ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আন্দোলনে দশম শ্রেণির ছাত্রের সাহস
বিভাগ-পূর্ব ত্রিপুরা ও বিভাগােত্তর কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা বিভাগ-পূর্বকালে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতির ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করলেও পরবর্তীকালে তা ধরে রাখতে পারেনি। প্রাধান্য পেয়েছে রক্ষণশীল রাজনীতি, মূলত ১৯৪৭ সালের পূর্ব থেকে মুসলিম লীগের দাপটে। অবশ্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলেও তিনি কুমিল্লা শহরে তার কর্মস্থল নির্ধারণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত।
১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। অবশ্য আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থে গােলাম সাকলায়েন সাকী লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ঠিক ১৯৪৮ সালে।… ঢাকায় ঘােষিত বিভিন্ন কর্মসূচি এখানে বিভিন্ন সময়ে পালন করা হতো।… আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন মাে. মহিউদ্দিন, মাে. ফায়েজুর রহমান’, কিন্তু এ বক্তব্যে কোনাে সুনির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ নেই।
এ শহরের গুরুত্বপূর্ণ ভাষাসংগ্রামী সামিউল আহম্মেদ ফটিকের সঙ্গে তাঁর সাংবাদিক জীবনে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে এমন কোনাে তথ্যের সমর্থন মেলেনি। প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাষা আন্দোলন সুস্পষ্ট চরিত্র নিয়ে প্রকাশ পায় ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির একুশে পর্বে। একাধিক ব্যক্তিগত সূত্রে একই মতামতের প্রকাশ।
দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদনেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে। ওই পত্রিকার ২২শে ফেব্রুয়ারী’র ভাষ্যে বলা হয়েছে, গতকল্য (২১ ফেব্রুয়ারি) এখানে এবং মফঃস্বলের সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। বেলা ১০টা হইতে ২টা পর্যন্ত দোকানপাট এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। বেলা ১০টা হইতে স্থানীয় সমস্ত শিক্ষালয়গুলির ছাত্রছাত্রীগণ এক বিরাট শােভাযাত্রা বাহির করে। শােভাযাত্রায় বহু লােক এবং মফঃস্বল স্কুলসমূহের বহু ছাত্র যােগদান করে। প্রায় চার হাজার বিদ্যার্থীর এক বিরাট শােভাযাত্রা সারা শহর প্রদক্ষিণ করিয়া লােকনাথ ময়দানে সমবেত হয়। সভায় বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করিবার এবং আরবী অক্ষরে বাংলা লেখার প্রচেষ্টার প্রতিবাদ জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
শান্তিপূর্ণ হরতাল ও শােভাযাত্রার চরিত্র বদল ঘটে ঢাকার ঘটনাবলির সূত্রে।
এ চরিত্রবদল প্রধানত ছাত্র আন্দোলনে স্থানীয় জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর পৌছানাের পরই সর্বত্র প্রতিবাদ ও সরকারবিরােধী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সারা শহরে কালাে পতাকা উত্তোলন, কালাে ব্যাজ ধারণ এবং সর্বাত্মক হরতাল ও মিছিল শহরের চেহারা পাল্টে দেয়। এ সম্পর্কে দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদন নিম্নরূপ:
‘গতকল্য (২৩ ফেব্রুয়ারি)- এই খানে ঢাকায় নিরস্ত্র ছাত্র ও জনসাধারণের উপর পুলিশের গুলী চালাইবার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। এই দিন সমস্ত ব্যবসায়ী ও দোকানদার স্বেচ্ছায় তাহাদের দোকানপাট ও কাজ কর্ম বন্ধ রাখে। রিকশা, ঘােড়ার গাড়ী, গরুর গাড়ী, বাস প্রভৃতি যানবাহন এবং স্থানীয় সিনেমা হলগুলি বন্ধ থাকে। বেলা ১০টায় ছাত্রছাত্রী ও জনসাধারণের সম্মিলিত এক বিরাট শােক শােভাযাত্রা শােকচিহ্ন ধারণ করিয়া সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। অপরাহ্ন সাড়ে ৪ ঘটিকায় সেন্ট্রাল ব্যাংক প্রাঙ্গণে এক বিরাট জনসভা হয়।’ (আজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একুশের ভাষা আন্দোলন ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অব্যাহত থাকে। আন্দোলন পরিচালনার জন্য ছাত্রদের উদ্যোগেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আহ্বায়ক কলেজ ছাত্রনেতা মতিউর রহমান। উল্লেখযোগ্য সদস্য মহিউদ্দিন আহমদ, সামিউল আহমদ, খান ফটিক, লুৎফর রহমান, শফিউদ্দিন আহমদ, মুহম্মদ মুসা, আবদুস সামাদ প্রমুখ।
এ আন্দোলনে শহরের আইনজীবী, স্কুল ও কলেজের শিক্ষকসমাজের প্রত্যক্ষ-পরােক্ষ সমর্থন ছিল সুস্পষ্ট। আর শহরবাসীর ছিল সক্রিয় সমর্থন মিছিলে, জনসভায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এ সম্বন্ধে দৈনিক আজাদ এর দুটো সংবাদ প্রতিবেদন উল্লেখ করার মতাে:
‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার এসােসিয়েশনের সদস্যগণ ২৬শে ফেব্রুয়ারী এক সভায় মিলিত হইয়া ঢাকায় নিরস্ত্র ছাত্র ও জনতার উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের নিন্দা, নিহত ব্যক্তিদের জন্য শােক ও তাহাদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। হাইকোর্টের বিচারপতিদের দ্বারা অবিলম্বে তদন্ত এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের দাবী জানাইয়াও সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ (১৩ মার্চ ১৯৫২)।
পরদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের শিক্ষকদের উদ্যোগে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এ সভায় কলেজের অধ্যাপকেরা তীব্র ভাষায় পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা, জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত অনুষ্ঠান, বন্দী ছাত্রদের মুক্তি এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ( আজাদ, ৬ মার্চ ১৯৫২)।
অন্যান্য শহরের মতাে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার আন্দোলনও এর একাধিক থানা এবং অন্যান্য দূর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। শহরের নিকটবর্তী আখাউড়া রেলজংশন শহরে ভাষা আন্দোলন উপলক্ষে স্থানীয় স্কুলগুলােতে ধর্মঘট পালিত হয়। সেই সঙ্গে ২৫ ফেব্রুয়ারি হরতাল (আজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ার ১৯৫২)।
একই ধারায় সন্নিহিত দাউদপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ২৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের এক বিরাট সভা হয়। সভা শেষে বিক্ষোভাত্মক স্লোগানসহকারে এক মিছিল বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে (আজাদ, ১ মার্চ ১৯৫২)। একই দিনে রামকৃষ্ণপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গণে কাজী আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় যথারীতি প্রস্তাব গৃহীত হয় (আজাদ, ৩ মার্চ ১৯৫২)। কসবাতেও ছাত্র-জনতার বিশাল এক জনসভায় ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানাে হয়।
১৯৯৫-এর ফেব্রুয়ারিতে ভােরের কাগজ-এর ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি পীযুষ কান্তি আচার্য স্থানীয় ভাষাসংগ্রামী মুহম্মদ মুসার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তারই জবানিতে জানান যে উল্লিখিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে নিয়াজ মুহম্মদ স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সামিউল আহমদ ফটিক আন্দোলনে বরাবর সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তিনি স্থানীয় কোর্ট বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে পাকিস্তানি জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলে এক দুঃসাহসী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
মুহম্মদ মুসা আরও বলেন, একুশের আন্দোলনে লেখক-শিক্ষকসহ ব্যাপক সক্রিয় সমর্থন ছিল শহরবাসীর। এর মাশুল দিতে হয়েছে অনেককে কারাবরণ করে। ছাত্র ফটিক দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী থাকেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন জেলখানা থেকে। পরিণত বয়সে সাংবাদিকতা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় সক্রিয় ফটিকের সঙ্গে আমার ঢাকায় পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে অনেক তথ্য জানার সুযােগ ঘটেছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আন্দোলনে উল্লিখিতদের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠা ভাষাকর্মীদের মধ্যে ছিলেন তাজুল ইসলাম, আল মাহমুদ, আবদুস সামাদ, রফিকুল ইসলাম। বিশেষ ভূমিকা ছিল তকালীন স্থানীয় আইনজীবী আবদুল বারীর। ভাষাসংগ্রামী আবদুস সামাদ লিখেছেন, এ আন্দোলনে স্থানীয় সরােজিনী গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের স্মরণীয় ভূমিকার কথা। ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী সুলতানার (কবি আবদুল কাদিরের কন্যা) নেতৃত্বে সরােজিনী গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা মিছিল করে বের হয়ে আসে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে। জনাব সামাদ আরও কয়েকজন সংগ্রামী ছাত্রীর নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হােসনে আরা, রহিমা খাতুন, আম্বিয়া খাতুন, রওশন আরা হেনা, নূর জাহান বেগম, মােহসেনা বেগম প্রমুখ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী অন্নদা স্কুলের ছাত্রদেরও ছিল সংগ্রামী ভূমিকা।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক