ভাষা আন্দোলনে যশাের
১৯৪৮-এ তার সর্বোত্তম ভূমিকা
যশোর (যশােহর) দক্ষিণবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা বিশেষত রাজনৈতিক আন্দোলনের বিচারে। এর সদর মহকুমা শহর যশােরের একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাজনীতির নানা মতাদর্শ বিচারে, বিশেষ করে বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে। তবে অবিভক্ত বঙ্গের যশােরে জাতীয় কংগ্রেসি রাজনীতিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুসলিম লীগেরও বিশেষ ভূমিকা। পাশাপাশি বিভাগ-পূর্ব সময়ে এবং অব্যবহিত পরের কিছু সময় পর্বে দ্বিতীয় সারির রাজনৈতিক দল হিসেবে উল্লেখযােগ্য ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ফরােয়ার্ড ব্লক ও অনুরূপ চরিত্রের দু-একটি সংগঠন।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে সংগঠিত চরিত্রের আন্দোলন যদিও ১৯৪৮-এর মার্চ থেকে, বিষয়টি নিয়ে লিখিত পর্যায়ে বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগে থেকে। মূল কারণ মুসলিম লীগের কোনাে কোনাে শীর্ষ নেতার অগ্রিম দাবি-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে শুধুই উর্দু। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিগত প্রতিবাদ নিবন্ধ বা বিবৃতির মাধ্যমে।
এ বিষয়ে বহুল উল্লেখিত প্রতিবাদী লেখকদের মধ্যে ছিলেন আবদুল হক, মাহবুব জামাল জাহেদী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড, কাজী মােতাহার হােসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক আবুল কাসেম, আবুল মনসুর আহমদসহ আরও বিশিষ্টজন। এসব স্বনামখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে ১৯৪৭-৪৮-এ যুক্ত হয় যশােরের দুই ছাত্রী ও ছাত্রের নাম। এঁরা হলেন যথাক্রমে হামিদা রহমান ও আফসার আহমদ। সিদ্দিকী। ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্বের ইতিহাসে এ দুটো নাম কম উল্লেখিত। এঁরা দুজনই তখন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের যশাের শাখার কর্মী। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এই দুই প্রতিবাদী কর্মীর চিঠির প্রথমটি ছাপা হয় জুলাই মাসে (১৯৪৭)। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র কলকাতার স্বাধীনতা পত্রিকায়, দ্বিতীয়টি ছাপা হয় ১৯৪৮-এর জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক মিল্লাত-এ। অবশ্য ১৯৯৩-এর ফেব্রুয়ারিতে ভােরের কাগজ-এ সাংবাদিক ফখরে আলম তার প্রতিবেদনে লেখেন যে আফসার সিদ্দিকীর চিঠিটি একই সঙ্গে দৈনিক ইত্তেহাদ-এর চিঠিপত্র বিভাগেও ছাপা হয়েছিল।
কিছুটা ব্যতিক্রমী ধারায় যশােরে ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন ছিল ব্যাপক, তীব্র ও রাজনৈতিক চরিত্রসম্পন্ন। কারণ আর কিছু নয়, এ সময়ের আন্দোলনে তৎকালীন শক্তিমান বাম রাজনীতির অপেক্ষাকত গভীব প্রভাব। হতে পারে নেপথ্যে ছিল ১৯৪৮-এর কমিউনিস্ট পার্টির উগ্ররাজনৈতিক নীতি ও রণকৌশলের পরােক্ষ প্রভাব।
১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ব্যবহারিক বাংলাবিষয়ক প্রস্তাব নাকচ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় যে প্রতিবাদী তৎপরতা শুরু হয়, সেই ধারায় একইভাবে যশােরেও ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় এম এম কলেজের এক লেকচার হলে। সভার চরিত্রটি ছিল সর্বদলীয়।
গুরুত্বপূর্ণ এ সভায় রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন ছাত্র ফেডারেশনের সুধীর রায়, হামিদা রহমান ও রণজিৎ মিত্র এবং ছাত্রলীগের পক্ষে আলমগীর সিদ্দিক ও সেয়দ আফজল হােসেন। এখানে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ৷ এর যুগ্ন আহ্বায়ক আলমগীর সিদ্দিকী ও রণজিৎ মিত্র। গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হামিদা রহমান, সুধীর রায়, দেবীপদ চট্টোপাধ্যায়, আফসার সিদ্দিকী, সৈয়দ আফজল হােসেন, হায়দুল্লাহ প্রমূখ (আকসাদুল আলম)।
উল্লেখ্য যে যশােরের ভাষা আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা ছাত্র-যুবাদের। এ পর্বে রাজনৈতিক নেতাদের ছিল পরােক্ষ সমর্থন। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের সর্বদলীয় ব্যাপক ভিত্তি নিশ্চিত করতে শহরের প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে ডা. জীবন রতন ধর ও আইনজীবী মশিউর রহমানকে সংগ্রাম পরিষদে যুক্ত করা হয়।
১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করার প্রক্রিয়ায় সূচনালগ্নে ২ মার্চ কলেজে ছাত্র ধর্মট পালিত হয়। শুরু হয় নানামাত্রিক প্রচার মিছিল, স্লোগান, সভা, পোস্টড় সাঁটা ইত্যাদি। পােস্টার, বলা বাহুল্য, হাতে লেখা, যার যার নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি কালিতে। ঢাকায়ও তখন সব পােস্টার অভিজ্ঞদের হাতে লেখা-হল-হােস্টেলের মেঝেতে বসে, বাদ যায়নি মেডিকেল ব্যারাক। তবে এ ব্যাপারে তৎকালীন আর্ট স্কুলের ছাত্রবন্ধুদের ছিল সর্বাধিক ভূমিকা। যেমন ইমদাদ, আমিনুল, বশীর প্রমুখ।
একটি বাস্তব সত্য হলাে ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন ছিল সাংগঠনিক দিক থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক। অন্যান্য জেলা শহরের সঙ্গে পরিকল্পিত ও সিদ্ধান্ত ভিত্তিক যােগাযােগ সামান্যই হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত ঢাকার বাইরে বিস্তার লাভ করেছে বিচ্ছিন্নভাবে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে- যেমন বরিশালে, তেমনি উত্তরবঙ্গের একাধিক শহরে, তেমনি যশোরে। কলকাতার ট্রেন যােগাযােগ যেখানে সহজ, সেখানে কলকাতার বাদপত্র খবরের উৎস, কখনাে খবর মিলেছে রেডিওতে ‘আকাশবাণী’ মারফত। তাই ঢাকার বাইরে আন্দোলন পুরােপুরি স্বনির্ভর, স্বতঃস্ফূর্ত। এখানে ১৯৫২-এর সঙ্গে অনেকটা তফাত।
ঢাকায় ঘােষিত ১১ মার্চের (১৯৪৮) আন্দোলনের সংবাদ ছাত্রনেতাদের সংগ্রামী চেতনায় জ্বালানি যােগ করে। ব্যাপকভাবে চলে ১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করার কার্যক্রম। পশ্চিমবঙ্গের সন্নিহিত প্রান্তিক জেলা বিধায় যশােরেও ছিল বিহারি মােহাজেরদের অবস্থান। রীতিমতাে গড়ে ওঠে বিহারিপাড়া। এরা বরাবর অন্ধ পাকিস্তান-ভক্ত এবং সেই যাত্রায় সরকারসমর্থক। তবে সরকারি অপকর্মে ব্যবহৃত হননি এমন ব্যতিক্রমী দুচারজনও ছিল। যেমন ছিল ঢাকা, সৈয়দপুর, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, রংপুর, তেমনি কুমিল্লাসহ পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ শহরে। বাদ ছিল না চট্টগ্রামও। এরা ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে সর্বাত্মক, শক্তিমান বিরােধিতা করেছে। ১৯৫২-এর ব্যাপকতায় তাদের বিরােধী ভূমিকা ছিল সীমাবদ্ধ। তবে একাত্তরে তারা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় বাঙালি নিধনে ব্যাপক ভূমিকা। পালন করেছে, বিশেষ করে তাদের তরুণ ও যুবক সমাজ। যশােরের বিহারি সমাজ ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করেছে।
তবে পারেনি ঢাকায়, বিশেষ করে ১৯৫২-তে। আরও একটি তথ্য এই ইতিহাসে উল্লেখিত হওয়ার মতাে গুরুত্বপূর্ণ যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যে বাঙালি মুসলমানের ছিল সর্বোচ্চ ভূমিকা, সেই বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত শ্রেণির পশ্চাৎপদ অবস্থানের কারণে, সেই সঙ্গে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতির বৈষম্যমূলক নীতির কারণে বাস্তব পরিসংখ্যানে দেখা যায় পূর্ববঙ্গের জেলা ও মহকুমাগুলােয় প্রশাসকদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি বিহার এবং উত্তর ভারত থেকে আসা। তাদের ছিল বাঙালিবিরোধী, বাংলা ভাষাবিরােধী ভূমিকা। অনেক কলেজের অধ্যক্ষ অবাঙালি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তেমনটাই প্রমাণ দেয়।
তাই ব্যতিক্রম নন যশােরের জেলা প্রশাসক নােমানি। এরা আন্দোলন দমন করতে কয়েক পা এগিয়ে ছিলেন। তাই পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন যেখানে ভাষাসংগ্রাম কমিটির সঙ্গে সমঝােতায় এক পায়ে খাড়া (১৫ মার্চ), সেখানে ১০ মার্চ যশােরে নােমানির ১৪৪ ধারা জারি, যাতে ১১ মার্চের কর্মসূচি সফল না হয়। অবশ্য ১১ মার্চ ঢাকায়ও পিকেটারদের ওপর চলেছে হামলা, গ্রেপ্তার; পরে মুক্তি (১৫ মার্চ)।
যশােরের ভাষাসংগ্রামী নেতাদের সিদ্ধান্ত ছিল যেকোনাে মূল্যে ১৪৪ ধারা ভেঙে ১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করা। কিন্তু সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ছিল ভিন্নমত। তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না। (তুলনীয় ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা)।
১১ মার্চ। সকাল থেকে যশােরের পথে পথে খণ্ড খণ্ড প্রতিবাদী মিছিলস্লোগান- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি। বেলা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যশাের হয়ে ওঠে মিছিলের শহর। ছাত্রদের সঙ্গে যােগ দেন বিভিন্ন স্তরের শহরবাসী মানুষ। মিছিল আর স্লোগান। ইতিপূর্বে যে মশিউর রহমান সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে জোরালাে মত প্রকাশ করেছিলেন, তিনিই এখন অবস্থাদৃষ্টে মিছিলে শামিল।
শুধু তা-ই নয়, মিছিল চলার একপর্যায়ে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি সভাপতিত্বও করেন। জমে ওঠা সভা জনারণ্যে পরিণত হয়। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা করেন সংগ্রাম পরিষদের নেতা-নেত্রী। নিষ্ক্রিয় থাকেনি পুলিশ। তাদের হাতে গ্রেপ্তার হন আইনজীবী মশিউর রহমানসহ রণজিৎ মিত্র, আবদুর রকিব, সৈয়দ আফজল হােসেন, অনন্ত মিত্র, রবি সাহা, পবিত্র ধর, হাবিবুর রহমান, এস এম জিন্নাহ, লুৎফর রহমান, আবদুর রাহাত, গােলাম মর্তুজা প্রমুখ প্রায় ৫০ জন নেতা-কর্মী। (ফখরে আলম, ভােরের কাগজ)।
স্বভাবতই ঘােষিত হয় নতুন দাবির স্লোগান বন্দী মুক্তি নিয়ে। একই কারণে আন্দোলন আরও জোরদার হয়, মিছিলের আয়তন বাড়ে, শক্তি বাড়ে। অন্যদিকে পুলিশও বেপরােয়া হয়ে ওঠে। চলে বেধড়ক লাঠিচার্জ এবং গ্রেপ্তার। কিন্তু উদ্যম হারায় না ছাত্র-যুবসমাজ। তাদের সঙ্গে শহরবাসীর বড়সড় অংশ। মূলত তরুণ ও যুবক।
একদিকে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জের মাধ্যমে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে, শহরের অন্যদিকে নতুন মিছিলের জন্ম। অবস্থা আয়ত্তে আনতে পুলিশ একপর্যায়ে গুলি চালায়। তাতে আহত হন কেউ কেউ। আকসাদুল আলমের তথামতে আলমগীর সিদ্দিকীর পায়ে গুলি লাগে। মিছিলকারীরা ইটপাটকেল ছুড়ে পুলিশকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালায়। তাতে আহত হয় জনাকয় পুলিশ।
ক্ষিপ্ত পুলিশ ও প্রশাসন। তাদের দমননীতির মাত্রা বাড়ে। গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেড়ে কারও মতে তা শতাধিক হয়ে দাড়ায়। পুলিশি নির্যাতন থেকে যশোরের প্রতিবাদী ছাত্রীরাও রেহাই পায়নি। অবস্থাদৃষ্টে হরতাল ও প্রতিবাদের ঘােষণা পরদিন ১২ মার্চ থেকে। গােটা শহর এ পর্যায়ে অচল। জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে দোকানপাট বন্ধ, মিছিলের পদচারণে পথে পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ।
মােহাজেরদের বাংলাবিরােধী তৎপরতা যশােরে বিশেষ মাত্রা অর্জন করে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায়। এমন ঘটনা প্রদেশের একাধিক শহরে ঘটেছে। কিন্তু ছাত্র-জনতা যেখানে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয়, সেখানে বিহারি-পুলিশ-প্রশাসন সফল হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও চলেছে সুযােগ বুঝে বিহারিদের হামলা ও লুটপাট।
কিন্তু পিছু হটেনি সংগ্রামী ছাত্র-জনতা। হরতাল চলে আপাতত লাগাতার। ১৩ মার্চ আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল স্লোগানসহকারে সারাক্ষণ শহরের পথে পথে চলতে থাকে। বলতে হয় শহর তখন অবরুদ্ধ। সরকার ও মুসলিম লীগের গুন্ডাদের প্রতিরােধ করতে শহরের মহল্লায় মহল্লায় গঠিত হয় প্রতিরােধ কমিটি।
অন্যদিকে নােমানির প্রশাসনিক উগ্রতা ও পুলিশ বাহিনীর নির্যাতন ও স্বেচ্ছাচারের বিষয়টি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে বিরােধীদলীয় সদস্যদের মাধ্যমে উত্থাপিত হলে মুখ্যমন্ত্রী তদন্তের আশ্বাস দেন। যদিও অবাঙালি আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস তাঁর ছিল না। কাজেই তদন্ত কাগজে-কলমেই থেকে গেছে। আন্দোলন চলেছে ১৮ মার্চের পরও। যদিও ঢাকায় তখন আন্দোলন স্থগিত।
প্রকৃতপক্ষে যশােরে ১৯৪৮-এর মার্চের আন্দোলন সুসংহত হওয়া, ছাত্রজনতার মধ্যে দৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মূলে ছিল সুসংগঠিত ছাত্রনেতত্ব। এদিক থেকে তারা ১৯৪৮-এর ঢাকার আপসবাদী আন্দোলনের তুলনায় রাজনৈতিক চরিত্র বিচারে অনেক এগিয়ে ছিল। তবু ১৯৪৮-এর বৈশিষ্টামাফিক যশাের শহরের অসাধারণ একটি আন্দোলন জেলার অন্যত্র, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ততটা বিস্তার লাভ করেনি।
তুলনায় ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি তথা একুশের আন্দোলন যশােরে অপেক্ষাকৃত গতানুগতিক ধারায় চলেছে। তাই বলে একুশের আবেগ অনুপস্থিত ছিল না। ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছে ছাত্রধর্মঘট, হরতাল, সভা- সমাবেশ, মিছিল। যে মিছিল ছিল ছাত্র-জনতার ঐক্যে শক্তিমান। স্কুল- কলেজ, দোকানপাট, যানবাহন ছিল বন্ধ। এবারও স্থানীয় মধুসূদন কলেক এবং স্কুলগুলাে আন্দোলনের সক্রিয় উৎস। দীর্ঘ মিছিল শেষে টাউন হল প্রাঙ্গণে সভা, বক্তৃতা ও সরকারবিরােধী প্রস্তাব গ্রহণ। মূল দাবি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা, গুলিবর্ষণের তদন্ত এবং অপরাধীদের শাস্তি বিধান।
তবে একদিক থেকে একুশের (১৯৫২) আন্দোলন ১৯৪৮ সালের মার্চের তুলনায় বিশিষ্ট ও অগ্রগামী। এ আন্দোলন শুধু শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। একুশের চরিত্রমাফিক আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল শুধু মহকুমা শহরগুলােতেই নয়, দূর থানা ইউনিয়ন পর্যায়ে। এবং কোথাও তা ২১ ফেব্রুয়ারি থেকেই। দৈনিক আজাদ-এর কিছু কিছু সংবাদ পরিবেশনে তেমন প্রমাণ মেলে। মেলে সৈনিক-এর আবেগাশ্রয়ী সংবাদেও।
দূর আলফাডাঙ্গায় (নড়াইল মহকুমার প্রান্তিক এলাকা) ‘২১ ফেব্রুয়ারি আতিকুজ্জামান হাই স্কুলে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। অপরাহ্নে ছাত্রদের অনুষ্ঠিত সভায় বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানাইয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।’ (আজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
দৈনিক আজাদ-এর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, যশােরের মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালাে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং তা পাকিস্তান গণপরিষদে গ্রহণের জন্য সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানায়। এমনকি প্রস্তাব গৃহীত না হলে ‘পূর্ববঙ্গের সদস্যগণকে অবিলম্বে পদত্যাগ করার দাবীও জানানাে হয়।’ (আজাদ, ২ মার্চ ১৯৫২)।
প্রসঙ্গত, একটি বিষয় অনুধাবনের যে ১৯৪৮-এ তাে বটেই, এমনকি ১৯৫২ সালেও পূর্ববঙ্গের যাতায়াতব্যবস্থা ও বার্তা যােগাযােগব্যবস্থা ছিল শােচনীয়। সংবাদপত্রের সংখ্যাও হাতে গােনা। তাদের পক্ষে দূর অঞ্চলের গ্রাম থেকে ঘটনার বার্তা সংগ্রহ অসম্ভবই ছিল। তাই ভাষা আন্দোলনের সর্বাত্মক চরিত্র সংবাদপত্রে ওঠেনি। ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস সে কারণে অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যশাের জেলার মহকুমা শহর মাগুরায়। সংঘটিত আন্দোলনের ইতিহাস যেমন যথাযথভাবে উঠে আসেনি কোথাও, তেমনি দুর্গম মহকুমা শহর নড়াইলের মতাে দূর এলাকার আন্দোলনবিষয়ক বিবরণও।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক