লিয়িনের জন্য নিয়াজির নতুন কৌশল
সপ্তম নৌবহরে আশায় অস্ত্রবিরতির আবেদন
নয়াদিল্লী, ১৫ ডিসেম্বর (ইউএনআই) বাঙলাদেশে দখলদার পাক সেনাবাহিনীর প্রধান লেঃ জেঃ নিয়াজি এবং “অসামরিক গভর্ণরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলি মার্কিন…
মানেকশ’র নিদেশ : আজ সকার ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণ চাই
দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ’র কাছে “যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করে এক বার্তা পাঠিয়েছেন। সরকারীভাবে এই সংবাদ জানানাে হয়েছে।
নিয়াজির এই বার্তা অবশ্য সরকারীভাবে প্রকাশ করা হয়নি, তবে কূটনৈতিক সূত্র থেকে লেঃ জেঃ নিয়াজির বার্তার যে সারমর্ম জানা গেছে, তদনুসারে মার্কিন নৌবহরে করে লেঃ জেঃ নিয়াজি তার সমস্ত সৈন্য নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবার সুযােগ চেয়ে এই যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করেছে।
বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকাও এই সংবাদ সমর্থন করেছে। বিবিসি বলেছে জেঃ নিয়াজি অস্ত্র সমর্পণ করতে চান না। তিনি চান জেনারেল মানেকশ’র পক্ষে গ্রহণযােগ্য কতকগুলি এলাকায় তার সৈন্যদের সমবেত করে রাখত যেখান থেকে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে যাবে।
ভারতের জেনারেল মানেকশ’ অবশ্য সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার জন্য নির্দেশ দিতে বলে জেঃ নিয়াজির কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন। ইতিমধ্যে নিয়াজির প্রস্তাবে “বিশ্বাস রেখে” আজ বিকাল ৫টা থেকে ঢাকার সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপরে বােমা বর্ষণ বন্ধ রাখা হয়েছে। আত্মসমর্পণের জন্য আগামীকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে পাকফৌজ আত্মসমর্পণ না করলে ভারতীয় বাহিনী আবার সর্বাত্মক অভিযান চালাবে বলে জেনারেল মানেকশ’ জানিয়েছেন।
আমাদের স্টাফ রিপোার জানাচ্ছেন
ইস্টার্ন কম্যাণ্ডের জনৈক মুখপাত্র আজ কলকাতায় জানান, ভারতীয় পদাতিক বাহিনী বিভিন্ন দিক দিয়ে ঢাকার দুই কিলােমিটারের মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে শহরের বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপরে আক্রমণ চালিয়েছে।
উত্তরে টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুর টুঙ্গি ছাড়িয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব-উত্তর দিকের আশুগঞ্জ থেকে মেঘনা পার হয়ে ভারতীয় বাহিনীর আরও একটি অংশ ঢাকার পূর্ব উপকণ্ঠে হাজির হয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। ঢাকার পূর্ব-দক্ষিণে মেঘনার পূর্ব তীরে যে ভারতীয় বাহিনী ছিল তারাও মেঘনা অতিক্রম করে দক্ষিণ দিক দিয়ে ঢাকার কাছে এগিয়ে গিয়েছে। আর ঢাকার পশ্চিমে যশাের জেলার মাগুরা থেকে ভারতীয় বাহিনীর আর একটি অংশ মধুমতী পার হয়েছে। তাদের পথও ফরিদপুর হয়ে ঢাকার দিকে। ঢাকা চারদিক দিয়ে পরিবেষ্টিত। ঢাকা এখন পদাতিক বাহিনীর ছােট কামান-মর্টার এর গােলার আওতার মধ্যে ৩০০০ গজের মধ্যে।
জানা গেল, পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট সম্পূর্ণ খালি করে শহরের অসামরিক এলাকা গুলিতে, অসামরিক ব্যক্তি, ছাত্রাবাস, হাসপাতালে ঘাঁটি গেড়েছে।
জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ইস্টার্ন কম্যাণ্ডের মুখপাত্র জানান, সৈন্যরা যে সব বাড়ীতে ঘাঁটি গেড়েছে সেই সব বাড়িকেই ভারতীয় বাহিনী সামরিক লক্ষ্যবস্তু বলে মনে করবে।
আরাে জানা গেল, ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণে, ইতিমধ্যেই বাঙলাদেশে দখলদার পাকফৌজের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির সদর দপ্তর বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে।
ভারতীয় বাহিনী গত কালই ঢাকার এলাকায় প্রবেশ করে।
খুলনা শহরে পাক প্রতিরােধ ভেঙে ভারতীয় বাহিনী শিরােমনি এলাকায় পাক বাহিনীর ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৫ জন সৈন্যের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে এবং প্রচুর চীনা রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ গােলাবারুদ দখল করেছ।
শ্রীহট্ট শহরে পাক বাহিনীর ২২ বালুচের একটি কোম্পানি ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনী চট্টগ্রামের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের | অর্ধেক ইতিমধ্যেই ভারতীয় বাহিনীর দখলে এসেছে, এখানে শত্রুসেনাদের প্রতিরােধ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
পাকসৈন্যরা এখনাে রংপুর, দিনাজপুর ও সৈয়দপুর প্রতিরােধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রংপুরকে ঘিরে ভারতীয় বাহিনীর বেষ্টনী ক্রমশ ছােট হয়ে আসছে।
বাঙলাদেশের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে এবং ঢাকা শহরে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানের সামনে পরিবেষ্টিত অবস্থায় বাঙলাদেশের পাক দখলদার বাহিনীর প্রধান লেঃ জেনারেল এ,এ, কে নিয়াজি ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রধানের কাছে “যুদ্ধ বিরতির আবেদন জানিয়েছেন। যুদ্ধ বিরতি মানে অবশ্যই অস্ত্রসমর্পণ কিংবা আত্মসমর্পণ নয়।
জেনারেল মানেকশ’র জবাব
নয়াদিল্লী থেকে ইউএনআই-র খবরে বলা হয়েছে যে লেঃ জেনারেল নিয়াজীর যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবের জবাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারের মানেকশ’ জানিয়েছেন, আজ নয়াদিল্লীস্থ মার্কিন দূতাবাস মারফৎ বেলা ২.৩০ মিনিটে জেনারেল নিয়াজির বার্তা তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছে। “ইতিপূর্বে আমি দু’টি বার্তায় জেনারেল ফরমান আলিকে জানিয়েছি যে, বাঙলাদেশে আত্মসমর্পণকারী আপনাদের সমস্ত সামরিক ও আধা সামরিক ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে।
“পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সমস্ত ব্যক্তি, বিদেশী ও সংখ্যালঘু নৃজাতির সকলেরই পূর্ন-নিরাপত্তা বিধান করা হবে। আপনি যেহেতু যুদ্ধ বন্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন, সেই হেতু আমি আশা করছি আপনি, বাঙলাদেশে আপনার কম্যাণ্ডের অধীন সমস্ত বাহিনীকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং আমাদের অগ্রসরমান বাহিনী যেখানেই থাকুক না কেন, সেখানেই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেবেন।”
জেনারেল মানেকশ’ তার বার্তায় আত্মসমর্পণকারী সমস্ত সৈন্যের প্রতি সৈনিকোচিত মর্যাদা প্রদর্শনের, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ব্যবহার করার আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের যথােচিত মর্যাদায় সমাধিস্থ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
জেনারেল মানেকশ জানান যে, তাঁর এই প্রস্তাবে জেনারেল নিয়াজির কাছ থেকে সমর্থক সাড়া পাওয়া মাত্র বাঙলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল আরােরাকে পাক বাহিনীর উপর স্থল ও আকাশ পথে যাবতীয় আক্রমণ বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে আমার সরল বিশ্বাসের নিদর্শন হিসাবে আমি আদেশ দিয়েছি যে, আজ বিকাল ৫টা থেকে ঢাকার উপরে বিমান হানা বন্ধ থাকবে। আমি আপনাকে নিশ্চিতভাবে জানাচ্ছি, আপনার সৈন্যদের অকারণে হতাহত করার কোনও ইচ্ছা আমার নেই, কারণ আমি মানুষের প্রাণহানি চাই না। কিন্তু আমি যা বলেছি তাতে যদি আপনি রাজি না হন, তাহলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৭টা থেকে চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়ে আবার আক্রমণ শুরু করা ছাড়া আমার আর কোনও বিকল্প নেই।”
সমস্ত বিষয় যাতে আলােচনা করে দ্রুত যাতে চূড়ান্ত ব্যবস্থা করা যায় সেজন্য আজ বিকাল ৫ টা থেকে ৬৬০৫ কে এইচ ও ৩২১৬ কে এইচ এই দু’টি বেতার তরঙ্গ মারফত সংযােগ ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জেনারেল মানেকশ জানিয়েছেন।
সূত্র: কালান্তর, ১৬.১২.১৯৭১