You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.19 | বরিশালে বর্বর পাকফৌজের বিরুদ্ধে মানুষ লড়ছে (১) | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বরিশালে বর্বর পাকফৌজের বিরুদ্ধে মানুষ লড়ছে (১)
(বিশেষ প্রতিনিধি)

কলকাতা, ১৬ জুলাই- বাঙলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত নদী বহুল বরিশাল জেলার খবর বিশ্বের মানুষ কমই পেয়েছে। গত কয়েক মাসে সেই জেলার সংগ্রাম-এর আংশিক কাহিনী আমরা সদ্য বাঙলাদেশ থেকে আগত একজন বর্ষিয়ান স্বাধীনতা সংগ্রামীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। ঐ জননেতা ২ জুলাই পর্যন্ত বরিশাল জেলার বিভিন্ন গ্রামে মুক্তিসংগ্রাম সংগঠিত করেছেন। তার পর বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা ও যশাের হয়ে এখানে এসেছেন। তিনি বলেন মার্চ থেকে পুরাে দু’মাস সমগ্র জেলা ছিল “স্বাধীন”। পাঞ্জাবী সৈন্যদের আক্রমণে অত্যাচার ও বর্বরতা জেলার শত শত গ্রাম বিধ্বস্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা, নিঃস্ব। কিন্তু পাঞ্জাবী সৈন্য, মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামীসহ ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর বর্বরতা মুক্তিযুদ্ধকে বাধা দিলেও ধ্বংস করতে পারে নি। আজও সৈন্যরা দিন থাকতেই ব্যারাকে ফিরে যায়, দালালরা ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়ায়। তারা সৈন্য নিয়ে আসে আবার পালিয়ে যায়। মুক্তিযযাদ্ধাদের হাতে মরে। এই অবিস্মরণীয় মুক্তিসংগ্রামের কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হবে।
মুক্ত বরিশালের দু’মাস
নেতারা যে যাই বলুন না কেন, জেলার সাধারণ মানুষ ঠিক করেছিল তারা স্বাধীন হবেই। নির্বাচনে তাই তারা বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ন্যাপ (মুজফফর) কে বিপুল সংখ্যায় ভােট দিলেও আসল সব কয়টি দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। তাই যখন ইয়াহিয়া নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিতে টাল বাহানা করল— জেলার মানুষ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিল।
১ মার্চ থকে আহ্বান এল অসহযােগ আন্দোলনের, সাধারণ মানুষ এগিয়ে এল। ন্যাপ, আওয়ামী লীগ বা কমিউনিস্ট কর্মীরা আলাদাভাবে নয়, একত্র।
যদিও জেলার প্রশাসন ক্ষমতা ছিল আওয়ামী লীগেরই হাতে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বরিশাল। অ-সহযােগ আন্দোলন, সশস্ত্র সংগ্রাম আর সত্যাগ্রহের ঐতিহ্যবাহী বরিশালের জীবনে সে এক অভূতপূর্ব জাগরণ।
এমন অ-সহযােগ কেউ কখনও দেখেনি। স্কুল-কলেজ বন্ধ। কোর্ট-কাছারী অচল। যানবাহন ও প্রশাসন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। জেলা শাসক থেকে চৌকিদার সবাই একই নিয়ন্ত্রণে। সরকারী অস্ত্রাগার থেকে হাজার হাজার রাইফেল জনতার হাতে হাতে। রাস্তায় রাস্তায় গ্রামে যুবকদের প্যারাড। দূর গ্রামের সাধারণ ছেলেরাও শহর বা আধা শহর থেকে রাইফেল জোগাড় করে নিজেরা সংগঠিত হল।
কে জেলার রাজনীতিক প্রশাসন কর্তৃপক্ষ সবদিক লক্ষ্য রেখেছেন : কোথায় খাদ্যভাব স্টীমারে করে চাল পাঠাও। কোথায় সিগারেটের দাম বাড়ল সিগারেট পাঠাও এভাবে দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ হল। এমনি সব দিকে লক্ষ্য রেখে স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতার স্বাদ, যেন সব হয়ে গেল।
এমনি চলল সারা মার্চ মাস। তারপর ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামের বর্বরতার খবর একে একে এল। এলেন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। জেলার মানুষ তাদের থাকতে খেতে দিচ্ছেন। দিনের পর দিন নতুন খবর মানুষের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করতে থাকল। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক দিন বড় স্টীমারের শব্দে সবাই সচকিত হল। এই বুঝি পাঞ্জাবী সৈন্য এল। হাজার খানেক স্বেচ্ছাসেবক বন্দুক নিয়ে স্টীমার ঘাট পাহারা দিচ্ছিল, কিন্তু স্টীমার বােঝাই সশস্ত্র লােক দেখে তারা পালিয়ে গেল। স্টীমার ভিড়লে দেখা গেল মুক্তিফৌজ খুলনা থেকে আহত ও নিঃস্ব শ্রমিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসেছে। সবাই আবার স্বস্তি ফিরে পেলেন। জেলায় প্রথম বােমা পড়ল ভােলা শহরে। ২২ এপ্রিল একটি সামরিক গান বােটটিকে নদী দিয়ে যেতে দেখে মুক্তিফৌজ বাধা দেয়, সৈন্যরাও গুলি ছােড়ে। গুলিতে একটা খাদ্য বিভাগের অফিসের ছাদ উড়ে যায় এবং কয়েকজন আহত হয়।
পরদিন শুরু হয় বিমান থেকে বােমা বর্ষণ, মেশিনগানের গুলিতে ৪ জন মারা যায় ও ৫ জন আহত হয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে শহরে হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান। ঢাকা শহর সৈন্যরা দালালদের সাহায্যে লুঠ করে ও পুড়িয়ে দেয়। হিন্দু ও মুক্তিযুদ্ধের সহায়কদের বাড়িগুলি একেবারে ধুলায় মিশিয়ে দেয়।
বরিশাল শহরে বােমা পড়ে ২৭ ও ২৮ এপ্রিল। স্টীমার ঘাট, লঞ্চ ঘাট ও মেডিকেল কলেজে বােমা পড়ে, হিন্দু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি লুণ্ঠিত হয়। শহরের সব লােক গ্রামে চলে যান। গ্রামগুলি তখন একেবারে পরিপূর্ণ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই আশ্রয় প্রার্থী। আশ্রয় ও দিয়েছেন তারাই।
ঐ দিনই বােমা পড়ে পটুয়াখালী শহরে। হেলিকপ্টার থেকে বেধড়ক বােমা। সারা শহর পুড়ে গেল। সবাই গ্রামের দিকে যাত্রা করল। বাউকাঠিতে মুক্তিফৌজ ১টি গানবোেট ডুবিয়ে দেয় ও ২৯ জন সৈন্যকে মেরে ফেলে।
২১ এপ্রিল বােমা পড়ল ঝালকাঠি শহরে। সৈন্য ও দালালরা বিশেষভাবে হিন্দুপ্রধান অংশ সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিল। বােমা পড়ল পিরােজপুর, নাতার হাট, কাউখালী বন্দরে। শহরের লোেকরা গ্রামের দিকে যাত্রা করলেন। সৈন্যরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, লুঠ করে, নারীর সম্ভ্রমহানি করে অভিযান চালাল। বিধ্বস্ত হল— কামারকাঠি, বানারীপাড়া, পূর্বজলাবাড়ী, ইদিরহাট, গােবর্ধন, বাসকাঠি। কোন হিন্দু এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক মুসলমানের বাড়ি রেহাই পেল না। | নাজিরপুর থানার, মালিখালী, দাচিয়া, বরুই বন্য, শাখারী কাঠি, শ্রীরাম কাঠি, দীঘরা সম্পূর্ণ ধ্বংস হল। এক মাত্র দৈ হাড়ী গ্রামে লােক নিহত হল দেড়শ’র ও বেশি। মােল্লার হাট থানায় হিন্দু মুসলমান সমান সংখ্যায় ছিলেন। কেউ রেহাই পান নি। বরিশাল সংলগ্ন খুলনা জেলার চিতলমারী, খড়মখালী, খালসাখালী, পাঙ্গাসিয়া, বাবুগঞ্জ বিধ্বস্ত হন। একমাত্র খড়মখালীতেই মারা গেলেন দেড়শ। উভয় সম্প্রদায়ের লােক, তবে হিন্দু বেশি।
আদ্ধার মানিক, চাউলতা খালী বড়বনিয়া, চরবনিয়া প্রভৃতি গ্রামগুলি ধ্বংস্তুপে পরিণত। সারা জেলায় কোন প্রাণ নেই, কোন প্রশাসন নেই।
বরিশাল সংলগ্ন ফরিদপুর জেলার ডুমরিয়াতে (শেখ মুজিবরের গ্রাম) ৩৫ জন হিন্দু নিহত হন দালালদের হাতে।
বরিশার জেলার প্রায় সম্পূর্ণ ইরি ও আউস ধান বিনষ্ট হল। আমন ধানও বােনা গেল না। কুড়িয়ানার প্রতিরােধ : পাঁচশ’ শহীদ।
ঝালকাঠি থানার কুড়িয়ানা, কীর্তিপাশা, ভীরুল গ্রামের প্রতিরােধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বরিশাল, ঝালকাটি প্রভৃতি শহরগুলি সৈন্যরা বর্বরভাবে ধ্বংস করলে হাজার হাজার লােক ঐ তিনটি গ্রামে আশ্রয় নেন। এমনি দশ হাজার লােক ছিলেন কুড়িয়ানা। অধিকাংশ হিন্দু, আশ্রয় দাতারা হিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিস্তীর্ণ পেয়ার বাগানকে দুর্ভেদ্য দূর্গ হিসাবে গড়ে তােলা হয়। শত শত স্বেচ্ছাসেবক রাইফেল নিয়ে সব সময় পাহারা দেয়।
পাঞ্জাবী সৈন্যরা দালালদের কাছে খবর পেয়ে গ্রামটির উপর ঝাপিয়ে পরে। তিনদিন ধরে যুদ্ধ পরাজিত পাঞ্জাবী সৈন্যরা পিছিয়ে যায়। তাদের তিনবারের ব্যর্থ আক্রমণে গ্লানি জনৈক পীর সাহেবের শয়তানীতে বর্বরতার রূপ নেয়। পীর সাহেব ঢাকা-করাচীতে দরবার করে এক হাজার সৈন্য ও গানবােট নিয়ে এসে কুড়িদিন ধরে গ্রামগুলির উপর আক্রমন করায়। কোন ঝােপ, কোন কচুবন বা পেয়ারা বাগান মেশিনগানের গুলি থেকে রেহাই পায় নি। শরণার্থীরা যে যে দিকে পারেন পালিয়ে যান। আশ্রয় পান মুসলমানদের বাড়ি। সৈন্যরা চলে যেতে বনে জঙ্গলে শতাধিক লােকের মৃতদেহ পড়েছিল।
দালালরা মুক্তিফৌজ পরিচয় দিয়ে পাট ক্ষেতে ও জঙ্গল থেকে আরও বহু লােককে বের করে হত্যা করেছে। সৈন্যদেরও ক্ষতি কম হয় নি। অন্তত ৩টি গানবােট মুক্তিফৌজ ডুবিয়ে দেয়।
পাশবিক বর্বরতা : পাঁচশ নামাজী নিহত
বাঙলাদেশের সর্বত্রই পাঞ্জাবী সৈন্যদের বর্বরতার নিদর্শন রয়েছে। বরিশালও তার থেকে রেহাই পায়নি। সব ঘটনা এখন ও কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। তবে তার মধ্যে সামান্য কয়েকটি নিদর্শন এখানে তুলে ধরা হল।
কীর্তিপাশার একটি মসজিদে শুক্রবারের নামাজে জড় হয়ে ছিলেন কয়েকশ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বর্বর সৈন্যরা মর্টার ও মেশিনগান দিয়ে মসজিদটি সম্পূর্ণ গুড়িয়ে দেয়। পাঁচশ জনেরও বেশি নামাজী সেখানে নিহত হন।
কাউখালিতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা একটি কিশােরকে নারকেল গাছে উঠে সৈন্যদের ডাব পেড়ে দিতে বাধ্য করে। ছেলেটি গাছ থেকে নামতে শুরু করলে ইয়াহিয়ার জানােয়াররা গুলি করে ছেলেটিকে গাছ থেকে ফেলে দেয়। গাছ থেকে মানুষ পড়তে ও মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে সৈন্যরা উল্লাসে মেতে ওঠে।
কাছ দিয়েই যাচ্ছিলেন একজ মৌলভী সাহেব। সৈন্যরা তাকে ধরে গ্রামের দিকে নিয়ে যায় মেয়ে আছে কোন বাড়ি তা দেখাবার জন্য। ইতিমধ্যে পথে কয়েকটি ‘খাসী’ দেখে লােভী সৈন্যরা সে দিকে গেলে মৌলভী সাহেব পালিয়ে এসে গ্রামে খবর দেন। গ্রামবাসীরা পালিয়ে বাঁচেন। কিন্তু তাদের বাড়ি-ঘর বিনষ্ট ও জিনিসপত্র লুণ্ঠিত হয়।
মাটিভাঙ্গা বাজারে সৈন্যদল ঢুকতেই গ্রামবাসীরা পালিয়ে যায়। দুই বান্ধবী পালাবার আগেই সৈন্যরা এসে পড়ে। ওরা একঘরে আশ্রয় নেয়। কয়েকজন সৈন্য সেখানে ঢুকে একের পর এক তাদের ধর্ষণ করে। এরা ছিলেন একজন গ্রামের বিশিষ্ট মুসলমানের মেয়ে, আরেকজন হিন্দুর মেয়ে। উভয়েই লেখাপড়া জানা।
সৈন্যরা ঐ ঘর থেকে বেরিয়েই একটি কিশােরের হাতে সােনার আংটি কেড়ে নেবার চেষ্টা করে কিন্তু না পেরে দাঁত দিয়ে আঙ্গুলের মাংস ছিড়ে তবে আংটি কেড়ে নেয়।
এমনি বর্বরতা চালিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এই পশুদের সাহায্য করছে দালালরা। মুক্তিফোজ দালালদের হত্যা করে তার প্রতিশােধ নিচ্ছে।

সূত্র: কালান্তর, ১৯.৭.১৯৭১