You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে ফরিদপুর - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে ফরিদপুর
অদৃশ্য নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত জেলাব্যাপী আন্দোলন

পূর্ববঙ্গের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের আরেকটি রাজনীতিমনস্ক জেলা ফরিদপুর। ব্রিটিশ শাসনবিরােধী আন্দোলনে এবং কৃষক বিদ্রোহেও ফরিদপুরের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। শেষােক্ত ক্ষেত্রে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য হাজি শরীয়তউল্লাহ সূচিত ফরায়েজী আন্দোলন, যা একাধারে ব্রিটিশবিরােধী ও সামন্ত জমিদার গােষ্ঠীবিরােধী কৃষক আন্দোলন। এতে বিপুল সমর্থন ছিল নিম্নবর্গীয় মানুষের। পরবর্তী শতকে (২০ শতকে) ব্রিটিশবিরােধী বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র ফরিদপুর (মাদারীপুর)। ঐতিহাসিক নীল বিদ্রোহও কিছু মাত্রায় স্পর্শ করে গেছে ফরিদপুরকে। পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে বাম রাজনীতি।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্নে সূচিত ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন ফরিদপুর শহরের ছাত্রসমাজকে প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করে। এখানে ছাত্র আন্দোলনের প্রধান উৎস স্থানীয় রাজেন্দ্র কলেজ এবং স্কুলসমূহ। ১৯৪৮-এর মার্চে ঢাকায় সূচিত ভাষা আন্দোলনের প্রচার-প্রচারণা শুরু হয় ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে, ঘােষিত হয় আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ ১১ মার্চ। এ ঘােষণা প্রদেশের একাধিক শহরের মতাে ফরিদপুর জেলা শহরকেও উদ্বুদ্ধ করে।
স্থানীয় রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রনেতৃত্ব ১১ মার্চের আন্দোলন সফল করার প্রস্তুতি পর্বে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তৎপরতা চলে মিছিল ও পথসভার মাধ্যমে। এতে মূল নেতৃত্বে ছিলেন রাজেন্দ্র কলেজের জ্যেষ্ঠ ছাত্রনেতা সৈয়দ মাহবুব আলী। তার সঙ্গী সহযােদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুল মতিন, মোশাররফ আলী, আবদুল বারী, আবদুল হালিম, আদিল উদ্দিন হাওলাদার, লিয়াকত আলী, মােল্লা জালাল উদ্দিন প্রমুখ।
১১ মার্চ ফরিদপুরে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সফল ধর্মঘট পালিত হয়। বিক্ষোভ মিছিল বের হয় রাজেন্দ্র কলেজ থেকে সৈয়দ মাহবুব আলীসহ অন্য ছাত্রনেতাদের তৎপরতায়। মিছিল শহর প্রদক্ষিণকালে পুলিশ মিছিলে হামলা ও বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। ফলে বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা-কর্মী আহত হন। আহত নেতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য সৈয়দ মাহবুব আলী, মহিউদ্দিন আহমদ, ইমান উদ্দিন আহমদ, এজহারুল হক, সূর্য মিয়া প্রমুখ। এদেরসহ আরও অনেককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরবর্তীকালে অবশ্য ঢাকায় বসে সূর্য মিয়ার কাছে শুনেছি আন্দোলনের কথা।
পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের সংবাদে শহরবাসী ও অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন। তারাও ক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে পথে নামেন। ভাষা আন্দোলনে ফরিদপুর-এর লেখক মাে. রেজাউল করিম জানিয়েছেন, এ সময় ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন স্বনামখ্যাত আবদুল হালিম চৌধুরী (শিক্ষাবিদ কবীর চৌধুরীর পিতা)। তার সহানুভূতিশীল ভূমিকায় এবং শহরবাসীর ক্ষুব্ধ আন্দোলনের কারণে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেয় পুলিশ প্রশাসন।
উল্লেখযােগ্য যে রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষসহ একাধিক শিক্ষক ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। এমনকি শহরের আইনজীবীদের বড়সড় অংশও যেমন গােপনে বা প্রকাশ্যে, তেমনি পেশাজীবীদের একাংশও সমর্থন দিয়েছিলেন। কমরেড শান্তি সেনসহ স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতাদেরও ছিল আন্দোলনের প্রতি সুস্পষ্ট ও সক্রিয় সমর্থন। এ ছাড়া ছিল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিস।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫১। এ সময় পর্বে সুস্পষ্ট আন্দোলন তৈরি না হলেও ফরিদপুরের ছাত্ররা ১১ মার্চ যথারীতি পালন করেছে। ১৯৫২-তে পৌছে স্বভাবতই ছাত্রনেতৃত্বের পরিবর্তন। এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মনােয়ার হােসেন, ইমামউদ্দিন আহমদ ও লিয়াকত হােসেন। এ পর্বে পূর্বোক্ত সূত্রমতে ইমামউদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও মুনাওয়ার হােসেনকে সহসভাপতি এবং লিয়াকত হােসেনকে সাধারণ সম্পাদক মনােনীত করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
পূর্বোক্ত রেজাউল লিখেছেন যে এ পর্বেও শান্তি সেনসহ স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতারা গােপনে আন্দোলনকারী নেতৃত্বকে নানাভাবে পরামর্শ ও সহায়তা করেছেন। তাঁর ভাষায়, কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্য নেতা-কর্মী ফরিদপুরের বিভিন্ন মহকুমা ও থানা পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এক অদৃশ্য নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ফরিদপুর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ত্বরিত গতিতে বৃহত্তর ফরিদপুরের সর্বত্র পৌছে যেত।’
ফরিদপুরে একুশের আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে পূর্বোক্ত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে। এ ক্ষেত্রে রাজেন্দ্র কলেজ ছিল আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র।
ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর ফরিদপুরে পৌছালে ছাত্র ও জনসমাজে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট, শিক্ষায়তন, যানবাহন, অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। ছাত্র-জনতার বিশাল এক মিছিলের পদচারণে শহর এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে। ঢাকার মতােই ফরিদপুরও হয়ে ওঠে মিছিলের শহর, বিশেষ করে ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রশাসনিক দপ্তরও প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
এ পর্যায়ে আন্দোলন ফরিদপুর শহর ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। মহকুমা শহরগুলাে নিজস্ব উদ্যোগে আন্দোলন সংঘটিত করে। কিন্তু সব মিলিয়ে আন্দোলন ছাত্র হত্যার প্রতিক্রিয়ায় সারা জেলায়, এমনকি প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এবং তা প্রধানত শিক্ষায়তনগুলােকে কেন্দ্র করে। স্কুলছাত্রদের এমন সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা এর আগে কখনাে দেখা যায়নি।
দৈনিক আজাদ-এ এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কয়েকটি উদ্ধৃতিই গােটা পরিস্থিতি বুঝে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি ইদিতপুরে ‘সকাল ৮ ঘটিকায় ছাত্রদের এক বিরাট শােভাযাত্রা বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করিয়া স্থানীয় ফুটবল মাঠে এক সভায় মিলিত হয়। মাে. হােসেন আলী মিয়া সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবরে দূর ফরিদপুরের চর যাত্রায় ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্ররাও ক্লাস বর্জন করে এক শােক মিছিল বের করে ‘চার মাইল পথ প্রদক্ষিণ করে।’ বিকেলে হেডমাস্টার সাহেবের সভাপতিত্বে ছাত্রসভা। (আজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
একই কারণে ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘মােমসিংহ হাইস্কুলের ছাত্রদের উদ্যোগে এক বিরাট সভা হয়। সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলাসহ সংশ্লিষ্ট দাবিদাওয়া নিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। (আজাদ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
একই দিনে ‘কনেশ্বর হাইস্কুলের ছাত্রগণ ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলী চালনার প্রতিবাদে হরতাল পালন করে। বেলা ১২টায় জনাব আবদুল বাকিমের সভাপতিত্বে তাহারা এক বিরাট সভায় যােগদান করে। (আজাদ, ৩ মার্চ ১৯৫২)। সভায় ভাষার দাবি ও গুলিবর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবাদি গৃহীত হয়।
বিস্ময়কর, একুশের আন্দোলন ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের মতাে দুরপ্রান্তিক এলাকার স্কুলছাত্রদের মধ্যেও প্রতিবাদী তৎপরতা সৃষ্টি করে। অনুষ্ঠিত হয় বিশাল প্রতিবাদ সভা। সে ক্ষেত্রে রাজবাড়ীর মতাে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যে আন্দোলন তৈরি হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক