সীমান্তের ওপারে
(বাঙলাদেশ সফররত স্টাফ রিপাের্টার)
পর এখন খুলনা কিছুটা চুপচাপ আছে। তবে যেকোন সময়ে প্রবল আক্রমণের আশঙ্কা। খুলনা শহর থেকে মৃত শিশু এবং বয়স্ক মহিলাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত জায়গায় গােপনে গেরিলা লড়াই ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। এই ট্রেনিং-এ আছেন সবাই, ন্যাপের উভয় গ্রুপ, আওয়ামী লীগ, ‘নকশালপন্থী’ এমনকি মুসলিম লীগ পর্যন্ত, সকলেই একসঙ্গে। ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনী স্থল পথে ব্যর্থ হয়ে এখন জলপথে হামলার চেষ্টা করছে। নদীর মধ্যে স্টীমার এবং জাহাজ থেকে মর্টার দাগছে। এই গুলিকে ধ্বংসের জন্য মুক্তি বাহিনীর হাতে কামান নেই এবং কামান দাগার প্রয়ােজনীয় সামগ্রী নেই বলেই মনে হয়। তবে ন্যাপের জনৈক নেতা এবং ইপিআর-এর জনৈক অফিসার জানালেন যে দু একদিনের মধ্যেই তারা এগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
ই,পি,আর’ এর ভূমিকা
বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরলেই ই,পি,আর এবং পুলিশের ভূমিকা চোখে পড়ে। এরা মুক্তি যুদ্ধে পাগল হয়ে নেমেছেন।
ই,পি,আর-এর জনৈক অফিসার এবং খুলনার একটি মহকুমা শহরের দারােগা সাহেবের সঙ্গে খুলনার একটি গ্রামে দেখা, তার সঙ্গী আওয়ামী লীগের জনৈক কর্মী। এরাই বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরছেন এবং গ্রামবাসীদের তাদের কর্তব্য এবং সংগঠন সম্পর্কে বুঝিয়ে বলছেন।
যে রাস্তাগুলি কাটা হয়েছিল, সেগুলি আবার ঠিক করলেন গ্রামের মানুষই ডাবও পাঠানাে হতে লাগলাে। এবং এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঐ গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলাে, সবুজ পতাকায় সােনালী গােল সূর্যের ওপর পূর্ববঙ্গের মানচিত্র লাঞ্ছিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ওঠান হলাে। আর নদীর পারে এক বিরাট আমগাছ তলায় সংগ্রাম পরিষদের অফিস স্থাপিত হলাে।
সীমান্তের কাছাকাছি আরেকটি গ্রাম দেখলাম। এখানে আনসার বাহিনী আছে। তাদের খাওয়ার গ্রামবাসীগণই সগ্রহ করছেন। রান্না করে খাওয়াচ্ছেন। আমি এ সময়ে সেখানে হাজির হয়েছিলাম। আমাকেও | জিজ্ঞাসা করলেন খেয়েছি কিনা ; আর একজন বললেন, আমাদের অস্ত্র সাহায্য করুন। আর কিছু চাই না।
আমার নানার সঙ্গে দেখা হলাে
এই গাঁয়ের রাস্তাতেই দেখা হলাে, এক বৃদ্ধের সঙ্গে। চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞাস করলেন, “ভাইসাব, আইছেন কেইথনে?” আমি নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি বলেন “তুমি আমার নাতির মতাে, তােমরে কই। আমার বয়স পাঁচকুড়ি হইতে আর চাইর বছর বাকী। আমার পাঁচ বিবি ছিল। পাঁচজনই গত হইছেন। আমিও মরুম শীগগীরই কিন্তু মরণের আগে ভালা কাম কইরা মরুম। স্বাধীনতার লাইগা লড়াই কইরা মরুম।” ভদ্রলােক খুলনায় যেতে চান। তাকে তখন বােঝানাে হলাে গ্রামেই থাকুন। আর গ্রামে থেকেই মুক্তি বাহিনীর জন্য কাজ করুন। এই বৃদ্ধের মনােভাবের মতই সমস্ত গ্রাম বাঙলার মনােভাব। সীমান্ত বরাবর একটি গ্রামের উলঙ্গ শিশু বলেছিল, ইয়াহিয়ার মৃত্যু চাই।
২ দিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা। বাঁশ পাতার ফাক দিয়ে হঠাৎ সে আমাকে বলল “আমারে একটু বন্দুক দাও, আমি গুরুম কইরা খানের মারুম” কি অসম্ভব ঘৃণা এই শিশুর চোখে।
ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম প্রসঙ্গে
ইয়াহিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই-এ শহরে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ এর উভয় দল, মুসলিম লীগ, ই,পি,আর কর্মকর্তা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের জন্য সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছেন। কিন্তু গ্রামগুলিতে এই সমস্ত দলের সমস্ত কর্মীরা এখনাে একসঙ্গে চলা রপ্ত করতে পারেন নি। তবে চেষ্টা করবেন বলে মনে হলাে। ভাসানীপুর ন্যাপের জনৈক নেতা একটি গ্রামে কথা প্রসঙ্গে গ্রামবাসীদের বলছিলেন মুজিবর সাহেব, ভাসানী সাহেবের কথা শুনে আরাে আগে স্বাধীনতা ঘােষণা করলে পারতেন। তিনি কথাটা আমাকেও বলেন। আমি উত্তর দিলাম “এটা আপনাদের ব্যাপার আমার কথা বলা উচিত নয়। তবে মুজিবর সাহেবের কর্মপদ্ধতির ফলে অন্ততপক্ষে আমরা গণতন্ত্রপ্রিয় ভারতবাসীগণ বুঝতে পেরেছি জনাব মুজিবর রহমান শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ মীমাংসাও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হস্তান্তরের জন্য চেষ্টা ক্ষমতা করেছেন।”
শ্রোতৃবর্গ গ্রামীণ মানুষ ঐ কর্মীকে বলেন, এখন লড়াই, আর এসব কথা কেন? আওয়ামী লীগের দু’একজন কর্মী তারাই কেল্লা ফতে করেছেন ভেবে নিজে নিজে চলার চেষ্টা করেন বলে মনে হলাে। কিন্তু ই, পি, আর কিংবা গ্রামের সাধারণ মানুষ কিন্তু এগুলিকে ধরেন না, তাঁরা সমস্ত দলগুলিকেই বর্তমানে ইয়াহিয়া সৈন্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী নেতা হিসাবেই ধরছেন— সকলের সামনেই শুধু একটি কথা স্বাধীন বাঙলা এবং চূড়ান্ত জয়।
জিনিসপত্রের অভাব
যুদ্ধকালীন অবস্থায় যা হয়, বর্তমানে বাঙলাদেশে তাই। দোকানে জিনিসপত্রের অভাব। আমি কয়েকটি দোকানে জিজ্ঞেস করলাম, কেরােসিন তেল থেকে শুরু করে সিগারেট পর্যন্ত কিছুই নেই। এবং সমস্ত কিছু বন্ধ থাকায় এগুলি পাওয়া যাচ্ছে না। ইয়াহিয়া সৈন্যরা খাবার এবং পানীয় পাচ্ছে না। স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র ইয়াহিয়া সৈন্যদের “ভাতে পানিতে মারার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাঙলাদেশের মানুষ তাই করছেন। কিন্তু মুক্তি বাহিনীর সৈন্যদের “ভাত আর পানির কোন অসুবিধা হবে না একথা কিন্তু হলফ করে বলা যায়।
চাই অস্ত্র, চাই ঔষধ
বাঙলাদেশের মুক্তি বাহিনীর কর্মী কিংবা সাধারণ মানুষ যার সঙ্গেই কথা হবে, তারাই কিন্তু একথা বলেছেন, চাই অস্ত্র, চাই ঔষধ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ কিংবা অন্যদলের সেচ্ছাসেবক সকলেই কিন্তু একথা বলবেন। ই,পি,আর নিজেদের বন্দুকের গুলি গুণে গুণে খরচ করছেন। এই যুদ্ধ বেশি দিন স্থায়ী হতে পারে তাই সমঝে খরচ।
৩১ শে মার্চ রাত্রে কমিউনিস্ট নেতা ডাঃ রণেন সেনের ভাষণ আকাশবাণীতে প্রচারিত হলাে। তার ভাষণের শেষে তিনি বলেছেন, “বাঙলাদেশের সরকারকে যাতে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেয় এবং অস্ত্রশস্ত্র যাতে পাঠানাে যায় এর জন্য চেষ্টা করা হবে। এই ভাষণ খুলনা জেলার একটি সীমান্তবর্তী গ্রামে বসে শুনছিলাম। সঙ্গী ছিলেন আওয়ামী লীগের জনৈক এম, এন, এ (আমাদের দেশের এম, পি বলতে যা বােঝায়)। ভাষণের পর তিনি হাত ধরে বলেন- “ভাই জান, জলদি জলদি করেন।”
সূত্র: কালান্তর, ৬.৪.১৯৭১