প্রসঙ্গক্রমে
অবিস্মরণীয় আত্মদান
স্বাধীন বাংলাদেশ এর অতুলনীয় মুক্তিসংগ্রাম সেখানকার মা-বােনদের অন্দরের অন্ধকার থেকে প্রকাশ্য রণাঙ্গনে টেনে এনেছে। বাঁচা নয় মেরে মরা— এই আদর্শে উদ্বেগ রমণীদের প্রতি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবেদন জানানাে হচ্ছে, আপনারা রামদা, দা, বটি, কুড়াল, খন্তা, এমন কি শুকনাে মরিচের গুঁড়াে যা দিয়ে সম্ভব হানাদার বদমায়েশদের প্রতিরােধ করুন।’ সন্তানের প্রতি মায়ের মমতা ও ভালােবাসাই আজ এই বীরাঙ্গণাদের শত্রু দমনে উদ্বুদ্ধ করেছে। এমনই পটভূমিতে সীমান্তের ওপার থেকে এমন একটি মহান আত্মদানের সংবাদ এসেছে যাতে বাঙলাদেশ-এর সমগ্র সংগ্রামী নারীকুলের প্রতি শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে যায়। ঢাকা মহিলা কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণির ছাত্রী রােশেনারা বেগম নিজের বুকে মাইন বেধে হানাদারদের একটি প্যাটন ট্যাঙ্কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং ট্যাংকটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। শঙ্কা ও মৃত্যুভয়ের উদ্ধে এই বালিকাটির জ্বলন্ত আত্মত্যাগের আগুন মুক্তিপাগল বাঙলাদেশ-এর লক্ষ লক্ষ প্রাণের বলিদানের অধ্যায়টিকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছে। রুশ, চীন ও ভিয়েতনাম নিজেদের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে শত্রু সৈন্যের সমরাস্ত্র ধ্বংস করার কাহিনী এখন কিংবদন্তী হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদেরই অন্তর্কলহ ও আত্মধ্বংসী রাজের প্রতিবেশী একটি দেশ মানবতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য এ হেন অভূতপূর্ব আত্মবলিদানের ঘটনা একটি তুলনাহীন নজির। একটি অসাধারণ দেশ প্রেমিকা কিশােরীর এমন শৌর্যের দৃষ্টান্ত আমাদের ভ্রান্ত স্বতিকে অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্যও লজ্জিত করুক।
সংহতি সাহায্য শক্তি চাই।
বাঙলাদেশে বাঙালীদের খুন ঝরছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, তরুণ, তরুণী কেউ বাদ যাচ্ছে না। পাঞ্জাবী নরঘাতকরা বাঙালীর রক্তপানে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিস্ট ও নাৎসী বর্বরতার কাহিনী বইয়ে পড়েছি, দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন নৃশংসতার কাহিনী পত্র পত্রিকায় দেখেছি ; কিন্তু সেই বর্বরতাকেও ম্লান করে দিয়েছে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের জল্লাদরা। এ অবস্থায় এ পারে বাঙালী চিত্ত ঘৃণা, ক্রোধ ও আবেগের উদ্বেলিত না হয়ে পারে না। তারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখা গেল বুধবারের সাবির্ক বন্ধে।
এতাে সূচনা। এবার এপারের বাঙালী সামজের ওপর গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত। বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। ওরা শুধু আমাদের প্রতিবেশী নয়, ওদের সঙ্গে আমাদের নাড়ীর টান, প্রাণের যােগ- আমরা একাত্ম। সুতরাং ওদের বিপদে আমাদের স্থির থাকা সম্ভব নয়। স্থির কেউ থাকছেও না। দলে দলে সীমান্তে চলে যাচ্ছে অনেকে ওদের অভিনন্দন জানাতে ও তাদের কথা জানতে। অনেকে যাচ্ছে সাহায্য সামগ্রী ওদের হাতে তুলে দিতে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ছেলের দল বেরিয়ে পড়েছে কৌটো হাতে অর্থ-সংগ্রহের জন্যে। বিভিন্ন সংস্থার তরফ থেকে ডাক দেয়া হয়েছে, রক্ত, অর্থ, বস্ত্র, খাদ্য ইত্যাদি দানের জন্যে। বাঙলার এপারের মানুষ আধপেটা খেয়ে, আধখানা কাপড় পরেও যে ওপারের মুক্তিসংগ্রামীদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে একথা আমরা জানি। সঙ্গে সঙ্গে একথাও আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে বন্যা ত্রাণের সাহায্যে ও মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যে পার্থক্য আছে। ধরতে গেলে বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যেকেই আজ মুক্তিযোেদ্ধা। ঘরে ঘরে প্রতিরােধের প্রস্তুতি। বালক, কিশাের, তরুণ তরুণী, প্রৌঢ়, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা সবাইকে আজ পাঞ্জাবী “বগীদের ঠেকাবার জন্যে, হঠাবার জন্যে সদা প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। এই জনযুদ্ধে সর্বাগ্রে কী কী সাহায্যের প্রয়ােজন তাই আমাদের জানতে হবে। রিলিফ নয়, প্রতিরােধ-শক্তি বাড়াবার জন্যে যেমন প্রয়ােজন রক্ত, ব্যাণ্ডেজ, ওষুধপত্র, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, রােগীর পথ্য, তবু ইত্যাদি তেমনি মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে দরকার শুল্ক খাদ্য (বিস্কুট, বাদাম, কৌটো দুধ প্রভৃতি) জুতাে, প্যান্ট, লৌহ শিরস্ত্রাণ, পরিখা খননের যন্ত্রপাতি ও এ ধরণের কিছু সামগ্রী।
কিন্তু এ সমস্তই নির্ভর করে সমবেত প্রয়াস ও সংগঠিত শক্তির ওপর। ভিয়েতনামে সাহায্য পাঠাবার সময়ও দেখা গিয়েছিল যে এখান থেকে সাহায্য হিসেবে সেখানকার মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে এমন কিছু সামগ্রী পাঠানাে হয়েছিল যেগুলাে বস্তুত তাদের কোনাে কাজে আসে নি। সুতরাং বাঙলাদেশের এই জরুরী অবস্থায়ও ওদের জরুরী প্রয়ােজনের দিকেই আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ সম্বন্ধে একটি সমন্বয় কমিটি গঠিত হলে তার মারফত ঠিক করা সহজ হবে কোন কোন সামগ্রী আগে ও কী পরিমাণ কোথায় তাড়াতাড়ি পাঠানাে দরকার। এভাবে সমন্বিত ও সংহত পন্থাই এপার থেকে ওপারের মানুষকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করা সম্ভব হবে।
সূত্র: কালান্তর, ২.৪.১৯৭১