১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খুনি চক্র
প্রথম ছবি মুস্তাক অনুগত্তদের মিছিল। ২য় ছবি রেডিও ভবনে মুস্তাকের রেডিও ভাষণের পূর্বে উল্লসিত ওসমানী দায়িত্ব প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার সাথে কথা বলছেন। পাশে জিয়া ও খলিলুর রহমান।
15 august
জন্ডিসে আক্রান্ত হবার পর থেকেই শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছিল রাসেলের, তবে দিন দুয়েক আগে বাবা বলেছিলেন নিচের বাগানে ইমরান আর আদিলের সাথে সাইকেল নিয়ে খেলতে দেবেন। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নই দেখছিল রাসেল। হঠাত কার ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিছু বুঝে উঠার আগেই মা তাকে টেনে উঠিয়ে পাশের বাথরুমে নিয়ে গেল, আর বলল ‘মাথা নিচু করে বসে থাকো’। ঘুমের ঘোর কেটে যাওয়ার এতক্ষণে রাসেল বুঝতে পারলো যে চারিদিকে খুব হইচই হচ্ছে, গোলাগুলি চলছে, কারা যেন বুট পায়ে দৌড়াদৌড়ি করছে!
মার কথা শুনে হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে রাসেল। বুঝতে পারছে ভয়ানক কিছু হচ্ছে আজ রাতে, কিন্তু কি হচ্ছে সেটা তার ছোট্ট মনে কিছুতেই ধরছে না। বুকটা ধুকপুক করছে অনেক জোরে, কিন্তু অজানা ভয়ে চোখ বুজে আসছে বারবার।
একটু পর গোলাগুলি বন্ধ হল। রাসেল ওভাবে বসে থেকেই কান পেতে শুনছে। শুনতে পেল বুটের আওয়াজ সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠেছে। এক পশলা গুলির শব্দে আবারো কান ঢেকে ফেলল রাসেল। এবারে গুলির শব্দ খুব কাছ থেকে এলো। গুলির শব্দ বন্ধ হল আবার। এবার রাসেল শুনতে পেল বাবার ভারী গলার শব্দ ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’
এরপর কিছুক্ষণ তর্কবিতর্ক চলল, কি নিয়ে তা বুঝলো না ছোট্ট রাসেল। ততক্ষণে সে তার ভাবীদের গলার আওয়াজও পাচ্ছে আশেপাশে। তারপর হঠাত করেই আবার অনেকগুলো গুলির শব্দ। কুঁকড়ে আর ছোট হয়ে মিশে যেতে চাইছে রাসেল। হঠাত করেই বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো মা আর রোজী ভাবী আর নতুন সুলতানা ভাবী। সবার পেছনে এই বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল নাসের চাচা আর রমা। মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাসেল। মা তাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছিলেন, রাসেলের একটা কথারও উত্তর দিচ্ছিলেন না। সবাইই কাঁদছিল ভয়ে।
দুই মিনিট পরেই বেডরুমের সামনের দরজায় লাথির আওয়াজ শোনা গেল, সেই সাথে গুলি। নাসের চাচা বললেন, ‘দরজা না খুললে ওরা গুলি করেই মেরে ফেলবে’। মা তখন গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘দরজা খুলছি, আপনারা কাউকে মারবেন না’। মা সবাইকে নিয়ে বের হয়ে দরজা খুলে দিলেন, প্রায় লাফ দিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল কালো পোশাক পড়া কয়েকজন সৈনিক। ওরা নাসের চাচা আর রমাকে একদিকে দাঁড় করালো, তারপর রাসেলকে হাত ধরে টেনে বলল, ‘নীচে চল’। রাসেলের মা কেও ওরা বলল ‘আপনিও নীচে চলুন’।
ঘর থেকে বের হয়েই রাসেল দেখতে পেল সামনের সিঁড়ির মাঝখানে বাবা পড়ে আছেন, রক্তে ভেসে যাচ্ছে সিঁড়ি। চোখ বুজে ফেলল ছোট্ট রাসেল। শুনতে পেল মা চিৎকার করে বলছেন ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’ সিঁড়ি দিয়ে রাসেলকে টেনে হিঁচড়ে নামাচ্ছিল সৈনিকটা। মাঝ সিঁড়িতে এসে বাবার দিকে আবার চোখ পড়ল আবার, পারলো না তাকিয়ে থাকতে রাসেল, চোখ বন্ধ করে ফেলল আবার। বাবার রক্তে পিচ্ছিল হয়ে আছে সিঁড়ি, সৈনিকটা টেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলেই আছাড়টা খেল না রাসেল।
নীচে এনে রাসেল সহ সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করানো হল। ছোট্ট রাসেল ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। উপর থেকে আবারো ভেসে এলো গুলির শব্দ আর মেয়েদের আর্তচিৎকার। রাসেল ততক্ষণে বুঝে গেছে কি হচ্ছে উপরে। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে সে পাশে দাঁড়ানো মহিতুল ভাইয়ার জামা খামছে ধরে জিজ্ঞাসা করে ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ মহিতুল সাহস দেয়, “না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।”
নাসের চাচাকে রাসেলের চোখের সামনেই পাশের বাথরুমে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলল ওরা। প্রতিটা গুলির সাথে সাথে কুঁকড়ে যেতে থাকে রাসেল। রাসেলের মনে হতে থাকে , এই সময়ে মাকে জড়িয়ে ধরলে হয়তো একটু ভাল লাগত; ‘আমাকে মার কাছে দিয়ে আসো, আমি মার কাছে যাব’ বলে রাসেল। একথা শুনে একজন সৈনিক আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বলল ‘যাও, ওকে মার কাছে দিয়ে এসো’। একজন সৈনিক ওকে হ্যাঁচকা টানে মহিতুলের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে যেতে থাকে। এবার আর চোখ বুঝে থাকে না রাসেল, উপরে যেতে যেতে অপলক তাকিয়ে থাকে মাঝ সিঁড়িতে পড়ে থাকা বাবার মৃতদেহর দিকে। সিঁড়ির উপরে উঠেই দেখতে পায় সামনেই পড়ে আছে মার মৃতদেহ। এবার রাসেল ডুকরে কেঁদে উঠে, কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে ‘আমি হাসু বুবুর কাছে যাবো।’
সৈনিকটা একটা ধাক্কা দিয়ে রাসেলকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বিকৃত স্বরে বলে ‘যাও, মার কাছে যাও।’
ধাক্কা খেয়ে মার মৃতদেহ পেরিয়ে দুই ভাবীর মৃতদেহের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে রাসেল। সেখান থেকেই দেখতে পায় অস্ত্র তুলছে সেই সৈনিকটা। সাথে সাথেই রাসেল বুঝে যায়, আর হবে না আদিল আর ইমরানের সাথে সাইকেল নিয়ে খেলা, পোষা কবুতরগুলোকে খাবার দেয়াও আর হবে না, হবে না দেখা হাসু বুবুর সাথেও।
চোখ বুজে অনন্তের অপেক্ষায় থাকে ছোট্ট রাসেল।
এক ঝাঁক গুলির শব্দ।
নীচে এক সৈনিক আরেকজনকে রিপোর্ট করে “অল আর ফিনিশড।’
নিভে গেল পৃথিবী থেকে আরেকটি নক্ষত্রের আলো।