ট (ছাতক ঐ) প্রভৃতির কারখানাও একই সঙ্গে চালু করা দরকার।
এ বিষয়েও কতকগুলাে নীতি পূর্বাহ্নে স্থির না করলে পরে নানা সমস্যা দেখা দেবে। বাংলারাষ্ট্রে অধিকাংশ বড়াে কারখানাই পশ্চিমা পুঁজিপতিদের অধিকারে ছিল। কারণ আয়ুব সরকার ফ্যাসিবাদী জাপানের মতাে রাষ্ট্রিয় উদ্যোগে কারখানা গড়ে তারপর বড়াে পুঁজিপতিদের কাছে সেগুলাে বেচে দেবার নীতি (!) গ্রহণ করে ছিল। তাদের মার্কিন পৃষ্ঠপােষকদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল এতে। এইভাবে দাউদ ও আদমজীর দল নিজেরা কোনাে ঝুঁকি না নিয়ে প্রাক্তণ পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পক্ষেত্রে বৃহৎ মালিকানা লাভ করে। বর্তমানে এই সব কলকারখানা নিঃসন্দেহে স্বাধীন বাংলা সরকার নিজেরা গ্রহণ করবেন। তাঁরা যে সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার শুরু এই থেকেই হতে পারে। কিন্তু মিশ্র অর্থনীতির উপর অবিমিশ্র আস্থা শেষ পর্যন্ত বিপরীত ফল দিতে পারে। কারণ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিয় উদ্যোগের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের কর্ম প্রেরণা (incentives) থাকে না, আবার ব্যক্তিগত মালিকানায় যারা শিল্প প্রসারে উদ্যোগী তাদের উদ্যোগের প্রেরণাস্বরূপ যে মুনাফা অর্জনের তাগিদ (profit motive) তা মিশ্র অর্থনীতিতে স্বীকৃত সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য ও পন্থার পরিপন্থী বিবেচিত হয়। এই কারণে কল-কারখানা চালু করার সময়ে এটা স্পষ্ট করা দরকার যে মিশ্র অর্থনীতিতে ও সকল রকম উদ্যোগের মধ্যে একটি সাধারণ সূত্র বা common factor আছে। প্রত্যেক কারখানার সঙ্গে মালিক শ্রমিক ও সমাজ তথা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত। সুতরাং প্রত্যেক উদ্যোগের পরিচালনায় এই তিনটি গােষ্ঠির প্রতিনিধি থাকা দরকার। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কারখানার পরিচালক এবং তাদের গােষ্ঠি বহির্ভূত সরকারী বা রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি এবং শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি থাকা দরকার। এ বিষয়ে শেষ কথা বলার উদ্দেশ্য থেকে উপরােক্ত বক্তব্য পেশ করছি না। আমার বক্তব্য শুধু এই যে, বাংলাদেশ সরকার যে সমাজতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার একটি গ্রাহ্য রূপ শুরু থেকে উপস্থিত করতে পারলে তবেই তারা সার্থক হবেন। নচেৎ তাঁদের অচিরে বিশ্বাস ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে এই নতুন বাংলার প্রাণ স্বরূপ যুব সাধারণ আজ বিশেষ ভাবে সজীব, সক্রিয় ও সচেতন একটি শক্তি, তাদের আস্থা-ই নতুন সরকারকে সকল বিপদ উত্তীর্ণ করার শক্তি দেবে এবং তারা সমাজতান্ত্রিক সঙ্কল্পে দৃঢ়। (বাংলাদেশ বেতার ১৮ ডিসেম্বর ৭১ কোলকাতা সময় বেলা ১টার সংবাদে প্রচারিত ছাত্র নেতাদের যৌথ বিবৃতি প্রসঙ্গত উল্লেখ করি)। স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রত্যেক অর্থনৈতিক কর্মসূচির একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে এবং প্রত্যেক রাজনৈতিক পদক্ষেপ অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছু না কিছু দাবি করে। এই দুই অঙ্গাঙ্গী ব্যাপার।
(২) বন্যাত্ৰাণ ও জল নিষ্কাশনের জন্য আগামী বর্ষার পূর্বেই একটি প্রাথমিক কার্যসূচী প্রণয়ন ও তার বাস্তব রূপদানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ। এটি বাস্তবিকই অত্যন্ত জরুরি সমস্যা কারণ বাংলারাষ্ট্রের শতকরা ৯০ ভাগ এলাকা ইদানীংকালে বন্যাপ্লাবিত হয়, এবং তার মধ্যে উল্লেখ্য একটি অংশ বছরে অন্তত দু-বার বন্যাপ্লাবিত হয়ে থাকে। এই সমস্যার সমাধান না করলে পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ ও কৃষি অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোনাে উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ-ই নেওয়া যাবে না। এই সমস্যার মােকাবিলার জন্য আমরা এখনই যা করতে পারি তা হলাে :
(i) পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা-ব্যারেজ স্কিমটি বাংলা রাষ্ট্রের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচের কাজে লাগাতে পারে এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করা। এতে আমাদের নিজেদেরও উপকার হবে।
(ii) আসামে ব্রহ্মপুত্র নদকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সব চেষ্টা বা তার সদিচ্ছার বিষয় শােনা যায় তার সঙ্গে বাংলারাষ্ট্রের যমুনা-নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের সমস্যাকে একসঙ্গে বিচার করে দেখা। এতেও নদী নিয়ন্ত্রণের কাজ সহজ হবে এবং সকলেরই উপকার হবে। যমুনার জল উত্তর বঙ্গের নদীগুলাের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যায় কি না তাও দেখা দরকার।
(iii) মধ্যবঙ্গে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বেই যে flush_irigation schemeটি রচিত হয়েছিল এবং দেশভাগের ফলে যা বরবাদ হয়ে যায়, সেটিকে রূপ দেওয়া। এতেও উভয় বঙ্গই উপকৃত হবে।
(৩) এরপর চট্টগ্রামে মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্য প্রাক্তন পাকসরকার যে স্টিল-মিলটি খুলেছিল কিন্তু যেটিকে কার্যকরী করার জন্য উপযুক্ত কয়লা সরবরাহ বা আকরিক লৌহ সরবরাহের কোনাে ব্যবস্থা-ই তারা নেয়নি, -এবং ভারতের সঙ্গে সহযােগিতা ব্যতীত সে-রকম ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভবও ছিল না সেই ইস্পাত কারখানাটি চালু করার কথাও অনতিবিলম্বে ভাবতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ী সমস্যাবলী এই পর্যায়ে সমস্যাগুলােকে আমরা দুটি পর্যায়ে ভাগ করতে চাই।
(১) অর্থনৈতিক এবং (২) সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক। সাংস্কৃতিক বিষয়ের আলােচনা পরে করতে চাই। অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেখি যে অর্থনৈতিক সমস্যার দুটি প্রধান অঙ্গ (i) কৃষি এবং (ii) শিল্প ও পরিবহন। কিন্তু দুই সমস্যার মূলে রয়েছে একটি সমস্যা যা ঔপনিবেশিক আর্থিক কাঠামাের অনিবার্য সৃষ্টি। তাহলাে আর্থিক বিকাশের সমস্যা। যে ধরনের ভূমি ব্যবস্থা, উৎপাদন সম্পর্ক, ও শিল্পনীতি এ দেশের সামাজিক অর্থনীতির বিকাশ রুদ্ধ করে তা আমাদের ঔপনিবেশিক দাসত্বের সময়েই এ দেশের ওপর সৃষ্ট ও আরােপিত হয়। এই অসহ্য অবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে বিপথগামী করার উদ্দেশ্য নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শয়তানরা প্রথম থেকেই এ দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিতে থাকে। আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা এবং শ্রেণী বিন্যাস ও বিরােধের সঙ্গে জাতি ও সম্প্রদায়গত বিভেদের জটিল যােগ সংযােগের ফলে, আমরা সাম্রাজ্যবাদী ফাঁদে পা-দিই। দেশ ভাগের এইটাই পটভূমিকা। আজকে সেই অশুভ ঐতিহ্যকে অতিক্রম করে একটি সত্যকার সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামাের ভিত্তি স্থাপন করতে হলে, শুধু আজকের এই মুহূর্তের আবেগ বিহ্বলতাকেই চিরকালীন পুঁজি ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকলে চলবে না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামাের পক্ষে অত্যাবশ্যক নতুন এক আর্থিক ও সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ গঠনের বিষয়টাও ভাবতে হবে এবং সে কাজে হাত লাগাতে হবে।
কৃষির ক্ষেত্রে যেটা দরকার তা হলাে (ক) কুলাকদের আধিপত্য দূর করা তথা বেনামদার জমিদারি উচ্ছেদ করে জমির মালিকানার সীমা আইন নির্দেশ করা। তাকে সত্য করে তােলা। (খ) স্বল্প জমির মালিকদের উৎপাদন ভিত্তিক সমবায়ে সংহত করা (গ) ভূমিহীন কৃষক ও কৃষকদের কর্মনিযুক্ত রাখার জন্য গ্রামাঞ্চলে নতুন কর্মক্রম হাতে নেওয়া। এইসব কিছুর জন্য প্রয়ােজনীয় গ্রামীণ জমি ও সম্পত্তির নির্ভরযােগ্য record of nights তৈরি করা। প্রথমেই সে কাজে হাত দেওয়া দরকার। গ্রামীণ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত বর্ষাপ্লাবিত পূর্ববঙ্গে। যারা অবহিত তারা জানেন যে পূর্ববঙ্গে নুনের দাম পশ্চিম বঙ্গের চেয়ে বরাবর বেশি ছিল। দেশ ভাগের পর এই সমস্যা চরমে ওঠে। নুন কোরােসিন সর্ষের তেল ও দেশলাই, প্রভৃতি কয়েকটি অত্যাবশ্যক পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থার স্থায়ী উন্নতি না হলে গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণ বঞ্চনার শিকার হয়েই চলবেন। কৃষক যাতে লাভজনক মূল্যে তার উৎপন্ন পাট, আখ প্রভৃতি অর্থকরী ফসল বিক্রয় করতে পারে সেই রকম ক্রয় সংস্থা গড়ে তােলার দায়িত্বও এই সঙ্গে নিতে হবে। পাট ব্যবসায়ের জাতীয়করণ আওয়ামী লীগের একটি প্রধান দাবী এ দেশেও পাট ব্যবসায়ের জাতীয়করণ প্রয়ােজন-কারণ যে গােষ্ঠি ওখানকার পাট ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করেছে তারা এ দেশের একচেটিয়াবাদীদের সঙ্গে নানা সম্পর্কে যুক্ত। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক সরকারি ভিত্তিতে Govt.to Govt. basis- এ পরিচালিত হবে এই প্রতিশ্রুতিও বাংলারাষ্ট্রের নেতারা দিয়েছেন। আশা করা যাক দুই দেশের মধ্যেকার বাণিজ্য সম্পর্ক যাতে এই ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। ভারত সরকার সে বিষয়ে সচেতন থাকবেন। তা না হলে এ দেশের লােভী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ভারত বাংলাদেশ সম্প্রীতির ভিণ্ডাই অচিরে নষ্ট করে দেবে এরকম আশঙ্কা হয়।
শিল্প ও পরিবহন ক্ষেত্রের স্থায়ী ও দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যাগুলাের সমাধান করতে হলে তার জন্যে অবশ্যই প্রথমে উপযুক্ত অনুশীলন প্রয়ােজন। সে কাজের উপযুক্ত একই সঙ্গে দরদী ও বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বাংলা রাষ্ট্রে আছেন- অবশ্য ইয়াহিয়ার সরকার যদি ইতিমধ্যেই তাদের কোতল না করে থাকে।
তবু মনে হয় যে, পরিবহনের ক্ষেত্রে পুর্ববঙ্গের সমস্ত রেলপথকে একই ব্রডগেজের আওতায় আনা, যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ প্রভৃতি কয়েকটি কাজে হাত দেবার কথা এখন থেকে ভাবতে হবে। সন্দেহ নেই যে, আশু ও মধ্যবর্তী কালীন কাজগুলাে সমাপ্ত না করে এ ধরনের কাজ হাতে দেওয়া সম্ভব হবে না।
শিল্পক্ষেত্রে বগুড়ায় সন্ধানপ্রাপ্ত কয়লাকে উত্তোলন করার বিষয়ে চট্টগ্রাম ও ছাতক ফেঞ্চুগঞ্জের বর্তমান শিল্পগুলােকে কেন্দ্র করে নতুন যন্ত্র ও রাসায়নিক শিল্প-বিকাশের বিষয় ভাবতে হবে। ঠাকুরগাঁও’র চিনিকলকে কেন্দ্র করেও হয়তাে রাসায়নিক শিল্পে নতুন পদক্ষেপ অসম্ভব নয়। কিন্তু এ সবই পরবর্তীকালীন সমস্যা এবং এ-সব কাজে হাত দেবার পূর্বে সযত্ন feasibility study র প্রয়ােজন।
শিল্পায়ন পরিকল্পনা হাতে নেবার সময়ে বা তার আগে নতুন সরকারকে একটি কথা বিশেষত স্মরণে রাখতে হবে। বাংলারাষ্ট্রে একটি স্থায়ী খাদ্যাভাবের সমস্যা আছে। খাদ্যের জন্য এই দেশটিকে অনেকদিন থেকেই আমদানির উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। বহির্বাণিজ্য ঘাটতির সমস্যা অবশ্য তাঁদের নেই। পাট, চা, বাের্ড প্রভৃতি রপ্তানির মােট আয় আমদানির চেয়ে উদ্ধৃত্তই হয় সাধারণত। তবু আভ্যন্তরীণ খাদ্য ঘাটতির সমস্যাকে প্রথমে মােকাবিলা না করে যদি দ্রুত শিল্পায়নের চেষ্টা করেন, তাহলে নেহেরু যুগের ভারতীয় পরিকল্পনা যে চড়ায় গত দশকের মাঝামাঝি এসে ঠেকে যায় তাদেরও সেই চড়ায় ঠেকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের গত পাঁচ বছরের অবস্থা থেকে বাংলাদেশ ও তার রাষ্ট্র নায়করা যেন উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তদনুযায়ী নিজেদের নীতি নির্বাচন করেন।
সূত্র: কম্পাস, ২৫শে ডিসেম্বর ১৯৭১