হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ার সূচনা
প্রতিটি রণাঙ্গনে ইয়াহিয়া বাহিনী যত মার খাচ্ছে পরিষদের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন ততই শিথিল হচ্ছে। কিছুদিন আগে পাক-বাহিনীর মুখ্য অফিসারদের প্রেসিডেন্ট লেঃ জেনারেল পিরজাদার সঙ্গে ইয়াহিয়ার মতভেদের সংবাদ জানা ছিল। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হলাে পূর্ব রণাঙ্গনে পাক-গভর্ণরের সামরিক উপদেষ্টা লেঃ জেনারেল ফরমান আলির যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইয়হিয়াকে ডিঙ্গিয়ে জাতিসংঘের কাছে দরবার করার সংবাদ। এই ঘটনাটি অনেক দূর এগিয়ে ছিল। অর্থাৎ জাতিসংঘ বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল এমন কি এই মর্মে একটি দলিলও জাতিসংঘের কিছু সদস্যের কাছে প্রচার করাও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার হস্তক্ষেপ এই ঘটনা আর বেশি দূর এগােতে পারে নি। এক ফরমান আলি ব্যর্থ হলেও আর কোন ফরমানের যে আবির্ভাব হবে না সে রকম কোন নিশ্চিয়তা নেই। বরং সেই সম্ভাবনাই বেশি।
অস্ত্রের জোরে যারা শাসন কায়েম করে এবং তা বজায় রাখার চেষ্টা করে একটা প্রবল স্রোতের ধাক্কায় তাদের সমগ্র কাঠামোেটা তাসের মত ভেঙ্গে পড়ে। পাকিস্তানের সামরিক জুন্টা সেই ভবিষ্যৎ সম্মুখীন। এই প্রশ্নে ইতিহাসে হিটলার ও তার সাম্রাজ্য সর্বকালের সাক্ষী হয়ে আছে। যদিও হিটলার আর ইয়াহিয়ার মধ্যে একমাত্র সামরিক শক্তির দাপটে জনগণকে পায়ের তলায় রাখার প্রয়াস ছাড়া অন্য কোন মিল নেই।
বাঙলাদেশের প্রত্যেকটি যুদ্ধ ঘাঁটিতে বেশ কিছু পাকসৈন্য আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। অনেকে আত্মসমর্পনের লজ্জা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য পালাতে গিয়ে মার খেয়েছে। প্রতিটি রণক্ষেত্রে পরাজয় ছাড়া অন্য কোন সংবাদ পাক-বাহিনীর সমর দপ্তরে পৌঁছাচ্ছে না। এহেন পরিস্থিতি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। ফরমান আলি তারই একটি উদাহরণ।
ভারতের সেনাপতি অবরুদ্ধ পাকবাহিনীর উদ্দেশ্যে বার বার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বানও যে শত্রুকে বিচলিত করছে তা বলা বাহুল্য। বাঙলাদেশে যে পাকবাহিনী লড়ছে তার যদি দেশের জন্য লড়ত তবে প্রতিরােধের চেহারাও হত অন্যরকম, এই ইয়াহিয়া, পিরজাদা, ফরমান আলিদের জন্য লড়ছে। সেই পিরজাদা, ফরমানরা যখন নিজেরা বিভক্ত হয়ে পড়ে তখন ঐ ভাড়াটে সৈন্যদের শেষ মানসিক দৃঢ়তাও লুপ্ত হয়ে যায়। বাঙলাদেশে পাকবাহিনী এখন সেই অবস্থায় এসেছে। হঠাৎ কোন অচিন্তনীয় ঘটনা
ঘটলে এই বাহিনী এখনও যেটুকু প্রতিরােধ করছে তা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বেই। ফরমান আলির তারই সূচনা করেছে।
সূত্র: কালান্তর, ১৩.১২.১৯৭১