ভাষা আন্দোলনে বাগেরহাট
আন্দোলনে এক পা এগিয়ে
জেলা শহর খুলনার তুলনায় এর মহকুমা শহর বাগেরহাট অবস্থানগত বিচারে ছিল বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন। স্বভাবতই সেকালে ঢাকার সঙ্গে তার যােগাযোগ স্বচ্ছন্দ ছিল না। তবু বিভাগ-পূর্বকালের শিক্ষা-সংস্কৃতিবিষয়ক কারণে ওই দুর্গম মহকুমা শহরে ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষায়তন প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ (পিসি কলেজ)। অন্যদিকে খুলনা শহরের অনতিদূরে দৌলতপুরে ছিল বিএল কলেজ। দুটো কলেজের ছাত্ররাই বিভাগ-পূর্বকাল থেকেই ছিল রাজনীতি ও সংস্কৃতিমনস্ক।
সম্ভবত এ কারণে ঢাকায় সংগঠিত চরিত্রের প্রথম ভাষা আন্দোলনের (১৯৪৮ মার্চ) ধারাবাহিকতায় বিএল কলেজ ও পিসি কলেজের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। খুলনার ভাষা আন্দোলনে যেমন অগ্রণী ভূমিকা দৌলতপুর বিএল কলেজের ছাত্রদের, তেমনি বাগেরহাটে পিসি কলেজের ছাত্রদের। এদের নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগ ঘরানার।
এখানকার নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য মনসুর আহমদ, আশরাফ হােসেন, জহুরুল হক, মারুফুল হক প্রমুখ। এদের নিয়ে মার্চের (১৯৪৮) অন্দোলন সফল করতে গঠিত হয় ভাষা সংগ্রাম কমিটি। এর সভাপতি মনসুর আহমদ। এঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন বদরউদ্দিন আহমন, একরামুল হক, নুরুদ্দিন প্রমুখ।
শুধু কলেজের ছাত্ররাই নয়, ১৯৪৮-এর আন্দোলনে বাগেরহাট শহরের স্কুলছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। স্কুলছাত্রদের অন্যতম নেতা ইব্রাহিম হােসেন। এ শহরে রাজনৈতিক আন্দোলনে যুবনেতাদেরও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা। যেমন আমজাদ হােসেন, আবদুল বারি, আবদুল খালেক প্রমুখ।
শিক্ষার দিক থেকে যেকোনাে কারণেই হােক বাগেরহাট ছিল যথেষ্ট অগ্রসর। এখানে পূর্বোক্ত কলেজের পাশাপাশি ছিল কয়েকটি স্কুল, যেমন বাগেরহাট স্কুল, মুসলিম স্কুল, সম্মিলনী। এসব স্কুলের ছাত্ররা ১৯৪৮ থেকেই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। অথচ আমরা দেখেছি খুলনা শহরের জেলা স্কালের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। এ তথ্য সংশ্লিষ্ট সব লেখকের বক্তব্যেই উল্লেখিত।
১৯৪৮-এর ১১ মার্চ বাগেরহাটে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পূর্বোক্ত পিসি কলেজ থেকে। কলেজছাত্রদের বিরাট এক মিছিল মনসুর আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে শহর প্রদক্ষিণ শুরু করে। মিছিলের মুখে স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’ ইত্যাদি। এদের সঙ্গে যােগ দেয় শহরের স্কুলছাত্রদের মিছিল। তবে খুলনার মতােই ব্যতিক্রম মুসলিম স্কুলছাত্ররা। এর কারণ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কট্টর মুসলিম লীগ নেতা ডা. মােজাম্মেল হােসেনের প্রবল বিরােধিতা।
পূর্বোক্ত ছাত্রমিছিল শহর প্রদক্ষিণ শেষে সিসি ব্যাংকের পাশে এসে সমবেত হয়। এখানে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতা করেন পূর্বোক্ত ছাত্রনেতারা। এতে আরও বক্তৃতা করেন কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা তথা যুবনেতা- যেমন আমজাদ আলী, আবদুল খালেক প্রমুখ। সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এর পাশাপাশি সরকারবিরােধী স্লোগানও উচ্চারিত হয়। ড. শেখ গাউস মিয়ার মতে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাগেরহাটের মাটিতে এই প্রথম সরকারবিরােধী প্রতিবাদী স্লোগান ও বক্তৃতা। ছাত্র-জনতার ওই উত্তেজনাপূর্ণ সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে গণস্বাক্ষর গ্রহণের প্রস্তাবও গৃহীত হয়।
মনে রাখতে হবে, সময় ১৯৪৮-এর সূচনালগ্ন। ১৯৪৭-এর আগস্টের পাকিস্তানি মৌতাত তখন প্রবল। মাত্র ৫-৬ মাসের ব্যবধানে বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৪৮-এর সরকারবিরােধী ভাষা আন্দোলনের সূচনা। শাসকগােষ্ঠীরও তখন প্রচণ্ড দাপট। যেকোনাে প্রকার যুক্তিসংগত সমালােচনা প্রচারিত হতাে পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় উসকানি- ইসলাম বিপন্ন। সে সময় এসব অপপ্রচারে মানুষ প্রভাবিত হয়েছে। ব্যতিক্রম ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির সময়পর্ব।
স্বভাবতই জনসমর্থনের বিবেচনা মাথায় রেখে প্রশাসন ও মুসলিম লীগ দলের গুন্ডাবাহিনী সে সময় দেশের সর্বত্র ভাষা আন্দোলনের ওপর হামলা চালিয়েছে, কোথাও কোথাও ছাত্রনেতাদের মারধর করেছে। আর পুলিশ কর্তৃক আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার তাে নিয়মিত ঘটনা। খুলনা বা বাগেরহাটও ব্যতিক্রম ছিল না। বরং এ অঞ্চলে হামলার প্রকৃতি ছিল কঠোর। সরকারি নির্দেশে এসব ঘটনা ঘটেছে।
বাগেরহাটের প্রধান ছাত্রনেতা কলেজছাত্র মনসুর আহমদের ওপর যেমন নির্যাতনমূলক হামলা হয়েছে, আশ্চর্য যে স্কুলছাত্রনেতা ইব্রাহিম হােসেনও ওই গুন্তামি ও মারধরের হাত থেকে রক্ষা পাননি। তাকে পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। এ ধরনের ঘটনার প্রতিক্রিয়া অবশ্য সরকার বা মুসলিম লীগের পক্ষে যায়নি।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে বাগেরহাট তমদ্দুন মজলিসের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের কর্মতৎপরতা শুরু হয়। অন্যদিকে একই বছরে (১৯৪৯) বিপরীত ধারায় প্রগতিবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক তৎপরতা পরিপ্রেক্ষিতে নভেম্বর মাসে বাগেরহাটে তিন দিনব্যাপী সাহিত্য- সংস্কৃতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য এ অনুষ্ঠান ছিল সর্বদলীয় চরিত্রের। এতে যেমন ঢাকা থেকে বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী যােগ দেন, তেমনি আসেন কলকাতা থেকে এক দল সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মী ও নাট্যজন। বলা বাহুল্য এ-জাতীয় সম্মেলন ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে।
১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি। এবারও আন্দোলনের প্রধান উৎস পিসি কলেজ। সেই সঙ্গে মুসলিম স্কুল ব্যতীত অন্যান্য স্কুলের ছাত্ররা। উল্লেখ্য যে ১৯৪৮-এ মুসলিম স্কুলের ছাত্ররা এর প্রতিষ্ঠাতা এবং শিক্ষকদের কড়া পাহারার কারণে মিছিলে যােগ দিতে না পারলেও ছাত্রদের একাংশে ছিল আন্দোলনের প্রতি সমর্থন। তার প্রমাণ মেলে একজন ছাত্রের বহিষ্কারে। এ প্রবণতা অধিকতর ছিল ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই নির্ধারিত কর্মসূচি সফলভাবে পালনের উদ্দেশ্যে বাগেরহাটে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
এই কমিটির আহ্বায়ক তৎকালীন কলেজছাত্র, পূর্বোক্ত এ এস এম জহুরুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক পূর্বোক্ত শেখ আশরাফ হােসেন। এই কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন কলেজের অধ্যাপক মীর মােশারফ আলী ও নারায়ণচন্দ্র সমাদ্দার। কমিটির সদস্যদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মনসুর আলী, আবদুল খালেক, আশরাফ আলী প্রমুখ। অধ্যাপক কালিদাস মুখার্জি, জিতেন্দ্র লাল ও জহুরুল হকও ছিলেন এঁদের সমর্থক।
পরিস্থিতিদৃষ্টে বােঝা যায় ১৯৫২ সালে এসে রাজনৈতিক পরিবেশের কতটা পরিবর্তন ঘটেছে, এবং তা মূলত মুসলিম লীগের দুঃশাসন এবং তাদের দল ও সরকারের হঠকারী আচরণে। তা সত্ত্বেও অদূরদর্শী মুসলিম লীগ দল ও তাদের সরকারের পূর্বোক্ত ভূমিকা বন্ধ হয়নি। তারা বৃথা চেষ্টা চালিয়েছে। আন্দোলন বন্ধ করতে নানা প্রকার অপপ্রচার ও হঠকারী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
ঢাকার ঘটনাবলির খবরাখবরের পরিপ্রেক্ষিতে বাগেরহাটে আন্দোলনের সূচনা ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে। আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র পিসি কলেজ। এখানে অবস্থান ধর্মঘট, ছাত্রধর্মঘট এবং শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। অধিকাংশ দোকানপাট, যানবাহন চলাচল বন্ধ। ছাত্রদের মিছিলে যােগ দেন অনেক সাধারণ মানুষ। মিছিল শেষে কলেজ প্রাঙ্গণে সভা। বক্তা পূর্বোক্ত মনসুর আহমদ, জহুরুল হক প্রমুখ।
পরদিন একই কর্মসূচি পালিত হয় আরও ব্যাপকভাবে। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল, স্লোগান, সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে একুশের কর্মসূচি পালন। এই পরিপ্রেক্ষিতে চাঁদা তােলা, শহরময় পােস্টার লাগানাে, লাগাতার প্রতিবাদের পক্ষে সবই চলে প্রবল আবেগে। এবার সরকারবিরােধী রাজনৈতিক দলের নেতারা এগিয়ে আসেন আন্দোলন শক্তিশালী করতে। এদিনের কর্মসূচি সফলভাবে পালিত হয় ব্যাপক জনসমর্থনের মাধ্যমে। দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদনও একই চিত্র তুলে ধরে :
‘গতকল্য (২৩ ফেব্রুয়ারি) বাগেরহাটে সমস্ত দোকানপাট, রিকশা ও সিনেমা হল বন্ধ হইয়া যায়। অপরাহ্নে স্থানীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক প্রাঙ্গণে বিরাট জনসভা হয়। সভায় অমানবিক জুলুমের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদাদানের দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়’ ইত্যাদি।
২৩ ফেব্রুয়ারির বিশাল মিছিল, জনসমাগমে মুখর সমাবেশ-সভা বাগেরহাটবাসীর এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। বাগেরহাটের সন্তান কবি আবু বকর সিদ্দিক দীর্ঘকাল পর (১৯৯০) সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নিবন্ধ লিখে বাগেরহাটে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের আবেগময় বিবরণ তুলে ধরেছেন।
আরও একাধিক শহরের মতাে বাগেরহাটের ভাষা আন্দোলনও (১৯৫২) মহকুমা শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এবং তা মূলত ছাত্রনেতাদের কর্মতৎপরতার কারণে। স্বভাবতই ছাত্র আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলন অব্যাহত থাকে শহর ও প্রান্তিক এলাকাজুড়ে মার্চের প্রথম দিক অবধি। শহরে চলে নিয়মিত মিছিল, সমাবেশ ও প্রতিবাদ সভা। এ প্রসঙ্গে দৈনিক আজাদ-এর একটি প্রতিবেদনে আন্দোলনের সর্বজনীন চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয় :
‘গত ২৬শে ফেব্রুয়ারী মফস্বল অঞ্চলের বহু স্কুল হইতে ছাত্ররা দলে দলে এইখানে (বাগেরহাট শহরে) আসিয়া স্থানীয় কলেজ ও স্কুলের ছাত্রদিগের সহিত মিলিত হইয়া এক বিরাট শােক মিছিল বাহির করে এবং… স্থানীয় কলেজ সংলগ্ন রামনারায়ণ পার্কে সমবেত হয়। অপরাহে এক বিরাট জনসভা হয়।… স্থানীয় এমএলএর পদত্যাগ দাবী করিয়া সভায় বহু বক্তা বক্তৃতা করেন।’
এরপর বাগেরহাটে ৫ মার্চের হরতাল পালনের খবর প্রকাশিত হয় দৈনিক অজাদ-এর ১২ মার্চ সংখ্যায়। আজাদ এর সংক্ষিপ্ত খবরটির বিশদ বিবরণ প্রকাশ করে ১৬ মার্চ সাপ্তাহিক সৈনিক। তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ছাত্রনেতাদের শহরের বাইরের কর্মতৎপরতা এবং প্রান্তিক এলাকায় জনগণের সমর্থনের বিষয়টি। ঢাকায় বিশেষ কারণে ৫ মার্চ হরতাল সফল না হলেও প্রদেশের বিভিন্ন শহরে হরতাল প্রবল প্রতিবাদে পালিত হয়।
সৈনিক-এর উল্লিখিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘শহীদ দিবস উপলক্ষে বাগেরহাট রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা এই মহকুমার মােড়লগঞ্জ, চিরুলিয়া, কান্দাপাড়া, মােল্লাহাট, চিতলমারী, যাত্রীপর, মূলঘর, ফয়লাহাট, গিলাতলা প্রভৃতি কেন্দ্রে বক্তৃতা করিয়া (মুসলিম) লীগ সরকারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কাহিনী ছাত্র ও জনসাধারণকে ওয়াকিবহাল করান।….
‘১৫/১৬ মাইল দূরবর্তী এলাকার জনসাধারণ ও ছাত্রগণ শােভাযাত্রা করিয়া এই সমস্ত সভায় যােগদান করে।’ (সৈনিক, ১৬ মার্চ ১৯৫২)।
ভাষা আন্দোলনে বাগেরহাট এভাবে তার প্রান্তিক এলাকাসহ অনন্য ভূমিকা পালন করে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক