ভাষা আন্দোলনে ঈশ্বরদী
কঠোর হুশিয়ারির মধ্যে আন্দোলন
সৈয়দপুরের মতাে অতটা না হলেও ঈশ্বরদীতে অবাঙালি তথা বিহারিদের সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না। মােহাজের হিসেবে ভারত থেকে পূর্ববঙ্গে আসা সত্ত্বেও তাদের উচ্চম্মন্যতা যথেষ্টই দেখা গেছে। পাকিস্তান নিয়ে তাদের প্রচণ্ড অহমিকা ছিল লক্ষ করার মতাে। সৈয়দপুরের মতো রেলওয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটির সর্বত্র ছিল বিহারিদের একচেটিয়া আধিপত্য।
ঈশ্বরদীতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা কিছুটা ভিন্ন ধারায় এবং তা বেশ চমকপ্রদ। তবে একটি তথ্য সৈয়দপুরের মতাে ঈশ্বরদীর ক্ষেত্রেও সত্য যে এখানেও বিরূপ পরিস্থিতির কারণে ১৯৪৮ সালের মার্চের আন্দোলন জমে উঠতে দেখা যায়নি। কিন্তু ১৯৫২ সালে পরিস্থিতি ভিন্ন। হয়তাে তাই মাড়ােয়ারি পান বিক্রেতার দোকানে সচল রেডিও থেকে আকাশবাণী কলকাতার প্রচারিত খবর, ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হতাহতদের কথা শুনে বিচলিত হন কয়েকজন স্থানীয় ছাত্রনেতা।
তাৎক্ষণিক আবেগে অভিভূত ছাত্রনেতারা ঈশ্বরদীতে আন্দোলন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আবু মাে. মুসা, বীরেন্দ্রনাথ রায়, সুশীল কুমার বিশ্বাস, আবদুল্লাহ আল মামুন খান প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা মাহবুব আহমেদ খান ও আফসার উদ্দিন। এঁরা স্থানীয় স্কুলের ছাত্রদের সমবেত করে পুরােনাে বটতলায় প্রতিবাদী সমাবেশের আয়ােজন করেন। এ তথ্য জানান কিরণ আহমেদ।
এ সমাবেশে বক্তব্য দেন স্থানীয় স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন এবং বীরেন্দ্রনাথ রায়, বিধুভূষণ মজুমদার, আবু মুসা প্রমুখ। ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ বলা বাহুল্য ছাত্র-জনতার মধ্যে তীব্র সরকারবিরােধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বটতলার এই সমাবেশ থেকে পথে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ এক প্রতিবাদী মিছিল।
মিছিল চলে আসে স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে। ছাত্রীদের উদ্দেশে আহ্বান জানানাে হয় ক্লাস বর্জনের। লক্ষণীয়, ছাত্রীরা মিছিলের ডাকে সাড়া দেয়। মিছিলটি ঈশ্বরদী বাজার হয়ে ডাকবাংলাে মাঠে এসে ছাত্রনেতাদের সহযােগিতায় আরও একটি বড় সমাবেশের আয়ােজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন আফসারউদ্দিন আহমেদ। এ সভায় বক্তব্য দেন মাহবুব আহমদ খান, স্কুলশিক্ষক মজিবর রহমান, আবুল কালাম প্রমুখ। সভায় শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আদায়ের এ আন্দোলনে স্থানীয় বিহারি ছাত্ররা যােগ না দিলেও সৈয়দপুরের মতাে প্রত্যক্ষ বিরােধিতা করতে সাহস পায়নি। বরং বাঙালি ছাত্রনেতাদের সিদ্ধান্ত এরপর বিহারি ছাত্রদের স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রনেতারা স্কুলগেটে অবস্থান নেন এবং বিহারি ছাত্রদের স্কুলে ঢুকতে বাধা দেন বিহারি ছাত্ররা স্কুল-ধর্মঘটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্লাস করতে চাইলে দুই পক্ষে সংঘাত হয়। বিহারি ছাত্ররা স্কুল কমিটি, স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা নুরুজ্জামান খান এবং শিক্ষকসহ সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তরে বিচারের দাবি করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপার স্কুল কমিটির প্রধান এবং বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে ছাত্রদের উদ্দেশে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই বলে যে ভাষা আন্দোলনের নামে পাকিস্তানবিরােধী কোনাে কর্মকাণ্ড বরদাশত করা হবে না। এই নির্দেশ অমান্য করা হলে সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
২৩-এ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রী বনাম প্রশাসনের পরস্পরবিরােধী অবস্থান গ্রহণের ফলে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে- কেউ কারও অবস্থান থেকে সরে আসেনি। এর মধ্যে শিক্ষকদের কেউ কেউ মধ্যস্থতার চেষ্টা করে বিফল হন। বস্তুত প্রশাসনের কঠোর হুঁশিয়ারির ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তারা কিছুতেই পিছু হটবে না।
ইতিমধ্যে পাবনা থেকে আবদুল মতিন, আবদুল আজিম প্রমুখ কয়েকজন ছাত্রনেতা ঈশ্বরদীতে আসেন স্থানীয় ছাত্রনেতাদের মনােবল চাঙা করার উদ্দেশ্যে। এদিন ২৪-এ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় ছাত্রনেতাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। চলে সভা-সমাবেশ, মিছিল, স্লোগান। মূল স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’, ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়’ ইত্যাদি।
ঢাকার মতােই ঈশ্বরদীতেও ছাত্রদের পাশাপাশি স্থানীয় স্কুলের ছাত্রীরা নির্ভীক পদচারণে মিছিলে অংশ নেয়, স্লোগানে মুখর তাদের কণ্ঠ। ছাত্রীদের আন্দোলন সংগঠিত করতে যেসব ছাত্রী নেতৃত্ব দেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযােগা সুফিয়া বেগম, জাহানারা প্রধান, নূরজাহান বেগম, হালিমা খাতুন, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ। ঢাকার তুলনায় প্রদেশের বিভিন্ন শহরে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ কোনাে অংশে কম ছিল না।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রছাত্রীদের তৎপরতায় সংঘটিত ভাষা আন্দোলন অবাঙালি ছাত্র ও প্রশাসনের বাধা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট সময় ও পরিসীমায় শেষ হয়। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে সরকারি নির্দেশে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয় অগ্রণী ছাত্রনেতা আবদুল্লাহ আল মামুনকে। পড়াশােনা অব্যাহত রাখতে তিনি ভর্তি হন পাকশীর একটি স্কুলে।
১৯৫৩-এর ভাষাশহীদ দিবস উদ্যাপনে ঢাকায় গৃহীত কর্মসূচির প্রভাব সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর সাংগঠনিক তৎপরতা বায়ান্নর চেয়ে কোনাে অংশে কম ছিল না। বরং তুলনায় তা অনেক বেশি সংহত ও সংগঠিত ছিল। বিরােধিতার মুখেও ঈশ্বরদীর ছাত্রছাত্রীরা দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করেন। সভায় বিহারি ছাত্রদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালানাের সিদ্ধান্ত হয়।
পরিকল্পনামাফিক চেষ্টা চলে নাজিমুদ্দিন স্কুলের বিহারি ছাত্রদের আন্দোলনে ও মিছিলে টেনে আনতে। কিন্তু এর ফল হয় বিপরীত। তর্ক ও বাদানুবাদে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়। বাঙালি ছাত্রমিছিলে হামলায় যুক্ত হয় পুলিশের লাঠিপেটা। সংঘর্ষে আহত হন লুৎফর রহমান, আবু মাে. মুসা প্রমুখ ছাত্রনেতা। পুলিশ এঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এত সব সত্ত্বেও শহীদ দিবস ঈশ্বরদীতে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। একইভাবে ১৯৫৪-র একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উদ্যাপিত হয় অধিকতর সাংগঠনিক তৎপরতায়। পূর্বোক্ত ছাত্রনেতারা এ সময় কলেজছাত্র। তবু তারা একদিনের আন্দোলন বেগবান করতে চেষ্টা চালান। এ তৎপরতায় জেলে আটক জনা বিশ ছাত্রনেতা মাসখানেক পর মুক্তি পান। একুশের এ ধারাবাহিকতা ছিল প্রদেশজুড়ে। ঈশ্বরদীর স্বনামখ্যাত কমিউনিস্ট শ্রমিকনেতা জসীমউদ্দীন মণ্ডল তখন একাধিক সহযােদ্ধার সঙ্গে কারাগারে। তা সত্ত্বেও নেপথ্য থেকে কমিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলনে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে। তাদের ছাত্রনেতারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কর্মীরা অংশ নিয়েছেন।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক