ঘরে বাইরে পাকিস্তান
এবার বাংলাদেশ নয়। খােদ পাকিস্তানেই উত্তাল তরঙ্গ বইছে। এমন কি পাকিস্তানিদের মধ্যেও পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি লাহােরের “নওয়া এ-ওয়াক্ত” পত্রিকায় এই মর্মে এক খবর প্রকাশ করা হয় যে, লন্ডনে অধ্যায়নরত ছাত্ররা পাকিস্তান স্টুডেন্টস্ হােস্টেলে কায়েদে আজম জিন্নার একটি প্রতিকৃতি টাঙিয়ে রাখতে অস্বীকার করেছেন।
পত্রিকাটি এই সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন যে, জিন্নার প্রতিকৃতিটি যাতে হােস্টেলের কমিউনিটি হলে টাঙিয়ে রাখা যায় সেজন্য হােস্টেল কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের রাজী করাতে চেষ্টা করেছেন। ছাত্রদের একটি অংশ বলেছেন যে, তারা এতে অনুমতি দেবেন না কারণ, তারা জিন্নাকে সাম্রাজ্যবাদের উঞ্ছবৃত্তিধারী বলে মনে করেন। তারা এও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে যদি প্রতিকৃতিটি টাঙানাে হয় তাহলে তারা সেটাকে নষ্ট করে ফেলবেন। পত্রিকাটির লন্ডনের সংবাদদাতা আরও জানিয়েছেন যে, এই ধরনের ছাত্রদের মধ্যে বাংলাদেশের ছাত্রই শুধু নেই, পশ্চিম পাকিস্তানেরও আছেন।
এই জাতীয় সংবাদের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করেছে সম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি সংবাদপত্র। ঐ সংবাদপত্রগুলােতে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, জিন্নার সমাধিকে অপবিত্র করার চেষ্টার অভিযােগে প্রায় ডজন খানেক পশ্চিম পাকিস্তানিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জিন্নার স্মৃতিসৌধের কাছে পাঁচজনের অধিক ব্যক্তির জমায়েত নিষিদ্ধ করে সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি সামরিক আইন জারি করে ঘােষণা করেছেন যে, যদি দেখা যায় যে, পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেলের স্মৃতি সৌধের কেউ ক্ষতি করেছে অথবা সেটিকে কেউ অপবিত্র করার চেষ্টা করেছে, তাহলে সে ব্যক্তিকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলাের আরও খবর দক্ষিণ ইয়েমেন, ধােপার এবং ওমান প্রভৃতি উপসাগরীয় অঞ্চলে কিছুদিন ধরে পাকিস্তান বিরােধী মনােভাব ক্রমবর্ধমান।
এই সম্পর্কেও লাহােরের “নওয়া-এ-ওয়াক্ত’- এর বেইরুটস্থিত সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, বিপ্লবী কমান্ড এবং ধােপারের পপুলার ফ্রন্ট কর্তৃক প্রকাশিত তিনটি ভােলা পুস্তিকায় পাকিস্তানকে উপসাগরীয় এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মুখ্য নায়ক” বলে নিন্দা করা হয়েছে। এই পুস্তিকাগুলােতে ইয়াহিয়া খানকে সাম্রাজ্যবাদীদের ও অনুচররূপে বর্ণনা করে মন্তব্য করা হয়েছে যে, জাতীয় আন্দোলন দমনের জন্য তাকে (পাকিস্তানকে) ব্যবহার করা হচ্ছে।
আরব বিপ্লবীদের পুস্তিকায় বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানানাে হয়েছে এবং বিশ্বের সমগ্র, বিশেষ করে আরবদের প্রগতিশীল শক্তিগুলােকে আহ্বান জানানাে হয়েছে যে, পাকিস্তানকে উপসাগরীয় অঞ্চলে একটি প্রভাবশালী সামরিক শক্তি হিসেবে চাপিয়ে দেবার যে চেষ্টা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলাে করছে সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে তারা যেন এগিয়ে আসেন। এইসব সংবাদের উপর মন্তব্য করে “নওয়া-এ ওয়াক্ত” পত্রিকা লিখেছেন: “এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যের কথা যে, আরব দুনিয়ার প্রগতিশীল সমাজে পাকিস্তান বিরােধী যে ক্রমবর্ধমান মনােভাব সৃষ্টি হচ্ছে সে সম্পর্কে পাকিস্তানিরা সতর্ক নয়। এ রকমের মনােভাব সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তানের স্বার্থের পক্ষে ধ্বংসাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে।”
ভূতপূর্ব পাকিস্তানি সাংবাদিক মি. এন্টনি মাসকারেনহাস তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘রেপ অ বাংলাদেশ” নামক গ্রন্থে গণহত্যার সুসম্বন্ধ প্রণালী রীতি বিশ্লেষণ করে বলেছেন “সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক হত্যার প্রণালী অভিধানগত গণহত্যার সংজ্ঞার সাথে সঠিক মিলে যায়। কুমিল্লাস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর ১৬নং ডিভিসনে অবস্থানকালে আমি (প্রবন্ধকার) হৃদয়ঙ্গম করেছি যে কী রকম পৈশাচিকতা ও নিপুণতার সাথে এই অভিযান পরিকল্পিত হয়েছে এবং কার্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই গণহত্যার লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই। তারা হলেন: (১) ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান রাইফেলস-এর অন্তর্গত সেনারা, পুলিশ এবং আধা সামরিক আনসার ও মুজাহিদরা। (২) হিন্দুরা “আমরা কেবলমাত্র পুরুষদের হত্যা করছি, মেয়েরা ও ছােট ছেলেমেয়েরা মুক্ত। আমরা হচ্ছি সৈনিক, ভীরু নই যে ওদের হত্যা করবাে।…” এই ধরনের উক্তি আমাকে কুমিল্লাতে শুনতে হয়েছে। (৩) আওয়ামী লীগভুক্ত সমস্ত কর্মকর্তা ও স্বেচ্ছাসেবকরা। (৪) ছাত্র কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং জঙ্গী মনােভাবাপন্ন মেয়েরা। (৫) বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যেমন অধ্যাপক ও শিক্ষক, যাদের সৈন্যবাহিনী জঙ্গী মনােভাবাপন্ন বলে চিহ্নিত করেছে।
এই ভয়াবহ কার্য সম্পাদনে যখন পাক সৈন্যরা ঢাকা ও প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তখন তারা তাদের এই সমস্ত হতভাগ্য লক্ষ্যবস্তুর তালিকা সঙ্গে নিয়ে নেয়। তাতেই মনে হয় ২৫ শে মার্চের আগেই এই তালিকা তৈরি করে রাখা হয়েছিল। এই তালিকায় হিন্দুরা আগে থেকেই চিহ্নিত হয়েছিল। কারণ শাসকবর্গ তাদের (হিন্দুদের) মনে করত “ভারতীয় দালাল”_ যারা পূর্ববাংলার মুসলমানদের প্রভাবান্বিত করেছে। বাঙালি সৈনিক ও পুলিশদের নির্মূল করা হয়েছে। কারণ এরাই একমাত্র শিক্ষাপ্রাপ্ত শ্ৰেণী যারা দরকার হলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। অপর যারা গণহত্যার লক্ষ্যবস্তুরূপে পরিগণিত হয়েছে তাদের রাজনৈতিক উচ্চকাঙ্খ পাকিস্তানের পরিপন্থীস্বরূপ।
গত ৩১শে অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকায় ভারতে আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথের লিখিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে “আমরা যদি সমর্থন না করি, তাহলে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সর্বোত্তম বাস্তব সমাধান হিসেবে পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক একটি কার্যকরী স্ব-সরকার প্রদানে রাজী হওয়ার অন্ততপক্ষে একটা আশা থাকে। তবে অনতিবিলম্বেই এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশা করাটা নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত আশাবাদ। যদিও জুন অন্তক আর্থিক বছরে গত এক বছরে কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় কমে গেছে এবং বাৎসরিক শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ ১১ শতাংশ থেকে ২.৪ শতাংশ নেমে গেছে এইসব কিছুর বেশির ভাগের জন্য পূর্ববঙ্গের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়া অবস্থায়ই দায়ী। পশ্চিম পাকিস্তান এখনও সমৃদ্ধশালী। কিন্তু প্রতিরােধ আন্দোলন দমন এবং বাংলায় একটি অপ্রিয় সরকার চালানাের অতিরিক্ত ব্যয় বেড়েই যাবে। কর বাড়বে। বিনিয়ােগ ভাণ্ডার কমবে। বৈদেশিক বিনিয়ােগ বন্ধ হয়ে যাবে। পশ্চিম পাকিস্তানে এমন অনেক বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন লােক আছেন যাদের কাছে এই ভবিষ্যতের ছবি কোনাে সাড়া জাগাবে না।
কেশবচন্দ্র শূর
সূত্র: কম্পাস, ২৭শে নভেম্বর ১৯৭১