বনগাঁর বিভ্রাট সর্বভারতীয় সংকটের সূচনা
জিতেন সেন
বনগাঁ এবং আশে পাশের এলাকাগুলােতে আজ যে সব সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেগুলাে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের রিলিফের সমস্যাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সীমান্তে অবস্থিত সব এলাকা সম্বন্ধেই একথা খাটে। প্রধান দুটো সমস্যা হলাে, সাম্প্রদায়িকতা এবং শরণার্থী ও স্থানীয় লােকেদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত। গত ২৯শে মে তারিখে যে সাইকেল-রিক্সায় চেপে বনগাঁ থেকে ট্রোপােল যাচ্ছিলাম, তার চালকটি দেখি রাগে গরগর করছে শরণার্থীদের আরা ের জীবন দেখে। এই অসন্তোষ যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, এমন কথা জোর করে বলা যায় না। সে কথা পরে বলছি।
বড়াে রকমের সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা এখনও বাধেনি। মজরে-মজুরেও লাঠালাঠি শুরু হয়নি। তবে অখিল ভারতীয় শান্তিসেনা মণ্ডলের সম্পাদক শ্রীনারায়ণ দেশাই আমাকে বললেন যে, tension খুব বেশি, যে কোনাে সময়ে বেধে যেতে পারে। পেট্রাপােলের একজন অফিসার (যিনি নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) স্পষ্টই বললেন, সব ফ্রন্টেই initiative আমাদের হাত থেকে চলে গিয়েছে পাকিস্তানের হাতে। তারা মার দিয়ে যাচ্ছে, আমরা কোনাে মতে ঠেকিয়ে যাচ্ছি। নিজের দেশে বসে তারা গুপ্তচরের মারফৎ সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে আমাদের দেশে, আমরা সে বিষয়ে সচেতন” বলে ঘােষণা করছি, বলছি সে বিষয়ে চিন্তা করছি।
সম্প্রতি একটি লােক বনগাঁয়ে চামড়া বিক্রী করছিল। কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরে মারতে শুরু করে। তাদের বক্তব্য হলাে, লােকটা এপারে গরু চুরি করে ওপারে গিয়ে তার মাংস বিক্রী করেছে, এখন এপারে এসেছে তার চামড়া বিক্রী করতে। ব্যাপারটা যখন একটা বিশ্রী রূপ নিচ্ছে, এবং লােকটি আধমরা হয়ে এসেছে, তখন শ্রী দেশাই শুনতে পেয়ে সেখানে গিয়ে অতিকষ্টে তাদের কবল থেকে লােকটিকে উদ্ধার করে থানায় দেবার ব্যবস্থা করলেন, যাতে সে অন্তত প্রাণে বেঁচে যায়। পেট্রাপােলের ক্যাম্পে হিন্দু মুসলমান প্রায় সমান সংখ্যায় ছিলেন কিছুদিন আগে পর্যন্ত। এখানে কয়েকদিন আগে মুসলমানদের উত্তেজিত করার জন্য কয়েকজন প্রকাশ্যে শুয়ােরের মাংস খেতে আরম্ভ করেছিল।
পেট্রাপােল থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত বয়রা গ্রামে সীমানার ওপারে নড়াইল সাব-ডিভিসন থেকে বহু শরণার্থী আসেন। বয়ড়ার অধিবাসী শ্রী সুনীল ভট্টাচার্য এবং তার ছেলে শ্রী দিলীপ ভট্টাচার্য মনপ্রাণ দিয়ে সেবা করছিলেন তাদের। আশে পাশের সমস্ত এলাকায় তারা আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন। পাকিস্তানি গুপ্তচরেরা তাদের দুজনকেই ছুরি মারে। পুত্ৰ দিলীপ হাসপাতালে মারা যান। এই রিপাের্ট লেখার সময় পর্যন্ত পিতা সুনীলের অবস্থা সংকটজনক বলে জানা গিয়েছে। এই ঘটনায় সমস্ত এলাকা উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে। যতদূর জানা গিয়েছে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ এভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। সাধারণ লােক দেখছে, মুসলমানের হাতে হিন্দু খুন হলাে। আমাদের নিজেদের মধ্যেকার সযত্নে রক্ষিত সাম্প্রদায়িকতাকে জাগিয়ে তুলতে এটুকুই যথেষ্ট।
পাকিস্তান সরকার ভারতের কাছে প্রস্তাব করেছিল দুই বাংলার সীমানায় একটা no man’s land খাড়া করার। ভারত এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পাকিস্তান কিন্তু তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। গত ২৫, ২৬ ও ২৭শে মে তারিখে সীমান্তের ওপারে অবস্থিত সাদিপুর, রঘুনাথপুর ও ১৬ গ্রামে আগুন দেওয়া হয়। ২৮ তারিখেও পেট্রাপােল থেকে সারাদিন জ্বলন্ত গ্রামগুলাের ধোয়া দেখা যায়। সেখান থেকে নাকি ছাই উড়ে আসে এপারে। এই সব গ্রামের অধিবাসীদের বলা হয় গ্রাম ছেড়ে এপারে চলে আসতে, নইলে তাদের গুলি করে মারা হবে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই হিন্দু ছিল।
গত ২৮শে মে তারিখে তারা দলে দলে এপারে বয়ড়ায় চলে আসতে থাকে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর গুলি ছোঁড়া শুরু হয়। বহুলােক পথেই মারা পড়ে। যারা এপারে চলে আসতে পেরেছিল, তারা তিনদিন অনাহারে এবং মৃত্যুর ভয়ে একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়ে; সীমান্তের বেশি ভিতরে ঢােকবার সামর্থ ছিল না তাদের। সীমানার কাছাকাছিই তাদের জন্য খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হলাে। তারা যখন খেতে বসেছে, তখন আবার ওপার থেকে গুলি চলল তাদের উপর। খাবার ফেলে দিয়ে তারা যে যেদিক পারল পালাল।
পরদিন আমি যখন যাই, তখন দেখি আবার তারা দল বেঁধে চলেছে বনগার দিকে। উদ্ভ্রান্ত, দিশাহারা মানুষের দল। ভাবলেশহীন দৃষ্টি তাদের ধ্বনিহীন কণ্ঠ। কোলকাতার কোনাে নীরব মিছিলকে এমন নীরব দেখিনি। যশাের রােড বােঝাই করে চলেছে তারা, তাদের মধ্যে দিয়ে “পথ চিরে চিরে” আতিকষ্টে চলেছে সাইকেল-রিক্সা, গরুর গাড়ি, মােটর গাড়ি, ট্রাক। এগুলাের হর্ণ ও চালকদের চীকার তাদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিছে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে, একটু আধটু ধাক্কা লাগলে নীরবে সরে যাচ্ছে। “নাহি ভসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি। মানবেরে নাহি দেয় দোষ।”
এই হিন্দু-নিধন ও হিন্দু বিতাড়নের পিছনে দুটি মতলব কাজ করেছে। একটি হলাে এইভাবে হিন্দুদের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি করে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানাে। দ্বিতীয় মতলব হলাে, সীমানার কাছের গ্রামগুলাে খালি করে পাকিস্তানের এলাকায় একটা no man’s land তৈরি করা। শােনা গেছে পশ্চিম পাকিস্তানের exservice man-দের আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে এই এলাকায় এসে বসবাস করার জন্য, যাতে no man’s land এর ঠিক পরেই একটা স্থায়ী আধা সামরিক বাহিনীর বসবাস হয়।
শরণার্থীদের মধ্যে অনেকে আদিতে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ছিলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হলে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। তাঁরা আবার “শরণার্থী হয়ে এদেশে ফিরে এসেছেন। তাঁদের সকলেরই এখানে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব আছেন। তারা তাদের কাছে চলে গিয়েছেন।
কিছু কিছু শরণার্থী ওপারে সাইকেল রিক্সা চালাতেন। সেগুলাে তারা নিয়ে এসেছেন এবং এখানে চালাচ্ছেন। শরণার্থী হিসেবে ডােল পান তাঁরা, এবং ন্যায্য ভাড়ার চাইতে কম ভাড়ায় আরােহী নেন। এর ফলে স্থানীয় সাইকেল-রিক্সা চালকদের মনে স্বাভাবিক কারণেই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। জন মজুররাও এভাবে rate cutting করছেন, যার ফলে ‘লেবার অত্যন্ত সস্তা হয়ে পড়েছে। স্থানীয় মজুরদের অবস্থা এমনিতেই সঙীন, তারপর যদি শরণার্থীদের কাছে তারা এভাবে মার খেতে থাকেন, তাহলে খালিপেটে কদিন তাদের প্রতি সহানুভূতি টিকিয়ে রাখতে পারবেন তারা তা বলা কঠিন। সহানুভূতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, দাড়ি পাল্লার অন্য পাল্লাটি ভারী হয়ে উঠেছে অসন্তোষের বাটখারায়। আমাদের সাইকেল রিক্সাচালকের অসন্তোষের কারণ এটাই।
স্ট্রোপােলের বিরাট শরণার্থী শিবির যশাের রােডের একপাশে, অন্য পাশে সারি সারি দোকান। সব শরণার্থীদের। শিবিরে থাকেন তাঁরা, স্থানীয় লােকের চাইতে অনেক বেশি রেশন বরাদ্দ তাদের জন্য, তার উপর আবার দোকান করে বসেছেন। এতে পূর্ববঙ্গ ললাকেদের enterprising spirit- এর পরিচয় মেলে, কিন্তু এভাবে স্থানীয় লােকের সহানুভূতি হারাচ্ছেন তাঁরা। লােকে স্বভাবতই তুলনা করছে তাদের ও গত তেইশ বছর ধরে আগত শরণার্থীদের অবস্থার। অবশ্য হাজার হাজার শরণার্থীরা সবাই দোকান করেনি; সবাই জনমজুরি করে না, সবাই রিক্সা চালায় না। হাজারে ২১ জনই এই অতিরিক্ত সুবিধা নেয় কিন্তু অসন্তোষ সৃষ্টি করার পক্ষে এই যথেষ্ট বিশেষ করে অসন্তোষ সৃষ্টি করার জন্য যদি মতলববাজ লােক থাকে।
এছাড়া কিছু কিছু শরণার্থী, শিবির ছেড়ে এদিকে ওদিকে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করছেন। বনগাঁ ও তার আশেপাশের এলাকায় দুলক্ষের মতাে শরণার্থী আছেন। তাঁদের চিরকাল শিবিরে রেখে খাওয়াতে গেলে ভারত দেউলিয়া হয়ে যাবে। তারা আশে পাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লেও তার পরিণাম ভয়াবহ হবে।
“দেখি কী হয়” এ জাতীয় ক্লীবনীতির জন্যই ভারত সরকার ভারতের অভ্যন্তরে এক প্রচণ্ড সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক বিস্ফোরণের ক্ষেত্র তৈরি হতে দিয়েছে। বাংলাদেশের ভিতরে যতদিন মুক্তিফৌজ ও জনতা প্রবল প্রতিরােধ করতে পারছিল, ততদিন কোনাে শরণার্থী ভারতে আসেনি। সেই সময়ে যদি তারা ভারত সরকার থেকে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি প্রচুর পরিমাণে পেতাে বা massive help পেতাে; তবে বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে যেতাে ভারতের ঘাড়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বােঝা পড়তাে না, সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন উঠতাে না। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের আর কোনাে সুযােগই থাকতাে না। তথাকথিত “বিজ্ঞনীতি” “সাবধানী নীতি” আজ ভারতকে ডুবুতে চলেছে। যা ছিল একটি পরিচ্ছন্ন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী আত্মনিয়ন্ত্রণের সগ্রাম-বাংলাদেশকে নিয়ে সে সগ্রাম যদি পরাজিত হয় তবে তার বিষময় প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি কী হতে পারে তার ইঙ্গিত পাচ্ছি আজ আমরা সীমান্ত বরাবর অঞ্চলে। আমাদের সীমান্তে আজ এই ধরনের বিপদের সত্যিকার মােকাবিলা করার সাহস আজও কি আমাদের হয়েছে? আমরা এখনও চোখ বুজে বিপদ এড়াবার চেষ্টা করছি। সীমান্ত থেকে সব শরণার্থীদের ভারতের ভিতরে অন্যান্য রাজ্যে চালান করার দাবি ও কর্মপন্থার একটা আওয়াজ উঠেছে। এ যদি সম্ভবও হয়-তাও করতে ২/৩ বছর লাগবে। ৪০ লক্ষ শরণার্থীকে (কিছু দিনের মধ্যে তা এক কোটিতে দাঁড়াতে বাধ্য) ট্রেনে ট্রাকে প্লেনে (ত্রিপুরা থেকে তাড়াতাড়ি সরাতে গেলে প্লেনেই সরাতে হয়) এত লােক ভারতের অন্যত্র সরাতে গেলে কত অতিরিক্ত ট্রেন, গাড়ি, ট্রাক, প্লেন লাগবে? অন্তত ২/৩ বছর সময় তাে লাগবেই। ততদিনে অনর্থ যা হবার সবই হতে পারে। তাছাড়া যে অশান্তি অসাম্য ও বিস্ফোরণের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আছে আজ বর্ডার অঞ্চলে, তাকে দেশের ভিতরে ঢােকালে দেশ তা সব হজম করে নেবে, না সারা দেশেই আগুন জ্বলবে? গােটা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক অবস্থা এভাবে বিপন্ন করে ফেলার জন্য দায়ী ভারত সরকারের ক্লীব-নীতি।
সম্পাদক
সূত্র: কম্পাস, ১২ই জুন ১৯৭১