মৌলানা আবদুল হামিদ খাঁ ভাসানীর বিবৃতি
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙ্গিয়া দেশকে স্বাধীন ও মুক্ত করার জন্য লক্ষ লক্ষ বাঙালি শুধু দীর্ঘকাল কারাবাস, অন্তরীণ, বেত্রাঘাত প্রভৃতি শাস্তিভােগ করে নাই, বহুসংখ্যক বাঙালি যুবক ও প্রবীণ স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিয়াছে তাহা আপনারা অবগত আছেন। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস ব্রিটিশ শাসন হইতে মুক্তিলাভের পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও শােষক গােষ্ঠি ধর্মের নামে ধোকা দিয়া পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা সমূলে বিলুপ্ত করিবার যে যে ভীষণ ষড়যন্ত্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হইতে আরম্ভ করিয়া সেই দূরভিসন্ধির বিস্তারিত বিবরণ দিবালােকের মতাে স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। আপনারা অবগত আছেন যে ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি, সেই প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে দেশের পূর্বাঞ্চলে ও পশ্চিমাঞ্চলে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হইয়াছে। শুধু বাঙালিদিগের দ্বারা নয় তৎকালীন অখণ্ড ভারতের দশ কোটি মুসলমানের দ্বারা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এই প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ববাংলাতে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হইতে চলিয়া আসিতেছে। সুতরাং আজিকার স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ কায়েমের যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হইয়াছে তাহা নতুন কিছু নহে। ইহা একটি জাতির বাঁচা-মরার প্রশ্নে পূর্ব- স্বীকৃত প্রস্তাব বাস্তবায়নের মহান সংগ্রাম।
পাকিস্তানের মূল ভিত্তিকে নস্যাৎ করিয়া দিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদিগের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ও শােষণ অব্যাহত রাখার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে কতিপয় মুখচেনা বাঙালি দালালদিগকে নানা প্রলােভনে হাত করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্ত প্রভু পুঁজিপতি আমলাগণ পূর্ববাংলার ন্যায়সঙ্গত দাবী আদায়ের সগ্রামকে বার বার নস্যাৎ করিবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছে। কিন্তু দুর্জয় মনােবল ও রাজনৈতিক সচেতনতার অধিকারী পূর্ব বাংলার সগ্রামী জনতা নানা অত্যাচার, শােষণ শাসনের কুটিতে না দমিয়া বারবার বুকের রক্ত ঢালিয়া স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সেই মহান সংগ্রামকে ২৩ বৎসর যাবৎ অব্যাহত রাখিয়া আসিয়াছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সন্ত্ৰাম তাহারাই চূড়ান্ত রূপ। তকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলার দাবী নস্যাৎ করিয়া এক আজগুবি শাসনতন্ত্র চাপাইয়া দিতে চেষ্টা করিলে পূর্ববাংলার সংগ্রামী কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা তাহা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করিয়া দেয়। সাড়ে সাত কোটি তথা পাকিস্তানের নিরবিচ্ছিন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষাকে ধ্বংস করিবার ষড়যন্ত্রে স্বয়ং জিন্নাহ সাহেব ব্রতী হইয়া ছিলেন। ঢাকার বুকে রক্তের গঙ্গা বহাইয়া দিয়া অসংখ্য ছাত্র জনতা, নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরিয়া স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠি বাংলাভাষার ন্যায়সঙ্গত ও মহান সংগ্রামকে চিরতরে স্তব্ধ করিবার অপচেষ্টায় ব্যর্থ হইয়াছে। ১৯৫২ সালের পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন তাহারই জ্বলন্ত নিদর্শন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নৌকামার্কা বাক্সে ভােট দিয়া দালাল ও পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থবাদীদিগের শােষণ ও শাসনের নির্মম যাতাকলের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার নিপীড়িত জনতা ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে এবং বাংলার স্বাধিকার আদায়ের রায় জানায়। কিন্তু ব্রিটিশের পােষ্য তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ সেই ঐতিহাসিক রায়কে বানচাল করিবার ষড়যন্ত্রে শেরে বাংলা জনাব এ. কে. ফজলুল হকের মন্ত্রী সভা মাত্র ৪১ দিনের মধ্যেই ভাঙিয়া দেন এবং ব্রিটিশ আমলের স্বৈরাচারী সরকারি কর্মচারী ইসকেন্দার মির্জার দ্বারা পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াও বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মান্দোলন নসাৎ, করিতে না পারিয়া অসংখ্য লােককে বিনা বিচারে দীর্ঘকাল আটক, বহু সংখ্যক কর্মীকে বেত্রাঘাতের শাস্তি প্রদান ও বহুসংখ্যক দেশপ্রেমিককে বাংলার মাটি হইতে চিরদিনের তরে বহিষ্কার করিয়া দেন। ইহার দ্বারাও বাংলার নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করিতে না পারিয়া স্বৈরাচারী সামরিক নেতা আয়ুবের নেতৃত্বে নয়া ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আয়ুব মন্ত্রীসভা ও পার্লামেন্ট ভাঙিয়া দেন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল ঘােষণা করিয়া ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন ঘােষণা করেন। জেল জুলুম, বেত্রাঘাত, গুলি দ্বারা হত্যা করিয়া এবং সর্ব প্রকারে রাজনৈতিক দল ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ করিয়া এক ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। কিন্তু ইহাতেই মজলুম ঙালিরা ঘাবড়ায় নাই। ১৯৬২ সালে আয়ুবের বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্র জনতা তুমুল আন্দোলন শুরু করে। আয়ুব একশ্রেণীর দালালকে হাত করিয়া বিশ্ববাসীকে ধোকা দিবার জন্য মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া নির্বাচনী প্রহসনের নামে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমূলে বিনাশ করিবার অপচেষ্টা করে। কিন্তু বিপ্লবী বাঙালিগণ আয়ুবশাহীর নির্মম শােষণ শাসনের বিরুদ্ধে ঘেরাও আন্দোলন শুরু করে। তথাকথিত আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। ছাত্রজনতা কৃষক, শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলগুলাের এই ব্যাপক গণ-আন্দোলন ১৯৬৯-৭০ সালে ব্যাপকতম রূপ লাভ করিলে তাহার উত্তরসূরী অপর এক কুখ্যাত সামরিক শাসক স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করিয়া ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান চিরদিনের তরে বিদায় লইতে বাধ্য হন। তৎপর জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাংলার বিপ্লবী জনতার আন্দোলনের মুখে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি বারবার দিতে থাকিলেও পর্দার অন্তরালে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ, পুঁজিপতিগণ ও সামন্ত প্রভুগণ ভাবিয়াছিলেন তাহারা নির্বাচন দিতে বাধ্য হইলেও ইসলাম ও সংহতির নামে দেদার টাকা পয়সা ঢালিয়া পূর্ববাংলার কতিপয় বিশ্বাসঘাতককে হস্তগত করিয়া পূর্ববাংলার নির্বাচনী রায় তাহাদের স্থায়ী শশাষণ ও শাসনের স্বপক্ষে লইতে পারিবে। কিন্তু তাহাদের ২৩ বৎসরের নির্মম শােষণে বিক্ষুব্ধ বাঙালি চেতনা দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়া তাহাদের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করিয়া দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রতীকে ভােট দিয়া বাংলার আবাল-বৃদ্ধ বণিতা জানাইয়া দিয়াছে যে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালিরা স্বাধীন ও সর্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠার মহান সম্রামে বদ্ধপরিকর। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রতীকে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন শতকরা ৯৮.৩ জন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রতীকে সদস্য নির্বাচিত হইয়াছেন শতকরা ৯৯ জনেরও বেশি। নির্বাচনের এই ঐতিহাসিক বিজয়ের এই মূল কারণ, হইতেছে শােষিত ও নিপীড়িত জনগণের প্রাণপ্রিয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সােনালী স্বপ্ন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও শােষকগােষ্ঠি নির্বাচনের পূর্বে স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালিদের এই অপূর্ব একতার কথা উপলব্ধি করিতে পারে নাই। ফলে নির্বাচনের ঐতিহাসিক ফলাফল শাসক ও শােষকগােষ্ঠির মাথা বিগড়াইয়া দিয়াছে। তাহারা বিকারগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে। এবং বিকারগ্রস্ত মন লইয়া গণ হত্যায় ঝাপাইয়া পড়িয়াছে।
সাড়ে সাত কোটি মজলুম বাঙালিদের গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাৎ করিয়া দিবার জন্য কুখ্যাত জেনারেল, ইয়াহিয়া খান আলােচনার অজুহাতে প্রস্তুতির সময় লইয়া তাহার বর্বর সৈন্যদিগকে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অমানুষিক অত্যাচার চালাইয়া হত্যা করিবার জন্য ২৫ মার্চ প্রদান করেন। রাত্রি ১২ টায় গুপ্ত অবস্থায় পূর্ববাংলা হইতে পিণ্ডিতে পলায়ন করেন। টিক্কা খানের নেতৃত্বে ২৫ মার্চ রাত্রি সাড়ে ১০টা হইতে ঢাকায় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড শুরু করা হয়। নগরের ছাত্র, যুবক, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, শ্রমিক, সরকারী কর্মচারী, বুদ্ধিজীবি, বাঙালি ব্যবসায়ী ও অন্যান্য জনসাধারণকে কামান, ট্যাঙ্ক, মর্টার, মেশিনগান প্রভৃতি উন্নত ধরনের মারাত্মক মারণাস্ত্র দ্বারা হত্যা করিতে থাকে এবং শহরের অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, ছাত্রাবাস, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক বস্তীসহ অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালাইয়া এবং উড়াইয়া
দেওয়া হয়। তাহার পর ২৬ তারিখ হইতে চিটাগাং, রাজশাহী, খুলনা, যশাের, রংপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি বহু শহরে নির্বিচারে গুলি চালাইয়া, বিমান হইতে বােমা মারিয়া ও বিমানের সাহায্যে আকাশ হইতে গুলি চালাইয়া অসংখ্য নিরপরাধ, নিরস্ত্র ও অসহায় জনগণকে হত্যা করিতে থাকে। শুধু শহরেই এই হত্যাকাণ্ড, লুঠতরাজ, বাড়িঘর জ্বালানাে সীমাবদ্ধ রাখা হয় নাই। যেখান দিয়া নারকীয় পশু টিক্কা-ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনী গিয়াছে সেই পথের দুই পার্শ্বের গ্রাম ছারখার করিয়া জ্বালাইয়া দেয়া হইয়াছে। মন্দির, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙা হইয়াছে। নির্বিচারে গণহত্যা চালানাে হইয়াছে। নারী ও শিশুরাও রক্ষা পায় নাই। মেয়েদিগের সতীত্বহানি ও তাহাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হইয়াছে। গ্রামে কৃষকের বীজধান, চাউল ডাউল গরু বাছুর ছাগল হাঁস-মুরগি তরিতরকারি ইত্যাদি লুটিয়া লওয়া হইয়াছে। শহরে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের তালা ভাঙিয়া মূল্যবান দ্রব্যাদিসহ নগদ টাকা পয়সা লওয়া হইয়াছে এবং বহুসংখ্যক ব্যাঙ্ক ও সরকারি কোষাগার বর্বর সৈনিকেরা লুটতরাজ করিয়াছে। শহরের স্কুল কলেজের মেয়েদিগকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। এই হতভাগিনীদের ভাগ্যে কী ঘটিয়াছে তাহা কে জানে? এইরূপ নির্মম অত্যাচারের মর্মন্তুদ ঘটনা কোনাে দেশে কোনকালে ঘটিয়াছে বলিয়া কাহারাে জানা আছে কি? ইতিহাস এইরূপ বর্বর নির্মম অত্যাচারের সাক্ষ্য দেয় না। চীনে চিয়াং কাইশেকের আমলের, রাশিয়ায় জারের আমলের, অখণ্ড ভারতে ব্রিটিশ আমলের, কারবালায় জালেম এজিদের জুলুম এইরূপ জঘন্য সীমাহীন অত্যাচারের জ্বলন্ত নজীরের কাছে ম্লান হইয়া গিয়াছে। ইয়াহিয়া সরকার ও তাহার জালেম সমর্থকগণ ভাবিয়াছে এইরূপ নজীরবিহীন অত্যাচার কিছুদিন চালাইতে পারিলে বাংলার জনসাধারণ ভীত হইয়া স্বাধীন বাংলার দাবী চিরতরে ছাড়িয়া দিবে। তাহাতে পশ্চিম পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক জনতা পুঁজিপতি সামন্তপ্রভু ও আমলাদের শােষণ-শাসন পূর্ব বাংলায় অব্যাহত থাকিবে এবং বাঙালিদের শিরদাঁড়া চিরতরে ভাঙিয়া দেয়া যাইবে। কিছু দালাল সংগ্রহ করা হইবে। এবং তাহাদের দিয়া দুনিয়ার মানুষকে ধোকা দিবার জন্য সারা দুনিয়ায় প্রচার করা হইবে স্বাধীন বাংলার দাবী বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের নহে। পাকিস্তানের মহাশত্রু ভারত সরকার পূর্ব বাংলার মুষ্টিমেয়, দুষ্কৃতিকারীকে নিযুক্ত করিয়া সর্বতােভাবে সাহায্য দিয়া এই আন্দোলন সৃষ্টি করিয়াছে। ইহা পূর্ব বাংলার জনসাধারণের আন্দোলন নহে। এইরূপ জঘন্য মিথ্যা প্রচারে দুনিয়ার মানুষ বিভ্রান্ত হইবে না। কেননা ২৬ তারিখে কেন বৈদেশিক সাংবাদিকদিগকে পূর্ব পাকিস্তান হইতে বহিষ্কার করিয়া দেওয়া হইল? তাহারা বিশ্ব কাছে বাঙালি আপামর জনসাধারণের স্বাধীনতা লড়াইয়ের মহান চিত্র ও ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈনিকদের বর্বর নারকীয় অত্যাচারের কাহিনী বিশ্বের কাছে তুলিয়া ধরিবে এই ভয়ে কি?
গত মহাযুদ্ধের সময় বিদেশী সাংবাদিকগণ জীবন বিপন্ন করিয়া স্বচক্ষে দেখিয়া যুদ্ধের বিবরণ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনাে স্বৈরাচারী সরকারই ইয়াহিয়া সরকারের মতাে এরূপভাবে বৈদেশিক সাংবাদিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন নাই এবং দেশ হতে বাহির করিয়া দেন নাই। শুধু সাংবাদিকগণকেই নহে এই বর্বর সরকার তাহাদের সীমাহীন অত্যাচারে আহত অত্যাচারিত, লুণ্ঠিত, গৃহহারা ও সম্পদ স্বজন পরিজন হারা জনসাধারণকে সেবা করিবার জন্য আন্তর্জাতিক সেবা প্রতিষ্ঠান বিশ্ব রেড ক্রশ সংস্থাকে পূর্ব বাংলায় যাইতে অনুমতি দেয় নাই। তাহাদের একটি দলকে করাচী হইতে ফিরাইয়া দিয়াছে কেননা তাহাদের বর্বরতা ও মিথ্যা প্রচার ঢাকিবার জন্যই ইহা করা হইয়াছে। বিশ্ব যাহাতে জানিতে না পারে যে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশ কায়েম চায়। ভারতের সহিত এই জনযুদ্ধের কোনাে সংশ্রব নাই। কেননা কোনাে জাতির নিজস্ব প্রেরণা না থাকিলে শুধু অন্যের সাহায্যে মুক্তি আসে না।
এখানে প্রশ্ন হইতেছে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও ধর্মীয় গােষ্ঠি সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত নিস্পেষিত শােষিত মজলুম বাঙালির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার মহান দাবী সমর্থন করিবে, না গণহত্যার মাধ্যমে যাহারা একটি জাতিকে চিরতরে দাস বানাইতে চায় সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকে সমর্থন জানাইবে? প্রশ্ন, বিংশ শতাব্দীতে মধ্যযুগীয় বর্বরতাই মানবতা বােধের উপরে মাথাচাড়া দিয়া উঠিবে?
মুসলমান ইয়াহিয়া ধর্মের দোহাই তুলিয়া আজ পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদিগকে নির্মমভাবে হত্যা করিতেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান নামধারী ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈনিকেরা মুসলমান নারীসহ জাতিধর্ম বিনষ্ট করিতেছে। মুসলমান হইয়া অসংখ্য মসজিদ বিনষ্ট করিতেছে। নামাজ পাঠরত মুসলিমগণকেও হত্যা করিতে কুণ্ঠাবােধ করিতেছে না। ইসলামের দোহাই দিয়া মানবতা বিরােধী কাজে লিপ্ত রহিয়াছে। মুসলিম বিশ্ব এ সম্পর্কে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে? তাহারা কি ইয়াহিয়ার অনৈস্লামিক মানবতা বিরােধী জঘন্য কার্যক্রম সমর্থন করিবেন, না জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে দাঁড়াইয়া মহান ইসলাম ধর্মের সত্য ন্যায় প্রীতির প্রতি সমর্থন জানাইবেন? গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির প্রশ্ন গণতন্ত্র হত্যার এই মারণ যজ্ঞে তাহারা কি স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া সরকারকে সমর্থন জানাইবেন, না পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বাজে অজুহাতে নিরপেক্ষ থাকিয়া বর্বর অত্যাচারকেই পক্ষান্তরে সমর্থন করিবেন? পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম মােটেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শশাষকরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি লাহাের প্রস্তাবকে উপেক্ষা করিয়া পূর্ব বাংলাকে তাহাদের স্থায়ী উপনিবেশ সৃষ্টি করিবার জন্য ২৩ বৎসর যাবৎ পূর্ব বাংলার উপর নানাভাবে আক্রমণ চালাইয়া আসিতেছে। ১৯৭১ সালের বাঙালির এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম তাই বহিঃশক্তি শােষণ শাসন ও বাঙালিদের স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানি অসুরশক্তি বাহির হইতে শক্তি প্রয়ােগ করিয়া বাঙালিদিগকে দাসে পরিণত করিবার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জঘন্য সংগ্রামে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। প্রশ্ন হইতেছে গণহত্যার এই ব্যাপক মারণযজ্ঞে বিশ্বজনগণের কি কিছুই করিবার নাই? গণতান্ত্রিক বিশ্ব কি অহেতুক অজুহাতে পূর্ব বাংলার গণহত্যাযজ্ঞকে সমর্থন জানাইবে? চীনসহ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া সর্বসময়েই শােষিত, নিপীড়িত ও মজলুম জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মহান সংগ্রামে সর্বপ্রকার মদদ জানাইয়াছে। কিন্তু আজ পূর্ব বাংলার সাড়ে ৭ কোটির নিপীড়িত নিষ্পেষিত শােষিত মজলুম মানুষের দীর্ঘ ২৩ বৎসরের সংগ্রামের যে চূড়ান্ত সংগ্রামীরূপ পূর্ব বাংলার মাটিতে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে বাঙালিদের মহান সংগ্রাম ও স্বাধীনতার প্রশ্নে তারা কী ভূমিকা গ্রহণ করিবে? স্বৈরাচারী ইয়াহিয়াকে সমর্থন করিয়া তাহারা বিশ্ব জনমতকে কী করিয়া বুঝাইবেন যে তাহারা নিপীড়িত শশাষিত মানুষের বন্ধু?
পূর্ব বাংলা এশিয়া ভূখণ্ডেরই একটি অন্যতম অঙ্গ। এশিয়ার জাতিসমূহের কাজে বিশেষ করিয়া আফ্রোএশিয়ার জাতিসমূহের ভূমিকার উপর পূর্ব বাংলার কোটি কোটি মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ রহিয়াছে। পূর্ব বাংলার বর্তমান চরম দুর্যোগের মুহূর্তে বিশ্ব মানবজাতির কাছে রক্তঝরা দুর্ভাগিনী পূর্ব বাংলার জ্বলন্ত প্রশ্ন যে বর্বর পশু শক্তির কাছে কি মানবতা ও ন্যায়সঙ্গত মহান সংগ্রাম মার খেয়ে চিরতরে নিষ্পেষিত হইবে?
পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, মাঝি, তাঁতী, কুটিরশিল্পী, ছাত্র, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবি, চাকুরীজীবীসহ আপামর জনসাধারণের কাছে আমার আবেদন আপনারা ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য গড়িয়া তুলুন। পূর্ব বাংলার মুখচেনা কতিপয় সুবিধাবাদী পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জনতা শিল্পপতি সামন্তপ্রভু ও স্বেচ্ছাতান্ত্রিক আমলাদিগের দালাল সাজিয়া ধর্মের নামে তথাকথিত সংহতির নামে মিথ্যা প্রচার চালাইয়া আপনাদিগকে বিভ্রান্ত করিতে অপচেষ্টা চালাইতেছে। পূর্ব বাংলার এইসব মিরজাফরগণ গত ২৩ বৎসর যাবৎ বাংলা দেশের স্বাধীনতা হরণে শােষণে শাসনে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থবাজদের দালালী করিয়া পূর্ব বাংলার জনসাধারণের ন্যায়সঙ্গত দাবী দাওয়া সমূহের স্বাধীনতা সগ্রামের পিছনে ছুরিকাঘাত করিয়াছে। এই বিশ্বাসঘাতকদিগের কথায় আপনারা কান দিবেন না। আপনার দৃঢ় একতা ও ইস্পাত দৃঢ় একতায় কোনােক্রমে ফাটল ধরাইতে পারিলেই স্বার্থবাজদের কাজ হাসিল হইবে। চিরতরের জন্য আপনারা পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক পুঁজিপতি, আমলা ও সামন্তবাদের গােলামে পরিণত হইয়া যাইবেন। বর্তমান মুহূর্তে একতা আর মনােবল ও জ্বলন্ত দেশপ্রেমই হইবে আমাদিগের অন্যতম অস্ত্র। জয় আমাদের সুনিশ্চিত, অবধারিত। আল্লাহ জালেমকে ঘৃণা করেন। আমাদিগের মহান সংগ্রামের পথে আমরা আল্লাহের সাহায্য নিশ্চিতভাবে পাইব। এবং পূর্ব বাংলাকে সুখী সমৃদ্ধশালী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসাবে গড়িয়া তুলিব।
সারা বিশ্বের শান্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশের জনসাধারণ ও সরকারের নিকট আমার আকুল আবেদন এই যে যতশীঘ্র সম্ভব আপনারা নব গঠিত গণপ্রজাতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিন। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন!
মৈমন সিংহ
২২.৪.৭১
সূত্র: কম্পাস, ৫ই জুন ১৯৭১