ভাষা আন্দোলনে বরিশাল
দুই বিপরীত চেতনার মধ্যেও ভাষা আন্দোলন
সাগরসংলগ্ন জেলা বরিশাল ঐতিহ্যবাহী স্বাধীনতাসংগ্রামে ছিল গভীরভাবে জড়িত। স্বদেশি আন্দোলনখ্যাত বরিশালের অধিকতর পরিচিতি অশ্বিনীকুমার দত্ত, ফজলুল হক, জীবনানন্দর দেশ হিসেবে। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন এবং প্রজা আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার বরিশাল বাম আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবেও সুনামখ্যাত। বরিশালের নারীসমাজও রাজনৈতিক সচেতনতা ও কর্মকাণ্ডে ইতিহাস রচনা করেছে। মনােরমা মাসিমা, নিকুন্তলা সেন বা ড. ফুলরেণু গুহ প্রমুখ বাম রাজনৈতিক নেত্রী তাঁদের ত্যাগ ও শ্রমে সর্বজনশ্রদ্ধেয়।
এমন একটি রাজনৈতিক জেলা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবে এমনটিই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে বরিশালের স্বনামখ্যাত বিএম (ব্রজমােহন) কলেজের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। সক্রিয় ছিল স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউট। তবে এটাও ঠিক ১৯৪৮-৫০ সাল পর্যায়ে এ শহরে একদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অন্যদিকে বাংলা রাষ্ট্র ভাষাবিরােধীরাও ছিল সক্রিয়। তা সত্ত্বেও ১৯৪৮-এর সীমিত পরিসরের আন্দোলন বরিশাল শহরকে স্পর্শ করে গেছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) গণপরিষদের বাংলাবিরােধী ভূমিকার প্রতিক্রিয়ায় বরিশালে মুসলিম ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ভাষাবিষয়ক এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। অন্যদিকে বিএম কলেজের ছাত্ররা আলাদা একটি প্রতিবাদ সভায় সমবেত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে।
এরপর ১১ মার্চ বরিশাল ঘােষিত কর্মসূচি পালনে তৎপর হয়ে ওঠে। উদ্যোক্তা স্কুল-কলেজের ছাত্রনেতারা।
বরিশালের সমাজসংস্কার ও প্রতিবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্য সত্ত্বেও এর বিপরীত দিকে ছিল সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতা, রক্ষণশীলতা, এমনকি সাম্প্রদায়িক চেতনা। তাই ১৯৪৮-এ পাকিস্তানি চেতনার প্রভাব ছিল প্রকট। প্রতিবাদীদের পক্ষে সভা-সমাবেশের জন্য স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। তবু হাল ছাড়েনি ছাত্ররা।
শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রনেতা কাজী বাহাউদ্দিন আহমদ। বক্তা ইতিপূর্বে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক শামসুল হক চৌধুরী, আবদুল লতিফ, আশরাফ আলী খান, হাসান ইমাম চৌধুরী, মােখলেসুর রহমান প্রমুখ। এ পর্বে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন। করেন কাজী বাহাউদ্দিন আহমদ।
পূর্ববঙ্গে তখনাে সরকারবিরােধী শক্তিমান রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠেনি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে একমাত্র শক্তি স্কুল-কলেজের ছাত্র ও যুবসমাজ। এ পর্যায়ে তাদের মধ্যে কোথাও কোথাও ছিল বিভাজন। ছাত্রসমাজের একাংশ সরকার সমর্থক। তাই সরকারের পক্ষে সহজ হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটিয়ে সমাজকে ভিন্ন পথে চালিত করা।
দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহরে ঘটে কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এর। বীভৎস রূপ প্রকাশ পায় ঢাকাসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব প্রভৃতি স্থানে।
বরিশালেও ঘটে এ দাঙ্গার কুৎসিত প্রকাশ। বাহাউদ্দিন প্রমুখ ছাত্রদের দাঙ্গা দমনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ হত্যাকাণ্ডে পুলিশ যে নিষ্ক্রিয় থাকে এ তথ্য সর্বজনস্বীকৃত। ভাষাসংগ্রামী এম আর আখতার মুকুল কথাটি সর্বদাই উল্লেখ করেছেন তার আলাপচারিতায়। সূত্র তার পুলিশ অফিসার পিতা সাদত আলী আখন্দ।
প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গে তার মানবতাবিরােধী অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি ১৯৫২-এর ব্যাপকভিত্তিক ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রভাবে। ১৯৫৪ এর নির্বাচনে এ দলের মূল শিকড় কাটা পড়ে। কিন্তু সমাজ বদল না ঘটায় কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নামের অপশক্তি পূর্বঙ্গে বিভিন্ন সময়ে অঘটন ঘটাতে পেরেছে।
দাঙ্গা-উপদ্রুত বরিশালের সামাজিক অঙ্গনে পাকিস্তানি চেতনার প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব কমে আসে প্রবর্তী সময়ে প্রাক্-একুশে পর্বে। তাই বরিশালে ভাষা আন্দোলন সুসংগঠিত রূপ ধারণ করে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির ঘােষিত কর্মসূচি উপলক্ষে। তাতে জ্বালানি যােগ করে ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা। বরিশালে একুশের আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রাখে বিএম কলেজ এবং এ কে ইনস্টিটিউট স্কুলের ছাত্ররা। তবে অন্য ছাত্রদের অংশগ্রহণও গুরুত্বহীন ছিল না।
২১ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী বরিশালে সর্বাত্মক ছাত্রধর্মঘট, সাধারণ হরতাল এবং ছাত্রদের মিছিল ও স্লোগানে মুখর ও তৎপর হয়ে ওঠে গোটা শহর। ইতিপূর্বে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বিশেষ ভূমিকা রাখে এ আন্দোলনের নেতৃত্বে। এর সভাপতি আওয়ামী মুসলিম লীগের আবদুল মালেক খান এবং আহ্বায়ক তৎকালীন যুবলীগের আবুল হাশেম। এদের সঙ্গে কর্মতৎপর ছিলেন বরিশাল যুবলীগের সভাপতি আলী আশরাফ (পরবর্তী সময়ে স্বনামখ্যাত সাংবাদিক)।
পাশাপাশি বিএম কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্র আন্দোলন পরিচালনায় জন্য স্বতন্ত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে কলেজ ইউনিয়ন ভিপি সৈয়দ গােলাম কিবরিয়াকে আহ্বায়ক মনােনীত করে। সদস্য নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা।
ঢাকায় পুলিশের গুলির খবরে ছাত্রসমাজে প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয়। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বরিশাল এ কে স্কুলের প্রায় ৫০০ ছাত্র মিছিল করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এতে নেতৃত্ব দেন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র এ কে এম আজহারউদ্দিন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নবম শ্রেণির আরেক ছাত্রনেতা আবদুল বারেক খলিফা এবং মীর আশ্রাফ উদ্দিন প্রমুখ। এরা একুশের আন্দোলন সফল করে তােলেন।
বিক্ষুদ্ধ শহরে ঢাকার শহীদদের উদ্দেশে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের শােকসভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্বোক্ত ছাত্রনেতা আজাহার উদ্দিন আহমদ।
পরদিন অশ্বিনীকুমার টাউন হলের সামনে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার উপস্থিতি। দ্রুত চারদিকে ছাত্র হত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ছাত্র-ছাত্রী, নারী-পুরুষ মিলে বিশাল এক সমাবেশ। আশপাশের গ্রাম এলাকার মানুষও এই প্রতিবাদী সমাবেশে যােগ দেয়। শহরের মহিলা সংগঠনের নেত্রীদের উদ্যোগে বহুসংখ্যক মহিলা মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণের মাধ্যমে প্রতিবাদে অংশ নেন। মূল নেতৃত্বে মিসেস হামিদুদ্দিন। অন্যান্যের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হােসনে আরা নীরু, মঞ্জুশ্রী, রানী ভট্টাচার্য, মাহে নূর বেগম প্রমূখ।
এই আন্দোলন পরবর্তী দিনগুলােতে আরও সংগ্রামী রূপ ধারণ করে। এ কে স্কুল মাঠে, পূর্বোক্ত টাউন হলে একের পর এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। সেই সঙ্গে মিছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না ‘, ‘নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ চাই’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত শহর। এ যেন এক নতুন চেহারার শহর। এ আন্দোলনে যােগ দেন শহরের গণতন্ত্রী ও প্রগতিশীল সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির মানুষ, বিশেষত আইনজীবীরা।
২৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও বিশিষ্ট নাগরিকদের চেষ্টায় টাউন হলের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এ কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখেন আবুল হাশেম, জাহিদ হােসেন, মােশারেফ হােসেন, আলী আশরাফ প্রমুখ। শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন আবুল হাসেম। পুলিশ বাহিনী ২৭-এ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। অবশ্য ১৯৭৩ সালে সরকারি উদ্যোগে স্থায়ী শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
অন্যান্য জেলা শহরের মতাে বরিশালেরও মহকুমাসহ দূর প্রান্তিক অঞ্চলে একুশের ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এর বিস্তার গ্রাম অবধি। দৈনিক আজাদ-এর সংবাদসূত্রে দেখা যায় পিরােজপুর, স্বরূপকাঠি, সুফলকাঠি, নাজিরপুর, বদরটুলী, মেহাঙ্গল প্রভৃতি এলাকায় আন্দোলন সংগঠিত রূপে দেখা দেয়।
উল্লেখযােগ্য যে বরিশাল শহরের বাইরে অন্যত্র সব আন্দোলনই ছিল শিক্ষায়তনভিত্তিক, অর্থাৎ স্কুল-কলেজের ছাত্ররা এ আন্দোলন গড়ে তোলেন। অন্য সূত্রে দেখা যায় বানারীপাড়া, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি প্রভৃতি এলাকায় একই রকম আবেগে ভাষা আন্দোলন প্রকাশ পেয়েছে। বানারীপাড়ায় আন্দোলন সংগঠিত করেন প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আবদু শহীদ, অতুল ভট্টাচার্য। এ ছাড়া চাখার কলেজ, নারায়ণপুর হাইস্কুলের পাশাপাশি দূর এলাকার স্কুলগুলােও ছিল আন্দোলনের কেন্দ্র।
২০১০ সালে একুশে চেতনা পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভাষাসংগ্রামী সম্মেলনে উপস্থিত বায়ান্নর ছাত্রনেতা প্রবীণ আজহার উদ্দিন বলেন যে তাঁদের দাবি ছিল সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন, যা বাস্তবায়িত না হওয়ায় একুশের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক