পুস্তক সমালােচনা
লােকশক্তি
(মাসিকপত্র) বাংলাদেশ’ সংখ্যা। ১ম ও ২য় সংখ্যা মে-জুন
মূল্য এক টাকা, গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গের গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র লােকশক্তি। পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে সারা ভারতের সর্বোদয় নেতা আচার্য বিনােবা ভাবে ও জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্বেলিত মনােভাব দুটি প্রবন্ধে প্রস্ফুট। বাংলাদেশের বিপর্যয়ে সারা বিশ্বের বিপদ আজ ঘনিয়ে এসেছে। আচার্য বিনােবা ভাবে পরিষ্কার বলেছেন-“ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলাভাষাকে দুই টুকরাে করা হয়েছে আর ধর্মের আড়ালেই গত ২০ বছর ধরে পূর্ব বাংলাকে শােষণ করা হয়েছে। এই শােষণের প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছে গােটা পূর্ব বাংলার মানুষ শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে পূর্ব বাংলায় নরমেধ যজ্ঞ। গভীর ক্ষোভের সঙ্গে আচার্য বিনােবা ভাবে মন্তব্য করেছেন- “মানুষ মানুষের উপর কত রকম অত্যাচার ও নির্যাতন চালাতে পারে বাংলাদেশের ঘটনা তা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রশ্ন তুলেছেন পূর্ব বাংলায় হস্তক্ষেপ করার। তাঁর মতে মানবতা ও স্বাধীনতার স্বার্থে বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলায় হস্তক্ষেপ করাই ভারতের পক্ষে যুক্তিযুক্ত হবে। এটা ঠিক যে পূর্ব বাংলা বরাবরের মতাে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। এ ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করা যাবে না। পূর্ব বাংলায় যে পরিমাণ গণহত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন হয়েছে তা কোনমতেই উপেক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা সর্বতােভাবে সমর্থন করতে হবে। পান্নালাল দাশগুপ্ত তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন- বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলেছে, তা আমাদের অর্থাৎ পশ্চিম বাংলা তথা ভারতেরও যুদ্ধ। পশ্চিম বাংলার মানুষ কোনমতেই বাংলাদেশের এই মুক্তি আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচনের শুরুতে দুটি রচনায় তার মনােভাব পরিস্ফুট করেছেন। শেখ মুজিবের “আমার স্বপ্নের সমাজ নামক প্রবন্ধ লােকশক্তির এই বাংলাদেশ সংখ্যার সব চাইতে উল্লেখযােগ্য রচনা। শেখ মুজিব বলেছেন, ‘একদিন জনগণ ভােট দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু আজ কী অবস্থা? আজ বাংলার বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে দুর্ভিক্ষজনিত অবস্থা বিরাজ করছে। তেইশ বছর ধরে চলেছে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পূর্ববাংলায়। পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছে। ইসলামের দোহাই দিয়ে এ দেশকে কায়েমী স্বার্থের অবাধ শােষণ ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। বাংলার ইতিহাস বড়ই করুণ। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্যই শেষ পর্যন্ত বাঙালিরা স্বাধীনতার সগ্রামে ব্রতী হয়েছে। বাংলায় রাজনৈতিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য, জনগণকে বৈষম্যের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানাের জন্য দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে মুক্তি কামনা করেছে। সুদীর্ঘকাল ধরে পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা হয়েছে চাকুরির ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে। এই অসহনীয় অবস্থা থেকে বাংলাকে মুক্ত করার স্বপ্নই শেখ মুজিবের রচনায় ফুটে উঠেছে। লেখক আমিনুল হক বাদশা প্রশ্ন করেছেন সােনার বাংলা শশান কেন!” সারা পাকিস্তানের আমদানি রপ্তানি, উন্নয়ন ক্ষেত্রে বিনিয়ােগ, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সুদীর্ঘ তেইশ বছর ধরে শশাষণ করা হয়েছে। পাকিস্তানি আমলে সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চ: বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক অনুন্নত! মােটামুটিভাবে বলা যায় যে ‘লােকশক্তির আলােচ্য বাংলাদেশ’ সংখ্যা পূর্ব বাংলার যে মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে, তা ভালােভাবে অনুধাবনের পক্ষে সাধারণ পাঠককে যথেষ্ট সাহায্য করবে। শেখ মুজিব, জয়প্রকাশ নারায়ণ, বিনােবা ভাবে, পান্নালাল দাশগুপ্ত প্রমুখ রাজনৈতিক নেতাদের রচনা সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশ’ সংখ্যায় বাংলাদেশের সমস্যাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে বুঝবার ও জানবার ক্ষেত্রে পত্রিকাখানি পাঠক সমাজকে যথেষ্ট সাহায্য করবে।
64 Team (Betersc0 Too) Issued by Radhakrishna. Editor, Peoples Action. Sarva Seva Sangh Monthly Newsletter, 223 Rouse Avenue, New Delhi-1. (দামের উল্লেখ নেই)।
‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মাধ্যমে কী ভাবে ২৬শে মার্চ (১৯৭১) একটা নতুন জাতি, নতুন দেশের জন্ম হ’ল তা এই ক্ষুদ্র পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। শেখ মুজিব চেয়েছিলেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনে শেখ মুজিব জনগণের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছিলেন অকুণ্ঠভাবে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠি ও সামরিক চক্র ক্ষমতা হস্তান্তরে শেষ পর্যন্ত গররাজী হলাে। ফলশ্রুতি হলাে ২৫শে মার্চ সারা পূর্ব বাংলার সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন। সঙ্গে সঙ্গে যা ছিল স্বায়ত্তশাসনের সগ্রাম—তা’ পরিণত হলাে স্বাধীনতার সংগ্রামে মুক্তির সংগ্রামে।
আলােচ্য পুস্তিকায় শেখ মুজিবের ছ’দফা দাবী ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলীর কথা স্বল্প পরিসরে সুন্দরভাবে আলােচিত হয়েছে।
রণজিৎ সেনগুপ্ত
সূত্র: কম্পাস, ৫ই জুন ১৯৭১