কুড়িগ্রাম থেকে
(সফররত স্টাফ রিপাের্টার)
আমার সঙ্গী প্রশান্ত বক্সী আর পল্লব বাবু বুরঙ্গামারিতেই থেকে গেলেন। ক্যাপ্টেন রােসন সাহেবের প্রয়ােজনীয় অনুমতি নিয়ে খােলা জীপে উঠলাম। সঙ্গা চণ্ডী গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব আর কয়েকজন মুক্তি ফৌজ। গন্তব্যস্থল কুড়িগ্রাম। বুরঙ্গামারি থেকে ২৬ মাইল আর ভারত সীমান্ত সাহেবগঞ্জও প্রায় ৪০ মাইল দূরত্ব।
সবুজ ধান ক্ষেতের বুক চিরে জীপ ছুটল। আকাশ কালাে হয়ে এসেছে, মেঘের গর্জন। যারা কাজ করছেন, জীপের গর্জনে তাদের অনেকেই মুখ ফিরে তাকালেন কেউ বা হাঁক দিয়ে বললেন ‘জয় বাংলা’। মুক্তি বাহিনীর সৈনিকেরাও হাঁক দিলেন ‘জয় বাংলা’ বলে।
খােলা জীপ গাড়িতে আমার ঠিক পেছন দিকে যে বসে, তার বয়স খুবই অল্প। মাথায় লতা পাতায় ঢাকা হেলমেট। প্যান্ট আর শার্ট পরিহিত হাতে একটি রাইফেল। ছেলেটি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ভারত থেকে আসছেন? আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম। ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম, আমি। একগাল হেসে বলল—ডাক নাম ‘মধু’। ভাল নাম সামদুদ্দীন।
-বয়স কত তােমার? —তা অনেক। উত্তর পেলাম। —অনেক কত? —আঠার হবে। এবার আমার হাসির পালা। আমি হেসে ফেললাম। ও যেন একটু রাগই করল।
আমার কাঁধে ঝােলানাে ক্যামেরা দেখে ছেলেটি হঠাৎ কি যেন ধারনা করলাে। জিজ্ঞেস করল আপনি কি সিনেমা কোম্পানীর লােক? আমি না বলতে ও যেন একটু হতাশ হলে। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি কর তুমি?’
ছেলেটি জানাল ও আগে কুড়ি গ্রামের সিনেমা হলে কাজ করতাে। এখন মুক্তিবাহিনীর সৈনিক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি রাইফেল ছুড়তে জানাে?’ কথাটায় যেন ছেলেটি একটু অপমানিত বােধ করল। ও গর্বের সঙ্গে বলল, আমার ট্রেনিং হয়ে গেছে। রাইফেল ছুড়তে জানি। ডিনামাইট ফাটাতে জানি। তারপর একটু থেমে, একটু আস্তেই ও বলল লালমণিহাট যুদ্ধে আমি ছিলাম, জানেন।”
কথায় কথায় জীপ নাগেশ্বরীতে এসে পৌছুল। গর্জন করে জীপটি এসে থামল, নাগেশ্বরী পুলিস শিক্ষা আবাসের সামনে। পুলিশ শিক্ষা আবাসের সামনে বিরাট করে লেখা শৃঙ্খলা, ন্যায়, মর্যাদা। মুক্তি বাহিনীর কিছু তরুণ সৈনিক ছুটে এসে জীপের সৈনিকদের সঙ্গে হাত মেলাল। কয়েক জনের বুকে কালাে ব্যাজের ওপর লাল ফিতার ক্রশ। ওগুলি কি জিজ্ঞেস করায় ওরা জানালেন যে ওরা ‘সেবা বাহিনীর কর্মী।
ইতিমধ্যেই ওরা নার্সিং এর ট্রেনিং নিয়েছেন। আমাকে এবার জীপ থেকে নামতে হলাে। মুক্তিবাহিনীর লােকেরা জানালেন যে, নাগেশ্বরীর এই আবাস এতদিন এঁরা ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করেছেন তবে আজ এই ঘটি বদল হবে।’ আরও নিরাপদ জায়গায় ওরা সরে যাবেন।
ইতিমধ্যে একটি মটর সাইকেল। করে একটি ছেলে এগিয়ে এল। কালাে শান্ত চেহারা, রুক্ষ চুল। ও পাটেশ্বরী হয়ে কুড়িগ্রাম যাবে। ছেলেটি আমাকে ওর মটর সাইকেলের পেছনে বসতে বলল। কথানুযায়ী ওর মটর সাইকেলে চড়ে বসলাম।
যেতে যেতে ওর সঙ্গে আলাপ।’ ওর বয়স কুড়ি। কুড়ি গ্রাম কলেজের বি.কম-এর ছাত্র আর এই মহকুমা ছাত্রলীগের সম্পাদক ছাত্রলীগ হলাে আওয়ামী লীগের ছাত্র শাখা। ও যাচ্ছে পাটেম্বরীতে কয়েকটি লরির খোজে। ওঁদের আজ লরির বিশেষ প্রয়ােজন। ছেলেটির নাম মঞ্জু মণ্ডল। মমণ্ডল নাম শুনে জিজ্ঞেস করলাম—“তুমি কি হিন্দু?” ও উত্তর দিল, “না”মুসলমান। তবে আমি হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ মানি না। ওর উত্তর শুনে নিজের প্রশ্নে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলাম।
পাটেশ্বরীতে গিয়ে যখন পৌছলাম তখন সন্ধ্যা। পাটেশ্বরী মটর সার্ভিসের দপ্তরে কয়েকজন প্রহরী। প্রত্যেকেই লুঙ্গীপরা, পায়ে কাপড়ের জুতা, গায়ে ছিটের হাফহাতা শার্ট, কিন্তু হাতে রাইফেল, একজনের হাতে মেশিনগান।
মঞ্জুও নেমে গিয়ে কথা বলল। তারূপর বলল একটু পাশের গ্রামে গেমিঞার কাছে যাব যাবেন নাকি? আমি রাজী হলাম। গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর, একটি সুন্দর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাক দিতেই একটি মেয়ে বার হয়ে এল। চাচা আছ কিনা জিজ্ঞেস করে আমরা দুজনেই বাড়িতে গেলাম। বাড়ির মালিক বললেন “আমার কাছে আসার কি প্রয়ােজন? সব গাড়িইতাে দিয়ে রেখেছি। নিয়ে যাও। এরপর আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলাে। বাড়ির মালিক এবং সকলে আমাকে থেকে যেতে বল্লেন সম্পূর্ণ জয়ের পর এখানে আবার আসব বলে আমরা বেরিয়ে এলাম।
আসতে আসতে মঞ্জু ওরই সমবয়সী এই বাড়ির আরেক ছেলেকে বলল ‘আব্বাকে এবার তিনতলা ছেড়ে নীচে আসতে বল শুধু দিলেই হবে না। এরপর ও আমার দিকে ফিরে হাসতে হাসতে বলল জানেন এরা বুর্জোয়া, তবে এই যুদ্ধের মধ্যেই ওরা সকলের সঙ্গে মিশে যেতে বাধ্য হবে।
গ্রাম থেকে ঘুরে আবার পাটেশ্বরী। গাড়ি পাওয়া গেছে পেট্রলও কিছু আছে। তবে ড্রাইভার নেই। খবর গেল পাশের গায়ে। একজন ড্রাইভার ছিলেন, যে এগিয়ে এলেন, গাড়ির সামান্য মেরামৃত, দরকার। মেকানিক মুক্তিবাহিনীর হাতে বিশেষ নেই। ড্রাইভার নিজেই যা পারলেন, গাড়ি ঠিক করলেন, এরপর গাড়ি নিয়ে গন্তব্যস্থলে রওয়ানা দিলেন। আমরা রওয়ানা দিলাম কুড়িগ্রামের দিকে। পাটেশ্বরী থেকে কুড়িগ্রাম সামান্য পথ।
কুড়িগ্রাম। রংপুর জেলার অন্যতম মহকুমা শহর। এখানে ইয়াহিয়ার সৈন্য এসে একটি ব্যাঙ্ক লুঠ করে এবং কয়েকজনকে হত্যা করেছে। এরপর ঐদিনই রাত্রে মুক্তি বাহিনীর তাড়া খেয়ে ওরা পালিয়েছে।
কুড়িগ্রাম এখন নিস্তব্ধ।… ছেড়ে সরে এসেছেন। এই শূন্যতার সুযােগে অনেক দুষ্কৃতকারীর পােয়া বারাে হয়েছে। এরা বহু মানুষের ফাঁকা বাড়ি লুঠ করেছে। আর এই দুষ্কৃতকারীরা সবাই বাঙ্গালী। এই লুঠের খবর ১১ তারিখ মুক্তি বাহিনীর দপ্তরে পৌছানাের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর লােকেরা শহরে এসে দুষ্কৃতকারীদের কয়েকজনকে ধরে রাজপথের পাশে জামগাছে বেধে রেখেছে। এদের মধ্যে দুষ্কৃতকারীদের মহাজন বলে খ্যাত কুড়ি গ্রামের সাত্তার মিঞাও আছেন। মুক্তিবাহিনী বিচার করবে রাত্রে, আর খুব সম্ভবতঃ এদের দেওয়া হবে মৃত্যুদণ্ড। স্বাধীনতার যুদ্ধের মুখােমুখী দাঁড়িয়ে মুক্তিবাহিনী কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারে না। মুক্তি বাহিনীর স্থানীয় অধিকর্তা দল গুলিই বললেন আমাকে।
কুড়িগ্রামের চর থেকে ফিরে চলেছি। পথেই প্রচণ্ড বৃষ্টি। বাধ্য হয়ে মােটর সাইকেল ঠেলে নিয়ে ওঠানাে হল পাশের এক পরিত্যক্ত চালা ঘরে। ইতিমধ্যেই ভিজে গেছি। গায়ের জামা খুলে শুকোতে দিয়ে মঞ্জুর গায়ের চাদর গায়ে দিয়ে জাকিয়ে বসলাম। আমাদের দুইজনের গল্প শুরু হলাে। একথা সেকথার পর কলকাতার গল্প উঠল। কলকাতার শহর কি রকম ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ মঞ্জু প্রশ্ন করল আচ্ছা কলকাতায় খুব ভয়? বহু লােক খুন হচ্ছে রােজ তাই না? কেন এটা হচ্ছে? ওর প্রশ্ন গুলিতে আমার খুব মজাও লাগল লজ্জাও লাগল। যে এখন রাইফেল হাতে মুক্তির জন্য লড়ছে সে এই প্রশ্নগুলি ছুড়ে দিল। প্রশ্নের জবাব নেই, আর ঐ প্রশ্নগুলি যেন আমার কাছে নয়: কলকাতার সমস্ত যুবকদের কাছে?”,
আলোচনার প্রসঙ্গ বদর বাঙ্গলা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ বাঙ্গলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ইত্যাদি সম্পর্কে। আওয়ামী লীগের জন্য আমরা এত কাজ করেছি কেন জানেন? এ প্রশ্ন করল।
কেন?
… কারণ আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলেছে। আর এর জন্যই এখানে জমায়েত ইসলাম, মুসলীম লীগ সম্পূর্ণ হেরেছে। এরা প্রতিক্রিয়াশীল।
ছাত্র সংগঠনগুলির কথা উঠল। এই যুবক নিজে মহকুম ছাত্রলীগের সম্পাদক। ইয়াহিয়া সৈন্যদের তালিকায় ওর নাম। কিন্তু ও যখন ছাত্র সংগঠনের কথা বলল তখন ছাত্র ইউনিয়নের প্রদেশিক নেত্রী মতিয়া চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাল। ও বলল বাঙলাদেশে, যেমন বঙ্গবন্ধু মুজিবর সাহেব, তেমনি ছাত্র যুবকদের মেত্রী হলেন ‘আগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী। ছেলেটি নিজে একটি অন্য ছাত্রসংগঠনের নেতা, কিন্তু তবুও সে মতিয়া চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দ্বিধা করল না।
এরপর একটু থেমে ও বলল জানেন “মতিয়া হলাে ‘রুশপন্থী’। আলােচনা প্রসঙ্গের আবার পরিবর্তন। এবার এ চাল ঘরে লাগানাে সিনেমার পােস্টার গুলি দেখিয়ে মহা উৎসাহেসে সিনেমার শিল্পীদের নাম বলে যেতে লাগল আর জানতে চাইল আমি সিনেমা দেখতে ভালবাসি কিনা? আরও জানতে চাইল নজরুল, সুকান্ত রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের লেখা কবিতাগুলির মধ্যে কোন কবিতাগুলি আমার প্রিয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বাইরে সবুজ ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে তখনও প্রচণ্ড বৃষ্টির ঝাপটা। আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবতে শুরু করলাম যে গত পরশু ও এক বিরাট যুদ্ধে নিজে অংশ নিয়েছে, আজ সারাদিন কাছে রাইফেল আর মাথায় হেলমেট লাগিয়ে মুক্তি যুদ্ধের বিভিন্ন সরবরাহের কাজে ব্যস্ত থেকে, খাওয়ার সময়ও পায়নি। সে এরমধ্যেই সুকান্ত, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দের কবিতা কিংবা সিনেমা নিয়ে ভাবছে, আর অদ্ভুত প্রাণশক্তিতে হাসছে।
সূত্র: কালান্তর, ১৯.৪.১৯৭১