ভাষা আন্দোলনে ফেনী
আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ফেনী কলেজ
সাগরসংলগ্ন নােয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা শহর ফেনী বিভাগপূর্বকালে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অগ্রসর জনপদ হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনের প্রভাব মূলত ১৯৪৫-৪৬ থেকে এখানে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। তবে পূর্ব ধারায় ফেনীতে বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাব ও উপস্থিতি ছিল। ‘ফেনী কলেজের ছাত্র-শিক্ষকসূত্রে অমদ্দুন মজলিসের ছিল শিক্ষিত সমাজে বিশেষ প্রাধান্য’ (আবু মোহাম্মদ দেলােয়ার হােসেন )।
স্বভাবতই ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে ফেনীর বিশেষ ভূমিকা মূলত কলেজছাত্রদের উদ্যোগে। সঙ্গে ছিল স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। এ উপলক্ষে কলেজ সংসদের সাধারণ সম্পাদক কোব্বাদ আহমদকে আহ্বায়ক করে ভাষা উদ্যাপন কমিটি গঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে সামসুল হক চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, যারা ফেনীতে ভাষা আন্দোলন গড়ে তােলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এ ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত ‘সংগ্রাম’ পত্রিকা সম্পাদক যুবনেতা খাজা আহমদের ছিল বিশেষ ভূমিকা। সরকারবিরােধী ভূমিকার কারণে এ পত্রিকা এবং পত্রিকার সম্পাদককে অনেক প্রশাসনিক হয়রানির মুখে পড়তে হয়। এ ছাড়া পরবর্তীকালের স্বনামখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসাও ছিলেন ফেনী কলেজের ছাত্র। তিনিও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ফেনীতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পালিত হয় ঘােষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্রধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ। তবে এ পর্যায়ে ভাষা আন্দোলন ছাত্রসমাজে সীমাবদ্ধ ছিল, একাধিক সূত্রে এমনটিই প্রকাশ পেয়েছে। এ ধারাবাহিকতা চলে ১৯৫১ সাল অবধি।
তবে অবস্থা ভিন্ন হয়ে দাঁড়ায় ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের ক্ষেত্রে। ঢাকার ঘটনাবলি প্রভাব ফেলে ফেনীর ছাত্রসমাজে। পূর্ব ঐতিহ্যমাফিক ফেনীর বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের মূল প্রতিনিধি ফেনী কলেজের ছাত্ররা কলেজ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক মনােনীত করে। স্থানীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন।
এই কমিটির উদ্যোগে ও নেতৃত্বে এবং সাধারণ ছাত্রদের ব্যাপক সক্রিয় ভূমিকায় ফেনীতে গড়ে ওঠে একুশের ভাষা আন্দোলন। ধর্মঘট, মিছিল ও সভা-সমাবেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ফেনীতে ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি পালিত হয়।
কিন্তু ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ফেনীর ছাত্রসমাজ। উত্তেজিত ছাত্রমিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘খনি নুরুল আমিনের বিচার চাই’ ইত্যাদি। স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় শহরে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। এমনকি তাতে যােগ দেয় আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররাও, যেমন দেখা গেছে ঢাকায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই ছাত্র আন্দোলনেও ছিল জনসাধারণ ও শহরের শিক্ষিত সমাজের সংশ্লিষ্টতা ও সহযােগিতা। আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মহকুমার প্রান্তিক এলাকায়। সেসব স্থানেও ছাত্রদের সঙ্গে ছিল জনসংহতি।
বিচলিত প্রশাসনের রুদ্র মূর্তি। পুলিশ শুধু মিছিলেই হামলা চালিয়ে শান্ত থাকেনি। ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার করে ছাত্র ও যুবনেতাদের। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছাত্রনেতা জিয়াউদ্দিন আহমদ, জুলফিকার হায়দার চৌধুরী, লুঙ্কর রহমান, ফরমান উল্লাহ, শামসুল হুদা প্রমুখ। বাদ যাননি প্রগতিশীল যুবলীগ নেতা সাংবাদিক খাজা আহম্মদ। আটক করা হয় স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের।
তা সত্ত্বেও ফেনীতে একুশের আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে শহরে ও শহরের বাইরে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলেছে। দমননীতি আন্দোলন দমন করতে পারেনি। উল্লেখ্য, ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার সমাবেশে পুলিশ গুলি চালালে আহত হন ফেনীর সন্তান, সচিবালয়ের কর্মচারী, আবদুস সালাম। তাঁর ‘মৃত্যু সেদিন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য’- এ তথ্য সঠিক নয়। তাঁর মৃত্যু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এপ্রিল মাসে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক