আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা
পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী শেখ মুজিবুর রহমান অতি অল্পবয়সে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। শৈশবেই তাঁর মধ্যে জাগ্রত হয় অন্ন-বস্ত্রহীন মানুষের প্রতি দরদ ও গভীর মমত্ববােধ। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শেখেন। ধীরে ধীরে বয়স যতই বাড়তে থাকে ততই রাজনৈতিক অঙ্গনে বৃদ্ধি পায় তাঁর বিচরণ। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে তাঁর মধ্যে জাগ্রত হয় স্বাধিকারবােধ, জাতীয়তাবাদী চেতনা ও নেতৃত্বদানের গুণাবলি। জাতির মুক্তি আকাঙ্ক্ষা আর পরাধীনতার জটাজাল ছিন্ন করতে তিনি যুক্ত হন ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে। কলকাতায় অবস্থানকালে নেতাজি সুভাষ বসু হয়ে ওঠেন তার রাজনীতির প্রেরণাপুরুষ। যুক্ত হন হলওয়েল মনুমেন্ট-বিরােধী আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর তথা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম লীগ প্রার্থীদের বিজয় লাভে রাখেন বিশেষ অবদান। এভাবে ব্রিটিশশাসিত বঙ্গদেশে যৌবনকালেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সঙ্গীদের নিয়ে কর্মীশিবির’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে নতুন ধারার কল্যাণধর্মী রাজনীতি গড়ে তােলার কাজ শুরু করেন। সে প্রচেষ্টা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি প্রগতিশীল ও উদার রাজনৈতিক বলয়ের বন্ধুবান্ধব ও সহযােদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তােলেন গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রভৃতি সংগঠন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে কার্যনির্বাহী কমিটিতে যুক্ত হন। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করলে তিনি প্রথম থেকেই প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সরকারি নানা অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণের পাশাপাশি লিফলেট ছেপে তা জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করেন। ভাষা আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে আয়ােজিত সর্বদলীয় সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হলে তিনি তার সদস্য মনােনীত হন।১ ওই সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১১ মার্চ ধর্মঘট ও ‘দাবি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সঙ্গে এই কর্মসূচি সফল করার জন্য জেলায় জেলায় চলে সাংগঠনিক সফর।
—————
১. Statement of Shamsul Haque : quoted from Sheikh Hasina (edited), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol-2, (1951-1952), Hakkani Publishers, Dhaka : February, 2019; P. 116
———————
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ধর্মঘটের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর, যশাের, দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করেন। এরপর ঢাকায় ফিরে ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে এক সভায় ১১ মার্চের কর্মসূচিতে কে, কোথায়, কী দায়িত্ব পালন করবে তা নির্ধারণ করেন। পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার গােপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘Secret information was received on 12.3.48 that the subject (Bangabandhu) along with others took part in the discussions held at Fazlul Haq Hall on 10.3.48 and gave opinion in favour of violating section 144 cr.p.c. on 11.3.48. On this decision, small batches of Hindu and Muslim students were sent out on 11.3.48 to picket the G.P.O., the secretariat and other important Govt. officers. The subject (Bangabandhu) was arrested on 11.3.48 for violating the orders… He took very active part in the agitation for adopting Bengali as the State language of Pakistan, and made propaganda at Dacca for general strike on 11.3.48. on this issue. On 11.3.48 the subject was arrested of violating orders under section 144 Cr. P.C.”১১
মার্চ সকালে কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি জেনারেল পােস্ট অফিস ও ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পিকেটিং করেন। পিকেটিং করার সময় পুলিশি হামলার শিকার ও গ্রেপ্তার হন। শেখ মুজিবসহ অনেককে কারাগারে পাঠানাে হয়। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন : ১১ই মার্চ ভােরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পােস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করলাে। … সকাল নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার, শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ. ওয়াদুদ গুরুতররূপে আহত হল। … আমাদের উপর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। … আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তরজনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়।২ কারাগারের রােজনামচায় তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন : ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
———————
১. Sheikh Hasina [edited], ÔSecret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman (1948-1971), Vol-1, Hakkani Publishers, Dhaka : September, 2018; P. 160, 319
২. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, চতুর্থ মুদ্রণ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৮; পৃ. ৯৩।
——————-
(এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আবদুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।১
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিসহ বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণেও স্থান পেয়েছে। ১১ মার্চের ধর্মঘট পালনের বিবরণ। তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে লিখেছেন : ১১ মার্চ ‘৪৮, বৃহস্পতিবার : … সকাল ৭টায় সাধারণ ধর্মঘটের পক্ষে কাজ করতে বেরিয়ে প্রথমে এফএইচএম হলে গেলাম। তােয়াহা সাহেব এবং আমি একসঙ্গে কাজ করছি। রমনা পােস্ট অফিসের কাছে তােয়াহা সাহেব ও অন্য কয়েকজন পুলিশ কর্তৃক আটক হলেন। আমি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হলাম। একটু পরে তােয়াহা সাহেবকে পুলিশ ছেড়ে দিল। ১২টায় পিকেটিং বন্ধ হলে ১টায় নাইমউদ্দীন সাহেবের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা হলাে। বেলা ২টায় সচিবালয় অভিমুখে মিছিল শুরু হলে পুলিশ হাইকোর্ট গেটের কাছে বাধা দিল। আমরা উত্তর গেটের দিকে রওয়ানা হলাম। তখনই পুলিশ লাঠিচার্জ করল। তােয়াহা সাহেবকে মারাত্মক মারধর করল, অন্যরাও মার খেল। কোথাও যেতে পারলাম না। সাড়ে ৩টায় সভার পর সবাই চলে গেল। মুজিব, শামসুল হক, মাহবুব, অলি আহাদ, শওকত, আনসার ও অন্যান্য ৬৯ জনকে আটক করে জেলহাজতে রাখা হয়েছে। ১৪ জন আহত হয়ে হাসপাতালে। সেন্ট্রাল জেল, কোতােয়ালি ও সূত্রাপুর থানা এবং হাসপাতালে তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। … বি. দ্র. পুলিশের নির্যাতন ও ভাড়াটে গুণ্ডাদের গুণ্ডামি সত্ত্বেও আজকের ধর্মঘট চমৎকার সফল হলাে।২
১১ মার্চের ধর্মঘটে পুলিশের লাঠিচার্জ ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। আন্দোলন আরও প্রবল রূপ ধারণ করে। এই আন্দোলন প্রশমন এবং পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ববঙ্গ সফর শান্তিপূর্ণভাবে করার লক্ষ্যে সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ৮-দফা। সমঝােতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির শর্তগুলাে যথাযথ হয়েছে কিনা তা কারাগার থেকেই দেখে দেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৬-৩-৪৮-এ গােপালগঞ্জে।
——————–
১. শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রােজনামচা, পঞ্চম মুদ্রণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা : অক্টোবর, ২০১৭; পৃ. ২০৬।
২. তাজউদ্দীন আহমদ, ১১ মার্চ, ১৯৪৮; তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-১৯৪৮, প্রথম খণ্ড, প্রতিভাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা : জানুয়ারি ২০১৪; পৃ. ২২৫-২২৬
—————–
সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। বিকেলে এসএন একাডেমি এবং এমএন ইনস্টিটিউটের ৪০০ ছাত্র শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নাজিমুদ্দীন নিপাত যাক’, ‘মুজিবকে মুক্তি দাও’, ‘অন্য গ্রেপ্তারকারীদের মুক্তি দাও’ ইত্যাদি শ্লোগান দেয়।১ তবে তার আগেই ১৫ মার্চ ১৯৪৮ তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা দেড়টায় সভা শুরু হলাে। মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করলেন। সংশােধনীগুলি গৃহীত হলাে এবং অলি আহাদের মাধ্যমে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানাে হলাে।২ সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কারাগারের রােজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “১৬ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয়। আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকালে আইনসভার সামনে লাঠিচার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, ‘নাজিমুদ্দীন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে। ২১শে মার্চ বা দুই একদিন পরে কায়েদে আজম প্রথম ঢাকায় আসবেন। সেই জন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলাে। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম।৩ ১৬ মার্চের সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্ব করা প্রসঙ্গে শওকত আলী লিখেছেন : ১৬ তারিখ সকাল থেকে আমরা সভার ব্যাপারে কাজকর্ম করতে থাকলাম এবং বেলা দেড়টা দুটোয় সভা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুরু হলাে। সভায় সভাপতিত্ব করল শেখ মুজিবর রহমান। সেই বক্তৃতা করল এবং একটি মিছিল নিয়ে আমরা Assembly House-এর দিকে গেলাম।৪
১৭ মার্চ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নাইমউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সন্ধ্যার
———————–
১. Sheikh Hasina [edited), Secret Documents Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 1948-1971, Vol-1, p. 9
২. তাজউদ্দীন আহমদ, ১৫ মার্চ, ১৯৪৮; তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-১৯৪৮, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৩০
৩. শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রােজনামচা, পৃ. ২০৬
৪. শওকত আলী, সাক্ষাৎকার ; উদ্ধৃত, বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা : জুলাই ১৯৯৫; পৃ. ২৫০
——————————
পর ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভা অনুষ্ঠিত হয়, এই সভায় শেখ মুজিবুর রহমান যােগদান করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন : ‘সন্ধ্যার পরে খবর এল ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভা হবে। ছাত্ররাও উপস্থিত থাকবে। আমার যেতে একটু দেরি হয়েছিল। তখন একজন বক্তৃতা করছে আমাকে আক্রমণ করে। আমি দাঁড়িয়ে শুনলাম এবং সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তার বক্তৃতা শেষ হলে আমার বক্তব্য বললাম। আমি যে আমতলার ছাত্রসভায় বলেছিলাম, কাগজ দিয়েই চলে আসতে এবং এ্যাসেম্বলি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে চলে যেতে অনুরােধ করেছিলাম এবং বক্তৃতাও করেছিলাম, একথা কেউ জানেন কি না? যা হােক, এখানেই শেষ হয়ে গেল, আর বেশি আলােচনা হল না এবং সিদ্ধান্ত হল আপাতত অমাদের আন্দোলন বন্ধ রাখা হল। কারণ, কয়েকদিনের মধ্যে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় আসবেন পাকিস্তান হওয়ার পরে। তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে হবে।১
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঢাকার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনার জবাবে তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন এবং রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলেন : ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়। তাঁর এ বক্তব্য সবাই নির্বিচারে গ্রহণ করেনি। তাই ‘সভার এক প্রান্তে প্রতিবাদের ধ্বনি উখিত হয় এবং যারা এই ধ্বনি তুলেছিলেন তাঁদের নেতৃত্বদান করেন শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ এবং আবদুল মতিন। যদিও এই প্রতিবাদের সুর খুব প্রচণ্ড ছিল না, তবু পাকিস্তানের জাতির জনক এই প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় একটি অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খেলেন।২ এ প্রসঙ্গে নূহউল-আলম লেনিন লিখেছেন : ‘জিন্নাহ তাঁর বক্তৃতায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা করেন। নাে নাে বলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান। শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন ছাত্র।৩ অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘােড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘােষণা করলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। আমরা প্রায়
————————–
১. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৯৮।
২ মযহারুল ইসলাম, ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, আগামী প্রকাশনী, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ঢাকা : এপ্রিল, ২০১৭; পৃ. ৩২
৩ নূহ-উল আলম লেনিন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল, সময় প্রকাশন, ঢাকা : একুশে বইমেলা ২০১৫; পৃ. ৩১
——————–
চার-পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না।১ তিনি কারাগারের রােজনামচায় লিখেছেন : “তিনি [জিন্নাহ] এসে ঘােষণা করলেন, “উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ ছাত্ররা তাঁর সামনেই প্রতিবাদ করল। রেসকোর্স ময়দানেও প্রতিবাদ উঠল। তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন এরপরে কোনােদিন ভাষার ব্যাপারে কোনাে কথা বলেন নাই।২
পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ধুরন্ধর ব্যবহারজীবী ‘জিন্নাহ তার চাতুর্য ও কূটবুদ্ধি। প্রয়ােগ করে আন্দোলনটির মূল খাত পাল্টে দিলেন, এর লক্ষ্যকে কক্ষচ্যুত করে দিলেন।৩ এরপর ভাষা আন্দোলন ধীরে ধীরে থেমে গেলেও ভাষার প্রশ্নে চলত বিভিন্ন আলােচনা-পর্যালােচনা। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সামনে অনুষ্ঠিত এক সভায় কতিপয় ছাত্রনেতা উর্দুপ্রীতিমূলক বক্তৃতা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতিবাদ জানান। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন : “জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করছিল, তার নাম আমার মনে নাই। তবে সে বলেছিল “জিন্নাহ যা বলবেন, তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে।” আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজও আমার এই একটা কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, “কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তা প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্নজন লােকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হােক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।” সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শােভাযাত্রা করে চলল।”৪
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি পূর্ববঙ্গ
——————–
১ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৯৯
২ শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রােজনামচা, পৃ. ২০৬
৩ হায়াৎ মামুদ, অমর একুশে, ইত্যাদি প্রথম সংস্করণ, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৫; পৃ. ৬৬
৪ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৯৯-১০০।
——————–
সফরে আসেন। তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি বৈঠক। বসে। আজিজ আহমদ, আবুল কাসেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন। আহমদ, আব্দুল মান্নান, আনসার এবং তাজউদ্দীন আহমদ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।১ এতে ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান।
ভাষা আন্দোলন ও বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রদের ওপর জুলুমনির্যাতনের প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে গঠন করা হয় ‘জুলুম প্রতিরােধ কমিটি’। ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ‘জুলুম প্রতিরােধ কমিটির উদ্যোগে হরতাল, মিছিল ও ছাত্র সমাবেশ আয়ােজন করা হয়। ‘ছাত্রসমাজের ওপর দমননীতির স্টিমরােলার’ শিরােনামে একটি ইশতেহারও। প্রকাশ করা হয়। এ কর্মসূচি উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নাইমউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। ৮ জানুয়ারির সভা সম্পর্কে পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার একটি গােপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘In connection with the observance of the Antirepression Day at Dacca on 8.1.49 the subject [Sheikh Mujibur Rahman] bitterly criticised the Government for it’s alleged repressive measures against the students and suggested Direct Action if the demands of the students were not met.২ সভায় ছাত্রদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার জন্য সরকারকে এক মাসের সময় দেওয়া হয়। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন : “ছাত্ররা আমাকে কনভেনর করে জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালন করার জন্য একটি কমিটি করেছিল। একটা দিবসও ঘােষণা করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সমস্ত জেলায়। এই দিবসটি উদযাপন করা হয়। … এই প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ। এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই। তখনকার দিনে আমরা কোনাে সভা বা শােভাযাত্রা করতে গেলে।
———————-
১ বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তঙ্কালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, সুবর্ণ সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ঢাকা : সেপ্টেম্বর ২০১৭; পৃ. ১২৬৪
২ Sheikh Hasina [edited], Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman (1948-1971),Vol-1, Hakkani Publishers, Dhaka : September, 2018. p. 319
—————————
এক দল গুণ্ডা ভাড়া করে মারপিট করা হতাে এবং সভা ভাঙার চেষ্টা করা হতাে। জুলুম প্রতিরােধ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও কিছু গুণ্ডা আমদানি করা হয়েছিল। আমি খবর পেয়ে রাতেই সভা করি এবং বলে দেই, গুণ্ডামির প্রশ্রয় দেয়া হলে এবার বাধা দিতে হবে। আমাদের বিখ্যাত আমতলায় সভা করার কথা ছিল; কর্তৃপক্ষ বাধা দিলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের মাঠে মিটিং করলাম। একদল ভাল কর্মী প্রস্তুত করে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে রেখেছিলাম, যদি গুণ্ডারা আক্রমণ করে তারা বাধা দিবে এবং তিন দিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হবে যাতে রমনা এলাকায় গুণ্ডামি করতে না আসে- এই শিক্ষা দিতে হবে।১
১৯৪৯ সালের ১১ মার্চেও প্রতিবাদ দিবস’ পালন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এ কর্মসূচি পালনের প্রধান উদ্যোক্তা। আর সেজন্য তাঁকে। কারাবরণ করতে হয়। ড. মযহারুল ইসলাম বলেছেন : ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ গণ-আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। দেশের পরিস্থিতি উপলব্ধি করে। পূর্ব বাংলার তৎকালীন নূরুল আমীন সরকার দমননীতির মাধ্যমে আন্দোলনের কণ্ঠরােধের প্রচেষ্টা চালালেন। ১১ই মার্চের সংগ্রাম দিবসের কর্মসূচির প্রধান উদ্যোক্তা শেখ মুজিবকে পুনরায় কারারুদ্ধ করা হয়।২
ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল অতি উজ্জ্বল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাংগঠনিক কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। বস্তুত, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তিনি ঢাকার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হন এবং নিজের সাংগঠনিক দক্ষতায় নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের শক্ত ভিত নির্মাণ করেন।
———————-
১ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১১১
২ মযহারুল ইসলাম, ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, পৃ. ৩৫
———————-
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম