ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ
প্রায় দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হলে স্বাধীনতার গৌরবে গৌরবান্বিত পূর্ব বাংলার মানুষ আশায় বুক বাঁধে এবং নতুন দিনের স্বপ্নে বিভাের হয়। তারা ভেবেছিল- এবার শােষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি সুন্দর জীবন পাবে, পাবে স্বাধীনতার সুফল। কিন্তু বিধি বাম! তাদের সে আশা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর ফলে বাঙালির স্বপ্নেরও ঘটে অপমৃত্যু। কুচক্রী পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী শুরু থেকেই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষের টুটি চেপে ধরে। বাঙালির আত্মজাগরণ ও স্বকীয় সত্তাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিকল্পিতভাবে আঘাত হানে বাঙালির অস্তিত্ব তথা তাদের ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর। পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই সরকার সুকৌশলে দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা বর্জন শুরু করে।১ এ কাজে জনমত গঠন করতে মাঠে নামায় কিছু তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাকে। এরই প্রতিবাদে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।
বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তান সরকারের প্রথম প্রত্যক্ষ অবজ্ঞা ও আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি; এবং সেটা হয় পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব নাকচের ফলে। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। মাতৃভাষা বাংলাকে অবহেলার প্রতিবাদে তারা রাজপথে নেমে আসে। বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার প্রশ্নে সর্বপ্রথম দাবি তােলে গণআজাদী লীগ নামক একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন। এরপর ‘তমদুন মজলিস’ নামের আরেকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষা করার দাবি তােলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও কিছু সংস্কৃতিকর্মী। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিকে জোরদার করতে গড়ে তােলা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার ছাত্র, তরুণ ও যুবসমাজের আশাআকাক্ষার প্রতীক হিসেবে জন্মলাভ করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর ফলে ভাষা আন্দোলনে আসে নতুন গতিবেগ। এতদিন যে আন্দোলন প্রধানত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তা ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর ছাত্রসমাজের মধ্যে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তমদুন মজলিস ও পূর্ব। পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যৌথভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে
——————
১। মমতাজউদদীন আহমদ, প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, পৃ. ৭২।
——————
দেশব্যাপী কাজ শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের সম্মিলিত সভায় শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে পুনর্গঠন করা হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। ওইদিন পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হন অনেক ছাত্র ও যুবনেতা। কারাবন্দি করা হয় অনেককে। এরপর আন্দোলনকে স্তিমিত করতে মুসলিম লীগ সরকার সুকৌশলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ৮-দফা চুক্তি করে এবং কারাবন্দিদের মুক্তি দেয়। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দেন। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা তাঁর সামনেই ‘নাে নাে’ বলে মৃদু চিৎকার করে ওঠে। জিন্নাহর সফরের পর ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায়।
ভাষা আন্দোলনের প্রবল রূপ লক্ষ করা যায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এর আগে ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে গঠন করা | হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। নানা কারণে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়, যার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণার পর। তার এই ঘােষণায় ফুঁসে ওঠে পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজ তথা সর্বস্তরের মানুষ। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম। ছাত্রলীগের উদ্যোগে আহ্বান করা হয় এক সর্বদলীয় সভা। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম। ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গােলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় চল্লিশ সদস্যের ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর উদ্যোগে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের ঘােষণা দেওয়া হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে সব ধরনের মিছিলসমাবেশ নিষিদ্ধ করে এবং ১৪৪ ধারা জারি করে। সার্বিক পরিস্থিতি আলােচনা এবং ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের লক্ষ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর এক সভা আহ্বান করা হয়। সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। অবশেষে আসে ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় হাজার হাজার ছাত্র ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে হয় বিশাল সভা। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আয়ােজিত ওই সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভেঙে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে রাজপথে নেমে আসে বাংলার দামাল সন্তানেরা। এরপর পুলিশের সঙ্গে চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ। বেলা তিনটার পর ঘটে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। কোনাে রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই পুলিশ মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে রফিক-বরকতসহ অনেকে শহীদ হন, আহত ও গ্রেপ্তার হন অগণিত মানুষ। প্রতিবাদে ফুসে ওঠে ঢাকাসহ সারা দেশ। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দেশজুড়ে চলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। ঢাকা শহরে এদিন শহীদ হন। সালাম-শফিউরসহ অনেকে। আন্দোলন যতই দানা বেঁধে ওঠে, সরকারি নির্যাতনও ততই বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যেই গড়ে তােলা হয় ভাষাশহীদদের স্মৃতিঅম্লান করে রাখার শহীদ মিনার। এরপর সরকারি দমন-পীড়নে ধীরে ধীরে আন্দোলনের গতি থেমে আসে। আন্দোলন থামলেও নির্বাপিত হয় না চেতনার বহ্নিশিখা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভাষা আন্দোলনের চেতনায় জাগরুক বাঙালি ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে পতন ঘটায় মুসলিম লীগ সরকারের। নানা কাঠখড় পােড়ানাের পর অবশেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়।
ভাষা আন্দোলন ছিল পাকিস্তান সরকারের নানাবিধ শােষণের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষের ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। এই আন্দোলন গড়ে তুলতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন পালন করে। প্রত্যক্ষ-পরােক্ষ ভূমিকা। এর মধ্যে গণআজাদী লীগ, তমদুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন, লেবার ফেডারেশন, ইসলামী ভাতৃসংঘ প্রভৃতি সংগঠনের ভূমিকা অতি উজ্জ্বল। সার্বিকভাবে বলা যায়, ভাষা আন্দোলনে মূল নেতৃত্ব দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা। পরে এতে যুক্ত হয় পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষ।
ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলে অসংখ্য নাম সামনে চলে আসে। সবার নাম স্বল্পপরিসরে তুলে ধরা কঠিন, তবুও যাদের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারণ করতে হয়, তাঁরা হলেন : কামরুদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক আবুল কাসেম, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, আবুল হাশিম, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব, আবদুল গফুর, নূরুল হক ভূঁইয়া, শামসুল আলম, নাইমউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, গাজীউল হক, খালেক নেওয়াজ খান, এমএ ওয়াদুদ, মােহাম্মদ সুলতান, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল মতিন, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, আনােয়ারা খাতুন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, শহীদুল্লাহ কায়সার, গােলাম মাওলা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ইমাদুল্লাহ, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, কামরুজ্জামান, শামসুল হক চৌধুরী, এম নূরুল আলম, বদরুল আলম, মুজিবুল হক, জিল্লুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল, আহমদ রফিক প্রমুখ। রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরােধা ব্যক্তিদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীসমাজও এই আন্দোলনে রেখেছেন অনন্য অবদান। মূলত, পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বাংলা ভাষাবিরােধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রথম লেখনী ধারণ করেছিলেন এবং সােচ্চার হয়েছিলেন পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীগণ। এঁদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবদুল হক, ড. এনামুল হক, কাজী মােতাহার হােসেন, আই এইচ জুবেরী, মাহবুব জামাল জাহেদী, হাসান হাফিজুর রহমান, আনিসুজ্জামান, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম