ভাষা আন্দোলনে মাদারীপুর
সরকারি হুমকিতেও পিছু হটেনি প্রতিবাদীরা
দক্ষিণাঞ্চলের বড়সড় জেলা ফরিদপুর। পাকিস্তানি আমলের পূর্ববঙ্গের এই জেলার একটি বৃহদায়তন মহকুমা মাদারীপুর সত্তরের দশকে বিভাজনের শিকার, মূলত কৃষকবান্ধব ফরায়েজী আন্দোলনের প্রভাবে। এ আন্দোলনের মূল সংগঠক হাজী শরীয়তউল্লাহর নামানুসারে মাদারীপুরের সংশ্লিষ্ট পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় স্বতন্ত্র শরীয়তপুর মহকুমা। ভাষা আন্দোলন পর্বে মাদারীপুর মহকুমা আপন ভৌগােলিক সত্তা নিয়ে সক্রিয়।
ইতিহাসের সাক্ষ্যে বলা চলে যে এ মহকুমা ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে বঙ্গের একাধিক অঞ্চলের মতােই। দুই পর্যায়ে সরকারবিরােধী ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে মাদারীপুর তার ঐতিহ্যিক মর্যাদা রক্ষা করেছে।
১৯৪৮ সালে এখানে আন্দোলনের সূচনা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে দৃঢ় ঘােষণার প্রতিক্রিয়ায়। মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া স্কুলের ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে সােচ্চার হতে সাহস জোগান স্থানীয় কংগ্রেস নেতা পরেশ দাশগুপ্ত। পূর্বোক্ত স্কুলছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে সভা ও মিছিলের আয়ােজন করে। যথারীতি স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। মাইকের অভাবে টিনের চোঙায় ক্ষুব্ধ স্লোগান স্থানীয় জনগণকে সচেতন করে তােলে।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমাফিক মাদারীপুরেও প্রতিবাদসভা ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন দশম শ্রেণির আবুল ফজল এবং আবদুল মান্নান ভূইয়া, আবদুল লতিফ, সৈয়দ আলী প্রমুখ নির্ভীক ভাষাপ্রেমী ছাত্র।
এরপর কিছুটা বিরতি। ইতিমধ্যে মাদারীপুরের শিক্ষায়তনগত ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি। খাজা নাজিমুদ্দিনের নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজের ছাত্ররাও পূর্বােক্ত স্কুলছাত্রদের মতােই ভাষা আন্দোলনে সচেতনতার পরিচয় রাখে। ১৯৫০-এ ঢাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের মূলনীতি কমিটির রিপাের্টে আবারও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার সুপারিশ করায় ঢাকার রাজনৈতিক মহলে এবং ছাত্রদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও অন্যান্য দাবিতে যে ব্যাপক আন্দোলন দেখা দেয়, সম্ভবত তার প্রভাব পড়েছিল ঢাকার বাইরে কোনাে কোনাে শহরে, সর্বত্র নয়।
হতে পারে সেই টানে ১৯৫১ সালে নতুন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে স্থানীয় স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা। তবে পূর্ব ধারামাফিক এবারও স্কুলছাত্ররা ছিল আন্দোলনে সবচেয়ে সােচ্চার ও তৎপর। যেমন পূর্বোক্ত স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নুরুল হক। সঙ্গে তৎপর পর্বোক্ত স্কুলছাত্র আবুল ফজল (এ সময় কলেজ ইউনিয়নের ভিপি)। তার সহযােদ্ধা একাধিক কলেজছাত্র। তবে এবার যুক্ত হন আন্দোলন পরিচালনায় গঠিত সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক সংগ্রামী ছাত্র নুরুল হক।
২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকায় সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলির প্রভাব প্রদেশের অন্যান্য স্থানের মতাে মাদারীপুরকেও গভীরভাবে স্পর্শ করে, বিশেষ করে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতের অবিশ্বাস্য ঘটনা। পূর্বঘােষিত ও প্রচারিত কর্মসূচি অনযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরের সব শিক্ষায়তনে ধর্মঘট পালিত হয়। ক্ষুব্ধ মহকুমা প্রশাসক ও স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে আন্দোলনের মূল কেন্দ্র মাদারীপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ছাত্রদের পক্ষে। বলা বাহুল্য, ছাত্ররা প্রশাসনের হুমকি গ্রাহ্য করেনি।
এ আন্দোলনে বিশেষ তীব্রতা ও জনসংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পায় ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে তখনকার বিখ্যাত স্টিমার সার্ভিসে ঢাকার খবর পৌছানাের পরিপ্রেক্ষিতে। এ সম্পর্কে দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদনের বক্তব্য নিম্নরূপ (৪ মার্চ ১৯৫২):
‘গত ২৪শে ফেব্রুয়ারী রাত্রে তারপাশামেইল মাদারীপুর পৌছার সাথে সাথেই সমস্ত মাদারীপুর শহর ও শহরতলী ঢাকার মর্মান্তিক সংবাদে শােকাচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। ভাের হওয়া মাত্র এই সংবাদ চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়ে। শহরে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। বেলা ১১টায় ছাত্র ও নাগরিকদের ১ মাইল দীর্ঘ একটি মিছিল এবং অর্ধমাইল দীর্ঘ ছাত্রী দলের অপর একটি মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতে করিতে সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করিয়া স্থানীয় জুম্মা মসজিদ প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতের সমস্ত কাৰ্য্য বন্ধ হইয়া যায়। মসজিদ প্রাঙ্গণে জনাব আছমত আলী খানের সভাপতিত্বে এক জনসভা হয়।’
এ সভায়, ওই প্রতিবেদনমতে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পূরণ, গুলিবর্ষণের নিন্দা ও জড়িতদের বিচার এবং অবিলম্বে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
প্রতিক্রিয়া এতই ব্যাপক ছিল যে অন্যান্য শহরের মতাে মাদারীপুর মহকুমার থানা ও প্রত্যন্ত এলাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এবং তা ২১ ফেব্রুয়ারির পর থেকেই। মাদারীপুরের অন্তর্গত শিবচর থানায় ২২ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত আন্দোলন সম্পর্কে আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) অংশবিশেষ নিম্নরূপ :
‘শিবচর নন্দকুমার ইনস্টিটিউশনের ছাত্রবৃন্দ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ধর্মঘট পালন করে। শিবচর থানার অন্যান্য স্কুলের ছাত্রগণও তাহাদের সঙ্গে মিলিত হয়। অতঃপর প্রায় দেড় হাজার ছাত্র শােভাযাত্রা করিয়া বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে। অপরাহ্নে স্কুল প্রাঙ্গণে এক বিরাট সভা হয়। মােহাম্মদ মােশাররফ হােসেন সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদদানের দাবী জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।’
মাদারীপুরে সংঘটিত ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে স্থানীয় সন্তান সিরাজুল হকের (আমার সহপাঠী বন্ধু এবং একই ব্যারাকবাসী) বয়ানে প্রদত্ত তথ্যে কিছু ভুলত্রুটি সম্পর্কে উল্লেখ করতে হচ্ছে। প্রতিবেদক আনিসুর রহমানের বিবরণমতে, ‘শহীদ বরকতকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান ডা. সিরাজুল হক তােতা। বরকত তার হোস্টেল ব্লকের (২০ নম্বর ব্যারাক) সামনেই গুলিবিদ্ধ হন।’ (আবু মােহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন)।
প্রকৃত তথ্য হলাে, আবুল বরকত গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ১২ নম্বর ব্যারাকের সামনে এবং তাকে বহন করে হাসপাতাল ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়েছিলে বরকতেরই পরিচিত মিঞা মােহন ও মেডিকেল ছাত্র শফিকুর রহমান। মাঝপথে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন আরও দু-একজন। আর সহপাঠী সিরাজুল হকের আমার কাছে প্রদত্ত লিখিত তথ্যমতে তিনি ২০ নম্বর ব্যারাকের সামনে গুলিবিদ্ধ জব্বারকে নিয়ে গিয়েছিলেন ইমার্জেন্সিতে। আবুল বরকত সম্বন্ধে আমাদের প্রদত্ত তথ্য আরও একাধিক নির্ভরযােগ্য রচনায় উল্লিখিত রয়েছে। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই বইটিতে সন্নিবিষ্ট ভুল তথ্যের সংশােধন দরকার। বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম অধ্যাপক দেলােয়ার হােসেনের সঙ্গে।
এবার পূর্ব প্রসঙ্গে। তৎকালীন মাদারীপুরের কৃতী সন্তান, মেডিকেল কলেজছাত্র ইউনিয়নের ভিপি গােলাম মাওলা (এমএসসি) একুশের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন যেমন ২০ ও ২১ তারিখে, তেমনি ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে।
প্রদেশের অন্যান্য শহর ও গ্রামগঞ্জের শিক্ষায়তনগুলােতে ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিবাদী আন্দোলনে যে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, মাদারীপুরের স্কুল-কলেজের ছাত্ররা তার ব্যতিক্রম নন। প্রশাসনের হুমকির মুখে এখানে যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আবুল ফজল, নুরুল হকের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ছিলেন মতিয়ার রহমান, আবদুল মান্নান প্রমুখ। তাদের ত্যাগ ও শ্রমে মাদারীপুরে ভাষা আন্দোলনের সফলতা।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক