You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.29 | গারাে পাহাড় সীমান্ত থেকে | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

গারাে পাহাড় সীমান্ত থেকে

মেঘালয় রাজ্যের গারাে পাহাড় সীমান্তে লক্ষাধিক শরণার্থীর ভিড় জমেছে। গত ২১শে এপ্রিল থেকে স্রোতঅব্যাহত আছে। পূর্ব বাংলার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা তৈরি সর্বাপেক্ষা সুরক্ষিত অঞ্চল। বর্তমানে সেই জেলার অনেকাংশ পাক-বাহিনীর কবলে। জয়দেবপুর, মধুপুর অঞ্চলে তৈরি মুক্তিবাহিনীর ব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম না হয়ে পাক বাহিনী ভৈরব বাজার, কিশােরগঞ্জ, গৌরীপুর জংশন দিয়ে ময়মনসিংহ শহরের অপর পারঘাটে, শম্ভুগঞ্জে, এসে হাজির হয়। বিমান বাহিনীর বােমা বর্ষণে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়, তার ফলেই আশ্রয়-প্রার্থীদের স্রোত বাড়তে থাকে।
গারাে পাহাড়ে আশ্রয়প্রার্থীরা জড়াে হয়েছেন প্রধানত রংরা, বাঘমারা, আংরাতলি, গাসুয়াপাড়া, ডিমাপারা, ডালু, চেটিংপারা, হালচেতি, পুরাকাসুয়া ও মহেন্দ্রগঞ্জ অঞ্চলে। লক্ষাধিক আশ্রয় প্রার্থী। ২০ এপ্রিল থেকে জনস্রোত বাড়ছেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনাে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এই অনুন্নত জেলার ভার লাঘব করতে গারাে পাহাড় অঞ্চলে আসেননি। তুরা ব্যবসায়ী সংঘ শ্ৰীযুক্ত আনন্দ কিশাের ঘােষ, হস্তীমল বােখরা, অধ্যাপক পরিমল কর ও মেঘালয় সংসদ সদস্য শ্রী মনবাহাদুর নেওয়ারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রিলিফ কমিটি তৈরি করে ডালু অঞ্চলে একটি রিলিফ কেন্দ্রের বন্দোবস্ত করেন। তুরা শক্তি সংঘের সভ্যরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। দুধ, বার্লি ও শিশুদের উপযােগী অন্যান্য খাদ্য বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। গত দু সপ্তাহ যাবৎ মেঘালয় বিধান সভার উপাধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত গ্রহণসিং মারাক, জেলা কাউন্সিলের কর্মাধ্যক্ষ শ্রী মােদী মারাক, ও সরকারি জেলাশাসকের নেতৃত্বে একটি সেন্ট্রাল রিলিফ কমিটি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাম্পে সাহায্যার্থে এই কমিটি বিভিন্ন কাজ হাতে নিয়েছেন। ছাত্র সংস্থাগুলাে স্বেচ্ছাসেবক পাঠাচ্ছেন। জেলাশাসক শ্রীযুক্ত তেরণ কাজী ও মেঘালয় সরকার ত্বরান্বিত রিলিফের বন্দোবস্ত সাধনে ত্রুটি করছেন না। তথাপি অধিকাংশ আশ্রয় প্রার্থী এখনও গৃহহীন, তবুহীন উক্ত অঞ্চলে বাস করছেন। পায়খানা প্রস্রাবখানার বন্দোবস্ত আজও হয়ে উঠেনি। স্ত্রীলােক আশ্রয় প্রার্থীরা আজও লজ্জা নিবারণের সংকটকে এড়াতে পারেন নি। স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রেও আশাপ্রদ বন্দোবস্ত হয়নি। ফলে বসন্ত ও কলেরা দেখা দিয়েছে। আমপাতি অঞ্চলে সপ্তাহ দুই পূর্বেই বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে ক্যাম্পে। শ্রীযুক্ত মনবাহাদুর নেওয়ার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এই সব বিষয়ে। আশা করা যায়, সমাধান হয়ে যাবে শীঘ্রই।
এখানকার জনপ্রতিনিধি, সরকারি প্রশাসকগণ ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রের গারাে পাহাড় অঞ্চল সম্পর্কে অনীহা প্রকাশে বিশেষ ক্ষুব্ধ আছেন। চার লক্ষ লােকের এই অতি অনুন্নত জেলায় লক্ষাধিক আশ্রয় প্রার্থী এসে যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে, এবং এই সীমান্তে মুক্তিযােদ্ধারা যে প্রকার সফল সগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তা জানার জন্য এবং সংবাদপত্রে প্রকাশ করার জন্য কোনাে সাংবাদিক এদিকে আসছেন না। তার কারণ হয়ত যাতায়াতের অসুবিধা। সর্ব ভারতীয় কমিটির সভ্যরাও এ অঞ্চল এড়িয়ে যাচ্ছেন। মেঘালয় রাজ্যের আশ্রয় প্রার্থী সমস্যা বহুলাংশে গারাে পাহাড় জেলার আঞ্চলিক সমস্যা। সামরিক দিক থেকেও এ অঞ্চল পূর্বসীমান্তে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ও বেসরকারি দৃষ্টি গারােপাহাড়ের আশ্রয় প্রার্থী তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সমস্যার উপর বর্ধিত হােক, এই জেলা তা আশা করে।
ময়মনসিংহ সীমান্তে আত্মগােপনকারী বিপ্লবীদের যােগসূত্র থেকে জানা গেছে সীমান্তে পাক-কবলমুক্ত অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিপ্লবীরা। পাক বিমান বাহিনীর ত্বরিত আক্রমণ ও মুসলিম লীগ প্রভৃতির মিরজাফরীর ফলে মুক্তি বাহিনীর সভ্যদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল তাকে অতি শীঘ্র পুনর্গঠন করতে কর্মীরা সচেষ্ট হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের সাথে উত্তর সীমান্ত থেকে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় শতাধিক জাতীয় ও প্রাদেশিক সভার সভ্যগণ সীমান্তে ছড়িয়ে আছেন। তাদের মধ্যে অতিশীঘ্র নিবিড় যােগাযােগ স্থাপন করা ও তাদের তত্ত্বাবধানে তথাকথিত শান্তি কমিটির প্রত্যুত্তরে সশস্ত্র সংগ্রাম কমিটির সংগঠনকে সুগঠিত করার আশু প্রয়ােজন বলে শরণার্থীর দায়িত্বশীল মহল মনে করেন। মুক্তিফৌজের সংবাদাদি বহন করে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের ও বিশেষ প্রয়ােজন।
ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ সীমান্তে মুক্তিযােদ্ধারা ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে আশানুরূপ ফল লাভ করেছে। তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করেন, বর্ষাকালে নদী নালা, বন, জঙ্গল গেরিলা তৎপরতার পক্ষে বিশেষ উপযুক্ত। বর্তমানে মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের বিরিসিরি, হালুয়া ঘাট, শেরপুর ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে আবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছে। রংরা, বাঘমারা, ডালু, মহেন্দ্রগঞ্জ এলাকার ভারতীয় সীমান্ত চৌকি বরাবর পাকবাহিনী নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করেছে। মর্টার ব্যবহার করছে ভােরেও বিকেলে। মুক্তিযোেদ্ধাদের হাতে আপাততঃ উন্নত ধরনের ও দূর পাল্লার অস্ত্রাদির কিছুটা অভাব রয়েছে। শিক্ষাও তাদের স্বল্পকালীন তথাপি তাদের দৃঢ় বিশ্বাস-জয় আমাদের হবেই। বিপ্লবের সার্থক সমাপ্তি যতই বিলম্বিত হবে, পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক কাঠামাে ততই ছন্নছাড়া হয়ে যাবে।
পরিমল কর

সূত্র: কম্পাস, ২৯শে মে ১৯৭১