You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.13 | পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান

[নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বিখ্যাত সাপ্তাহিক নিউজ উইক’- এর সম্পাদক (Senior Editor) আর্নো দ্য বর্চগ্রেভ (Anaud de Borchgrave) সাক্ষাৎ করেন। ঐ সাক্ষাঙ্কারকালে গেরিলা যুদ্ধ এবং ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধের সম্ভাবনাময় সংকট মুহূর্তে পাকিস্তানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সে সম্পর্কে প্রে: ইয়াহিয়া খান যে মন্তব্য করেন আমরা তা এখানে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি—সম্পাদক।]
পূর্ব বাংলায় গেরিলা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে প্রে: ইয়াহিয়া খান মি. বর্চগ্রেভকে বলেন :
“যুদ্ধ যেখানে আসন্ন, সেখানে যুদ্ধ আসন্ন নয় একথা আপনাকে বলতে পারি না। ভারতীয়রা ইতিপূর্বেই আমাদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় আছে। তবে উভয় দেশে মুখােমুখি যুদ্ধ না চলার একমাত্র কারণ হলাে, আমরা প্রত্যাঘ্যাত করছি না। ক্রমবর্ধমান প্ররােচনা ও উস্কানী সত্ত্বেও, আমরা এখনও যথাসম্ভব নিজেদের সংযত করছি। পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ভারতীয়রা কামান ও মর্টার থেকে ব্যবহার করে থাকে ১৫০ থেকে ৩০০০ গােলাগুলি। (পূর্ব পাকিস্তানি গেরিলারা।] সাঁকো, বৈদ্যুতিক স্তম্ভ ধ্বংস করছে এমন কি এই সেদিন তারা খাদ্যবাহী এক জাহাজ ধ্বংস করে দিয়েছে। ভারতীয়রা ২৩টি গেরিলা যুদ্ধ শিক্ষণ শিবির খুলেছে।… তাদের সীমান্ত এলাকা থেকে তারা অসামরিক লােকদের অপসারণ করেছে, প্রতিদিনই তাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমাদের হুমকি দিয়ে চলেছে…। ঐ অঞ্চল গ্রাস করে একটা পেটোয়া বাংলাদেশ সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে ভারতীয়রা যদি তাদের প্রচেষ্টা সম্প্রসারিত করে, তাহলে ত’ যুদ্ধ হবেই।

ভারতের বিরাট সমর-যন্ত্র
“যে সেনাবাহিনী (ভারতীয়) আয়তনে আর এক সেনাবাহিনীর (আমাদের) তুলনায় পাঁচগুণ ভারী, সেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কেমন করে আমাদের সেনাবাহিনী জয়ী হবে? আমি যদি আমাদের সেনাবাহিনীকে নিয়ে এ অবস্থায় যুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে যাই, তাহলে তা সামরিক দিক দিয়ে আমার পক্ষে পাগলামি হবে। কিন্তু যদি আমরা আক্রান্ত হই, তাহলে আমরা সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব…। ভারতীয়দের সমর-যন্ত্র বিরাট এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারা প্রতিদিনই ৩০০০ হাজারের বেশি ‘সেল ব্যবহার করতে পারছে এর অর্থ হলাে, তাদের হাতে প্রচুর যুদ্ধসম্ভার আছে। পক্ষান্তরে, দৈনিক এত পরিমাণ ‘সেল’ ব্যবহার আমাদের সেনাবাহিনীর পক্ষে বিলাস মাত্র কারণ, তাদের এত যুদ্ধ সম্ভার নেই।

পাকিস্তান ও চীনা সাহায্য
“পাকিস্তান আক্রান্ত হলে, চীনারা তা কখনই সহ্য করবে না। আমাদের প্রয়ােজনীয় সব রকমের অস্ত্রশস্ত্রই আমরা তাদের কাছ থেকে পাব সব রকমের সাহায্য) শুধু তাদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ বাদে। আমরা তাদের কাছ থেকে কোনাে কোনাে জিনিস বিনামূল্যে পাচ্ছি এবং অন্যান্য জিনিসের জন্য দাম দিচ্ছি। কিন্তু চীনাদের সাহায্য দেওয়ার শর্ত এত সহজ যে তাদের ঋণ আমাদের পরিশােধ করতে হবে ২৫ বছর বাদে এবং ঐ ঋণের জন্য তারা আমাদের কাছ থেকে কোনাে সুদ নেবে না। গত বছর যখন আমি পিকিং-য়ে গিয়েছিলুম, তখন আমাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার জন্য বিনা সুদে ২০০০ লক্ষ ডলার মূল্যের অর্থনৈতিক সাহায্য চুক্তির মাধ্যমে বন্দোবস্ত করেছিলুম।

শরণার্থীদের সংখ্যা বড় জোর ৪০ লক্ষ
“আমি সামরিক কার্যকলাপ সম্প্রসারণ করতে চাই না। যাতে এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। উ. থান্টের প্রস্তাব মতাে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদল তাদের ইচ্ছামতাে যা দেখতে চান তা দেখাতে, এমন কি পূর্ব পাকিস্তানে] ভারত থেকে ফিরে-আসা শরণার্থীদের আমরা কীভাবে পুনর্বাসন দিচ্ছি, তা দেখবার জন্য আমি বারবার সম্মতি দিয়েছি…। [ভারতে ৯০ লক্ষ পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থী আছে ] আমি এ সংখ্যা মানতে রাজী নই। সম্ভবত ঐ সংখ্যা হবে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ;- পর্যবেক্ষকরা যে হিসেব কষেছেন, তার পরে ঐ সংখা এমন কি ৪০ লক্ষও হতে পারে। শরণার্থীর সংখ্যা যাই হােক না কেন, পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে যারাই মার্চ মাসের পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে গিয়েছে, আমি তাদের ফিরিয়ে নেব। আর রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানেই তা হতে পারে।

বাঙলিদের প্রতি অন্যায় স্বীকার
এতাবস্ক্রাল বাঙালিদের প্রতি কেউ-ই ভালাে ব্যবহার করেনি। আমরাও ভুল করেছি। অবশ্য “আমরা” বলতে, পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত যারা হয়েছিলেন তাঁদের কথাও বলছি। পূর্ব পাকিস্তান অবহেলিত ও ধর্তব্যের বাইরেই ছিল, এবং আমরা এর উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত দৃষ্টি দিইনি। এখন সেই ভুলভ্রান্তি সংশােধনের জন্য আমরা সচেষ্ট হয়েছি। ২০শে ডিসেম্বর নতুন সংবিধান চালু করা হবে। তারা ১০০০ মাইল দূরে থাকে। এ কারণে, স্বভাবতই তারা সব চাইতে বেশি মাত্রায় স্বায়ত্ত শাসনের ও নিজেদের ব্যাপার নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারী হবে। এর অর্থ হলাে, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও কর ব্যবস্থা বাদে আর সব কিছুতেই তাদের স্বায়ত্ত শাসনাধিকার থাকবে।

মুজিবর প্রসঙ্গে
“অনেকে হয়ত আমার কথায় বিশ্বাস করবে না, তবুও আমার মনে হয়, যদি তিনি বাঙালিদের নেতা মুজিব দেশদ্রোহিতার অভিযােগে যার বিচার চলছে ফিরে যান (পূর্ব পাকিস্তানে], তাহলে তার দেশবাসীরাই তাকে মেরে ফেলবে। কারণ, তাঁর ঐ দেশবাসীদের ধারণা, তাদের বর্তমান সব রকমের দুঃখকষ্টের জন্য তিনিই দায়ী। যা হােক, এটা নেহাৎই গবেষণার প্রশ্ন। দুবছর ধরে তিনি আমার সঙ্গে আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্ত শাসনের ব্যাপারে আলােচনা চালিয়ে যেতে যেতে তাঁর কথা ফিরিয়ে নিলেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠন করে, সেই বিদ্রোহে দিলেন তিনি নেতৃত্ব…। ঐ বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করা ছাড়া আর কোনাে বিকল্প ছিল না। অন্য যে কোনাে রাষ্ট্রও ঐ একই ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। এমতাবস্থায় আমি কেমন করে ঐ লােকটিকে ডেকে এনে তার সঙ্গে আলােচনায় বসি? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযান এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে আনুগত্যের ভাব ধ্বংস করার জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদেশের সব চাইতে ভালাে ও সব চাইতে মানী আইনজীবী এ, কে, ব্রোহী তার পক্ষ সমর্থন করছেন। ব্রোহী যদি ভাবতেন যে সামরিক আদালতে এ ব্যাপারে কোনাে রকমের লুকোচাপা কাজ হবে, তাহলে তিনি এই মামলার ভার নিতেন না। কোনাে কোনাে রাষ্ট্রে যেমন হয়ে থাকে, সে ধরনে আমি তাকে প্রথমেই গুলিতে হত্যা করে পরে বিচারের ব্যবস্থা করি নি। দণ্ডাজ্ঞা দেওয়ার পরে কী করা হবে, তা রাষ্ট্রপ্রধানের বিশেষ নির্দেশাধিকারের ওপরই নির্ভর করছে। খেয়ালখুশিমতাে আমি তাকে মুক্তি দিতে পারি না। এ ব্যাপারে আমার বিরাট দায়দায়িত্ব রয়েছে। অবশ্য সমগ্র জাতি যদি তার মুক্তি দাবী করে, তাহলে আমি তাকে মুক্তি দেবই।

আল্লার কাছে শ্ৰীমতী গান্ধীর জন্য আরজ
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রে: ইয়াহিয়া খান বলেন :
স্বাধীন বাংলাদেশ হলে, ভারতীয়দেরই সব চাইতে ক্ষতি হবে। পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামও শীগগীরই সামিল হবে। আর তাে হলেই, শুরু হবে ভারতীয় ইউনিয়নে ভাঙন-ধরার পালা। আল্লার কাছে আমার এই আরজ এ বিষয়টা যেন এই মেয়ে মানুষটি শ্রিীমতী গান্ধী। এখনই ভালােভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।

সূত্র: কম্পাস, ১৩ই নভেম্বর ১৯৭১