You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে কুড়িগ্রাম - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে কুড়িগ্রাম
যােগাযােগ সমস্যা সত্ত্বেও আন্দোলন

রংপুর জেলার মহকুমা শহর কুড়িগ্রাম। উত্তরাঞ্চলেরও উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এই জনপদ নামেই মহকুমা। যাতায়াত ও যােগাযােগ ব্যবস্থা কোনােটাই সহজ ও সুগম ছিল না। পাকিস্তান আমলেও একই অবস্থা। ঢাকা থেকে দৈনিক পত্রিকা আসে দিন দুই পরে।
এ অবস্থায় ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলনে কুড়িগ্রাম প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে না পারলেও কিছুদিনের মধ্যে এ বিষয়ে স্থানীয় যুবকদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তাদের মধ্যে তৎপরতা লক্ষ করা যায়।
বিশেষ সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে একটি ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সভাপতি কাজী এমদাদুল হক। সদস্যসচিব মিয়া আবদুল হাফিজ। এ কথা জানা যায় মনােরঞ্জন রায়, আমিনুল ইসলাম ছমির রচিত আঞ্চলিক ইতিহাস শিরােনামের গ্রন্থ থেকে। কিন্তু এদের রচনায় ভাষা আন্দোলন বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলে না। দৈনিক পত্রিকাগুলােতে তেমন কোনাে খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি।
একই সূত্রে বলা হয়েছে ১৯৪৮ সালের মে মাসে মাওলানা ভাসানীর কুড়িগ্রামে আসা এবং জনসভা অনুষ্ঠানের কথা। সে সভায় তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তােলেন তাঁর বক্তৃতায়। ভুরুঙ্গামারীতে তিনি প্রায়ই যাওয়া-আসা করতেন। স্বভাবতই মুসলিম লীগের উদারপন্থীদের মধ্যে এর কিছু প্রভাব পড়ে।
অন্য একটি সূত্রে বলা হয়েছে, ১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কুড়িগ্রাম মহকুমা শাখার প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মতিউর রহমান, খয়রাত হােসেন প্রমুখ নেতা বক্তৃতা করেন (হাসিবুর রহমান- জেলায় জেলায় ভাষা আন্দোলন)। এসব ঘটনার সুপ্রভাব পড়ে কুড়িগ্রামের রাজনৈতিক মহলে। এমনটিই অনুমান সংশ্লিষ্ট মহলের।
এভাবে কুড়িগ্রামে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব (১৯৪৮-১৯৫১) শেষ হয়। আসে বিস্ফোরক একুশে ফেব্রুয়ারি পর্ব (১৯৫২), যার সূচনা ঢাকায় রক্ত ঝরানাের মাধ্যমে।
পূর্বোক্ত আঞ্চলিক ইতিহাসের লেখকদ্বয়ের পরিবেশিত তথ্যে প্রকাশ যে ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর ‘কুড়িগ্রামে পৌছায় ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে’। এই সংবাদ শহরের ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত মহলে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তখন কুড়িগ্রামে কোনাে কলেজ ছিল না। স্বভাবতই স্কুলের ছাত্ররাই কুড়িগ্রামে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। তাদের সঙ্গে যােগ দেয় শহরের পূর্বোক্ত রাজনীতিসচেতন অংশ।
কুড়িগ্রাম হাইস্কুলের ছাত্রদের উদ্যোগে সূচিত বিক্ষোভ মিছিল শহরের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে সভা। এতে সর্বস্তরের মানুষ যােগ দেয়। এসব কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল হামিদ, আবদুল আহাদ, বাদল রুদ্র, হারিছুর রহমান প্রমুখ।
পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি হাইস্কুল ছাত্রদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রসমাবেশ। সেখানে অন্যান্য স্কুলের ছাত্রদের উপস্থিতি সমাবেশের আকার বৃদ্ধি করে। এরপর মিছিল, স্লোগান ও শহর পরিক্রমা শেষে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে এসে মিছিল শেষ হয়। স্বাভাবিক নিয়মে এখানে সম্ভবত সভাও হয়ে থাকবে। লক্ষণীয় যে এ মিছিলে সাধারণ মানুষই নন, বিড়িশ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যােগ দেন।
স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় কর্মতৎপরতা বাড়ে। লেখা হতে থাকে পােস্টার ও দেয়াললিপি প্রতিবাদী স্লোগান তুলে ধরে। এ পর্বের আন্দোলনে নেতাদের মধ্যে আরও ছিলেন আবুল মনসুর, রুহুল আমিন প্রমুখ। প্রতিবাদের ঘনঘটায় টনক নড়ে প্রশাসনের এবং মুসলিম লীগ দলের উগ্রপন্থীদের।
এবার মিছিলে মিছিলে নিয়মিত পুলিশের হামলা চলতে থাকে। এখানে শক্তিমান ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠন না থাকায় আন্দোলন খুব বেশি দিন সক্রিয় থাকতে পারেনি। বিশেষ করে প্রশাসনের কঠিন দমননীতির কারণে। তবু কুড়িগ্রামের ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ বিক্ষোভে একুশের ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষা করতে পিছিয়ে থাকেনি।
ভিন্ন সূত্রের (পূর্বোক্ত হাসিবুর রহমান) দাবি, ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর কুড়িগ্রামে পৌছায় ২২ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন কুড়িগ্রাম হাইস্কুলে শােকসভা হয়। শােকসভায় বক্তব্য দেন শামছুল হক, আবদুস সামাদ, আমানউল্লাহ, আজিজুল হক, ওসমান আলী, চিত্তপাল, আবদুল হামিদ প্রমুখ। মূলত এই ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বেই তখন আন্দোলন গড়ে ওঠে।
ভাষা আন্দোলনের দুর্ভাগ্য যে যথাসময়ে এ আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস সংকলিত না হওয়ার কারণে দীর্ঘকাল পর লিখিত বিবরণে এমন অনেক স্ববিরােধিতার প্রকাশ ঘটেছে। বিপন্ন পাঠক, তারা কোনটিকে সঠিক বলে গ্রহণ করবেন? আরও সমস্যা, জীবিত ভাষাসংগ্রামীদের অনেকে বিস্মৃতির কারণে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন। তাই তাঁদের বক্তব্যেও পরস্পর বিরােধিতা প্রকাশ পেয়েছে। শহীদ মিনার নির্মাণ ও তার দিন-তারিখ নিয়েও একই অবস্থা।
কুড়িগ্রামের প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী শুধু আন্দোলনের ওপরই হামলা চালায়নি; তারা প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চাতেও বাধা দিয়েছে। তবু নানা সংগঠনের আড়ালে চলেছে প্রগতি সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা এবং সেই সূত্রে ভাষার অধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস।
বৃদ্ধি পায় আঞ্চলিক লােকসংগীত, গণসংগীতসহ প্রথাসিদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা। পূর্বোক্ত নিবন্ধকারের মতে এ সময়ের সংস্কৃতিচর্চায় নিয়ােজিত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য জুলহাস উদ্দিন, আলী আমজাদ, অজিত কুমার রায় প্রমুখ শিল্পী ও নাট্য অভিনেতা, যারা এ সময় কুড়িগ্রামে ছিলেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন ভাষা আন্দোলনে।
উল্লিখিত নিবন্ধকারদের মতে, কুড়িগ্রামে কাজী এমদাদুল হক ও আবদুল হাফিজের উদ্যোগে এবং ছাত্রদের প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কাদামাটি দিয়ে ইট গেঁথে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করা হয়।… স্বাধীনতার আগেই কুড়িগ্রাম মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। এরপর ১৯৮৫ সালে পৌরসভার উদ্যোগে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়। এসব নিয়েও রয়েছে ভিন্নমত।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক