You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে মৌলভীবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে মৌলভীবাজার
কুলাউড়া-শ্রীমঙ্গলের শক্তিতে আন্দোলনের প্রকাশ

শ্রীহট্ট তথা সিলেট জেলার দূর পশ্চিম প্রান্তের মহকুমা শহর মৌলভীবাজার। রাজনৈতিক দিক থেকে সেখানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রাধান্য। শিক্ষায়তন বলতে গােটা কয়েক হাইস্কুল। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশােনার জন্য।
স্বভাবতই ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন মহকুমা শহর মৌলভীবাজারকে স্পর্শ করেনি। ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে হতাহতের খবর শহরে পৌছালে স্কুলছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়ে বেরিয়ে আসে। চেষ্টা করে মিছিলে সমবেত হতে। স্লোগান তােলে : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। স্মরণযােগ্য যে ছাত্রদের এই প্রতিবাদ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কেউ তাদের বলেনি যে সভা, হরতাল, মিছিল করতে হবে। প্রদেশের দূর থেকে দূরতম এলাকার ছাত্রদের এই ভাষিক চেতনার প্রকাশ বিস্ময়কর। এখানে একুশের তাৎক্ষণিক সাফল্য ও সামাজিক-রাজনৈতিক উত্তর প্রভাবের রহস্য নিহিত।
একুশের বিশেষত্ব ও মহত্ত্বের নেপথ্যে মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববােধ এবং সম্ভবত তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ঢাকায় ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহত হওয়ার ঘটনা, যা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার দূরপ্রান্তে ছাত্র-জনতাকে যে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ ও প্রতিবাদ করে তুলেছিল অখ্যাত দূরসীমান্ত শহর মৌলভীবাজারও তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
যথারীতি ছাত্রদের খণ্ড মিছিলেও পুলিশ বাধা দিয়েছে, বাধা অমান্যকারীদের ওপর লাঠি চালিয়েছে। অমানবিক পুলিশি ঔদ্ধত্যে তারা ছােট ছােট কচি স্কুলছাত্রকে প্রহার করতে দ্বিধা করেনি। আহত দুই ছাত্র গফুর ও মনির। এই ছিল পূর্ববঙ্গের শহরে গ্রামে-গঞ্জে মুসলিম লীগের পুলিশি শাসনের নমুনা। অথচ সাধারণ মানুষ, এমনকি বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখা গেছে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সহানুভূতি ও মায়া-মমতার প্রকাশ ঘটাতে।
দমননীতির মুখে খাস মৌলভীবাজার শহরে একুশের ভাষা আন্দোলন ততটা জোরালাে হতে না পারলেও হাল ছাড়েনি নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা। তারা আশ্চর্য সাহস ও তৎপরতায় ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছে এ মহকুমার অধীন একাধিক থানা শহর ও সন্নিহিত এলাকায়। বিশেষভাবে কুলাউড়া ও শ্রীমঙ্গল থানায়। সেই সঙ্গে কমলগঞ্জ, শমসেরনগরের মতাে একাধিক স্থানে। ছাত্রনেতারা ট্রেনে যাতায়াত করেছে অবাধে, কেউ তাদের কাছে টিকিট দেখতে চায়নি। যেখানে যাতায়াতব্যবস্থার অসুবিধা সেখানে তারা হেঁটে লক্ষ্যস্থলে পৌছেছে। এমনই ছিল আন্দোলন সফল করতে তাদের শ্রম ও নিষ্ঠা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও স্কুলছাত্রদের পক্ষে আন্দোলনে প্রতিবাদী যাত্রায় এমন আন্তরিকতা বাস্তব সত্য।
মৌলভীবাজারের ছাত্রদের এ আন্দোলনে সাহায্য এসেছে বিভিন্ন উৎস থেকে। যেমন অন্যত্র অধ্যয়নরত স্থানীয় ছাত্র, তেমনি শহরের উদারমনা পেশাজীবীদের সদস্যবিশেষ, যেমন আইনজীবী বা ব্যতিক্রমী ধারার রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক কর্মী। আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতাদের ছিল সহযােগিতা।
সম্ভবত এমন সব কারণে অনেক বাধার মুখেও মৌলভীবাজার শহর ভাষা আন্দোলনে অংশ নিতে পেরেছে। এখানে আন্দোলন উপলক্ষে যেমন সভা, পিকেটিংও মিছিল হয়েছে, তেমনি হয়েছে পােস্টার সাঁটা শহরের দেয়ালে দেয়ালে। এ কাজে সহায়তা করেছেন স্থানীয় আইনজীবী ইউনুছ মিয়া। অনুরূপ সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কুলাউড়ার বামপন্থী ছাত্রনেতা সৈয়দ আকমল হােসেন, সিলেট শহরে অধ্যয়নরত ছাত্র কামরুজ্জামান। অনুরূপ উদাহরণ সৈয়দ আহমেদ মাহমুদ, আবদুল সঈদ চৌধুরী প্রমুখ ছাত্র।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারির ছাত্রধর্মঘট স্থানীয় প্রতিটি স্কুলে সফলভাবে পালিত হয়েছিল। এবং তা প্রশাসনিক চাপ সত্ত্বেও। ২৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল পার্কে বিশাল এক জনসভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় আইনজীবী আবদুল আজিজ। সভায় যথারীতি ছাত্র হত্যাকারীদের বিচার, নুরুল আমিন সরকারের পদত্যাগ, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
এ ছাড়া স্থানীয় শ্রীনাথ মডেল স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা করেন বসন্ত দাস, পীর হাবিবুর রহমান, তারা মিয়া প্রমুখ বিশিষ্টজন। আত্মগােপনে থাকা শশাঙ্ক ঘােষের সহযােগিতাও ছিল উল্লেখযোগ্য।
তুলনামূলক বিচারে কুলাউড়ার আন্দোলন ছিল অপেক্ষাকৃত ব্যাপক ও জোরালাে। এখানে আন্দোলন গ্রামপর্যায়ে বিস্তার লাভ করে। এখানে দুজন অধ্যাপক নিয়ে আন্দোলন পরিচালনায় সংগ্রাম কমিটিও গঠিত হয়। জনগণের মধ্য থেকে বেশ সাড়া পাওয়া যায়। সমর্থন মেলে স্থানীয় কৃষক আন্দোলনের নেতাদের কাছ থেকে। এ পর্বে এখানে কয়েকটি জনসভাও হয়।
অন্যদিকে শ্রীমঙ্গলে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন মৌলভি মােহাম্মদ ইসমাইল। সভায় বক্তারা সরকার ও প্রশাসনের সমালােচনা করেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবগুলাে যথারীতি অন্যান্য স্থানের মতােই। উল্লেখ্য যে স্বনামখ্যাত বহুভাষাবিদ ও সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর মূল বাড়ি মৌলভীবাজারের একটি গ্রামে। তিনি লিখিতভাবে ভাষা আন্দোলন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।
বিচ্ছিন্নভাবে হলেও মৌলভীবাজার মহকুমা শহর ও একাধিক স্থানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এবং নুরুল আমিন সরকারের অনাচারী শাসনের প্রতিবাদে যে আন্দোলন সংঘটিত হয়, ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে তার গুরুত্ব কোনাে অংশে কম নয়। দুর্ভাগ্যজনক যে শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরে জেলা শহর, এমনকি মহকুমা ও থানা শহরগুলােতে সংঘটিত আন্দোলনের ইতিহাস তাৎক্ষণিকভাবে, এমনকি পরবর্তীকালেও লিখিত হয়নি। ফলে সেসব ঘটনা বিস্মৃতির বালুচর হারিয়ে গেছে। যা লেখা হয়েছে, তা ইতিহাসের বিচারে অকিঞ্চিৎকর।
দীর্ঘকাল পর জীবিত স্বল্প কয়েকজন ভাষাসংগ্রামীর ঝাপসা স্মৃতি থেকে যেসব ঘটনা উদ্ধার করা হয়েছে, তা-ই হয়ে উঠেছে একুশের আঞ্চলিক ইতিহাস। পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চল এদিক থেকে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার। যেমন উত্তরাঞ্চলের, তেমনি পূর্বাঞ্চলে দূর এলাকাগুলাে, হােক না তা মহকুমা বা থানা শহর। সিলেটের অধিকাংশ শহরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসবিষয়ক পরিস্থিতি একই রকম, কিছুটা কম আর বেশি, যেমন দূর ভাটি এলাকা সুনামগঞ্জ।
যা-ই হােক মৌলভীবাজারে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদক আকমল হােসেনের বক্তব্যে জানা যায় যে ইটের ওপর ইট রেখে সেগুলােকে রঙিন কাগজে মুড়ে শহীদ মিনার তৈরির চেষ্টা চালায় সেখানকার কিছুসংখ্যক দূরদর্শী ছাত্র। পরে স্থানীয় রক্ষণশীলদের বিরােধিতার মুখে পর্যায়ক্রমে শহীদ মিনার নির্মাণের চেষ্টা চলে।
একপর্যায়ে স্থায়ী শহীদ মিনারও নির্মিত হয় নানা কারণে একাধিকবার ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় রক্ষণশীলদের বিরােধিতা ছিল শক্তিমান। তা সত্ত্বেও শহরে স্থায়ী মিনারটি নির্মিত হয় ১৯৮৩-৮৪ সালে।
অন্যদিকে শ্রীমঙ্গলে শহীদ মিনার নির্মিত হয় ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এটি অবশ্য ভাষাশহীদ ও স্থানীয় কৃষক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত সম্মিলিত চরিত্রের স্থাপত্যকর্ম। এ ছাড়া এ মহকুমার একাধিক স্থানে ভাষিক কর্মতৎপরতার প্রতীকরূপে তৈরি হয়েছে নানা আকৃতির শহীদ মিনার।
মৌলভীবাজারের ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনার সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে ২ মার্চের আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, ‘২৮ ফেব্রুয়ারি মহকুমা মােছলেম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ, …অবিলম্বে ঘটনা সম্পর্কে তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানানাে হয়। সভায় আরও একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ অর্থাৎ জনদাবির কাছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় শাখার নতিস্বীকার।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক